এই ‘নাসুম’ই হতে চেয়েছিলেন নাসুম
ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারটা উঠেছে নাজমুল হোসেনের হাতে। ওঠা অস্বাভাবিকও নয়। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে টিকে থাকার ম্যাচ। আর সেই ম্যাচে ব্যাট হাতে ৭৬ রানের ইনিংস খেলেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। শেষ পর্যন্ত দল জিতেছে ৬৮ রানে, নাজমুল ম্যাচ–সেরা হতেই পারেন।
তবে গাণিতিক মডেল বলছে, গতকাল আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ম্যাচের সেরা ক্রিকেটটা খেলেছেন নাসুম আহমেদ। ক্রিকইনফোর ভাষায়, ‘মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার’ (এমভিপি)। ব্যাট হাতে করেছেন ২৪ বলে ২৫ রান, বল হাতে ২৮ রানে ৩ উইকেট। সংখ্যা নাকি সব সময় সত্য বলে না। আসল চিত্র তুলে ধরতে পারে না। কিন্তু আসল যদি না–ও থাকে, কিছু না কিছু তো নিশ্চয়ই ভেসে ওঠে।
ক্রিকইনফোর এমভিপিতে যেমন ফুটে ওঠে একজন খেলোয়াড়ের ব্যাটিং–বোলিংয়ের প্রভাব ম্যাচে আসলে কতটা পড়েছে। কতটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসেছে, কার বিপক্ষে এসেছে; সংখ্যায় যতই হোক, সেই রান বা উইকেটের প্রকৃত মূল্যই–বা কত ছিল। আফগানিস্তান ম্যাচে নাসুমেরটা যেমন জ্বলজ্বল করছে সবার ওপর—ইমপ্যাক্ট পয়েন্ট ১৩১.৯১। কাছাকাছি থাকা আফগান স্পিনার খারোতে প্রায় ২৫ পয়েন্ট পেছনে। আর নাজমুল তো আরও পেছনে—তালিকার ৪ নম্বরে।
এই যে ম্যাচে প্রভাবের দিক থেকে সবার ওপরে, তবুও কি দিনের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখ হিসেবে নাসুমের চেহারাটা আপনার চোখে ভেসে ওঠে? একটা ম্যাচ মানে তো শুধু ব্যাটিং বা বোলিং নয়, অনেক মুখের ভিড়ে দু–তিনটি মুখের আলাদা হয়ে ওঠা, ‘ক্যারেক্টার’ হয়ে ওঠা। তিন বছরের বেশি সময় ধরে জাতীয় দলের আঙিনায় থাকা নাসুমকে দেখে কি এমন কিছু কখনো মনে হয়েছে?
অতি ক্ষীণ ঝুঁকি নিয়ে বলেই দেওয়া যায়, বেশির ভাগের উত্তর হবে—‘না’। নাসুম ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলছেন সেই ২০১১ সাল থেকে। আরও স্পষ্ট করে বললে ১৭ বছর বয়স থেকে। কিন্তু জাতীয় দলের দরজা খুলতে খুলতে বয়স ২৬। ওয়ানডেতে অভিষেক তারও এক বছর পর।
২০২১ সাল থেকে গত তিন বছরে নাসুম ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছেন মোটে একবার। সেটাও ভীষণ অস্বস্তিকর এক ঘটনায়, বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। যেটায় আবার নাসুমের দায়ও নেই। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচের ৭টিতে হেরে বাংলাদেশ দল যখন সমালোচনায় জেরবার, তখন সামনে আসে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের হাতে নাসুমের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের তৎকালীন নেতৃত্ব এ ঘটনায় নীরবতা পালনের নীতি নিলেও এবারের আগস্টে বোর্ডে পরিবর্তনের সূত্রে তা আবার জেগে ওঠে। ফারুক আহমেদের নেতৃত্বাধীন বোর্ড হাথুরুসিংহেকে মেয়াদ শেষের আগে বরখাস্ত করার পেছনে যে দুটি কারণ দেখিয়েছে, তার একটি ছিল নাসুমকে হেনস্তার ঘটনা।
একটি টেস্ট খেলুড়ে দেশের কোচ হিসেবে দলের এক খেলোয়াড়কে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় বরখাস্ত হয়েছেন—এটি হাথুরুর জন্য যেমন বিব্রতকর, তেমনি এ ধরনের ঘটনায় ভুক্তভোগী হিসেবে আজীবনের জন্য আলোচনার খোরাক হয়ে যাওয়া নাসুমের জন্যও কম অস্বস্তিকর নয়।
এর আগে ২০২০ বিপিএলেও কাছাকাছি রকমের ‘হেনস্তা’ হতে হয়েছিল তাঁকে। সেবার মাঠের মধ্যেই নাসুমকে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম, যা গ্যালারি আর টিভির সামনে বসা দর্শক দেখেছিলেন সরাসরিই।
এসব ঘটনায় জনমানসে ‘ভুক্তভোগী’ ও ‘নিরীহ’ হিসেবে চিত্রিত হয়ে ওঠা নাসুম খেলার মাঠেও খুব কৌতূহল জাগানো কোনো চরিত্র নন। উইকেটশিকারে বা ভালো ক্যাচ নিয়ে এমন কোনো শারীরিক ভঙ্গিমাও দেখান না, যা অন্যদের মনোযোগ কাড়বে।
বিপরীতে এটাও ঠিক, নিজেকে নিয়ে অন্যদের মধ্যে কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে দরকার হয় ব্যাটে–বলে বিশেষ কিছুর। সেটাও বা নাসুম এত দিনে কতটা পেরেছেন? বিশেষ করে বাংলাদেশ দল যে সংস্করণে তুলনামূলক ভালো খেলে থাকে, সেই ওয়ানডেতে?
নাসুম কাল শারজায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে যে ম্যাচটি খেলেছেন, সেটি ওয়ানডেতে তাঁর ১৬তম। আগের ১৫ ম্যাচে উইকেট মোটে ১২টি। দুবার তিন উইকেট করে নিয়েছেন বটে, কিন্তু ম্যাচের ফলে সেটার প্রভাব ছিল ন্যূনতম।
মূল পরিচয় বাঁহাতি স্পিনার হলেও ব্যাটিংও খারাপ করেন না। গত বছর এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ৪৪ রানের একটা ইনিংস আছে তাঁর। কিন্তু বল হাতে ৫০ রান দিয়ে উইকেটহীন থাকা আর একই ম্যাচে সাকিব আল হাসানের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে বাংলাদেশের জয় নাসুমের ইনিংসটি ঢেকে দিয়েছিল অনেকটাই।
নাসুম আরও আড়ালে পড়ে যান ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর। বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে বলেছিলেন দেশকে এমন কিছু এনে দিতে চান, যা আগে হয়নি। কিন্তু ৩ ম্যাচে সাড়ে ২৪ ওভার হাত ঘুরিয়ে দেশে ফিরেছেন উইকেটশূন্য হাতে। সঙ্গে যদি ‘বোনাস’ কিছু হয়ে থাকে, তা হাথুরুসিংহের হাতে হেনস্তা হওয়া।
সেই যে ২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর পুনেতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৭ ওভারে ৮৫ রান দিয়ে বাদ পড়েছিলেন, তারপর ওয়ানডে দলের একাদশে জায়গা মিলেছে পাক্কা এক বছর পর এই ৯ নভেম্বর, আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে। সিরিজের প্রথম ম্যাচেও হয়তো খেলতেন।
কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিয়মিত ‘সাক্ষাৎ’ হওয়া নাসুম অন্যদের সঙ্গে সময়মতো ভিসা পাননি (তাঁর সঙ্গে নাহিদ রানাও ছিলেন)।
দুই দিন আগে দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাল যখন প্রথমবারের মতো খেলতে নামেন, বাংলাদেশ দল তখন ঘোর বিপদে। একে তো সিরিজ বাঁচানোর ম্যাচ, তার ওপর ৪১তম ওভারে তিন বলের মধ্যে নাজমুল হোসেন ও মাহমুদউল্লাহকে হারিয়ে বাংলাদেশের স্কোর পরিণত হয়েছে ১৮৪ রানে ৬ উইকেটে। আফগানদের চ্যালেঞ্জ জানানোর পুঁজি তখনো বহুদূর।
উইকেটে নাসুমের সঙ্গী তখন অভিষিক্ত জাকের আলী। তুলনামূলক অভিজ্ঞ বলে দায়িত্বটা কাঁধে নেন নাসুমই। নাজমুল–মাহমুদউল্লাহকে ফিরিয়েছে যে খারোতে, সেই বাঁহাতি স্পিনারকেই স্লগ সুইপে উড়িয়ে মারেন মিড উইকেট দিয়ে। মুহূর্তেই যেন গা থেকে চাপ ঝেড়ে ফেলে বাংলাদেশ।
নাসুমের দেখানো পথ ধরে এক ওভার পর হাত খুলতে শুরু করেন জাকেরও। দুজনের সপ্তম উইকেট জুটিতে বাংলাদেশ পায় ৪৬ রান, ৫০ ওভার শেষে স্কোরবোর্ডে জমা হয় ২৫২ রান। জাকের অপরাজিত থাকেন ৩৭ রানে, আগেভাগে আউট না হলেও নাসুমের ২ ছক্কা ১ চারের ইনিংস হতে পারত আরও বড়।
ব্যাটিংয়ের পর নাসুমের বড় কাজ ছিল বোলিংয়ে। বিশেষ করে আফগানিস্তান যখন ২৫২ রান তাড়া করতে নেমে ১ উইকেটেই ৭০ রান তুলে ফেলে। ওই সময় আফগান ওপেনার সেদিকউল্লাহ আতালকে মিরাজের ক্যাচ বানিয়ে ৫২ রানের জুটি ভাঙেন নাসুমই। ইনিংসের মাঝে ফেরান আজমতউল্লাহ ওমরজাইকে। আর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের জয় এসেছে যে মুহূর্তে, আল্লাহ গজনফরকে বোল্ড করে সেটিও এনে দিয়েছেন এই নাসুমই।
গজনফরের ওই বোল্ডে শুধু বাংলাদেশের ৬৮ রানের জয়ই নিশ্চিত হয়নি, দীর্ঘদিন পর নাসুমও যেন ‘ক্রিকেটার’ পরিচয়ে হাসতে পারলেন! যে পরিচয়ে নাসুম আলোচিত হতে চান, চেয়েছেন সব সময়ই।