এই বিশ্বকাপ শুরুর আগে এমন কেউ কি ছিলেন, যাঁর ফেবারিটের তালিকায় ইংল্যান্ড ছিল না! কেউ কি ভেবেছিলেন, টুর্নামেন্টের মাঝামাঝি এসে ইংল্যান্ড পয়েন্ট তালিকায় ১০ দলের মধ্যে ১০ নম্বরে থাকবে! ইংল্যান্ডে প্রায় সবকিছু নিয়েই বাজি হয়। এ নিয়েও যদি বাজির কথা ভেবে থাকত কোনো বাজিকর প্রতিষ্ঠান, তাহলে বাজির দর কী হতো? হয়তো ১: ১ মিলিয়ন। মানে ১ টাকা ধরলে ১০ লাখ টাকা পাওয়ার সুযোগ।
এমন কোনো বাজি হয়নি। যা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই, তা নিয়ে কি আর বাজি হয় নাকি! এ কারণেই বিশ্বকাপের পয়েন্ট তালিকাটা আরও বেশি অবিশ্বাসে চোখ কচলে দেখতে হচ্ছে।
যেখানে ১০ দলের মধ্যে ১০ নম্বর না হতে বাংলাদেশ আর নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে ইংল্যান্ডের। দুদিন আগে বাংলাদেশ এই লজ্জা থেকে মুক্তি দিয়েছিল তাদের। গত পরশু অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৩০৯ রানে হেরেছে নেদারল্যান্ডস।
কাল বেঙ্গালুরুতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচের আগে ইংল্যান্ড ছিল ৮ নম্বরে। হারার পর নেমে গেছে ৯–এ। বিশ্বকাপ ইতিহাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম পরাজয়ে নেদারল্যান্ডসের নেট রানরেটের এমনই খারাপ অবস্থা যে যথেষ্ট বাজে খেলেও ইংল্যান্ডের পক্ষে আবারও ১০ দলের মধ্যে ১০ নম্বর হওয়া সম্ভব হয়নি।
পাঁচ ম্যাচে মাত্র একটি জয়। বাকি চার ম্যাচে জিতলেও ইংল্যান্ডের সেমিফাইনাল খেলার সম্ভাবনা বলতে গেলে শূন্য। এই বিশ্বকাপেই প্রথম দুই ম্যাচে একেবারে অচেনা হয়ে থাকার পর দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ডের আর ঘুরে দাঁড়ানোর সময় নেই। সেই ক্ষমতা আছে বলেও মনে হয় না। বাকি চার ম্যাচে ইংল্যান্ডের জয়ের পক্ষে সম্ভাব্য বাজির দরও অমন ১: ১ মিলিয়নের মতোই কিছু হবে।
টেস্ট ক্রিকেটে ‘বাজবল’ বিপ্লব তো অনেক পরে। ইংল্যান্ডের প্রথম বিপ্লবটা ছিল ওয়ানডে ক্রিকেটেই। ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরে গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নেওয়ার পর সবকিছু ঢেলে সাজানোর পুরস্কার ২০১৯ বিশ্বকাপ জয়ে। সেই বিশ্বকাপের আগে যেমন, তেমনি পরেও সাদা বলের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। বরং এবারের বিশ্বকাপের আগে এমন আলোচনাও হচ্ছিল, এই দল চার বছর আগে বিশ্বকাপজয়ী দলের চেয়েও ভালো।
গত কয়েক দিনে এউইন মরগান কি ইংল্যান্ডের এই দুর্দশা নিয়ে কোথাও কিছু বলেছেন? চোখে পড়েনি। না বলে থাকলে কারণ হয়তো একটাই, অবিশ্বাসে বিমূঢ় হয়ে যাওয়া। নিজের দলকে, নিজের সময়কে এগিয়ে রাখার একটা প্রবণতা প্রায় সবার মধ্যেই থাকে। অথচ ইংল্যান্ডের ওয়ানডে-বিপ্লবের মহানায়ক এই বিশ্বকাপের আগেই নির্দ্বিধায় চওড়া একটা সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছিলেন জস বাটলারের দলকে।
ওয়ানডে ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের আধিপত্য বোঝাতে বলেছিলেন, ইংল্যান্ড চাইলে বিশ্বকাপে দুটি দল খেলাতে পারে। তাতেও দেখা যাবে, এর একটি দল ফাইনালে খেলছে। চ্যাম্পিয়নের অহমও প্রকাশ পেয়েছিল এরপর, ‘গত চার বছরে আমরা সবচেয়ে বেশি রান করেছি, সবচেয়ে বেশি চার মেরেছি, সবচেয়ে বেশি ছয়ও।’
কথাটা হিসাব-টিসাব করেই বলেছেন কি না, কে জানে। তবে কেউ তা চেক করে দেখার প্রয়োজন মনে করেননি। ইংল্যান্ড যেভাবে খেলে আসছে, তাতে এটাই তো হওয়ার কথা। খেলার ধরনই এই ইংল্যান্ডকে ইংল্যান্ড বানিয়েছে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পরই রক্ষণশীলতার শিকল ছিঁড়ে নতুন এক মন্ত্রে দীক্ষা। যেটির শেষ কথা আক্রমণ, প্রথম কথাও। এই বিশ্বকাপে একটার পর একটা ম্যাচ হেরেছেন, আর জস বাটলার বলে গেছেন নিজেদের ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলতে চাওয়ার প্রতিজ্ঞার কথা। প্রতিজ্ঞার বদলে যেটিকে মনে হয়েছে আকুতি।
কোথায় সেই ইংল্যান্ডের ‘ব্র্যান্ড অব ক্রিকেট’? এক বাংলাদেশের বিপক্ষেই তার সামান্য একটু ঝলক। সেই ম্যাচে ইংল্যান্ড ৩৬৪ করেছে বটে, তবে সেটিতেও তো অ-ইংল্যান্ডসুলভ ঘটনা আছে। একসময় ৫৭ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলাটা তো তা-ই। বোলিংয়ে কোন ধার নেই, ব্যাটিংয়ে কোনো ঝাঁজ...এই ইংল্যান্ড কোন ইংল্যান্ড—প্রশ্নটা তাই জাগছেই। কারণ খুঁজেও হয়রান সবাই।
হঠাৎ করেই একটা দল এমন খারাপ হয়ে যায় কী করে! দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শোচনীয় ওই পরাজয়ের পর এক সাংবাদিক জস বাটলারকে একটা ‘অজুহাত’ খুঁজে দিয়েছিলেন। প্রস্তুতি ম্যাচ দিয়ে শুরু করে বিশ্বকাপের মূল আসরে এই যে ভ্রমণের ধকল, এটাই কি ইংল্যান্ডের এমন পারফরম্যান্সের কারণ। বাটলার কথাটা শেষও করতে দেননি, ‘আমাদের এই দলের এতজন আইপিএলে খেলি, এমন ভ্রমণসূচি আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়।’
আইপিএল খেলার সুবাদে ভারতের নানা চরিত্রের মাঠ আর উইকেটও এই ইংল্যান্ড দলের খুব চেনা। ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট মনে করায় ভূমিকা ছিল এটিরও। অথচ কোথায় সেই ইংল্যান্ড! খারাপ খেলতে থাকলে যা হয়, এখন উল্টো কথাও হচ্ছে। অনুশীলনের আগে গা গরমের যে ফুটবল হয়, তাতে ইংল্যান্ড খেলে তরুণ আর বয়সী দুই দলে ভাগ হয়ে। সেই তরুণ দলের গড় বয়স নাকি ৩২! এত দিন এটি ছিল রসিকতা। এখন হয়তো আর তা নয়।