শেষ ওভারের রোমাঞ্চের পর বাংলাদেশের ৩ রানের হার
হিসাবটা পরিষ্কারই ছিল। জয়ের সমীকরণ মিলিয়ে নিতে জাকের আলীর দরকার ছিল আরও একটি ছক্কা। শ্রীলঙ্কার ২০৭ রানের দূরের লক্ষ্যটাকে তখন একদমই কাছের মনে হতো। রান আর বলের মধ্যে পার্থক্য থাকত না। এক-দুই রানেই তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচটি জিতে যেতে পারত বাংলাদেশ।
কিন্তু স্মরণীয় সে জয়ের স্বাদ আর পাওয়া হলো না বাংলাদেশের। জাকের ছক্কা মারার চেষ্টা করলেন ঠিকই, কিন্তু দাসুন শানাকার বলটাকে বাউন্ডারির ওপারে পাঠাতে পারলেন না। লং অন বাউন্ডারির একটু সামনে থেকেই চারিত আসালাঙ্কার ক্যাচে থামল তাঁর ৩৪ বলে ৬৮ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস। বাংলাদেশ থেমে যায় ৮ উইকেটে ২০৩ রানে। ৩ রানের হারে উল্টো শ্রীলঙ্কাই সিরিজে এগিয়ে গেল ১-০ ব্যবধানে।
সিলেটের দর্শকেরা শেষ পর্যন্ত খুব কাছে এসে হেরে যাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে মাঠ ছাড়লেও শ্রীলঙ্কার ২০৬ রান তাড়া করতে নেমে ম্যাচটা শুরুতেই প্রায় হেরে বসেছিল বাংলাদেশ। সেখান থেকে দলকে ম্যাচে ফিরিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ, যাঁর টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে প্রায় ‘ফুল স্টপ’ বসে গিয়েছিল সেই ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। আর শেষের দিকে ম্যাচ জমিয়ে তোলা জাকের তো শ্রীলঙ্কা সিরিজের দলে ঢুকেছেন ভাগ্যক্রমে!
দুজনের ইনিংসের মাহাত্ম্য কতটা, তা ইনিংসের শুরুতে ফিরে গেলেই বুঝবেন। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের করা প্রথম ওভারেই লিটন দাস কট বিহাইন্ড। সেটাও ম্যাথুসের আউটসুইংয়ে শাফল করে মিড উইকেটে ফ্লিক করতে গিয়ে। লিটনের পথ ধরেন সৌম্য সরকারও। ১১ বলে ২ বাউন্ডারিতে ১২ রান করে বিনুরা ফার্নান্ডোকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ তোলেন। পাওয়ারপ্লেতে দুই ওপেনারকে হারিয়ে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশ। নাজমুল হোসেন ও তাওহিদ হৃদয় দলকে সে বিপদ থেকে বের করে আনার চেষ্টা করেন। তাওহিদ খেলছিলেন তাওহিদের মতোই। ইনিংস শুরু করেন ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে বিশাল ছক্কায়। কিন্তু ঝুঁকি নিতে গিয়ে হারিয়েছেন উইকেটও।
ব্যাটিং উইকেটে বাংলাদেশ তবু পাওয়ারপ্লেতে ৪৩ রান তুলেছে। তবে নাজমুল সুবিধাটা নিতে পারেননি। উইকেটে সময় কাটিয়েছেন ঠিকই, চেনা ছন্দটা খুঁজে পাননি এখনো। শেষ পর্যন্ত পাথিরানার শর্ট বলে পুল করতে গিয়ে আউট ২২ বলে ২০ রান করে। ওদিকে নেট রানরেট নাগালের মধ্যে রাখার কাজটা একাই করছিলেন মাহমুদউল্লাহ। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের পর আজই প্রথম টি-টোয়েন্টি খেলতে নেমে মাহমুদউল্লাহ দেখালেন পুরোনো ঝলক।
ক্রিজ ছেড়ে পুল শট, লফটেড ড্রাইভ, স্লগ সুইপে ছক্কা—কী ছিল না তাঁর ইনিংসে! প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচটায় বাংলাদেশের আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন তিনিই। শ্রীলঙ্কা আবার তাঁর প্রিয় প্রতিপক্ষও। আজকের ম্যাচের আগে লঙ্কানদের বিপক্ষে ১৩ ম্যাচে ৪০ গড়ে করেছেন ৩২৩ রান, স্ট্রাইক রেট ১৪৮। আজ তিকশানার বলে ছক্কা মারতে গিয়ে লং অন বাউন্ডারিতে ক্যাচ আউট হলেও তাঁর নামের পাশে তখন জ্বলজ্বল করছিল ৩১ বলে ৫৪ রান, ১৭৪ স্ট্রাইক রেটের বিস্ফোরক ইনিংসে ছিল ২টি চার ও ৪টি ছক্কা।
১০ বলে তখন ১১ রান জাকের আলীর। সেই জাকেরই আধা ঘণ্টার বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে ২৫ বলে অর্ধশত করে ম্যাচের চিত্র পাল্টে দেন। কিছুক্ষণ আগেও যে ম্যাচ জেতার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না, সে ম্যাচই জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বাংলাদেশ। জাকেরের পাওয়ার বেস থেকে আসা প্রতিটি বাউন্ডারিতে স্বপ্নটা বাস্তব মনে হতে থাকে। শেখ মেহেদী হাসানকে নিয়ে তাঁর ২৭ বলে ৬৫ রানের জুটি বাংলাদেশকে নিয়ে যায় ১২ বলে ২৭ রানের সমীকরণে। শেষ ওভারে তা এসে দাঁড়ায় ১২ রানে। কিন্তু যিনি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সেই জাকেরই দাসুন শানাকার করা শেষ ওভারের তৃতীয় বলে লং অফ বাউন্ডারিতে ক্যাচ। তাঁর ইনিংস থামে ৩৪ বলে ৬৮ রানে, ৪টি চার ও ৬টি ছক্কায় ২০০ স্ট্রাইক রেটে নিজের ইনিংস সাজিয়েছেন জাকের।
পরের বলেই শরীফুল ইসলাম চার মেরে রোমাঞ্চটা ইনিংসের শেষ বল পর্যন্ত জিইয়ে রাখেন। পরের বলে দৌড়ে এক রান নিলেও শেষ বলে জয়ের জন্য যখন দরকার ৫ রান, তখন তাসকিন আহমেদ দৌড়ে ১ রানের বেশি নিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত হারের হতাশা নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয় বাংলাদেশকে।
শ্রীলঙ্কা ৩ উইকেটে ২০৬ রান করলেও তাদের ইনিংসের শুরুতে ছিল শরীফুল ইসলামের দাপট। প্রথম বলেই আভিস্কা ফার্নান্ডোর আউটসাইড এজ খুঁজে নেন ফুল লেংথের সুইং মেশানো বলে। ফার্নান্ডোর ভাগ্যও ভালো, বলটা যায় প্রথম স্লিপে থাকা সৌম্য সরকারের একটু দূর দিয়ে। সে বলে বাউন্ডারিও পেয়ে যান লঙ্কান ওপেনার।
কিন্তু প্রায় একই লাইন ও লেংথের পরের বলেই কট বিহাইন্ড ফার্নান্ডো। পাওয়ারপ্লের পরের সাফল্যটা আসে আরেক পেসার তাসকিন আহমেদের বলে। ১৪ বলে ১৯ রান করে উড়তে থাকা কামিন্দু মেন্ডিস তাসকিনের বলে পুল করেন শর্ট মিড উইকেটে থাকা সৌম্য সরকারের হাতে।
শুরুর সাফল্য বলতে এই দুই উইকেটই। এরপর পেসাররা পাননি কোনো সুইং। লঙ্কান দুই ব্যাটসম্যান কুশল মেন্ডিস ও নাদিরা সামারাবিক্রমার চার-ছক্কায় বল বারবার গিয়েছে শিশির ভেজা আউটফিল্ডে। তার মধ্যেও অফ স্পিনার শেখ মেহেদী হাসানের কথা আলাদা করে বলতে হয়। ভেজা বলে তাঁকে বোলিং করতে হয়েছে লঙ্কান দুই ডানহাতির বিপক্ষে। দুজনই মেহেদীর বলে দ্রুত রান নিয়ে ইনিংসের ভিত গড়েছেন।
দুজনের জুটি লঙ্কানদের এনে দেয় ৬১ বলে ৯৬ রান। দুজনের মধ্যে বড় ক্ষতিটা করেছেন মেন্ডিস। রিশাদ হোসেনের বলে লং অনে আউট হওয়ার আগে মেন্ডিস ৫৯ রান করেন মাত্র ৩৬ বলে। ৬টি চার ও ৩টি ছক্কা ছিল তাঁর ১৬৩ স্ট্রাইক রেটের ইনিংসে।
কিন্তু মেন্ডিসের পর চারিত আসালাঙ্কার সঙ্গে আরও একটি জুটিতে শ্রীলঙ্কাকে বেশ ভালো অবস্থানে নিয়ে যান সামারাবিক্রমা। দুজন মিলে ৭৩ রান যোগ করেন মাত্র ৩৩ বলে। সামারাবিক্রমা অপরাজিত থাকেন ৪৮ বলে ১২৭ স্ট্রাইক রেটে ৬১ রানে। আর আসালাঙ্কা খেলেন ২১ বলে ৪৪ রানের বিস্ফোরক ইনিংস।
তাঁর ২০৯ স্ট্রাইক রেটের ইনিংসে ছিল না কোনো চার, কিন্তু ছক্কা মেরেছেন ৬টি। মোস্তাফিজের শেষ ওভারেই নিয়েছেন ২৪ রান, যা ছিল টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে খরুচে ওভার। পুরো ইনিংসে বাংলাদেশ ওভারে ১৫ বা এর চেয়ে বেশি রান দিয়েছে চারবার। শ্রীলঙ্কার রানটা ১৬০ বা ১৭০–এর জায়গায় দুই শতাধিকে চলে যায় ওই চার ওভারেই।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
শ্রীলঙ্কা: ২০ ওভারে ২০৬/৩ ( সামারাবিক্রমা ৬১*, মেন্ডিস ৫৯, আসালাঙ্কা ৪৪*, কামিন্দু ১৯; রিশাদ ১/৩২, তাসকিন ১/৪০, শরীফুল ১/৪৭)
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ২০৩/৮ ( জাকের ৬৮, মাহমুদউল্লাহ ৫৪, নাজমুল ২০, মেহেদী ১৬, সৌম্য ১২, তাওহিদ ৮ ; ম্যাথুস ২/১৭, বিনুরা ২/৪১, শানাকা ২/২৬)
ফল: শ্রীলঙ্কা ৩ রানে জয়ী।
ম্যাচসেরা: চারিত আসালাঙ্কা (শ্রীলঙ্কা)
সিরিজ: তিন ম্যাচ সিরিজে শ্রীলঙ্কা ১–০ ব্যবধানে এগিয়ে।