মাঠ থেকে ‘উধাও’ সেই আম্পায়ারই বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সিরিজের দায়িত্বে
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে একটু আগেভাগেই যুক্তরাষ্ট্রে গেছে বাংলাদেশ দল। গত শুক্রবার শক্তিশালী হারিকেনের প্রভাবে হওয়া ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই টেক্সাসের হিউস্টনে পৌঁছেছেন নাজমুল-সাকিব-মাহমুদউল্লাহরা। বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে সেখানে সহ-আয়োজক যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজ খেলবেন তাঁরা।
আইসিসির সহযোগী সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে এটিই হতে চলেছে বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ। হিউস্টনের প্রেইরি ভিউ ক্রিকেট কমপ্লেক্সে আগামী মঙ্গলবার হবে প্রথম টি-টোয়েন্টি। একই ভেন্যুতে শেষ দুটি ম্যাচ বৃহস্পতি ও শনিবার।
‘ঐতিহাসিক’ এই সিরিজে আম্পায়ারিংয়ের দায়িত্বে থাকবেন ৪ জন—সামির বান্দেকার, জারমেইন লিন্ডো, আদিত্য গাজ্জার, বিজয়া মাল্লেলা। এই ৪ আম্পায়ার বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হলেও তাঁদের কারও জন্ম সেখানে নয়। বান্দেকার, গাজ্জার ও মাল্লেলা ভারতীয় আর লিন্ডো জ্যামাইকান। সবচেয়ে অভিজ্ঞ বান্দেকার তো বিশেষ এক কারণে আলোচিত নাম। একবার মাঠ থেকে ‘উধাও’ হয়েছিলেন তিনি!
ঘটনাটা প্রায় দেড় যুগ আগের। ২০০৬ সালের ৪ ডিসেম্বর ফিরোজ শাহ কোটলায় (বর্তমান নাম অরুণ জেটলি স্টেডিয়াম) দিল্লি-উত্তর প্রদেশের মধ্যকার রঞ্জি ট্রফি ম্যাচের শেষ দিন ছিল। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন মিলিয়ে প্রায় ৬৮ ওভারের মতো নষ্ট হওয়ায় ম্যাচটি নিশ্চিত ড্রয়ের দিকে এগোচ্ছিল।
তবে শেষ দিনে দিল্লি চেয়েছিল যতক্ষণ সম্ভব ব্যাটিং করতে, যেন পরের ম্যাচের জন্য তারা অনুশীলন সেরে নিতে পারে। তা ছাড়া দিল্লির সেই সময়ের ওপেনার ও বর্তমান ধারাভাষ্যকার আকাশ চোপড়া ৬৮ রানে অপরাজিত ছিলেন। প্রথম ইনিংসে ১৫০ রান করা আকাশ দ্বিতীয় ইনিংসেও সেঞ্চুরি করতে চেয়েছিলেন। দিল্লির হয়ে ওই ম্যাচে বিরাট কোহলিও খেলেছেন। ১৩ রানে অপরাজিত থাকা কোহলিরই শেষ দিনে আকাশের সঙ্গে ব্যাটিং শুরুর করার কথা ছিল।
কিন্তু ওই দিন সকাল সোয়া ৯টায় মাঠের দুই আম্পায়ার ইভাতুরি শিবরাম ও সামির বান্দেকার ঘন কুয়াশার জন্য সৃষ্ট আলোকস্বল্পতাকে কারণ দেখিয়ে খেলা শুরুর সময় পিছিয়ে দেন।
ঘটনার শুরু এর পরেই। বেলা যখন পৌনে ১১টা বাজে, তখন কুয়াশা কেটে গিয়ে দিল্লির আকাশে ঝলমলে রোদ। কিছুক্ষণের মধ্যে খেলা শুরু হবে ভেবে দুই দল গা গরম করতে মাঠে নেমে পড়ে। ঠিক তখনই সবাই লক্ষ করেন, আম্পায়ার সামির বান্দেকার ও ম্যাচ রেফারি সম্বরন ব্যানার্জি মাঠ থেকে ‘উধাও’। স্টেডিয়ামের সব জায়গায় খুঁজেও বান্দেকার ও ব্যানার্জিকে পাওয়া যায়নি। এদিকে দুই দল খেলতে নামার অপেক্ষায়।
দুপুর ১২টার দিকে বান্দেকার ও ব্যানার্জি কোথা থেকে যেন হাজির! দুজন এতক্ষণ কোথায় ছিলেন, সেসবের উত্তর না দিয়েই মধ্যাহ্নভোজ বিরতির ঘোষণা দেন।
মধ্যাহ্নভোজ চলাকালে আবার আলোকস্বল্পতা দেখা দেয়। দিনের তখনো দুই সেশন বাকি। এরপর দুই আম্পায়ার শিবরাম ও বান্দেকার এবং ম্যাচ রেফারি ব্যানার্জি মিলে শেষ দিনের খেলা পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। ফলে ম্যাচটি ড্র হয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, দিনের খেলা বাতিল ঘোষণার কিছুক্ষণ পর আবার রোদ ওঠে এবং দিল্লি-উত্তর প্রদেশ দুই দলের কোচই খেলার অনুরোধ জানান। কিন্তু তা কী করে হয়! একবার খেলা বাতিলের ঘোষণা এলে কি আবার খেলতে নামা যায়? তা ছাড়া ম্যাচের ফলও তো নির্ধারিত হয়ে গেছে।
প্রায় ১৮ বছর আগের সেই ঘটনা নিয়ে দিল্লির সে সময়ের কোচ চেতন চৌহান ও উত্তর প্রদেশের কোচ রাজিন্দার সিং ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেন, ‘আমরা খেলতে নামার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু তাঁরা (ম্যাচ অফিশিয়ালরা) কেন খেলা শুরু করেননি, এ ব্যাপারে আমাদের কোনো ধারণা নেই।’
ম্যাচ শেষে অফিশিয়ালদের বিরুদ্ধে দিল্লি অ্যান্ড ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের (ডিডিসিএ) কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দেয় দুই দল। ম্যাচ রেফারি ব্যানার্জি অবশ্য দাবি করেন, তিনি টয়লেটে ছিলেন। মানে, প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে টয়লেটে!
পরে হিন্দুস্তান টাইমসের অনুসন্ধানেই সত্যিটা বেরিয়ে আসে। ফিরোজ শাহ কোটলার অদূরে সেন্ট স্টিফেনস গ্রাউন্ডে বেঙ্গল ও পাঞ্জাব অনূর্ধ্ব-২২ দলের খেলা চলছিল। ম্যাচ রেফারি সম্বরন ব্যানার্জি বাঙালি হওয়ায় তাঁর খুব আগ্রহ জেগেছিল বেঙ্গলের খেলা দেখার। তবে ব্যানার্জি একাই যেতে চাননি, তাই আম্পায়ার সামির বান্দেকারকে সঙ্গে নিয়েছিলেন।
বেঙ্গল-পাঞ্জাব অনূর্ধ্ব-২২ দলের ম্যাচে যখন বিরতি চলছিল, তখন তাঁরা ফিরোজ শাহ কোটলায় ফিরে এসে দিল্লি-উত্তর প্রদেশের ম্যাচে মধ্যাহ্নভোজ বিরতির ঘোষণা দেন। পরে কোনো এক অজানা কারণে দিনের দুই সেশন বাকি থাকতে ম্যাচের ইতি টেনে আবার মাঠ থেকে বেরিয়ে যান।
যা–ই হোক, ওই ঘটনার পর খুব বেশি দিন ভারতে থাকেননি আম্পায়ার সামির বান্দেকার। পাড়ি জমান মার্কিন মুলুকে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার পর তিনি আমেরিকান অঞ্চলে আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর ম্যাচে আম্পায়ারিং করতে শুরু করেন।
১৯৯৭ সালে মেয়েদের একটি ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আম্পায়ারিং শুরু করা বান্দেকার তিন সংস্করণ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৪টি ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। ৫৯ বছর বয়সী বান্দেকারই এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে অভিজ্ঞ আম্পায়ার।
সেই বান্দেকারকেই বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র টি-টোয়েন্টি সিরিজের দুটি ম্যাচে মাঠের আম্পায়ার হিসেবে দেখা যাবে। আগামী মঙ্গলবার প্রথম ও শনিবার শেষ ম্যাচে আম্পায়ারিং করবেন তিনি।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস পরিষেবাবিষয়ক কোম্পানি অ্যাকুওয়েদার বলছে, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সিরিজে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। প্রতিকূল আবহাওয়া দেখে বান্দেকার ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করে আবার ‘উধাও’ হয়ে যাবেন কি না—এমন রসিকতা চাইলে করতেই পারেন।