আফগানিস্তানকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষিদ্ধ করার আহ্বান হিউম্যান রাইটস ওয়াচের
তালেবানশাসিত আফগানিস্তান ক্রিকেট দলের সদস্যপদ স্থগিত করতে আইসিসিকে আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। আইসিসির কাছে পাঠানো ই–মেইল বার্তায় নির্বাসিত আফগানিস্তান নারী ক্রিকেট দলকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছে সংস্থাটি। একই সঙ্গে মেয়েদের অনুশীলন ও খেলার অনুমতি এবং আইসিসির পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক সহায়তাও চাওয়া হয়েছে।
আফগানিস্তান ক্রিকেট দলের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহণের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে চিঠিটি পাঠানো হয়েছে সরাসরি আইসিসি সভাপতি জয় শাহকে উদ্দেশ্য করে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি চিঠিটি পাঠানো হলেও সেটি প্রকাশ্যে এসেছে ৭ মার্চ। যেখানে বিষয় হিসেবে লেখা হয়েছে : ‘আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে স্থগিত করা এবং মানবাধিকার নীতি বাস্তবায়ন।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মূলত স্বাধীন, আন্তর্জাতিক, বেসরকারি সংস্থা, যারা গবেষণার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সহায়তা প্রধান করে থাকে।
আইসিসিকে পাঠানো ই–মেইল বার্তায় সংস্থাটি লিখেছে, ‘আমরা এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলকে (আইসিসি) তালেবানশাসিত আফগানিস্তানের আইসিসি সদস্যপদ স্থগিত করার এবং দেশটির আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি। যত দিন পর্যন্ত নারী এবং মেয়েরা আবারও শিক্ষা এবং খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না, তত দিন পর্যন্ত এই পন্থা অবলম্বন করা হোক। পাশাপাশি আইসিসিকে আমরা জাতিসংঘের ব্যবসা এবং মানবাধিকার নির্দেশনা নীতিমালা মেনে মানবাধিকার নীতি বাস্তবায়নেরও আহ্বান জানাচ্ছি।’
চিঠিতে নারী ক্রিকেটের উন্নতির ব্যাপারে আইসিসির প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে আফগানিস্তানের নারীদের প্রতি কী ধরনের বৈষম্য করা হচ্ছে, তা–ও উল্লেখ করা হয়, ‘২০২১ সালের আগস্টে আবারও ক্ষমতা গ্রহণের পর তালেবানরা মেয়েদের ওপর নিয়মনীতির দীর্ঘ এক তালিকা চাপিয়ে দিয়েছে, যা নারী ও মেয়েদের তাদের মৌলিক অধিকারের চর্চা থেকে বিরত রেখেছে। যেখানে মতপ্রকাশ ও চলাফেরার স্বাধীনতা, অনেক ধরনের চাকরিতে নিষেধাজ্ঞা ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির ওপরে না পড়ানোর মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত আছে। এগুলো তাদের জীবন, জীবিকা, আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য, পানীয়সহ কার্যত সব অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’
এই ই–মেইল বার্তায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আইসিসির বৈষম্যবিরোধী নীতির কথাও মনে করিয়ে দেওয়া হয়। যে নীতি অনুসারে ক্রিকেট যে জায়গাতেই খেলা হোক, সব ধরনের মানুষের তা উপভোগের অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা কিংবা মাতৃত্বকালীন অবস্থাতেও কোনো ধরনের ভয়ভীতি ছাড়া ক্রিকেট উপভোগ করতে পারবে।
একই মেইলে এটাও উল্লেখ করা হয় যে ২০২১ সালে আফগানিস্তান নারী দলকে অর্থ প্রদান স্থগিত করা হলেও, দেশটির পুরুষ দল নিরবচ্ছিন্নভাবে অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোগত সহায়তা পেয়ে আসেছে, যা কি না স্পষ্টভাবে আইসিসির নিজেদের তৈরি করা বৈষম্যবিরোধী নীতির লঙ্ঘন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ‘নারী এবং মেয়েদের ক্রিকেট দলকে খেলতে না দিয়ে এবং নারী ও মেয়েদের জাতীয় দলকে আন্তর্জাতিকভাবে অংশ নেওয়ার অনুমতি না দিয়ে আফগানিস্তান ক্রিকেট বৈষম্যবিরোধী নীতি মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছে।’
চিঠিতে আরও যোগ করা হয়, ‘আমরা জানি ২০২৮ সালের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমসে ক্রিকেটকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে তালেবান কর্তৃক নারী এবং মেয়েদের খেলায় অংশ নিতে না দেওয়া অলিম্পিক নীতি মারাত্মক লঙ্ঘন, যাতে বলা হয়েছে, “খেলাধুলা হচ্ছে মানবাধিকার।”’
২০২১ সালে তালেবানরা আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসার পর খেলাধুলাসহ জনজীবনে নারীদের স্বাধীন অংশগ্রহণ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অথচ এর আগে আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (এসিবি) ২৫ জন নারী খেলোয়াড়ের সঙ্গে চুক্তিও করেছিল। যাদের বেশির ভাগই এখন অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাসিত আছে।
গত বছরের জুলাইয়ে আফগানিস্তানের নারী ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়রা আইসিসিকে একটি চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠিতে তারা অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী দল গঠনের ব্যাপারে সাহায্যের আবেদন করে। যার ধারাবাহিকতায় গত ৩০ জানুয়ারি মেলবোর্নের জংশন ওভালে আফগানিস্তান উইমেন্স একাদশ ও ক্রিকেট উইথআউট বর্ডারসের মধ্যকার প্রীতি ম্যাচও অনুষ্ঠিত হয়।
একই সময়ে ব্রিটিশ এমপির পক্ষ থেকে ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডেকে (ইসিবি) চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ বয়কট করার দাবি জানানো হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি। দুই দল ঠিকই ম্যাচটি খেলেছিল। যেখানে আফগানিস্তানের কাছে হেরে বিদায় নেয় ইংল্যান্ড।
গত ৩০ জানুয়ারি মেলবোর্নের জংশন ওভালে আফগানিস্তান উইমেন্স একাদশ ও ক্রিকেট উইথআউট বর্ডারসের মধ্যকার প্রীতি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।
আইসিসি ইভেন্টে খেললেও ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া আফগানিস্তানের বিপক্ষে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সব মিলিয়ে আফগানিস্তানের পুরুষ দলকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি একটু জটিল। এর আগে আফগানিস্তান নারী দলের কয়েকজন সদস্য ইএসপিএনক্রিকইনফোকে এক পডকাস্টে বলেছেন, তাঁরা চান না দেশের পুরুষ দলকে খেলা থেকে বিরত রাখা হোক। কারণ, দলটি এখনো আশা বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু পুরুষ দলের কাছে অধিকারবঞ্চিত নারী ও মেয়েদের প্রত্যাশা যে আরও বেশি সেটিও জানাতে ভুল করেননি তাঁরা।
সবদিক বিবেচনা করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আইসিসির কাছ থেকে তড়িৎ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। পাশাপাশি নারী ও মেয়েদের নিজেদের প্রতিযোগিতায় অন্তর্ভুক্ত করতে আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে চাপ দিতে আইসিসি কী পক্ষেপ নিয়েছে, তা–ও জানতে চাওয়া হয়েছে।
ই–মেইলের শেষে বলা হয়েছে, ‘আইসিসির উচিত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির মতো অন্যান্য ক্রীড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পদক্ষেপ অনুসরণ করে তালেবানদের আফগান নারী ও মেয়েদের খেলাধুলায় অন্তর্ভুক্ত করতে এবং মানবাধিকার কাঠামোর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে বলা।’