২৫ বছর আগের ক্রিকেট–কাঁপানো সেই কেলেঙ্কারি

হানসি ক্রনিয়েএএফপি

অন্য অনেকের মতো হান্সি ক্রনিয়েরও ঘৃণিত হওয়ার কথা ছিল। ম্যাচ গড়াপেটা, পাতানো—এসবের সঙ্গে কোনো ক্রিকেটার জড়িত হলে তাঁকে কে পছন্দ করবে? ক্রনিয়ে জড়িয়েছিলেন। কিন্তু কেন জানি তিনি ঘৃণিত নন। অশ্রদ্ধা? বুকে হাত দিয়ে এটাও খুব বেশি ক্রিকেট সমর্থক বলতে পারবে না।
অথচ ক্রনিয়ে নিজে স্বীকার করেছিলেন, জুয়াড়িদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছেন তিনি। সরাসরি ম্যাচ পাতাননি, কিন্তু ম্যাচ-পূর্ববর্তী খবরাখবর ফাঁস করেছিলেন। অর্থের লোভে সতীর্থদের প্রস্তাব দিয়েছিলেন খারাপ খেলার জন্য! এত কিছুর পরও ক্রনিয়ের জন্য একটা দুর্বল জায়গা আছে ক্রিকেট সমর্থকদের মনে। দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের মনে তো অবশ্যই। নইলে কি আর ‘সর্বকালের সেরা ১১ দক্ষিণ আফ্রিকান’-এর একজন হিসেবে তাঁকে বেছে নেয় তারা! তা-ও আবার তাঁর রহস্যজনক মৃত্যুর দুই বছর পর!


২৫ বছর আগে ঠিক এই দিনে, মানে ৭ এপ্রিল, দিল্লি পুলিশ দাবি করল, ভারতীয় এক জুয়াড়ির পাল্লায় পড়ে ম্যাচ পাতানোয় ভূমিকা রেখেছিলেন ক্রনিয়ে। এর আগপর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক ছিলেন ‘ক্রিকেট–বিশ্বের ভদ্রলোক’। যান্ত্রিক দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে যেন প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন তিনি। দেখিয়েছিলেন অধিনায়কত্ব কতটা দারুণ, কতটা আধুনিক হতে পারে। কিন্তু ওই যে পাতানো ম্যাচের অভিযোগ আর তাতে স্বীকারোক্তি, সে কারণে ২০০০ সালের অক্টোবরে ক্রিকেট থেকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয় ক্রনিয়েকে।

কী ছিল সেই ঘটনা

২০০০ সালের ৭ এপ্রিল। দিল্লি পুলিশের এক বিস্ফোরক অভিযোগ নাড়িয়ে দেয় ক্রিকেট–বিশ্বকে। তারা দাবি করে, দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক হান্সি ক্রনিয়ে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত। এক জুয়াড়ির সঙ্গে ফিক্সিং নিয়ে তাঁর কথোপকথনের টেপ আছে তাদের কাছে। অভিযোগটা ছিল এমন একজনের বিরুদ্ধে, যা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। শুরুতে অনেকেই বিশ্বাস করেওনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় সেই অভিযোগের। তখনো ক্রনিয়ের পক্ষেই বেশির ভাগ ক্রিকেটপ্রেমী। ক্রনিয়ে নিজেও অভিযোগ অস্বীকার করেন। সংবাদ সম্মেলন করে তখনকার ইউনাইটেড ক্রিকেট বোর্ড অব সাউথ আফ্রিকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ব্যাখার তাঁর দলের অধিনায়কের ওপর পুরো আস্থা আছে বলে জানিয়ে দেন।

কিং কমিশনের সামনে শুনানিতে ক্রনিয়ে
এএফপি


এর মাত্র কয়েক দিন পর, ১১ এপ্রিলের ভোররাতে আলী ব্যাখারকে ফোন করে নিজের অপরাধ স্বীকার করেন ক্রনিয়ে। ব্যাখারকে তিনি ফোনে বলেন, ‘আমি (ক্রিকেট ক্যারিয়ারের) পুরোটা সময় সৎ ছিলাম না।’
সেদিনই দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়কের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয় হান্সি ক্রনিয়েকে। দেশটির প্রেসিডেন্ট এ ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশেই ‘কিং কমিশন’ নামে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। পরে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ক্রনিয়ে ব্যাখারের কাছে স্বীকার করেছেন, তিনি সম্পূর্ণ সৎ ছিলেন না। তিনি স্বীকার করেছেন যে বুকমেকার সঞ্জয়ের (সঞ্জীব চাওলা) কাছ থেকে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার ডলারের মাঝামাঝি একটি অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করেছিলেন।’

আরও পড়ুন

কমিশনের শুনানিতে আরও জানা যায়, জোহানেসবার্গের বাসিন্দা হামিদ কাসিম, যাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি, তিনি ক্রনিয়ের সঙ্গে সঞ্জয়ের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। শুনানিতে বলা হয়, সঞ্জয় ভারতে একজন দণ্ডিত অপরাধী। যিনি পালিয়ে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্নভাবে ক্রিকেটে ফিক্সিং করে যাচ্ছেন।

কমিশনের সামনে সত্য বলার শপথ নিচ্ছেন ক্রনিয়ে
এএফপি

কিং কমিশনের প্রমাণ সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন শামিলা বাটোই, যিনি বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিং কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতেই পরবর্তী সময়ে দেশটিতে ম্যাচ ফিক্সিংকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
হান্সি ক্রনিয়ের সঙ্গে ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে নাম এসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার আরও দুজন ক্রিকেটার হেনরি উইলিয়ামস ও হার্শেল গিবসের। অভিযোগ ছিল, ক্রনিয়ে তাঁদের ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ খেলতে বলেছিলেন। এই দুই ক্রিকেটারকে ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়।

আরও পড়ুন

ক্রনিয়ে নিজে শুরুতে কী বলেছিলেন

অধিনায়কের পদ থেকে অপসারণের দুই দিন পর, ১৩ এপ্রিল ২০০০ সালে, ক্রনিয়ে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেন। সেখানে তিনি ম্যাচের ফল প্রভাবিত করার অভিযোগ থেকে নিজেকে আলাদা করার চেষ্টা করেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু এটুকু বলব, আমি কখনো ম্যাচ ফিক্সিং বা ফলাফল নির্ধারণে জড়িত ছিলাম না। আমি সব সময় জয়ের জন্যই খেলেছি।’

ক্রনিয়ে নাকি তদন্ত কমিশনের কাছে বলেছিলেন, দুর্বল মুহূর্তে তিনি ‘শয়তান ও দুনিয়ার প্রলোভনের কাছে নতিস্বীকার করেছিলেন’ এবং তাঁর ছিল ‘অর্থের প্রতি দুর্ভাগ্যজনক মোহ’।


তবে কিছুদিন পর জুন মাসে অন্য এক বিবৃতিতে ক্রনিয়ে স্বীকার করেন, আগে মিথ্যা বলেছিলেন। তিনি ম্যাচ গড়াপেটায় যুক্ত ছিলেন এবং এর জন্য ‘অনেক হাজার’ ডলার ঘুষ নিয়েছিলেন। ওই বিবৃতিতে ক্রনিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি দক্ষিণ আফ্রিকার ইউনাইটেড ক্রিকেট বোর্ড, সরকার এবং যাঁরা আমাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের সবাইকে বিভ্রান্ত করেছি। এমনকি আমার আইনজীবীদের কাছেও আমি কিছু সত্য গোপন করেছিলাম। আমি সৎ ছিলাম না এবং আমি নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাইছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ক্রিকেট থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার এবং আর কখনো প্রতিনিধিত্বমূলক ক্রিকেট না খেলার। আমি অন্যদের কষ্টের কারণ হয়েছি, এটা যে কী পরিমাণ লজ্জা, অপমান ও যন্ত্রণা বয়ে এনেছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।’

আরও পড়ুন


দক্ষিণ আফ্রিকার সংবাদমাধ্যম জানায়, ক্রনিয়ে নাকি তদন্ত কমিশনের কাছে বলেছিলেন, দুর্বল মুহূর্তে তিনি ‘শয়তান ও দুনিয়ার প্রলোভনের কাছে নতিস্বীকার করেছিলেন’ এবং তাঁর ছিল ‘অর্থের প্রতি দুর্ভাগ্যজনক মোহ’।
তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্রনিয়েকে কোনো ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি; তিনি সেই বিচার থেকে রেহাই পান।

কে এই নীরজ কুমার

ক্রনিয়ে–কেলেঙ্কারি প্রথম যিনি ক্রিকেট–বিশ্বের সামনে এনেছিলেন, সেই নীরজ কুমার দিল্লি পুলিশের সাবেক কমিশনার। ৩৭ বছর ভারতীয় পুলিশে চাকরি করার পর ২০১৩ সালে তিনি অবসরে যান। চাকরিজীবনের একটা পর্যায়ে তিনি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) দুর্নীতি দমন ইউনিটের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ক্রিকেটে সংঘটিত অপরাধ নিয়ে তাঁর লেখা বই ‘আ কপ ইন ক্রিকেট’ যথেষ্ট আলোচিত।

ওই মামলাটি আমাকে একজন ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আমি এত হতাশ হয়েছিলাম! এর পর থেকে আমি সব সময় ক্রিকেট খেলাটিকে কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখেছি।
নীরজ কুমার

গত মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার সংবাদমাধ্যম ডেইলি ম্যাভেরিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নীরজ কুমার বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, এই কেলেঙ্কারিতে আরও অনেকে জড়িত ছিলেন। ফিক্সিংয়ে হান্সির সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ পেয়েছিল ফোনে আড়ি পাতা রেকর্ডিং থেকে, যেখানে তাঁর কণ্ঠ আমরা চিনতে পারি। পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেই তো অপরাধের কথা স্বীকার করেন। তবে ওই সময়ে ক্রিকেটে এই যে দুর্নীতির ঘুণ কতটা গভীরে পৌঁছেছিল, তা কল্পনা করাও কঠিন। তখনকার সময়ে প্রায় সব বড় ক্রিকেট তারকাই কোনো না কোনোভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন।’

নিজের পুলিশ-জীবন নিয়ে অনেকগুলো বই লিখেছেন নীরজ কুমার
এএফপি


নীরজ কুমার এটাও বলেন, ‘ওই মামলাটি আমাকে একজন ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আমি এত হতাশ হয়েছিলাম! এর পর থেকে আমি সব সময় ক্রিকেট খেলাটিকে কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখেছি।’
নীরজের দাবি, ‘ক্রনিয়ের ওই ঘটনাটা ক্রিকেটের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল। এর পর থেকেই পরিস্থিতির উন্নতি শুরু হয় এবং এখনো সেই ধারা অব্যাহত। তবে একই সঙ্গে তিনি এই সতর্কবার্তাও দেন, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না যে এখন ক্রিকেট একেবারে দুর্নীতিমুক্ত। তবে আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, ২০০০ সাল বা তার আগের তুলনায় আজকের ক্রিকেট অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন।’
এই পরিবর্তনের পেছনে নীরজ যে কারণগুলোর কথা উল্লেখ করেন, এর মধ্যে রয়েছে: বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের ধরা পড়া, ফাঁস হলে আজীবন নিষেধাজ্ঞা কিংবা কারাবাসের আশঙ্কা এবং ক্রিকেট বোর্ডগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) কঠোর দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা।

আরও পড়ুন

ক্রনিয়ের শেষটাও হৃদয়বিদারক

ক্রনিয়ের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে তাঁর পিতা এউই ক্রনিয়ে
এএফপি

সেই কেলেঙ্কারি ও ক্রিকেট থেকে ক্রনিয়ের নির্বাসনেই তাঁর শাস্তি শেষ হয়নি। তাঁর জন্য এর চেয়েও বড় ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করছিল।
২০০২ সালের ১ জুন। জোহানেসবার্গ থেকে নিজের শহর জর্জে ফিরছিলেন। বিমানে তিনিই একমাত্র যাত্রী। জর্জ বিমানবন্দরের কাছাকাছি এসে পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় বিধ্বস্ত হলো বিমানটা। দুজন পাইলটসহ ক্রনিয়ের মৃত্যু হলো কুটেনিকোয়া পাহাড়ে। দুর্ঘটনা বলেই মেনে নিয়েছিলেন সবাই। কিন্তু ২০০৭ সালে ক্রনিয়ের একসময়ের গুরু ও তখন পাকিস্তান দলের কোচ বব উলমারের রহস্যজনক মৃত্যুর পর দানা বাঁধে সন্দেহ। ম্যাচ পাতানোর চক্রটা তাদের তথ্যপ্রমাণ সব মুছে ফেলার চেষ্টা করেনি তো?
ক্রনিয়ের যেসব ম্যাচ নিয়ে গড়াপেটার অভিযোগ উঠেছিল, তখন তো কোচ হিসেবে উলমারও ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা দলে!
এ প্রশ্নের জবাবটাও নিজের সঙ্গে নিয়ে গেছেন ক্রনিয়ে।

আরও পড়ুন