শেষ পর্যন্ত ভারতের আশা পূরণ হলো না। অঘটন ঘটিয়ে নিউজিল্যান্ডকে হারানো হলো না আফগানিস্তানের। পাকিস্তানের পাশাপাশি গ্রুপ থেকে সেমিফাইনালে উঠে গেল নিউজিল্যান্ড। আফগানিস্তান তো বাড়িতে ফিরলই; ভারতেরও বিদায় হয়ে গেল টুর্নামেন্ট থেকে।
২০১২ সালের পর আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে নকআউট পর্বে উঠতে ব্যর্থ হলো ভারত; ২০১৩ সালের পর কোনো আইসিসি টুর্নামেন্টে সেমিফাইনালের আগে বাদ পড়ল। তা-ও এমন এক টুর্নামেন্টে, যেখানে ভারত গেছে সম্ভাব্য শিরোপাজয়ী হিসেবে। এমন বিদায়ের পর ভারতের সংবাদমাধ্যমে অধিনায়ক বিরাট কোহলি, সিনিয়র ব্যাটসম্যান রোহিত শর্মা কিংবা ভারতীয় দলের কোচ রবি শাস্ত্রীর সমালোচনা হওয়ারই কথা। তবে এবার ভারতের সংবাদমাধ্যমে সমালোচনার সুর কিছুটা পরিমিতই!
আবুধাবিতে আজ ভারতের গ্রুপ পর্বেই বিদায় নিশ্চিত হওয়ার পর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে কোহলিদের এমন বিদায়ের বেদনা। ভারতের বিখ্যাত সংবাদপত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস শিরোনামে লিখেছে, ‘শুধু প্রার্থনায় কাজ হয় না’। আরেক সংবাদপত্র দ্য হিন্দু লিখেছে, ‘কোহলি-শাস্ত্রী যুগের শেষ’। প্রায় সব সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনেই পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম দুই ম্যাচে ভারতের হার নিয়ে আক্ষেপ ঝরছে।
আফগানিস্তান-নিউজিল্যান্ডের ম্যাচের প্রতিবেদনে ভারতের বিদায়ের খবর জানাতে গিয়ে সংবাদসংস্থা পিটিআইয়ের প্রতিবেদনই নিজেদের ওয়েবসাইটে তুলে দিয়েছে দ্য হিন্দু, এনডিটিভি, টাইমস অব ইন্ডিয়ার মতো সংবাদমাধ্যম। সেখানে লেখা, ‘ভারতের আশা টিকে ছিল আফগানিস্তানের ব্ল্যাক ক্যাপদের (নিউজিল্যান্ড) হারানোর ওপর। সেটা হলে নেট রানরেট সামনে চলে আসত, বিরাট কোহলির দলের জন্য সেমিফাইনালে যাওয়ার দরজা খুলে যেত। কিন্তু এভাবে বাদ পড়ার পেছনে কোহলির দল এখন শুধু নিজেদেরই দুষতে পারে।’
প্রথম দুই ম্যাচে পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের কাছে ভারতের দুই হার নিয়েই আক্ষেপ ঝরেছে পিটিআইয়ের প্রতিবেদনে, ‘দলটা সুপার টুয়েলভে নিজেদের প্রথম দুই ম্যাচে পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের কাছে ধাক্কা খেয়েছে, যেটা শেষ পর্যন্ত ভারতের ভাগ্য লিখে দিয়েছে। আফগানিস্তান ও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ে দলটা ফিরে এসেছে ঠিকই, কিন্তু প্রথম দুই ম্যাচে হারের ক্ষতিটা অনেক বেশিই প্রমাণিত হলো।’
‘শুধু প্রার্থনায় কাজ হয় না, আফগানিস্তান হেরেছে, ভারত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে বাদ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস প্রথম তিন বাক্যে ভারতের অলরাউন্ডার রবিচন্দ্রন অশ্বিনের একটা টুইটকে সামনে নিয়ে এসেছে, ‘আফগানিস্তান ইনিংসের মাঝপথে টুইটারে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের একটা পোস্ট ভেসে ওঠে। আড়াআড়ি আঙুলের (প্রার্থনা বোঝাতে) সেই তিনটি ইমোজি হাজারো শব্দ বলে গেল। ভারতীয় দলের মূল ক্রিকেটারদের একজন, যিনি কিনা খুব ভালো বলতেও জানেন, তিনি আশার বিপরীতে আশায় বুক বেঁধেছিলেন।’
আফগানিস্তান-নিউজিল্যান্ড ম্যাচে ভারতের ভাগ্যও জড়িয়ে ছিল বলে এ ম্যাচ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাস্যরসাত্মক অনেক ছবি-পোস্ট (মিম) ছড়িয়ে পড়েছিল ম্যাচের আগে। কিন্তু বাস্তবতা যে এ হাস্যরসের বিপরীতেই ছিল, সেটি মনে করিয়ে দিয়েছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন, ‘মাঠে বাস্তবতা ভিন্ন ছিল। আফগানিস্তানের কাছে নিউজিল্যান্ডের হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা খেলাটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউই গুরুত্বের সঙ্গে নেননি, ভারতীয় দলের কেউ তো নেনইনি।’
ভারতের কোনো ক্রিকেটার যে নেননি, সেটার প্রমাণ হিসেবে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতের জয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে অলরাউন্ডার রবীন্দ্র জাদেজার একটা উক্তিকে সামনে এনেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। আফগানিস্তান হেরে গেলে কী করবেন, এমন প্রশ্নে জাদেজা সেদিন হিন্দিতে যা বলেছিলেন, তার বাংলা দাঁড়ায়, ‘কী আর, ব্যাগ গুছিয়ে ঘরে চলে যাব!’ দুদিন পর তা-ই হচ্ছে!
নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে আফগানিস্তানের ম্যাচে ভারতের ভাগ্য জড়ানো জেনেও যে এ ম্যাচে ভারতীয় দর্শকের সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা ছিল, সেটিও প্রতিবেদনে তুলে এনেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। ইঙ্গিত, ভারতের দর্শকেরা আসলেই বাস্তবে আফগানিস্তানের কাছে নিউজিল্যান্ডের হার কল্পনা করেননি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক ভারতীয় আফগানিস্তানের লেগ স্পিনার রশিদ খানের ওপর ভরসা রেখে পোস্ট করেছিলেন বলে লিখেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। আইপিএলের কারণে রশিদই ভারতের মানুষের কাছে সবচেয়ে পরিচিত কিনা!
কিন্তু নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আজ ৪ ওভারে ২৭ রানে ১ উইকেট পাওয়া রশিদের দুর্বলতা নিয়েই বরং বিশ্লেষণ করেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ‘সত্যিটা হচ্ছে রশিদ তখনই উইকেট নেওয়া বোলার হয়ে ওঠেন, যখন প্রতিপক্ষ দলের ওভারপ্রতি অনেক বেশি রান নেওয়ার দরকার পড়ে, ব্যাটসম্যানরা যখন রানের গতি বাড়াতে চান। বেঙ্গালুরুতে ভারতের বিপক্ষে রশিদের টেস্ট অভিষেকে ফিরে তাকালে বিষয়টা পরিষ্কার হবে, যেদিন এই লেগ স্পিনার ২ উইকেট পেতে ৩৪.৫ ওভারে দিয়েছিলেন ১৫৪ রান।’
ভারতের আরেক দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে, ‘ভারতের জন্য সব শেষ হয়ে গেল। টুর্নামেন্টের আগে যারা ফেবারিট ছিল, তারাই সেমিফাইনালের দৌড় থেকে বাদ।’ আফগানিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের তিন দলেরই ভাগ্য এ ম্যাচে জড়িয়ে ছিল জানিয়ে পত্রিকাটি লিখেছে, ‘ভারত ছিল এখানে তৃতীয় দল, যারা প্রতিবেশীদের ওপর ভরসা করেছিল, যাতে তারা (আফগানিস্তান) নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ভারতের সেমিফাইনালের আশা টিকিয়ে রাখে।’
দ্য হিন্দু ভারতের ব্যর্থতার কাটাছেঁড়াও করেছে। ‘একটা যুগের শেষ’ প্রতিবেদনে কোহলি ও শাস্ত্রী এখন শেষ ম্যাচে নামিবিয়ার বিপক্ষে জয় চাইবেন, লিখলেও ঘুরেফিরে টুর্নামেন্টে ভারত কোন কোন জায়গায় ব্যর্থ হয়েছে, সেগুলো তুলে ধরেছে তারা। তবে আগামীকাল নামিবিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচও দ্য হিন্দুর চোখে, ‘১৯৯২ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের দৌড় থেকে বাদ পড়ার পর লিগ পর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচের পর আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে এত অর্থহীন ম্যাচ আর খেলেনি ভারত।’
নিউজিল্যান্ড আফগানিস্তানকে হারানোর পর ভারতীয় দলের অবস্থা বোঝাতে লিখেছে, ‘ভারতীয় শিবিরের মনোভাব পরিষ্কার হয়ে গেছে, যখন বিসিসিআইয়ের অফিশিয়াল মিডিয়ার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সাংবাদিকদের জন্য একটা বার্তা এল, ‘‘আজ সন্ধ্যায় দলের (ভারত) ঐচ্ছিক অনুশীলন সেশন বাতিল করা হয়েছে।’’’
করোনার এ সময়ে ছয় মাস ধরে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট-সিরিজে খেলতে জৈব সুরক্ষাবলয়ে থাকা ভারতীয় দল এভাবে বলয়টা ছাড়তে চায়নি বলে লিখেছে দ্য হিন্দু। কেন এভাবে বিদায়, তার বিশ্লেষণে লিখেছে, ‘কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালের আগে ভারতের বাদ পড়া এবারই প্রথম নয়। কিন্তু এর আগে কখনো বিদায়টা এত হতাশার ছিল না, কখনো বিদায়টা এভাবে দেয়ালে লেখা ছিল না। ভারত দুটি ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ টসে হেরেছে, খুব বেশি না হলে কিছুটা বৈরি কন্ডিশনে বাজে ব্যাটিং করেছে, আর শিশিরভেজা উইকেটে বোলিংটা করেছে জঘন্য।’
ভারতের কোচ হিসেবে রবি শাস্ত্রীর অধ্যায় শেষ হয়ে যাচ্ছে এ টুর্নামেন্টের পর। কোহলিও বিশ্বকাপের পর ভারতের টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব থেকে সরে যাচ্ছেন। দ্য হিন্দু লিখেছে, কোহলিকে আগামী কিছুদিনের মধ্যে ওয়ানডে অধিনায়কত্ব থেকেও বাদ দেওয়া হতে পারে।
কিন্তু দুজনের শেষটা এত বাজে হওয়ার পেছনে দ্য হিন্দুর চোখে কারণগুলো হচ্ছে, ‘কয়েকটা বিষয় এমন হতশ্রী বিদায়ের কারণ। কোহলির বাজে অধিনায়কত্ব এবং দল নির্বাচন যদি একটা কারণ হয়ে থাকে, সেটি আরও জটিল হয়েছে হার্দিক পান্ডিয়ার মতো খেলোয়াড় জাতীয় দলের নির্বাচকদের কাছে নিজের ফিটনেসের সবকিছু খোলাখুলিভাবে না বলায়।’
কোহলির ব্যাটিংয়েরও সমালোচনা করেছে দ্য হিন্দু, ‘কোহলি শুধু টেস্টের অধিনায়ক হিসেবেই থাকবে কি না, নিশ্চিত নয়। তবে গত চারটি আইসিসি টুর্নামেন্টে তাঁর পারফরম্যান্স নিয়ে হতাশা থাকছেই। তাঁর বয়স মধ্য ৩০–এ চলে যাচ্ছে, তাঁর ব্যাটিংয়ে কিছুটা রক্ষণাত্মক ভাব এসে গেছে। আরেকটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ১১ মাস বাকি, ভারত এখান থেকে নতুন করে, নতুন ভাবনায় শুরু করবে, এটাই আশা করতে পারে ভারতীয়রা।’