আইসিসির টি-টোয়েন্টি বর্ষসেরা দলে মোস্তাফিজ
পাকিস্তানের মোহাম্মদ রিজওয়ান যে সুযোগ পাচ্ছেন, সেটি সম্ভবত যে কেউই চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারতেন। পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজমেরও সুযোগ পাওয়া বলতে গেলে নিশ্চিতই ছিল। শেষ পর্যন্ত এ দুজন আইসিসির বর্ষসেরা টি-টোয়েন্টি দলে সুযোগ পেয়েছেন।
তবে আজ আইসিসির ২০২১ সালের বর্ষসেরা টি-টোয়েন্টি দল ঘোষণার পর বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য খুশির খবর হয়ে এল বাঁহাতি পেসার মোস্তাফিজুর রহমানের একাদশে সুযোগ পাওয়া। পুরো বছরে ২০ ম্যাচে ২৮ উইকেট পেয়েছেন মোস্তাফিজ—আইসিসির পূর্ণ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বছরে তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি, সব মিলিয়ে পঞ্চম।
মোস্তাফিজ ছাড়া একাদশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব নেই। সব মিলিয়ে একাদশে পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার তিনজন করে খেলোয়াড় সুযোগ পেয়েছেন। গত নভেম্বরে শেষ হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া থেকে আইসিসির একাদশে জায়গা করে নিয়েছেন দুজন। চমক হতে পারে এটি যে, ভারতের কোনো খেলোয়াড়ই এই একাদশে সুযোগ পাননি।
আইসিসির একাদশে দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হচ্ছেন ইংল্যান্ডের জস বাটলার ও পাকিস্তানের রিজওয়ান। অক্টোবর-নভেম্বরে হয়ে যাওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে একমাত্র শতক হাঁকানো বাটলার সব মিলিয়ে বছরে ১৪ ম্যাচে ৬৫.৪৪ গড়ে করেছেন ৫৮৯ রান। বিশ্বকাপে শারজার ধীরগতির উইকেটে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শতকের পাশাপাশি টুর্নামেন্টে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বেশি রানও এসেছে বাটলারের ব্যাট থেকে।
আর রিজওয়ান? ২০২১ সাল তো টি-টোয়েন্টিতে পাকিস্তানের উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানের জন্য স্বপ্নের মতোই কেটেছে। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির ১৬ বছরের ইতিহাসে ব্যাট হাতে এমন দাপট আর কারও দেখা যায়নি। ২০২১ সালে পাকিস্তানের জার্সিতে ২৯টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন রিজওয়ান, তাতে ১টি শতক ও ১২টি অর্ধশতকসহ ৭৩.৬৬ গড়ে করেছেন ১৩২৬ রান—আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এক বছরে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড এটি।
বিশ্বকাপের বছরে বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সই তো সবচেয়ে বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, সেখানেও সেমিফাইনালে বাদ পড়া পাকিস্তানের রিজওয়ান টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক।
আর এ তো গেল শুধু ব্যাটিং গ্লাভস হাতে পারফরম্যান্সের হিসাব, উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে দাঁড়িয়েও বছরে ২৪টি ডিসমিসালে নাম লেখানো (২২ ক্যাচ, ২ স্টাম্পিং) রিজওয়ানের হাতেই থাকছে আইসিসির একাদশের উইকেটকিপারের দায়িত্ব।
ব্যাটিং-ক্রমের তিন নম্বরে কে নামছেন, সেটি অনুমান করে নিতেও কষ্ট হয় না। বাবর আজম ছাড়া আর কে! বছরজুড়েই দুর্দান্ত বাবর সবচেয়ে চোখধাঁধানো ফর্ম বের করে আনতে বেছে নিয়েছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকেই।
টুর্নামেন্টের আগে যাঁদের সম্ভাব্য পারফরম্যান্স নিয়ে সব সময়ই অনিশ্চয়তা থাকে, সেই পাকিস্তানের সেমিফাইনালের শেষ আধা ঘন্টার আগ পর্যন্ত দারুণ ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে বড় অবদান বাবরের ব্যাটের। আর বাবরের অধিনায়কত্বের। আইসিসির একাদশেও বাবরই অধিনায়ক। বছরে ২৯ ম্যাচে ৩৭.৫৬ গড়ে ৯৩৯ রান করা বাবর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শেষ করেছেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক হিসেবে।
চারে দক্ষিণ আফ্রিকার এইডেন মার্করাম। মিডল অর্ডারে তাঁর পাওয়ার হিটিংই নজর কেড়েছে আইসিসির একাদশের নির্বাচকদের। এ বছরে ১৮ ম্যাচে ছয়টি অর্ধশতকসহ ৪৩.৮৪ গড়ে ৫৭০ রান করেছেন মার্করাম, স্ট্রাইক রেট ১৪৮.৮২। তাঁর খন্ডকালীন স্পিন বোলিংয়ে পাওয়া ৫ উইকেটও বিবেচনায় আসতে পারে। দলের চতুর্থ বা পঞ্চম বোলার হিসেবে দু-চারটি ওভার তো হাত ঘোরাতেই পারবেন!
পাঁচ নম্বরে আইসিসির একাদশের নির্বাচকেরা রেখেছেন অস্ট্রেলিয়ার মিচেল মার্শকে। যদিও অস্ট্রেলিয়ার এবার প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার পথে মার্শের ব্যাট সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে মার্শ ব্যাটিং অর্ডারে তিনে পদোন্নতি পাওয়ার পরই! স্পিন ভালো খেলেন, এক-দুই নিয়ে তাঁর প্রান্ত বদলের দক্ষতাও নজর কাড়ে। বছরে ২১ ম্যাচে ৩৬.৮৮ গড়ে ৬২৭ রান করা মার্শ বল হাতেও নিয়েছেন ৮ উইকেট।
এরপর আইসিসির একাদশের ব্যাটিংয়ে নামবেন দক্ষিণ আফ্রিকার ডেভিড মিলার। আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের জন্য ‘কিলার মিলার’ উপাধি পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকান বাঁহাতি গত বছরে ১৭ ম্যাচে ৪৭.১২ গড়ে করেছেন ৩৭৭ রান। স্ট্রাইক রেট ১৪৯.৬০।
সাত ও নম্বরে দুজন স্পিনারকে থাকছেন আইসিসির একাদশে, আর স্পিনার কোটায় এ বছরে শ্রীলঙ্কার ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গার চেয়ে এগিয়ে আর কে-ই বা থাকতে পারেন! তাঁর সঙ্গে স্পিনে জুটি বাঁধবেন বোলারদের র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকান বাঁহাতি স্পিনার তাবরেইজ শামসি।
ব্যাট হাতে কিছু রান করতে পারেন, এমন পরিচয়ের পাশাপাশি এ বছরে স্পিনার হিসেবে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন হাসারাঙ্গা। শুধু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই নিয়েছেন ১৬ উইকেট—টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। বছরজুড়ে উইকেট নিয়েছেন আরও ২০টি। সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কার জার্সিতে ২০টি টি-টোয়েন্টিতে ১১.৩৬ গড়ে ৩৬ উইকেট নেওয়া হাসারাঙ্গা ব্যাট হাতেও করেছেন ১৯৬ রান।
আর শামসি? ২২ ম্যাচে ১৩.৩৬ গড়ে ৩৬ উইকেট নিয়েছেন ২০২১ সালে। তবে উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি নজর কেড়েছে তাঁর রান আটকে রাখার ক্ষমতাও। বছরে ওভারপ্রতি গড়ে রান দিয়েছেন মাত্র ৫.৭২ করে!
একাদশে বাকি তিনটি জায়গা দখল করছেন তিন ফাস্ট বোলার—দুজন বাঁহাতি, একজন ডানহাতি। মোস্তাফিজের সঙ্গে আরেক বাঁহাতি বোলার পাকিস্তানের শাহিন আফ্রিদি, আর তাঁদের সঙ্গে বৈচিত্র আনতে থাকছেন অস্ট্রেলিয়ার জশ হ্যাজলউড।
টেস্ট বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিতি পেলেও গত বছরে অস্ট্রেলিয়াকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতানোর পথে হ্যাজলউড ৭ ম্যাচে নিয়েছেন ১১ উইকেট। বছরজুড়ে ১৫ ম্যাচে নিয়েছেন ২৩ উইকেট, প্রতি উইকেট পেতে গড়ে তাঁকে খরচ করতে হয়েছে ১৬.৩৪ বল। ওভারপ্রতি গড়ে রানও দিয়েছেন মাত্র ৬.৮৭ করে!
পাকিস্তানের শাহিন আফ্রিদির জন্যও ২০২১ সালটা মনে রাখার মতো কেটেছে। নতুন বলে দারুণ সুইং আর ইনিংসের শেষ দিকে বল কিছুটা পুরোনো হয়ে এলে রিভার্স সুইং তো পাকিস্তানের বিখ্যাত ফাস্ট বোলারদের ‘ট্রেডমার্ক’, শাহিনও ব্যতিক্রম নন। গত বছরে ২১ ম্যাচে ২৬.০৪ গড়ে ২৩ উইকেট নিয়েছেন শাহিন, ওভারপ্রতি গড়ে দিয়েছেন ৭.৮৬ রান।
আর মোস্তাফিজ? কাটার আর হঠাৎ গতির অদলবদলে ব্যাটসম্যানদের ভড়কে দেওয়ার গুন তো তাঁর ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই চমক জাগায়। পরিসংখ্যানের দিক থেকে শাহিনের চেয়েও বছরটা বেশি ভালো কেটেছে মোস্তাফিজের। ২০ ম্যাচে ২৮ উইকেট নেওয়ার পথে গড়ে প্রতি ১৭.৩৯ বল পর উইকেট পেয়েছেন ‘ফিজ’, শাহিনের ক্ষেত্রে যেটি ২৬.০৪। রান দেওয়াতেও বেশি কিপ্টে ছিলেন মোস্তাফিজ। শাহিনের ৭.৮৬ ইকোনমি রেটের বিপরীতে মোস্তাফিজের ইকোনমি ৭.০০!