রোমান নেই, আর্চারিতেও নেই আলো
মার্টিন ফ্রেডরিখের পাঠানো খুদে বার্তাটি পড়ে চোখ ভিজে উঠেছিল রোমান সানার। ১৯ ডিসেম্বর এশিয়া কাপ আর্চারির স্টেজ থ্রিতে অংশ নিতে শারজা যাওয়ার পথে খুদে বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন বাংলাদেশ আর্চারি দলের জার্মান কোচ। দুটিমাত্র বাক্য, ‘প্রিয় রোমান, তোমাকে ছাড়া এটা প্রথম প্রতিযোগিতা। ভীষণ মিস করছি তোমাকে।’ এরপর কান্নার ইমোজি।
২০১০ সালে বিকেএসপিতে যুব আর্চারি গ্রাঁ প্রিতে জাতীয় দলে অভিষেক রোমানের। এরপর একবারই বাদ পড়েছেন জাতীয় দল থেকে। সেটাও পারফরম্যান্সের জন্য নয়। ২০১২ সালে দুর্ঘটনায় পা ভাঙায় খেলতে পারেননি থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নেন ফ্রেডরিখ। রোমান এর পর থেকেই ‘অটোমেটিক চয়েস’। সেই থেকে শারজা এশিয়া কাপেই প্রথম দেশসেরা আর্চারকে ছাড়া কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলল বাংলাদেশ।
রোমান আসার পর গত ১২ বছরে এশিয়া কাপ, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ, আন্তর্জাতিক সলিডারিটি চ্যাম্পিয়নশিপ, ইসলামিক গেমস—প্রতিটিতেই আর্চারিতে পদক জিতেছে বাংলাদেশ, প্রতিনিধিত্ব ছিল রোমানেরও।
২০১৯ সালে কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ এসএ গেমসে ‘পারফেক্ট টেন’ করে সবাইকে চমকে দেন বাংলাদেশের আর্চাররা। বাংলাদেশের আর্চারির সব সাফল্যের সঙ্গেই জড়িয়ে রোমানের নাম। অচেনা আর্চারিকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত করেছেন আনসারের এই তিরন্দাজ। হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের আর্চারির ‘পোস্টার বয়’।
গত নভেম্বরে শৃঙ্খলা ভাঙার অভিযোগে রোমানকে সব ধরনের প্রতিযোগিতা থেকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশন। এরপর অনুশীলনের জন্য রোমানের ঠিকানা হয় গাজীপুর আনসার একাডেমিতে। এখন অবশ্য ছুটি নিয়ে আছেন খুলনার বাড়িতে।
তাঁকে ছাড়া ভালো যায়নি বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। রিকার্ভের পুরুষ ও মিশ্র দল ব্রোঞ্জ নিষ্পত্তির ম্যাচে হেরেছে। রিকার্ভ এককের ফাইনালে হেরে দ্বিতীয় হয়েছেন হাকিম আহমেদ।
বাংলাদেশের আর্চারিতে রোমানের অর্জন অনেক। ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডে এশিয়ান গ্রাঁ প্রিতে জেতেন সোনা। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সলিডারিটি চ্যাম্পিয়নশিপে এবং ২০১৯ সালে এশিয়া কাপ স্টেজ ওয়ানে থাইল্যান্ডে জেতেন রুপা। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের আর্চারির বড় সাফল্য আসে রোমানের হাত ধরে।
নেদারল্যান্ডসে বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে রোমান জেতেন ব্রোঞ্জ, যেটি বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের প্রথম পদক। এই পদক জেতার সুবাদেই টোকিও অলিম্পিকে সরাসরি খেলার সুযোগ পান রোমান। এরপর ২০১৯ সালে ফিলিপাইনে এশিয়া কাপ স্টেজ থ্রিতে ও দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে জেতেন সোনা। এ বছর ইরাকের সুলাইমানিয়া শহরে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপ স্টেজ টুয়ে রুপা জেতেন রোমান।
আগামী বছর আন্তর্জাতিক আর্চারিতে বাংলাদেশের অনেক ব্যস্ততা। মার্চে চীনা তাইপেতে এশিয়া কাপের স্টেজ ওয়ান, এপ্রিলে উজবেকিস্তানে স্টেজ টু ও জুনে সিঙ্গাপুরে স্টেজ থ্রি। এ ছাড়া আগস্টে প্যারিসে বিশ্বকাপ, জুলাইয়ে বার্লিনে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। নভেম্বের এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ হবে ব্যাংককে।
রিকার্ভে রোমানের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড় ছাড়া বাংলাদেশ যে সফল হবে না, সেটি উপলব্ধি করতে পারছেন আর্চারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজীব উদ্দীন আহমেদও, ‘বাংলাদেশের ফল আগের মতো না–ও হতে পারে। রোমান জন্মগতভাবে প্রতিভাবান।
ওর মতো একজন খেলোয়াড় সহজে তৈরি হবে না।’ ফেডারেশনের প্রশিক্ষণ কমিটির প্রধান ফারুক ঢালীর চোখেও রোমানের সমমানের কোনো আর্চার ধরা পড়ছে না না, ‘রোমান নিঃসন্দেহে আমাদের সেরা আর্চার। এমন আরও আর্চার তৈরির জন্য আমরা কাজ করছি। এর মধ্যে যুব চ্যাম্পিয়নশিপে কিছু উদীয়মান খেলোয়াড় উঠে এসেছে। তবে ওদের রোমানের সঙ্গে তুলনা করা যায় না।’
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সফল হলেও গত কয়েক বছর ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় রোমানের পারফরম্যান্স তত ভালো ছিল না। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে রোমানকে হারিয়ে মাঝেমধ্যেই আলোচনায় উঠে এসেছেন রাকিব মিয়া, রামকৃষ্ণ সাহা, জুয়েল খান, সাকিব মোল্লা, সাগর ইসলাম, হাকিম আহমেদরা। কিন্তু ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় রোমানকে হারানো এই খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় সাফল্য নেই।
শাস্তির কারণে রোমান বাইরে। এদিকে আপাতত তাঁর বিকল্পও নেই। বাংলাদেশের আর্চারিটা যে আসলে ‘ওয়ানম্যান শো’ হয়েই ছিল, তা যেন এখন আরও পরিষ্কার।