কাসেমিরোর নামটা আড়ালেই থেকে যায়
ম্যাচের তখন ২৯ মিনিট। ভিয়ারিয়াল ডি-বক্সের বেশ বাইরে বল পেলেন লুকা মদরিচ। চমৎকারভাবে বলটা সামলে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখলেন। ডান প্রান্ত দিয়ে বক্সে ঢুকে পড়া করিম বেনজেমার উদ্দেশ্যে বলটা বাড়িয়ে দিলেন একদম সময়মতো। একটুও এদিক-ওদিক হলো না, বেনজেমার গোলে এগিয়ে গেল রিয়াল মাদ্রিদ। টুইটারে শুরু হয়ে গেল মদরিচ ও বেনজেমা বন্দনা। এদের আড়ালে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না কাসেমিরোকে।
কাসেমিরো আবার এল কোত্থেকে? দলের শিরোপা এনে দেওয়া গোল করেছেন বেনজেমা। আর মধ্য ত্রিশেও নব উদ্যমে আলো ছড়াচ্ছেন মদরিচ। এর মাঝে কাসেমিরোর আসলেই জায়গা পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু সময়টাকে ২৯ মিনিটের প্রথম কয়েক সেকেন্ডে নিয়ে গেলেই বোঝা যাবে এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের গুরুত্ব। নিজের বক্সের বাইরে থেকে মধ্যমাঠে পাস দিয়েছিলেন ভিয়ারিয়ালের সেন্টারব্যাক। সহজ এক পাস, অনায়াসেই বল পাওয়ার কথা ছিল তাঁর সতীর্থের। কিন্তু অনেক পেছন থেকে ছুটে এসে এক ট্যাকল করলেন। যার ফলেই বল চলে গেল মদরিচের কাছে। এর পরের গল্পটা তো জানা। সবাই যখন উদ্যাপনে মাতছে, তখন মদরিচ পেছন ফিরে ঠিকই দেখিয়ে দিলেন এই গোলের মূল নায়ক আসলে কে ছিল।
গতকাল লিগ শিরোপা জিতেছে রিয়াল। এ জয়ের অবদান অনেককেই দেওয়া হচ্ছে। স্বয়ং ক্লাব সভাপতি প্রথমেই বেনজেমার নাম নিয়েছেন। গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়ার নাম বলেছেন। রামোস তো অধিনায়কের চেয়েও বেশি কিছু। আর জিদান এর কারিগর। এতগুলো নামের মাঝে কাসেমিরো হারিয়ে যেতেই পারেন। কারণ নেপথ্যের নায়কেরা বরাবরই আড়ালে থাকেন।
একটু পিছিয়ে গত জুলাইয়ে ফেরা যাক। এক যুগ পর কোপা আমেরিকা জিতেছে ব্রাজিল। বহু আরাধ্যের ছুটিটা বেশ আয়েশ করে উপভোগ করছিলেন কাসেমিরো। কদিন পরই ফ্লোরিডায় যাওয়ার পরিকল্পনা। সেখানে মা, বোন, মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ছুটি কাটাবেন আরেকটু। তার আগে সাও পাওলোতে বসে টিভিতে রিয়াল মাদ্রিদের খেলা দেখছিলেন। তাঁকে ছাড়াই প্রাক মৌসুম খেলছিল রিয়াল। প্রাক মৌসুমের ম্যাচ খেলতে রিয়াল তখন যুক্তরাষ্ট্রেই। টিভিতে যা দেখলেন তাতে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন কাসেমিরো। হোক না প্রাক-মৌসুমের খেলা, তাই বলে ৭-৩ গোলে হার! সেটাও আবার অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে।
পড়ে রইল ছুটির পরিকল্পনা। বিমানে চড়ে মাদ্রিদে ফিরলেন। পরের সপ্তাহেই আরেক প্রীতি ম্যাচে খেলতে নেমে গেলেন। আরবি সালজবুর্গের বিপক্ষে ১-০ গোলে জয়ে ক্ষণিক স্বস্তি পেল রিয়াল।
এ মৌসুমে কাসেমিরোর কাজটা কঠিন করে তুলেছিলেন জিনেদিন জিদান। দলে তাঁর একমাত্র বিকল্প মার্কোস ইয়োরেন্তেকে বিক্রি করে দিয়েছেন কোচ। ফলে একমাত্র ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলেছেন কাসেমিরো। দলে টনি ক্রুস, মদরিচ, ইসকো, এডেন হ্যাজার্ড, হামেস রদ্রিগেজ, কিংবা বেলদের মাঝে একমাত্র ব্যতিক্রম এই ব্রাজিলিয়ান। আক্রমণ নয়, যাকে প্রতি মুহূর্তে ভাবতে হয় প্রতিপক্ষের আক্রমণ নষ্ট করা নিয়ে। দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি ট্যাকল বা বল কেড়ে নেওয়ার রেকর্ডটি এ মৌসুমেও তাই কাসেমিরোরই দখলে।
প্রথাগত ব্রাজিলিয়ানদের সঙ্গে কাসেমিরোকে মেলানো যায় না। যেখানে দেখনদারিতেই আগ্রহ থাকে ব্রাজিলের মিডফিল্ডারদের, সেখানে কাসেমিরোর আগ্রহ খেলার ট্যাকটিক্যাল দিকে। রিয়ালের ম্যাচে যেকোনো বিরতিতে ক্রুস ছাড়া হাত দিয়ে মুখ আড়াল করে জিদানের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে আসা লোকটি তাই কাসেমিরো।
যেখানে ব্রাজিলিয়ানদের নিয়ে সমালোচনা হয়, তারা পরিশ্রম করতে চায় না, পার্টি আর বাইরের জগতেই আগ্রহ; সেখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম কাসেমিরো। রিয়ালের তরুণ স্ট্রাইকার রদ্রিগোর চোখে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হয়েও কাসেমিরো তাই আদর্শ। কারণ, ব্রাজিলিয়ানদের নিয়ে এখন আলস্যের গল্প বলতে চাইলেই কাসেমিরোর উদাহরণ দেখিয়ে দেওয়া যায়। আর বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তো সেই ছোটবেলা থেকেই দেখিয়েছেন। স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতেন। কিন্তু সাও পাওলোর একাডেমিতে ট্রায়াল দিতে গিয়ে দেখেন, সেখানে সবাই আক্রমণের খেলোয়াড়। এমন বিখ্যাত এক একাডেমিতে যোগ দেওয়ার জন্য মুহূর্তের সিদ্ধান্তে নিজেকে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে ঘোষণা করলেন। সে সিদ্ধান্তই তাঁকে ব্রাজিলিয়ান কোনো নিচু স্তরের ক্লাবের স্ট্রাইকার নয়, রিয়াল মাদ্রিদের শিরোপা জেতার কারিগর বানিয়ে দিয়েছে। ব্রাজিলের অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরার সুযোগ করে দিয়েছে।
কাসেমিরো মানেই বুদ্ধিদীপ্ত ট্যাকল। এমনভাবে বল কেড়ে নেন, যাতে প্রতিপক্ষের খেলার ছন্দ নষ্ট হয় কিন্তু রেফারি তাঁকে কড়া শাস্তি দিতে পারেন না। আবার দলের প্রয়োজন হলে কঠিনতম সিদ্ধান্তও নিতে জানেন। নিজের খেলার স্টাইল সম্পর্কে একবার কাসেমিরো বলেছিলেন, ‘বল নেওয়ার সময় আমি আক্রমণাত্মক থাকি। ৯০ মিনিট হোক কিংবা ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিট, আমি বলের জন্য সেভাবেই যাই যেভাবে আমি খেতে পছন্দ করি। সব সময় ভাবি এটাই আমার শেষ (জীবনে)।’
শুনে মনে হতে পারে, তাহলে তো মাথা গরম করে খেলা এক খেলোয়াড়। বরং উল্টো! কাসেমিরো উইস্কাউট নামে একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করেন। সেখানে প্রতিপক্ষ দলের খেলা দেখেন পুরোটা। আগামী ম্যাচের প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের মুভমেন্ট খেয়াল করেন। মাঠে কোন পজিশনে তারা থাকেন তা দেখেন। এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে পিএসজির বিপক্ষে বার্নাব্যুতে কিলিয়ান এমবাপ্পের কাছ থেকে বল কেড়ে নেওয়ার পেছনে এই অ্যানালাইসিসের অবদান স্বীকার করেছেন ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার। এভাবে অ্যানালাইসিস করেন বলেই, ক্যারিয়ারের শুরুতে রগচটা বলে পরিচিত কাসেমিরো এখন ট্যাকটিক্যাল ফাউলের জন্য বিখ্যাত। এবং এখন প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল কেড়ে নিতেও আগের মতো ফাউল করতে হয় না তাঁকে।
নিজেকে প্রস্তুত রাখার জন্য ঘরে জিম বানিয়েছেন। ব্যক্তিগত ফিজিও রেখেছেন। এতেই থামেননি। ঘরে একটি স্লিপ চেম্বার বানিয়েছেন, সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর উপায়ে নিজের শক্তি পুনরুদ্ধার করার জন্য। পেশিকে সবল রাখার জন্য আলাদা একটি যন্ত্র কিনেছেন। বিশ্রামের সময়টায় যখন উইস্কাউটে পরের ম্যাচের প্রতিপক্ষ নিয়ে ভাবছেন, শিখছেন, তখন তাঁর পেশিও আগামী ম্যাচের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এ কারণেই এসপানিওলের বিপক্ষে বেনজেমা যখন ব্যাকহিল পাসটি দিয়েছেন সেটি গ্রহণ করার জন্য অন্য কোনো আক্রমণের খেলোয়াড় নন, কাসেমিরোকেই পাওয়া গিয়েছিল বক্সে। মৌসুমের প্রথম ভাগে সেভিয়ার বিপক্ষে যখন ভয়ংকর চাপে পড়েছিল রিয়াল, তখন লুকা ইয়োভিচের এমনই এক ব্যাকহিলে গোল করতে এগিয়ে এসেছিলেন কাসেমিরোই।
লিগের প্রথমার্ধে সেভিয়ার বিপক্ষে সে ম্যাচ কিংবা করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে এসপানিওল ম্যাচ দুটোতে জয় না পেলে রিয়াল হয়তো আজ শিরোপা নিয়ে উৎসব করতে পারত না। সে গোলগুলোর কথাই সবাই ভুলে যেতে বসেছে। সেখানে প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকানোর কাজটা আর কেই-বা মনে রাখতে চাইবেন। কেই-বা মনে রাখে মাঝমাঠে স্লাইডিং ট্যাকল করছেন কে কিংবা কাঁধের ধাক্কায় প্রতিপক্ষকে ফেলে দিচ্ছেন কে।
কিন্তু জিদান জানেন, এক কাসেমিরো ছাড়া তাঁর শিরোপা জেতা অসম্ভব ছিল। ২০১৬ মাঝমাঠে হামেস কিংবা ইস্কোর পরিবর্তে কাসেমিরোকে খেলানোর অজনপ্রিয় সিদ্ধান্তটা যে তাঁর কোচিং ক্যারিয়ারের গল্পটাই বদলে দিয়েছে।