>আনা ফ্রাঙ্ক ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা তাঁর ডায়েরির জন্য। অনেকে বলেন, করোনাভাইরাস আক্রান্ত এই অনিশ্চিত সময়টাও নাকি বিশ্বযুদ্ধের মতোই। ক্ষুদ্র এক অনুজীবের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী তো যুদ্ধেই নেমেছে! তা এই সময়ে বাংলাদেশের ঘরবন্দী খেলোয়াড়েরা যদি ডায়েরি লিখতেন, কী থাকত তাঁদের লেখায়? খেলোয়াড়দের হাতে কলম তুলে দিয়ে সেটিই জানার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো
ফেসবুক, টুইটারের যুগে চিঠি, ডায়েরি এসব লেখার অভ্যাস হারিয়েই গেছে। এক সময় কাগজে লেখা অক্ষরে বেঁচে থাকতো সম্পর্ক। শৈশব থেকেই চিঠি লিখতাম প্রচুর। আর ছিল ডায়েরি লেখার অভ্যাস। এখন কেউ চিঠি লেখে না। আড্ডা জমে ভিডিও চ্যাটে। তবে আমি কিন্তু ডায়েরি লেখার অভ্যাসটা ধরে রেখেছি।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে ঘরে বসে থেকে অভ্যাসটা আরেকটু ঝালিয়ে নিচ্ছি। বিকেএসপির কোচ হওয়ার সুবাদে ছাত্রদের নিয়মিত যা শেখাই, সেসব ডায়েরিতে লিখে রাখি। এখন হাতে অবসর বেশি। তাই লেখালেখিটাও বেড়েছে।
দিনের শুরু হয় ছোট ছেলে আয়ান হোসেন খানের ডাকাডাকিতে। সকালে উঠে বড় ছেলে আলী হোসেন ও মেয়ে আমিরা হোসেনকে পড়াতে বসাই। কখনো ওরা ছবি আঁকে। কে কেমন এঁকেছে সেগুলো দেখি। দুপুরে ছেলেদের গোসল করাই। বিকেলে ছাদে ঘুরি। কখনো ফুল গাছে পানি দিই।
আগে কখনো সাত দিন ছুটি পাইনি। অনুশীলনের সময় একটু ছুটি পেলেই ঘুমাতে ইচ্ছে হতো। অথচ এখন একমাস ধরে ঘরে বন্দি। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত না থাকলে সময় কাটানো কঠিনই হতো।
মাঝে মাঝে অ্যালবাম খুলে পুরনো ছবি দেখি। সেদিন কমনওয়েলথ গেমসের সোনা জয়ের ছবিগুলো দেখছিলাম। কত স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিল! ২০০২ ম্যানচেষ্টার কমনওয়েলথে জেতা সোনার এই পদকটা এখন অসহায় মানুষদের সাহায্যে নিলামে তুলতে চাই। এজন্যই ওই দিনগুলির কথা বেশি মনে পড়ছে।
তখন এসএসসি পরীক্ষা চলে। পরীক্ষার মধ্যেই বাংলাদেশ গেমস শুরু হলো। বিকেএসপির স্যারেরা পড়াশোনার ব্যাপারে কঠোর। গেমসের আগে স্যার বললেন, 'ইংল্যান্ডে একটা খেলা আছে। প্রস্তুতি নাও ভালোভাবে। বাংলাদেশ গেমসে ব্রোঞ্জ জিতলে ক্যাম্পে ডাক পড়ে। ততদিনে পরীক্ষাও শেষ। কিন্তু ছুটি উপভোগ করতে পারলাম না।
এখন যেমন করোনাভাইরাসের কারণে আইসোলেশনে রাখা হচ্ছে, তখন অনেকটা এ রকমই অবস্থায় আমাকে রাখা হলো। ক্যাম্প করি। কারোর সঙ্গে যোগাযোগ নেই। স্যার এসে বলতেন, 'কক্সবাজার নাকি ইংল্যান্ডে যাবি ঠিক কর?' মনকে বোঝালাম, যেভাবেই হোক বিদেশে খেলতে যাব।
ওটা ছিল ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক সফর। প্রথম বিমানে উঠব। ভেতরে ভেতরে রোমাঞ্চিত। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটা ফ্লাইটে চড়ে বসলাম। কিন্তু জানালার ধারে সিট পড়েনি বলে মন খারাপ। জাফর চাচা (বিওএর সাবেক মহাসচিব প্রয়াত জাফর ইমাম) এয়ার হোস্টেসকে অনুরোধ করে জানালার ধারে সিট জোগাড় করে দিলেন।
ম্যানচেস্টারে গিয়ে মনে হয়নি বিদেশে এসেছি। মনে হতো যেন বিকেএসপি থেকে ফেডারেশনে খেলতে গেছি। শুধু একটা কথাই ভাবতাম, সেরাটা দিব।
অলিম্পিক সোনাজয়ী ভারতীয় শুটার অভিনব বিন্দ্রার তখন বিশাল খ্যাতি। সবে জুনিয়র বিশ্বকাপ জিতে এসেছে। শুটিং শুরুর আগে ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। সেভাবে সাড়া দিল না। ওসব না ভেবে রেঞ্জে দাঁড়ালাম। বাছাই শেষ করলাম পঞ্চম হয়ে। এরপর ফাইনালে উঠলাম। ফাইনালে আগাগোড়া ভালো ছিলাম। চেষ্টা করেছি নিশানায় গুলি লাগাতে। শট শেষ। পেছন ফিরে দেখি ফেডারেশনের কর্মকর্তারা, জাফর চাচা সবাই চিৎকার করছেন। তখনও স্কোরবোর্ডের দিকে তাকাইনি। বললাম, কি হয়েছে চাচা? চাচা বললেন, তুই জিতে গেছিস। বিন্দ্রাকে হারিয়ে সোনা জিতে ইতিহাস গড়লাম!
মাঝে মাঝে লাইব্রেরিতে ঢুকি। আমার পড়ার নেশা আছে। হেনরি রাইডার হেগার্ডের ভক্ত আমি। জুল ভার্ন, মাসুদ রানা সিরিজের বই, সমরেশ মজুমদার, জাফর ইকবালের উপন্যাসও পড়ি। জার্মানি থেকে কোচিংয়ের কিছু বই এনেছি। সেগুলোও পড়া হচ্ছে এখন।
করোনায় থমকে গেছে পৃথিবী। এজন্য হয়তো আমরাই দায়ী। আমি আশাবাদী সৃষ্টিকর্তা এই দুর্যোগ শিগগিরই থামিয়ে দেবেন। তবে আমাদের সচেতন হতে হবে, নিয়ম মানতে হবে। সৃষ্টিকর্তাও নিশ্চয় চান না তাঁর সৃি জীব এভাবে কষ্ট পাক। জানি, শিগগিরই ঘুচে যাবে সব অন্ধকার।