ঘরের মায়া কাটিয়ে এবার একটু বেশিই থাকতে হবে সাকিব-মাশরাফিদের

দেশ–বিদেশের সিরিজ–টুর্নামেন্টে সাকিব এখন প্রায়ই স্ত্রী–সন্তানকে সঙ্গে রাখেন। ছবি: প্রথম আলো
দেশ–বিদেশের সিরিজ–টুর্নামেন্টে সাকিব এখন প্রায়ই স্ত্রী–সন্তানকে সঙ্গে রাখেন। ছবি: প্রথম আলো
>

লম্বা সফর সামনে। আয়ারল্যান্ড–ইংল্যান্ড মিলে দুই মাসের বেশি সময় বিদেশ সফরে থাকতে হবে বাংলাদেশকে। সাকিব–মুশফিকরা যতই ভীষণ পেশাদার ক্রিকেটার হোন, লম্বা সফরে একটা সময় গৃহকাতরতা জেঁকে বসতেই পারে মনে। পারফরম্যান্সে সেটার প্রভাব পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ারও সুযোগ নেই। এটি কাটিয়ে ওঠার উপায় কী?

২০০৭ বিশ্বকাপের সেই ঘটনাটা মনে পড়লে ভীষণ হাসি পায় হাবিবুল বাশারের। গ্রুপ পর্বের বৈতরণি পেরিয়ে প্রথমবারের মতো ‘সুপার এইটে’ ওঠে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপটা হাবিবুলদের হয়ে যায় দুই মাসের। ১৯ এপ্রিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যে ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ শেষ, ঠিক পরদিনই দেশে ফেরার সুযোগ ছিল না বাংলাদেশের। নিরুপায় হয়ে আরও কটা দিন কাটাতে হয় বারবাডোজের হিলটন হোটেলে।

পাঁচ তারকা একটা হোটেলে যা যা থাকার কথা সবই ছিল বারবাডোজের হিলটনে। আর চোখজুড়োনো, হৃদয়কাড়া সুনীল ক্যারিবীয় সাগর আর রুপালি বালুকাবেলা তো ছিলই। তবুও সব যেন অসহ্য লাগতে শুরু করল হাবিবুলদের। দুই মাসের বেশি হয়ে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজে আছেন। ছবির মতো সুন্দর ক্যারিবীয় দ্বীপ আর তাঁদের টানছে না। সবার মনে একটাই প্রশ্ন—কখন বাড়ি ফেরার ফ্লাইট ধরবেন। যেহেতু ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেছে আইসিসি, তাদের সূচি মেনেই হাবিবুলদের ফিরতে হবে বাড়ি। আর সেই সূচি মানতে নিজেদের টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার পরও অতিরিক্ত তিন-চার দিন বাংলাদেশকে থাকতে হলো বারবাডোজে।

বারবাডোজে পাওয়া অতিরিক্ত সময়টা কাজে লাগাতে আর খেলোয়াড়দের মনের ভেতর জেঁকে বসা ‘হোম সিকনেস’ বা ‘গৃহকাতরতা’ কাটিয়ে উঠতে ট্রেনার কিছু নিয়ম করে দিলেন খেলোয়াড়দের। এর একটি, দুভাগ হয়ে ভলিবল খেলা। ভলিবল খেলতে গিয়েই তুচ্ছ এক ঘটনায় নিজেদের মধ্যে লেগে গেল। দুই গ্রুপের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইচ্ছেমতো শব্দবোমা বর্ষণ—কত কিছু যে হলো সেদিন! খেলোয়াড়দের এই কাণ্ড দেখে অবিশ্বাস্য চোখে হোটেলের অন্যরা বোঝার চেষ্টা করছে, ঘটনটা কী! কোচ ডেভ হোয়াটমোর তো খেপে আগুন! তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, কড়া একটা রিপোর্ট লিখবেন। ঘটনার খানিক পরই হোয়াটমোর অবিশ্বাস্য চোখে আবিষ্কার করলেন, খানিকক্ষণ আগে কী হয়েছে সেটি ভুলে খেলোয়াড়েরা একে অপরের সঙ্গে হাসি-তামাশা করছেন। হাসতে হাসতে একজনের গায়ে আরেকজন গড়াগড়ি খাচ্ছেন! হোয়াটমোর বুঝলেন, ভলিবলের ঘটনাটা আসলে কিছুই নয়। এটা নিয়ে রিপোর্ট লেখারও কোনো দরকার নেই। এত দিন পর হাবিবুল মনে করেন, সেটি হয়েছিল তীব্র গৃহকাতরতার কারণেই। হোম সিকনেস এমনই জাপটে ধরেছিল খেলোয়াড়দের, সেটির প্রভাব পড়েছিল তাঁদের মেজাজ-মর্জিতে। সামান্য কথাতেই মেজাজ হারাতে শুরু করেছিলেন ক্রিকেটাররা।

গৃহকাতরতা শুধু মেজাজে নয়, প্রভাব পড়তে পারে পারফরম্যান্সেও। জাভেদ ওমর যেমন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে এতটাই হোমসিক হয়ে পড়েছিলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজে তাঁর যেন মন টিকছিল না। সেটির কারণও ছিল। তিনি যখন প্রথম সন্তানের বাবা হন, সেদিনই ছিল বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ। সে ম্যাচে তিনি একাদশের বাইরে ছিলেন। নিশ্চয়ই মনে আছে, বাংলাদেশ জিতে যাওয়ার পর তামিম-হাবিবুল দুই হাতে অদৃশ্য শিশু দোলাচ্ছিলেন। সেটি ছিল জাভেদের সন্তানের জন্ম উপলক্ষে। তাঁর ছেলে দাইয়ান জাভেদ বেলিমের জন্ম ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ। ‘২০০৭ বিশ্বকাপে হয়তো আরও একটু ভালো খেলতে পারতাম যদি আবেগ বা গৃহকাতরতা আমার কম থাকত। প্রতিদিন হিসাব করতাম আর ২০ দিন বাকি, আর ৫ দিন বাকি...। আমার স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। এ কারণেই বেশি বিচলিত হয়ে পড়ছিলাম’—হোম সিক হওয়ার কারণ বলছিলেন জাভেদ।

বাংলাদেশের আরও একটি লম্বা সফর আসছে সামনে। ১ মে আয়ারল্যান্ডে রওনা দেবে বাংলাদেশ। ত্রিদেশীয় সিরিজটির ফাইনালও যদি খেলে, বাংলাদেশ ইংল্যান্ডে পৌঁছাবে ১৮ মে। আইসিসির অধীনে চলে যাবে ২৩ মে। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে না উঠতে পারলেও বাংলাদেশের সফর শেষ হবে ৫ জুলাই। সব মিলিয়ে প্রায় ৭০ দিনের সফর। এই লম্বা সফরে একটা সময়ে হোম সিকনেস তীব্র হয়ে ওঠার আশঙ্কা বেশি। ক্রিকেটাররা যতই পেশাদার হন, মনের ওপর সেটির প্রভাব ফেলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। বিসিবি সূত্রেই জানা গেল, কয়েকজন ক্রিকেটার এরই মধ্যে প্রস্তাব দিয়েছেন, আয়ারল্যান্ড সফর শেষে কদিনের জন্য দেশে ফিরে এরপর ইংল্যান্ডে রওনা দেওয়া যেতে পারে। সেটি হলে দেশে সময় কাটিয়ে যেতে বড় জোর চার দিন সময় পাওয়া যাবে।

কিন্তু ইংল্যান্ড-বাংলাদেশের লম্বা বিমানযাত্রা এই অল্প সময়ের বিরতি সতেজ-চনমনে হতে কতটা কার্যকর হবে কিংবা ভ্রমণক্লান্তি উল্টো ক্ষতি করবে কি না, সেটিও ভাবাচ্ছে বিসিবিকে। বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দীন চৌধুরী বললেন, ‘এটা কতটা বাস্তবসম্মত, দেখার বিষয়। যে বিরতির কথা বলা হচ্ছে, পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে যেতে–আসতে আবার দুই-তিন দিন নষ্ট হয়ে যাবে। এটা স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে কষ্ট বেশি হয়ে যাবে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। তিন-চার দিনের জন্য দেশে আসাটা কতটা কাজে দেবে, কতটা উদ্দেশ্য পূরণ হবে, সব দেখতে হবে।’

নিজামউদ্দীনের কথায় মনে হলো, তিন-চার দিনের জন্য ছুটি দেওয়ার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নয় বিসিবি। তবে বিষয়টি তিনি খেলোয়াড়দের ওপরই ছেড়ে দিচ্ছেন। যদি আয়ারল্যান্ড সিরিজ শেষে কোনো বিরতি না নিয়েই বিশ্বকাপে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশ, তবে চনমনে হয়ে ওঠার উপায় কী? বিসিবি অতীতে যেটা করেছে, সেটাই করতে পারে। খেলোয়াড়দের স্ত্রী-সন্তানকে সঙ্গে নেওয়ার অনুমতি দিতে পারে। সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ গত বিশ্বকাপ খেলেছেন পরিবার কাছে রেখেই। অন্য ক্রিকেট বোর্ড বিদেশ সফরে ক্রিকেটারদের পরিবারের বিমান টিকিট দিয়ে থাকে। বিসিবি অবশ্য সেটি দেয় না।

২০১৫ বিশ্বকাপে মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে ছিল পরিবার। ছবি: প্রথম আলো
২০১৫ বিশ্বকাপে মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে ছিল পরিবার। ছবি: প্রথম আলো

তবে শতভাগ পেশাদার একজন খেলোয়াড়ের পরিবার সঙ্গে থাকলেই যে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন সেটির নিশ্চয়তা নেই বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানী আহমেদ হেলাল, ‘একেকজনের ক্ষেত্রে এটা একেক রকম। কোনো খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে পরিবার কাছে থাকাটা ইতিবাচক হতে পারে। কারও নাও হতে পারে। দেশে একটু ঘুরে গেলে ভালো হতে পারে। আবার কারও কাছে আয়ারল্যান্ড থেকে উড়ে আসা কষ্টদায়কও মনে হতে পারে। টানা ৭০ দিন থাকবে, এটিকে চাপ মনে না করে বরং চাপমুক্তভাবে সময়টা কীভাবে কাটাতে পারে সেভাবে কিছু কার্যক্রম বা উপাদান যোগ হতে পারে। চাপ নিয়েই তো তাদের খেলতে হয়। জাহাজের নাবিক, সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরও পরিবার ছেড়ে লম্বা সময়ে দেশের বাইরে থাকতে হয়। এটা তাদের পেশা। খেলোয়াড়দের পেশার ধরনও অনেকটা একই। এটাকে আলাদা চাপ মনে না করে বরং চাপমুক্ত হয়ে খেলার কৌশলগুলো রপ্ত করতে পারলে ভালো।’

সেই কৌশলগুলো কী, কিছু ধারণা দিলেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল, ‘খেলার ফাঁকে একটু ঘুরতে যাওয়া, হালকা ব্যায়াম, রিল্যাক্সেশন থেরাপি, ম্যাচের বাইরে একটু মুক্ত করে দেওয়া, নিজেদের মধ্যে সামাজিক দক্ষতা রপ্ত করতে পারে। পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা, কখনো মনে না করা যে সে দেশে নেই বলে পরিবারের অনেক বড় ক্ষতি হচ্ছে, বড় কিছু সে মিস করছে। বরং পেশার প্রয়োজনে সে যেখানে থাকবে সেটাই তার হোম, এটাই ভাবতে হবে। হোম সিক বলে কিছু নেই। যেখানে থাকবে সেটাই তার হোম।’

এই সময়ের ভীষণ পেশাদার ক্রিকেটাররা অবশ্য হোমসিকনেস বড় করে দেখেনও না। আজ এই সিরিজ তো কাল ওই লিগ—বছর জুড়ে দেশ-বিদেশে খেলেই তাঁদের সময় কাটে। গৃহকাতরতা এখন আর পেয়ে বসার সুযোগ নেই। তবে দিন শেষে তাঁরা রক্ত–মাংসের মানুষ, আবেগ কাজ করবে। হেলাল তাই বলছেন, পেশাটা যদি পুরোপুরি আত্মীকরণ করতে পারে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে না ক্রিকেটারদের।