ওয়ার্নার হাসলেন, ওয়ার্নার রাগলেন, ওয়ার্নার খেপলেন
>ডেভিড ওয়ার্নার ছন্দ খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর দল সিলেটও কাল জিতেছে। মাঠে তিনি ভালো মুডে থাকলেও সাক্ষাৎকারে পাওয়া গেল অন্য ওয়ার্নারকে।
ডেভিড ওয়ার্নারের সাক্ষাৎকার নেওয়ার প্রথম চেষ্টা ২০১৭ সালের আগস্টে, অস্ট্রেলিয়া দল যেবার টেস্ট সিরিজ খেলতে এল বাংলাদেশে। কিন্তু সব চেষ্টা বৃথা। অস্ট্রেলিয়া দলের মিডিয়া ম্যানেজার সিরিজজুড়ে পাথুরে মুখে ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে গেলেন, ‘একান্ত সাক্ষাৎকার দেওয়া যাবে না। আপনাকে দিলে অন্যদেরও দিতে হবে।’
যেদিন নিশ্চিত হওয়া গেল ওয়ার্নার আসবেন বিপিএল খেলতে, নতুন করে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠল। এবার যদি অস্ট্রেলীয় তারকাকে একান্তে পাওয়া যায়! এর মধ্যে জল এত বেশি গড়িয়েছে, ওয়ার্নারের সাক্ষাৎকার ক্রীড়া সাংবাদিকদের কাছে পরম আরাধ্যের। কে জানত, যে বিষয় নিয়ে সাংবাদিকেরা কথা বলতে বেশি উৎসাহী হবেন, সেই বিষয়ই দপ করে নিভিয়ে দেবে ওয়ার্নারকেই!
নগরের হোটেল নির্ভানা ইনের লিফটে ওঠার আগে সিলেট মিডিয়া ম্যানেজার অবশ্য পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, ‘ভাই, ওর মুড আজ ভালো নেই। কাল জেতার পর খুব উচ্ছ্বসিত ছিল, সেই উচ্ছ্বাসের মধ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, আজ কথা বলবে। এ কারণেই সে সময় দিয়েছে। কিন্তু সকাল থেকে ওর মেজাজটা বিগড়ে আছে। বিতর্কিত বিষয়ে প্রশ্ন না করলে খুব খুশি হব।’
মিডিয়া ম্যানেজার তাঁর কাজ করেছেন। এখন সাংবাদিক করবে তাঁর কাজ। কিন্তু ওয়ার্নার তা বুঝলে তো!
ওয়ার্নার হাসলেন
শুরুতেই মজার প্রশ্ন। কাল বিশেষ উদ্যাপন দেখা গেল সিলেট সিক্সার্সের অধিনায়ককে। লিটন দাস ফিফটি করে কোমর দুলিয়ে নেচেছেন। ওয়ার্নারও ফিফটি করে কোমর দুলিয়ে নেচেছেন। এমনকি সাব্বির রহমানও ক্যাচ নিয়ে একই ভঙ্গিতে নেচেছেন। এই উদ্যাপনের পেছনের গল্প কী? ওয়ার্নার দন্ত বিকশিত করে বললেন, ‘আমাদের দলে দুজন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার আছে। ওরা আমাদের এই নাচের জন্য দায়ী (হাসি)। আসলে এটা আমাদের সিলেট দলের ট্রেডমার্ক উদ্যাপন বলতে পারেন। আর সে কারণেই এই নাচ প্রায়ই দেখার সৌভাগ্য হবে আপনাদের।’
মাঠে সব সময়ই দারুণ উজ্জীবিত দেখা যায় ওয়ার্নারকে। সব সময়ই এত সক্রিয় থাকেন, আজ সিলেট দলের এক পেসারই বলছিলেন, ‘ওয়ার্নারের তৎপরতা দেখে মনে হয়, আমরা ৫০ ওভারের ক্রিকেট খেলছি!’ এই যে অফুরন্ত প্রাণশক্তি, এটির উৎস কী, সেটা বললেন সিলেটের অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক, ‘আমরা যখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলতে আসি, তখন আমরা সেটাই করি, যা আমাদের করা উচিত। অন্যরা সেই বিষয়টি দেখে। ম্যাচ খেলা ছাড়াও অনেকটা সময় আমাদের হাতে থাকে। সেই সময়টা কীভাবে কাটাবেন আপনি, সেটা আপনার ব্যাপার। আপনি ফিটনেস নিয়ে কাজ করতে পারেন, জিমে যেতে পারেন, স্কিল নিয়ে বাড়তি কিছু করতে পারেন। এই ব্যাপারটা আমাদের (অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়) ভেতরে অনেক আগে থেকেই আছে।’
ওয়ার্নার রাগলেন
ওয়ার্নারের চাওয়া ছিল সাক্ষাৎকারে তাঁর বিতর্কিত বিষয়ে প্রশ্ন যেন না থাকে। কিন্তু সেটি কী করে হয়! কোন সাংবাদিকই–বা হাতের কাছে ওয়ার্নারকে পেয়ে শুধু নির্বিষ প্রশ্ন করে যাবেন? ওয়ার্নারের বল টেম্পারিং কাণ্ডের ব্যাপারটি উঠতই। অবধারিতভাবেই নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গটা এল।
প্রশ্ন: সর্বশেষ দশ মাস কতটা কঠিন ছিল?
ওয়ার্নার: ক্রিকেটের বাইরে থাকা অবশ্যই কঠিন। কিন্তু আমার আরও কিছুটা আলাদা ছিল। জীবন তো ক্রিকেটের চেয়েও বড় কিছু। আমরা তো একটা রুটিনের ভেতর থাকি। অনুশীলন, খেলা, বাড়ি ফেরা, ঘুম—পরদিন আবারও একই রকম। খেলা শেষে ব্যাগ গুছিয়ে আবার নতুন কোনো গন্তব্যে যাওয়া। সাত-আট বছর ধরে এভাবেই তো তিন ফরম্যাটে খেলে গিয়েছি। আমার জন্য শেষের এই কয়েক মাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল পরিবার। গত কয়েক মাসে আমার স্ত্রী-সন্তান আমাকে সমর্থন দিয়ে গেছে, অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে। এখন আমি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট দিয়ে আবার মাঠে ফিরেছি। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিশ্বমানের সব ক্রিকেটারের সঙ্গে খেলছি। সে সময় যা ঘটেছিল, তারপরও সবখানেই ক্রিকেটের সবাই আমাকে দারুণভাবে স্বাগত জানিয়েছে।
প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়া দলের সতীর্থদের কেমন মিস করেছেন এই সময়ে?
ওয়ার্নার: প্রত্যেককেই মিস করেছি খুব। একটা দলের সঙ্গে আপনি সাত-আট বছর ধরে থাকলে তার সবকিছু আপনি মিস করবেন। তবে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলার মজাটা এখানেই। নতুন নতুন সব জায়গায় আপনি যাবেন, নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হবে।
প্রশ্ন: ঘরের মাঠে ভারতের কাছে অস্ট্রেলিয়া সিরিজ হেরেছে? অনেকে বলেছে, স্মিথ ও আপনি থাকলে ব্যাপারটা অন্য রকম হতে পারত?
ওয়ার্নার: আমি ও স্মিথ তো ছিলাম না। তাই আমরা থাকলে কী হতো, সেটা জানি না। তবে যেটা ঘটেছে সেটা হলো, ভারত দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলেছে। বোলিংয়ে আমরা দ্রুত উইকেট তুলে নিতে পারিনি। অন্যদিকে ওরা দারুণ ব্যাট করেছে। পূজারার কথাই ধরা যাক। কী অসাধারণ ব্যাটিংটাই না করেছে (টেস্টে)। সব সময় ৩০০-৪০০ বল খেলেছে। ও একাই পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। আবার ভারতের পেস লাইনআপও দুর্দান্ত বোলিং করেছে।
প্রশ্ন: জাতীয় দলে ফেরার সুযোগ এলে আপনার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী হবে?
ওয়ার্নার: দেখুন, আমি মনে করি, আমার কাজ হলো রান করা। যদি আবার দলে সুযোগ পাই, আমি সেগুলোই করতে চাইব—রান করা, মাঠে প্রাণবন্ত থাকা, দলের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়া।
প্রশ্ন: নিষিদ্ধ হওয়ার পর কখনো কি ভেবেছিলেন, আপনার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে?
ওয়ার্নার: না।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন, শাস্তিটা বেশি হয়ে গেছে?
ওয়ার্নার: ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া আমাদের শাস্তি দিয়েছে, আমরা সেটি মেনে নিয়েছি।
শেষ দিকে সংক্ষিপ্ত উত্তর দেখেই বোঝা যাচ্ছে, শাস্তি-নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কথা বলতে তিনি খুব একটা আগ্রহী নন। তাঁর রাগী রাগী চেহারাটা সাক্ষাৎকার আর লম্বা হতে দিল না। সৌজন্য দেখাতে মুখে কিছু বললেন না। কিন্তু শুরুটা যেভাবে হাসিমুখে করেছিলেন, শেষটা সেভাবে হলো না।
এবং ওয়ার্নার খেপলেন
সাক্ষাৎকার শেষ হতেই ওয়ার্নার তাঁর মিডিয়া ম্যানেজারকে ডাকলেন। ভালোই একটা ঝড় গেল মিডিয়া ম্যানেজারের ওপর। ওয়ার্নারের কথা, তাঁকে কেন বিতর্কিত অধ্যায় নিয়ে প্রশ্ন করা হলো। এটা ঠিক, চাইলে ওয়ার্নারকে শুধু নিরীহ প্রশ্নই করা যেত। শুধু বিপিএলেই সীমাবদ্ধ থাকা যেত। কিন্তু দুর্দান্ত এই অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানের সাক্ষাৎকারে যদি তাঁর বিতর্কিত অধ্যায়টা বাদই দেওয়া হয়, পাঠকের কাছে সেটি যে মনে হবে লবণহীন তরকারি! পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে পাঠকের সামনে কি এই খাবার পরিবেশন করা যায়?
আরও পড়ুন: ওয়ার্নারকে মন ভরে দেখে নিন