>১ জানুয়ারি শুরু হচ্ছে শীতকালীন দলবদলের মৌসুম। মৌসুমের শুরুতে দলের মধ্যে সৃষ্ট হওয়া সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে শূন্যস্থান পূরণের জন্য হাজির হয় এই দলবদল মৌসুম। এ দলবদলে কোন দলের কী সমস্যা, কোন দলের বিভাগে দরকার নতুন মুখ—এ নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করা হবে প্রথম আলোতে। আজ চতুর্থ পর্বের দল হিসেবে থাকছে রিয়াল মাদ্রিদ।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদের জন্য কী ছিলেন? এককথায় প্রাণভোমরা। তাঁর গোলে রিয়ালের এগিয়ে যাওয়া কিংবা পিছিয়ে পড়েও জয় ছিনিয়ে আনা—নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। রোনালদোকে ছাড়া রিয়ালের কী হবে, কারও ভাবনাতেও আসেনি। এ নিয়ে ভাবনা শুরু হলো মৌসুমের শুরুতেই রোনালদোর জুভেন্টাসে নাম লেখানোর পর। একে তো কদিন আগেই সবাইকে হতবাক করে বিদায় নিয়েছেন কিংবদন্তি জিনেদিন জিদান। নতুন কোচ লোপেতেগির অধীনে রিয়ালের নতুন করে শুরু করা থমকে গেল প্রথমেই। মৌসুমের প্রথম ম্যাচেই হার, সেটাও আবার ১৭ বছর পর কোনো ফাইনালে!
এরপর দলকে প্রথমে ভালোভাবেই সামলে নিয়েছিলেন লোপেতেগি। দ্রুতলয়ের পাসিং ও হাই প্রেসিং ফুটবল—এই জোড়া কৌশলের রসায়নে সুন্দর ফুটবল উপহার দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন লোপেতেগি। দলের সবাই এক দল হয়ে খেললে তেমন কোনো বড় নাম দরকার হবে না, এই ভাবনাই ছিল রিয়াল ম্যানেজমেন্টের মাথায়। গ্রীষ্মকালীন দলবদলের মৌসুমে দলে এসেছেন মাত্র তিনজন—থিবো কোর্তোয়া, ওদ্রিওসোলা ও মারিয়ানো ডিয়াজ। নিয়মিত মাঠে নামার আশায় ধারে দল ছেড়েছেন মধ্যমাঠের কোভাচিচ, তাঁর বদলি চেয়েও পাননি লোপেতেগি। শেষ পর্যন্ত মধ্যমাঠে ভরসা রাখতে পারার মতো লোকের অভাবই লোপেতেগির ভাগ্য গড়ে দিয়েছে।
একে তো রোনালদোর অনুপস্থিতিতে মৌসুমে গোলসংখ্যা এক ধাক্কায় ৫০টা কমে গেছে। সেটা পূর্ণ করার দায়িত্ব ছিল বেল, বেনজেমা, ইসকো, এসেনসিওদের। প্রথম কয়েক ম্যাচে বেল-বেনজেমা সে কাজ করেছেন। পেছন থেকে গোল উৎসবে মন্ত্রণা দিয়ে আশা বাড়িয়েছেন ইসকো ও অ্যাসেনসিও। কিন্তু এক ইসকোর চোটেই সব বিভ্রম কেটে গেছে। খেই হারানো রিয়াল মাদ্রিদ একের পর এক ম্যাচে গোলের জন্য হাপিত্যেশ করেছে। কখনো ড্র করেছে, অধিকাংশ ম্যাচেই হেরেছে। চোট থেকে পরিপূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই ইসকোকে নামিয়েও লাভ হয়নি। এল ক্লাসিকোয় ৫-১ গোলে উড়ে যাওয়ার পর লোপেতেগি অধ্যায় শেষ হয়েছে রিয়ালে।
লোপেতেগিকে বিদায় করে ‘কাস্তিয়া’ (রিয়ালের ‘বি’ দল) থেকে কোচ পদে বসানো হলো সান্তিয়াগো সোলারিকে। একসময়ের ‘গ্যালাকটিকোস’-এর অংশ সোলারির কাঁধে ছিল রিয়াল মাদ্রিদকে বাঁচানোর গুরুদায়িত্ব। সোলারি এসেই পরিবর্তন করলেন খেলার ধরনে। কার্যকরী ফুটবলে সাফল্যও পাচ্ছেন। এর মধ্যেই ক্লাব বিশ্বকাপও জিতেছেন কিন্তু এর মধ্যেই এইবার ও সিএসকে মস্কোর কাছে হারে বোঝা গেছে রিয়ালের সমস্যা কাটেনি।
রিয়াল মাদ্রিদের সমস্যা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। দলের রক্ষণে ভাঙাচোরা অবস্থা চোখে পড়েছে সবারই। কিন্তু এই রক্ষণ নিয়েই গত তিন মৌসুম ইউরোপে রাজত্ব করেছে রিয়াল—তা কীভাবে সম্ভব? কারণ, তখন দলে ছিলেন একজন রোনালদো। রক্ষণের বাজে দিনেও গোল করে দলকে বাঁচাতেন এই ফরোয়ার্ড। কিন্তু রোনালদো চলে যাওয়ার পর গোলের অভাব দিনকে দিন বাড়ছেই।
এই দলবদল তাই রিয়ালের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই ভাঙাচোরা অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে নতুন কোনো কোচ কিংবা নতুন কোনো ট্যাকটিকস নয়, প্রয়োজন এমন কিছু খেলোয়াড়, যাঁরা মুহূর্তেই ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিতে পারেন।
গোল পোস্টের নিচে কে দাঁড়াবে, এ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই রিয়ালের। থিবো কোর্তোয়া ও কেইলর নাভাসের পাশাপাশি আছেন কিকো ক্যাসিয়া, লুকা জিদান। ধারে আছেন আন্দ্রে লুনিন। এ মৌসুম শেষে বরং কাকে ছাড়বে তারা, সেটাই আলোচ্য। আসল সমস্যা রক্ষণে। কারভাহাল, রামোস, ভারানে কিংবা মার্সেলো—সবাই ‘অটোমেটিক চয়েস’। কিন্তু নিজেদের দলের আক্রমণে এরা এতই ব্যস্ত থাকেন যে প্রতিপক্ষের আক্রমণের সময় তাঁদের খুঁজে পাওয়া কঠিন!
ফুলব্যাকরা স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে যাবেন আক্রমণে। সে ক্ষেত্রে রামোস-ভারানের থাকার কথা রক্ষণে, কিন্তু বরং হেড করতে সামনে এগিয়ে যান দুজনই। রক্ষণ তখন গড়ের মাঠ! এই সমস্যা সমাধানে রক্ষণে ভরসা রাখার মতো অন্তত আরেকজন খুঁজছে রিয়াল। সব কাজের কাজি নাচো আপাতত চোটে। ভায়েহোর ওপর জিদান আস্থা রাখতে পারেননি, লোপেতেগিও না। এখন দেখা যাচ্ছে সোলারিও সে পথে হাঁটছেন। এ কারণেই এস্পানিয়লের ডিফেন্ডার মারিও হারমোসোকে কিনতে চাচ্ছে রিয়াল। আয়াক্সের ডিফেন্ডার ম্যাথিও ডি লিটের দিকে নজর রাখছে রিয়াল। ২০১৮ সালে ‘গোল্ডেন বয়’ পুরস্কার পাওয়া ডি লিটকে আয়াক্স চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলোয় প্রতিপক্ষের কাছে ছাড়বে না, সেটি নিশ্চিত। আর ডি লিট নিজে বার্সেলোনার সমর্থক। এ দুটো বাধা পেরোলেও তাঁকে পেতে অন্তত ৬৫ মিলিয়ন ইউরো দিতে হবে রিয়ালকে। সে তুলনায় হারমোসোকে মাত্র ৭.৫ মিলিয়নেই আনতে পারবে রিয়াল।
মাঝমাঠ নিয়ে রিয়াল বলতে গেলে প্রায় নির্ভার। মদরিচ, ক্রুস, কাসেমিরোর তো একাদশে জায়গা পাকাই। এ ছাড়া ইসকো, সেবায়োস, ইয়োরেন্তেরাও আছেন। রিয়ালের মাঝমাঠ কখনোই চিন্তায় ফেলেনি কোচ কিংবা সমর্থকদের। চাইলে ফরমেশন বদলে ৪-৪-২–তে খেলালে অ্যাসেনসিও কিংবা ভাসকেজকেও পারেন মাঝমাঠে খেললে। গত বছর চ্যাম্পিয়নস লিগেই সাফল্যের সঙ্গে এটা করে দেখিয়েছেন জিদান।
রিয়ালকে সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে আক্রমণভাগ। বেনজেমা-বেলদের পারফরম্যান্স হতাশাজনক। গোল তো সেভাবে আসছেই না, উল্টো নষ্ট হচ্ছে সহজ সুযোগ। রোনালদোর ৭ নম্বর জার্সি তুলে দেওয়া হয়েছিল মারিয়ানোর কাঁধে, অথচ তাঁকে মাঠে দেখা যায় কালেভদ্রে। কখনো চোট আবার কখনো কোচের ভরসার পাত্র হতে না পেরে, মাঠে নামার দিন গুনছেন মারিয়ানো। এমনকি গত দুই মৌসুমে ঝলসে ওঠা অ্যাসেনসিও পারছেন না আশার প্রতিদান দিতে। লুকাস ভাসকেজ ভালো খেলছেন কিন্তু গোল করার ক্ষমতা তার কোনো কালেই ছিল না। অনেক আশা জাগিয়ে রিয়ালে হাজির হওয়া ভিনিসিয়ুস লিগে এখনো পর্যন্ত মাত্র একবার শুরুতে মাঠে নেমেছেন।
রিয়ালের তাই এখন হন্যে হয়ে খোঁজা উচিত ভরসা রাখার মতো ফরোয়ার্ড। যে খেলোয়াড়ের নাম সব সময় গুঞ্জন তুলছে, তিনি হলেন মাউরো ইকার্দি। ইন্টার মিলানের সঙ্গে নতুন চুক্তির কথাবার্তা চলা এই ফরোয়ার্ড ডি বক্সে সেরা। কিন্তু রিয়ালের খেলার সঙ্গে কতটা মানিয়ে নিতে পারবেন এ নিয়ে সন্দেহ আছে। তা ছাড়া তাঁর জন্য অন্তত ১০০ মিলিয়ন খরচ করতে হবে রিয়ালকে। আর গত তিন–চার মৌসুম ধরেই এডেন হ্যাজার্ডকে রিয়ালে পাঠিয়ে দিচ্ছে সব সংবাদমাধ্যম। কিন্তু অন্তত শীতকালীন দলবদলে তাঁকে দলে আনার সম্ভাবনা নেই।
বড় তারকার দিকে হাত না বাড়িয়ে গত কয়েক বছরের নীতিতেও হাঁটতে পারে রিয়াল মাদ্রিদ। সোসিয়াদাদের মিকেল ওয়েরজাবাল ও লেভান্তের রজার মার্তির দিকেও নজর রাখছে মাদ্রিদের ক্লাবটি। তবে নতুন স্টেডিয়ামের পরিকল্পনায় নামা রিয়াল এ দলবদলে ফরোয়ার্ড লাইনে কাউকে নাও আনতে পারে। মারিয়ানো, ভিনিসিয়ুস ও জুলাইয়ে হাজির হতে যাওয়া রদ্রিগোকে ভবিষ্যতের নিদান মিলবে। কিন্তু এই মৌসুমের ‘মহামারি’ দূর করতে দ্রুত একজন ডিফেন্ডার দরকার রিয়ালের। আর তার চেয়েও বেশি দরকার একজন গোলের পথ চেনা ফরোয়ার্ড।
আরও পড়ুন: