৯ বছর আগের ওই মিটিংটার কথা এখনো মনে পড়ে

অ্যালিস্টার কুক অবসর নিয়েছেন চার বছর হয়ে গেছে। তবে ৪০ পেরিয়েও আরেকটি সিরিজ খেলতে যাচ্ছেন জেমস অ্যান্ডারসনএএফপি
দীর্ঘদিন একসঙ্গে ইংল্যান্ড দলে খেলেছেন দুজন। খেলতে খেলতেই জেমস অ্যান্ডারসন ও অ্যালিস্টার কুকের গভীর বন্ধুত্ব। বৃহস্পতিবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে লর্ডস টেস্ট ম্যাচটি অ্যান্ডারসনের জন্য একটু বিশেষ কিছুই। বয়স ৪০ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর প্রথম টেস্ট ম্যাচ। সেই ম্যাচের আগে বন্ধু জিমি অ্যান্ডারসনকে নিয়ে লন্ডনের ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছেন অ্যালিস্টার কুক। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য সেই কলামের অনূদিত রূপ—

ভাবতে অবাকই লাগে, আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছেড়েছি প্রায় চার বছর, অথচ আমার বন্ধু জেমস অ্যান্ডারসন এখনো কী দারুণ খেলে যাচ্ছে! যে কিনা ৪০ বছর বয়সে একটা টেস্ট খেলতে যাচ্ছে।

ক্রিকেটাররা অবসর নেয় কখন? প্রথমত, শরীর যখন আর ধকল নিতে পারে না, যে কারণে একসময় যেভাবে পারফর্ম করত, তা আর করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, সবার মনোযোগ ও প্রত্যাশা সামলে দিনের পর দিন পারফর্ম করে যাওয়ার চাপটা অসহনীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু লম্বা সময় ধরে এসব জয় করে জিমি যেভাবে পারফর্ম করছে, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য।

৯ বছর আগের সেই ম্যানেজমেন্ট মিটিংটার কথা এখনো মনে পড়ে, যেটির বিষয় ছিল জিমি ও স্টুয়ার্ট ব্রডের ২০১৩ সালে পরপর দুটি অ্যাশেজে খেলার মতো ফিটনেস আছে কি না। ওরা খেলতে না পারলে পরিবর্তে কারা খেলবে। এরপর ও কত কিছুর মধ্য দিয়েই না গেছে—দারুণ জয়, লজ্জার পরাজয়, দুই অধিনায়ক এবং অবশ্যই কোভিড।

আমি যখন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছি, জয়–পরাজয়, ড্র—সবকিছুই ছিল দারুণ অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে দর্শকের সামনে খেলাই ছিল রোমাঞ্চকর। কিন্তু কোভিডের সময় সাউদাম্পটন ও ওল্ড ট্রাফোর্ডের ওই প্রাণহীন শূন্য মাঠে (থাকতেও হতো ওই মাঠেই) তার কি একবারও মনে হয়নি, আমি কিসের জন্য এটা করছি? কিন্তু জিমি এসব কিছুই ভাবেনি, এ সময় তার ৬০০ উইকেট নেওয়া ছিল দারুণ এক কীর্তি। সর্বকালের সেরাদের কাতারে তার স্থান এর মধ্যেই নিশ্চিত হয়ে গেছে। নিজের কাছে ছাড়া আর কারও কাছে তার কিছু প্রমাণেরও বাকি নেই। তারপরও সে খেলা চালিয়ে যাওয়ার প্রেরণা খুঁজে পাচ্ছে; কারণ, সে জিততে ভালোবাসে। এখনো বিশ্বাস করে, বল হাতে সে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সে এখনো হাতে বল চায়।

আরও পড়ুন

জিমি ও আমার প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটা মনে হয় অনেকেরই জানা। সেটা ২০০৫ সাল, এসেক্সের হয়ে অস্ট্রেলিয়ানদের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি করার পর চ্যাম্পিয়নশিপের একটা ম্যাচে খেলতে গেছি। তখন আমার বয়স ২০, জিমির চেয়ে আমি প্রায় তিন বছরের ছোট। ল্যাঙ্কাশায়ারের (অ্যান্ডারসনের দল) ওরা আমার ওপর একরকম ঝাঁপিয়ে পড়ল। কারণ, আমি নাকি খুব উদ্ধত, খুব ভাব নিয়ে চলি। এমনকি মার্ক চিলটন, যে কিনা বিশ্বের সবচেয়ে ভদ্র মানুষ, সে-ও পর্যন্ত স্লেজিং করছিল। জিমি আমাকে বাউন্সারে আউট করে, আমি বাউন্ডারিতে ক্যাচ তুলে দিই। বাউন্সারে আউট হতেই পারি, কিন্তু তাই বলে একজন মিডিয়াম পেসারের বলে? এটা অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক।

জিমি অ্যান্ডারসন, ক্যারিয়ারের শুরুতে যিনি ছিলেন কুকের প্রতিপক্ষ
রয়টার্স

পরে আমরা একসঙ্গে ইসিবি একাডেমিতে ছিলাম। যদিও আমাদের খুব বেশি কথা হয়নি। সত্যি বলতে, আমরা একসঙ্গে সময় কাটাইনি বললেই চলে। সে একজন ওপেনিং বোলার আর আমি ওপেনিং ব্যাটসম্যান, তাই বেশির ভাগ সময়ই আমরা আলাদা অনুশীলন করতাম। আর জিমিরও অপরিচিত কারও সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলার অভ্যাস নেই।

ইংল্যান্ড দলে আমরা দুজনই ভারত সফরে বদলি হিসেবে ডাক পেয়েছিলাম। সেই ডাক যখন পেয়েছি, তখন আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজে। অ্যান্টিগা থেকে নাগপুর—দীর্ঘ এক যাত্রা। আমি জানতাম, জিমি আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসবে না, তাই সাহস করে প্রথম উদ্যোগটা আমিই নিলাম। ৪৮ ঘণ্টা চুপ করে বসে থাকার চেয়ে এটাই ভালো মনে করেছিলাম (যদিও জিমি মনে হয় প্রথমটাই চাইছিল)। আমি ওকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, চেমসফোর্ডে ও গালাগালি করে যা বলেছিল, তা সত্যিই ওর মনের কথা কি না। উত্তরে ও বলল, আমি সবাইকেই এমন বলি। এভাবেই আমাদের সম্পর্কের শুরু।

আরও পড়ুন

আমাদের বন্ধুত্বের কথা যদি বলি, একসঙ্গে এত দিন খেলা অবশ্যই অনেক সাহায্য করেছে। আরেকটি ব্যাপারও এতে ভূমিকা রেখেছে, আমরা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে খেলাটা দেখতাম। সে খেলাটাকে দেখত ওপেনিং বোলার হিসেবে আর আমি ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে, আমাদের কথাবার্তাতেও এর ছাপ পড়ত। তবে একটা মিল ছিল, জয় পেতে আমরা দুজনই ছিলাম মরিয়া। স্বভাবে আমরা দুজনই একটু অন্তর্মুখী। তবে আমি যখন অধিনায়ক, ও আমার রুমে আসত, দুজন একসঙ্গে রুম সার্ভিসে অর্ডার করতাম। এমনও হয়েছে, আমরা খুব একটা কথা বলতাম না, তারপরও মনে হতো, আহ্! কী দারুণ এক সন্ধ্যা কাটালাম।

ভাবে আমরা দুজনই একটু অন্তর্মুখী। তবে আমি যখন অধিনায়ক, ও আমার রুমে আসত, দুজন একসঙ্গে রুম সার্ভিসে অর্ডার করতাম। এমনও হয়েছে, আমরা খুব একটা কথা বলতাম না, তারপরও মনে হতো, আহ্! কী দারুণ এক সন্ধ্যা কাটালাম।

জিমি আর আমি একসঙ্গে প্রচুর ডার্ট খেলতাম। এটা শুরু করেছিল স্টিভ হার্মিসন, যা পরে আমি চালিয়ে যাই। হাসিঠাট্টার মধ্য দিয়েই খেলাটা শুরু হতো, কিন্তু দুজনেরই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মনোভাবের কারণে প্রায়ই তা পরিণত হতো জয়ের জন্য মরিয়া নিঃশব্দ লড়াইয়ে। জিমি আমার চেয়ে ভালো খেলত, কখনো কখনো আমাকে একদম উড়িয়ে দিত। তবে খেলাটা যখন ক্লোজ হতো, আমি তখন বেশি ডাবল মারতাম। সফরে তো আমরা ডার্ট বোর্ড নিয়ে যেতাম, হোম টেস্টে তো তা থাকতই। অনেক হোটেল রুমের দরজায় এখনো ছিদ্র খুঁজে পাওয়া যাবে।

আমাদের মধ্যে তর্ক হয়নি, এমন নয়। তবে সেটির মূলে ছিল জয়ের জন্য তার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং নিজেকে সেরা প্রমাণ করার তাড়না। ও বুঝতেই পারত না, কেন ও ভালো বোলিং করছে না বা কেন আমরা যথেষ্ট ভালো খেলছি না। এটাই তাকে সব সময় ভালো করার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। যখন আমি অধিনায়ক ছিলাম, সব সময় একমত না হলেও ও আমার মতামতকে সম্মান করেছে। ভরসা রেখেছে আমার বিবেচনার ওপর। একজন বোলার হিসেবে কখনো এমন হতেই পারে যে একটা লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে বৃহত্তর ছবিটা আপনি ভুলে গেলেন। আমি চেষ্টা করতাম, এমন সময়ে যেন তার মনোযোগটা না সরে যায়। রাগটাও যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়।

টানা দুটি অ্যাশেজ খেলার মতো ফিটনেস ব্রড-অ্যান্ডারসনের আছে কি না, এক সময় প্রশ্ন উঠেছিল সেটি নিয়েই!
ফাইল ছবি
আরও পড়ুন

জিমির বোলিংয়ের একটা দিক অনেক সময়ই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, তা হলো, ও যদি তার চাওয়ামতো বল করতে না-ও পারে, তারপরও তার একই জায়গায় বল করে যাওয়া। মাঝেমধ্যে অনেকে বলে, ব্রড-অ্যান্ডারসন কি যথেষ্ট ওপরে বল করে? তবে ওদের ওপর আপনি ভরসা রাখতে পারেন, ওরা কাজের কাজটা ঠিকই করবে। টেস্ট ম্যাচে প্রথম ঘণ্টাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রড-অ্যান্ডারসনের বোলিং শুরু করাটা একজন অধিনায়কের জন্য বড় পাওয়া, আমার কাজটাও তা সহজ করে দিয়েছিল। বোলিংটা ভালো না হলে কিংবা বোলিং স্পেলের শেষে তাকে ফাইন লেগের পরিবর্তে মিড অফে রাখতে হতো। কারণ, ও সব সময় খেলাটায় থাকতে চায়। বোলারদের দেওয়া তার পরামর্শও তো অমূল্য।

একটা জায়গায়ই আমি ওর সঙ্গে কোনো লড়াইয়ে যেতে চাইতাম না, যখন ও নেটে আমাকে বোলিং করত। একটা ভালো শট খেললে পরের বলটা ও আরও ভালো করবে। আমি একটু ভাগ্যবানই ছিলাম; কারণ, সাধারণত নেটে সবার আগে আমিই ব্যাটিং করতাম, নেটে আমার ১৫-২০ মিনিট ব্যাটিং করার সময়ে ও মূলত নিজেকে একটু চনমনে করে নিত। ছন্দ পাওয়াটাই তখন তার মূল লক্ষ্য থাকত, বলটা হাত থেকে ঠিকমতো বেরোচ্ছে কি না, তা বোঝাও।

অ্যান্ডারসন: তখন ও এখন
ইনস্টাগ্রাম

ড্রেসিংরুমে ও তেমন খেলা দেখত না। আমার ইনিংস সে কতটুকু দেখেছে—সম্ভবত ১৫ শতাংশ, এমনকি তার কমও হতে পারে। এক কোনায় বসে ক্রসওয়ার্ড বা ধাঁধা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। ও খুব একটা গোছানো ছিল না, আমিও তা-ই। ড্রেসিংরুমে আমরা পাশাপাশি বসতাম, দুজনেরই গ্রে-নিকোলস কিট, যা প্রায়ই অদলবদল হয়ে যেত।

ও ছিল এমন একজন, অধিনায়ক হিসেবে কঠিন সময়ে যার সঙ্গে বিয়ার হাতে আলোচনা করতে পারতাম। জিমি আমাকে খুব ভালো বুঝত। আমার মনে হতো, তার সঙ্গে যেকোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা যায়।

জিমির সঙ্গে খেলাটা সত্যিকার সম্মানের ব্যাপার। এখন আমি বাড়িতে সেরা আসনে বসে ওর দুর্দান্ত বোলিং দেখব। আমার কোনো সন্দেহ নেই, এই সিরিজেও ও দারুণ করবে। সর্বকালের অন্যতম সেরার মূল্য আমাদের বোঝা উচিত, যাকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে নিজেকে আমি ভাগ্যবান মনে করি।