ইনজামাম-উল-হকের জন্মদিনেই তাহলে ওই ঘটনা!
‘ঘটনা’ না বলে দুর্ঘটনা বলাই ভালো। তাতেও বোধ হয় ব্যাপারটার গুরুত্ব পুরোপুরি বোঝানো যায় না। পাকিস্তান ক্রিকেটের, বলা ভালো বিশ্ব ক্রিকেটেরই ‘কালো দিন’টিকে কি আর শুধু দুর্ঘটনা বলে বোঝানো যায়!
লাহোরে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামমুখী শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের বাসে হামলা চালাল সন্ত্রাসীরা। ছয়জন নিরাপত্তারক্ষী মারা গেলেন, দুজন পথচারীও। আহত হলেন শ্রীলঙ্কার পাঁচজন ক্রিকেটার। সেই টেস্ট তো বাতিল হলোই, বাতিল হয়ে গেল সিরিজই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে পাকিস্তানের নামের পাশেও লাল দাগ পড়ে গেল। ওই ঘটনার আগেও পাকিস্তান নিরাপদ ছিল না। তবে খেলা আর খেলোয়াড়েরা সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু হয় না বলে একটা বিশ্বাস ছিল। সেটিই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল ওই ঘটনায়। ১৯৭২ মিউনিখ অলিম্পিকে ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসীদের হাতে ১১ জন ইসরায়েলি অ্যাথলেট নিহত হওয়ার পর ক্রীড়াবিদদের সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার প্রথম ঘটনা এটি। এর পর থেকেই পাকিস্তান বিশ্ব ক্রিকেটের ‘নো-গো জোন’!
তা হঠাৎ এই পুরোনো কাহিনি কেন? কারণ আজকের এই দিনেই লিবার্টি স্কয়ারে পাকিস্তান ক্রিকেটকে টালমাটাল করে দেওয়া ওই হামলা। সেটি ২০০৯ সালের ৩ মার্চ। এর পর থেকে এই দিনটি এলেই ইনজামামের মন খারাপ হয়ে যায়। অথচ এটি তাঁর জন্য আনন্দের এক দিন হওয়ার কথা। ওই দুঃস্বপ্নের ৩৯ বছর আগের এক ৩ মার্চেই যে তাঁর জন্ম। সেই জন্মদিন এখন বিষাদের আরেক নাম।
ইনজামামের জন্মদিন আর লাহোর হামলার এমন মিলে যাওয়াটা হয়তো খেয়ালই করা হতো না, যদি ক্রিকইনফো ওয়েবসাইটে ‘অন দিস ডে’ বিভাগটা না থাকত! এই বিভাগটা আমার খুব প্রিয়। এই ‘অন দিস ডে’র ভেলায় চেপে ক্রিকেট ইতিহাসে একটা ভ্রমণ হয়ে যায়। এই দিনে কবে কী ঘটেছিল, কার জন্ম, কার কী কীর্তি...রোমাঞ্চকর সেই ভ্রমণ!
আজকের এই দিনেই যেমন জর্জ লোহ্ম্যানের অবিশ্বাস্য সেই কীর্তি। জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্সে মাত্র ২৮ রানে ইংলিশ মিডিয়াম ফাস্ট বোলারের ৯ উইকেট। টেস্টে এক ইনিংসে ৯ উইকেট নেওয়ার প্রথম কীর্তি। সেই ১৮৮৬ সালের ঘটনা, এরপর এত দিনেও এত কম রানে কেউ ৯ উইকেট নিতে পারেনি। লোহ্ম্যানের ওই বোলিং ফিগারকে ছাড়িয়ে যেতে জিম লেকার. অনিল কুম্বলে ও এজাজ প্যাটেলকে নিতে হয়েছে ইনিংসের ১০টি উইকেটই।
লোহ্ম্যানের দুটি কীর্তি এত বছর পরও অমলিন। টেস্টে প্রতিটি উইকেট নিতে গড়ে রান দিয়েছেন ১০.৭৫, গড়ে বল করতে হয়েছে ৩৪টি—কমপক্ষে ২০০০ বল করেছেন, এমন বোলারদের মধ্যে এখনো এটি সেরা
লোহ্ম্যানের কথা উঠলে প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য জানানোর লোভ সামলানো কঠিন। মাত্র ১৮ টেস্টে তাঁর ১১২ উইকেট। উইকেট-সংখ্যায় তো কতজনই ছাড়িয়ে গেছেন তাঁকে। তবে লোহ্ম্যানের দুটি কীর্তি এত বছর পরও অমলিন। টেস্টে প্রতিটি উইকেট নিতে গড়ে রান দিয়েছেন ১০.৭৫, গড়ে বল করতে হয়েছে ৩৪টি—কমপক্ষে ২০০০ বল করেছেন, এমন বোলারদের মধ্যে এখনো এটি সেরা। অথচ লোহ্ম্যান সর্বশেষ টেস্ট খেলেছেন সোয়া শতাব্দীরও আগে!
আরেকটি বোলিং-কীর্তিরও সাক্ষী আজকের এই দিন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দুবার চার বলে ৪ উইকেট নেওয়ার কীর্তি শুধু একজন বোলারেরই। ওয়েস্টার্ন প্রভিন্সের বব ক্রিস্পের দ্বিতীয়বার চারে-চার ১৯৩৪ সালের ৩ মার্চে। দক্ষিণ আফ্রিকান সুইং বোলারের প্রথম চারে-চার দুই বছর আগে। ক্রিস্প টেস্ট খেলেছেন ৯টি, যাতে তাঁর ২০ উইকেট। তবে ক্রিস্পকে শুধু ক্রিকেটার পরিচয়ে আবদ্ধ রাখা কঠিন।
চার বলে ৪ উইকেটের কীর্তি দেখে তাঁর সম্পর্কে একটু পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখি, এ তো ‘জীবনের চেয়েও বড়’ এক চরিত্র, যাকে বলে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। দুঃসাহসী এক অভিযাত্রী মন ছিল তাঁর। টেস্ট দলে ডাক পাওয়ার খবরটা যখন পেলেন, মাত্রই নেমে এসেছেন কিলিমানজারো পর্বত থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ট্যাংক কমান্ডার হিসেবে সুপারহিরোর মতো সব কাণ্ডকীর্তি। তবে নিজের মতে চলার লোক ছিলেন বলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝামেলাও হয়েছিল। যুদ্ধের পর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন, বই লিখেছেন। ভাগ্যিস, ‘অন দিস ডে’টা দেখেছিলাম! নইলে এমন বর্ণাঢ্য এক চরিত্র সম্পর্কে জানাই হতো না।
এই দিনেই ক্ল্যারি গ্রিমেটের ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট শুরু। জীবনের শেষ সিরিজে ৪৪ উইকেট নেওয়ার পর বয়সের অজুহাতে যাঁকে আর টেস্ট খেলতে দেওয়া হয়নি। কে জানে, পরের বছর পরের সিরিজে সুযোগ পেলে অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার ৪৫ উইকেট পেয়ে যেতেন কি না! এই অদ্ভুত কথাটা বলার কারণ, শেষ সিরিজে বয়সের সঙ্গে মিলিয়েই উইকেট নিয়েছিলেন। বয়স ৪৪, উইকেটও ৪৪!
এত বছরের ইতিহাস, আরও কত কিছুই তো ঘটেছে এই দিনে। সব তো আর লেখা সম্ভব নয়। শেষ করি ‘অ্যাথলোন ক্যাসল’ দিয়ে। এটা আবার কী? একটি জাহাজের নাম। ক্রিকেটের কথা বলতে জাহাজ টেনে আনাকে কারও কাছে ‘আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর’ নেওয়ার মতো মনে হতেই পারে। তবে ‘অ্যাথলোন ক্যাসল’ নামে জাহাজটার কিন্তু ক্রিকেট ইতিহাসেও একটু জায়গা আছে। এই জাহাজ ছেড়ে যাবে বলেই তো টেস্ট ইতিহাসের দীর্ঘতম ম্যাচটি আরও দীর্ঘ হতে পারল না। হতে পারল না নিষ্পত্তিও।
১৯৩৯ সালে ডারবানে ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের শেষ টেস্টটি ছিল ‘টাইমলেস’ অর্থাৎ ফলাফল না হওয়া পর্যন্ত খেলা। ম্যাচ শুরুর ১১ দিন পর ওই অ্যাথলোন ক্যাসল জাহাজ ধরার জন্যই নিশ্চিত জয়ের হাতছানি উপেক্ষা করে মাঠ ছেড়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ড দল। তখন তো আর ‘প্লেনে উঠলাম আর নেমে পড়লাম’-এর দিন নয়। জাহাজ ছাড়বে কেপটাউন থেকে। ডারবান থেকে যেখানে যেতে পুরো দুই দিনের ট্রেন-যাত্রা।
জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল মাত্র ৪২ রানের। কিন্তু অ্যাথলোন ক্যাসল জাহাজ মিস করলে পরের জাহাজ পেতে আবার কত দিন অপেক্ষা করতে হয়—এই দুশ্চিন্তায় ইংল্যান্ড আর জয়ের কথা ভাবেনি।
ওই টেস্টের ১১ দিনের মধ্যে এক দিন বৃষ্টির কারণে খেলা হয়নি। আরেক দিন ছিল ‘রেস্ট ডে’। সেঞ্চুরি হয়েছিল ৬টি। খেলা হয়েছিল ৪৩ ঘণ্টা ১৬ মিনিট, যাতে মোট রান ১৯৮১, দুটিই এখনো রেকর্ড। রেকর্ড চতুর্থ ইনিংসে ইংল্যান্ডের ৫ উইকেটে ৬৫৪ রানও। এবং তা শুধু টেস্ট ক্রিকেটেই নয়, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটেও। জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল মাত্র ৪২ রানের। কিন্তু অ্যাথলোন ক্যাসল জাহাজ মিস করলে পরের জাহাজ পেতে আবার কত দিন অপেক্ষা করতে হয়—এই দুশ্চিন্তায় ইংল্যান্ড আর জয়ের কথা ভাবেনি। ৯ দিন খেলেও নিষ্পত্তি না হওয়ার পর ‘টাইমলেস টেস্ট’-এর যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। ডারবানেই তাই কবর রচিত হয় টাইমলেস টেস্টের।
ক্রিকেটের গল্পে জাহাজ টেনে আনার কারণ তো জানলেন। তা হঠাৎ টাইমলেস টেস্টের প্রসঙ্গই বা কেন? কারণ, আজকের এই দিনেই শুরু হয়েছিল ইতিহাসের শেষ টাইমলেস টেস্টটি। সেটিও তো জানাল ক্রিকইনফোর ওই বিভাগটাই।
জয়তু ‘অন দিস ডে’!