বিপুল ব্যয়ের সুইমিংপুল বেহাল

পানিশূন্য সুইমিংপুলটি ২২ বছর ধরে অব্যবহৃত। দুই কিশোর মিলে তাই সেটাকে বানিয়ে ফেলল ফুটবল মাঠই! সম্প্রতি বরিশাল জেলা সুইমিংপুলেসাইয়ান

সারা দেশে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) নির্মাণ করেছে ২২টি সুইমিংপুল। এতে সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা। অথচ এই সুইমিংপুলগুলোর বেশির ভাগই অযত্ন-অবহেলায় প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। অনেক সুইমিংপুলেই পানি নেই, কোথাও পানি থাকলেও তা ব্যবহার উপযোগী নয়। এর মধ্যেই ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে রংপুরে আরেকটি সুইমিংপুলের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সাড়ে ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ভোলায় আরেকটি সুইমিংপুলের কাজ শুরু হয়ে গেছে।

এর মধ্যে নির্মিত ২২টি সুইমিংপুলের মধ্যে ১০টি কোনোমতে চালু আছে। বাণিজ্যিকভাবে সাঁতার শেখানো হচ্ছে এসব পুলে, যদিও সেগুলোর অবস্থাও খুব ভালো নয়। আরও চারটি সুইমিংপুল মোটামুটি ব্যবহারযোগ্য, কিন্তু সেগুলো পড়ে আছে অব্যবহৃত অবস্থায়। আটটি সুইমিংপুল পুরোপুরিই অচল।

প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা সরেজমিন দেখে এবং জেলা পর্যায়ের সাঁতারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে সারা দেশের সুইমিংপুলের এ চিত্র পাওয়া গেছে। অনেক ক্ষেত্রে নিম্নমানের কাজ হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

‘এই পুলে আমরা কার্যক্রমই করতে পারলাম না এখনো। পুলটা ঠিকভাবে বানানোই হয়নি।’
হালিমা ইসলাম, স্থানীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সদস্য

চট্টগ্রাম বিভাগীয় সুইমিংপুল নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাবউদ্দিন শামীম যেমন তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘চট্টগ্রামের পুলের কিছু যন্ত্রে সমস্যা আছে। নিম্নমানের কিছু জিনিসপত্র দিয়েছে, এগুলো বদল করার চেষ্টা করছি। সবচেয়ে বড় সমস্যা, গিজার লাগানো নেই, শীতকালে পুলটা ব্যবহারই করা যায় না।’

বেশির ভাগ সুইমিংপুলের নির্মাণকাজেই বড় ধরনের ত্রুটি আছে। সবচেয়ে বেশি ত্রুটি পুলে পানি তোলার পাম্পে। অন্তত ১২টি পুলে পাম্প বিকল বা প্রায় বিকল হয়ে আছে। বাকি পুলগুলোতে পানি তোলা গেলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পানিতে প্রচুর আয়রন। এসব পুলে পানি শোধনের উপযুক্ত ব্যবস্থাও নেই। মুন্সিগঞ্জের সাঁতারের কোচ নুরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, সুইমিংপুলে পানি পরিশোধনের জন্য ফিল্টার প্ল্যান্ট লাগবেই। কিন্তু বছর বিশেক আগে বাংলাদেশে একসঙ্গে ১০টি সুইমিংপুল হয়েছে ফিল্টার প্ল্যান্ট ছাড়াই। এই পুলগুলোর বেশির ভাগই এখন অকার্যকর।

চালুই হয়নি বরিশালের সুইমিংপুল

নুরুল ইসলাম যে ১০টি সুইমিংপুলের কথা বলেছেন, বরিশাল ও ফেনীর সুইমিংপুল দুটি সেই সময়ের। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, বরিশালের চাঁদমারি এলাকায় ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত পুলটি ২২ বছরে এক দিনের জন্যও ব্যবহৃত হয়নি। খটখটে শুকনা পুলটি অনেক বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ফেনীর দাউদপুর এলাকায় ২০০০ সালে নির্মিত পুলটি ২২ বছরে ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র একবার।

একই সময়ে নির্মিত রাজবাড়ীর পুলে পানি শোধনের ব্যবস্থা না থাকায় মাস কয়েকের বেশি তা সচল রাখা যায়নি। শহরের ভবানীপুরে প্রায় ৩ একর জমির ওপর ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত পুলের টাইলসগুলোও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। রাজবাড়ী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘২০০৩ সালে রাজবাড়ীর পুলটি নির্মাণের সময় দরপত্রে কী ছিল, তা আজও জানি না। রাজবাড়ীর পানিতে প্রচুর আয়রন থাকার পরও পুল তৈরির সময় ওয়াটার ফিল্টার মেশিন ছিল না কেন, এটাই বড় প্রশ্ন।’

২০১৮ সালে নির্মাণের পর গত চার বছর অব্যবহৃত পড়ে আছে খুলনার সুইমিংপুল। বিভিন্ন সমস্যা থাকায় বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে নির্মিত এই পুলটি গ্রহণ করতেই রাজি হয়নি বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা।

সে তুলনায় বগুড়ার সাঁতার কমপ্লেক্সটির ছয় বছর ধরে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকাটা হয়তো কোনো খবরই নয়। ২০০২ সালের ২৯ নভেম্বর উদ্বোধন করা হয় সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পুলটি। কিন্তু জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তাদের অভিযোগ, পুল নির্মাণের সময় পানি পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে পানি ভরার পর তাতে দু-এক দিনের মধ্যেই শেওলা জমে যায়। বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদ জানিয়েছেন, ‘বগুড়ায় পুল থাকলেও ৬ বছর ধরে সেটি কোনো কাজে আসছে না। আমরা চাই অবিলম্বে এটি সংস্কার করে ছেলেমেয়েদের সাঁতারচর্চার সুযোগ করে দেওয়া হোক।’

চাঁদপুর আউটার স্টেডিয়ামের পাশে প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত অরুণ নন্দী সুইমিংপুলের উদ্বোধন করা হয় ২০০৮ সালে। শুরুতে মাঝেমধ্যে এটি ব্যবহৃত হলেও পানি সরবরাহের পাম্প ও ফিল্টার নষ্ট থাকায় ২০১৯ সাল থেকে তা অচল অবস্থায় পড়ে আছে।

চাঁদপুর আউটার স্টেডিয়ামের পাশে প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত অরুণ নন্দী সুইমিংপুলের উদ্বোধন করা হয় ২০০৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। শুরুতে মাঝেমধ্যে এটি ব্যবহৃত হলেও পানি সরবরাহের পাম্প ও ফিল্টার নষ্ট থাকায় ২০১৯ সাল থেকে তা অচল অবস্থায় পড়ে আছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে টাইলসসহ অন্যান্য সরঞ্জাম। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুলের পাশের ভবনটিও এখন জরাজীর্ণ।

২০১৮ সালে নির্মাণের পর গত চার বছর অব্যবহৃত পড়ে আছে খুলনার সুইমিংপুল। বিভিন্ন সমস্যা থাকায় বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে নির্মিত এই পুল গ্রহণ করতেই রাজি হয়নি বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। পড়ে থাকতে থাকতে পানি শোধনযন্ত্র, সরবরাহ পাম্পসহ প্রায় সবকিছুই এখন অকেজো হয়ে গেছে। স্থানীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সদস্য হালিমা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘এই পুলে আমরা কার্যক্রমই করতে পারলাম না এখনো। পুলটা ঠিকভাবে বানানোই হয়নি।’

গোপালগঞ্জে দুটি পুলেই সমস্যা

গোপালগঞ্জে শেখ কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্সে নির্মিত জেলা সুইমিংপুলও একই রকম সমস্যায় জর্জরিত। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে উদ্বোধনের সাত মাস পর শেখ কামাল সুইমিংপুলে ২৭তম জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার বাইরে সেটিই ছিল জাতীয় সাঁতারের প্রথম আসর। কিন্তু পানি তোলার পাম্পে সমস্যা থাকায় পুলটি এখন অকেজো। একই সময়ে নির্মিত গোপালগঞ্জে মহিলা ক্রীড়া সংস্থায় নির্মিত পুল জন্ম থেকেই অচল। সেখানে পানির কোনো উৎসই নেই। সুইমিংপুল নির্মাণের সময় গভীর নলকূপ স্থাপন না করায় এ অবস্থা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে পুলও অচলের তালিকায় পড়ে। তবে বিকল্প উপায়ে পানি তুলে আপাতত পুলটি ব্যবহার করছে একটি সংস্থা।

গোপালঞ্জের দুটি পুলেই আছে সমস্যা
ছবি: নতুন শেখ

পুল চালু রাখতে বিদ্যুৎও প্রয়োজন। কয়েকটি জেলা ক্রীড়া সংস্থা বাকির খাতায় নাম তুলেছে সেখানেও। চাঁদপুরে একসময় সুইমিংপুল বাবদ বিদ্যুৎ বিল বাকি ছিল ২৪ লাখ টাকা। এ টাকা পৌরসভা পরে পরিশোধ করে দিয়েছে। রাজবাড়ীতে বিল বাকি পড়ে আছে চার লাখ টাকা। এভাবে কোথাও দুই লাখ, কোথাও তিন লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল বাকি। বিদ্যুৎ বিলের ভয়েই অনেক জায়গায় পুল চালানো হয় না।

রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কার?

জেলা পর্যায়ে একেকটি পুল ভালোভাবে চালাতে মাসে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা প্রয়োজন। কিন্তু এনএসসি এ খাতে কোনো টাকা দেয় না। এ ব্যাপারে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মুহাম্মদ সারওয়ার জাহানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্টেডিয়াম, ইনডোর, টেনিস কোর্ট ইত্যাদি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দ থাকলেও সুইমিংপুল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের আলাদা কোনো আর্থিক বরাদ্দ নেই।’

তাহলে সুইমিংপুলগুলো কীভাবে চলবে, এ প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ডিএসএর সাধারণ সম্পাদকেরাই মূলত এটা দেখভাল করবেন। তাঁদের একটা পরিকল্পনা থাকতে হবে, পুল ঠিক রাখতে কী করতে হবে, কীভাবে পানি বদলাতে হবে...তাঁরাই ঠিক করবেন।

তবে জেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলোর সাধারণ সম্পাদকেরা একই সুরে বলেছেন, সুইমিংপুল রক্ষণাবেক্ষণ অনেক ব্যয়বহুল। জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এসব চালু রাখা কঠিন।

সমাধান কী?

কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে নির্মিত সুইমিংপুলগুলো এভাবে অচল হয়ে থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তারা। দ্রুত সংস্কার করে তা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত সাবেক সাঁতারু ও কোচ লায়লা নূর অবশ্য সুইমিংপুলের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ সংস্থানের জন্য একটা পরামর্শ দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের সব নষ্ট পুল দ্রুত মেরামত করে ভাড়া দেওয়া যেতে পারে।

ভারতে দেখেছি, বিভিন্ন রাজ্যের পুল বিভিন্ন ক্লাব ইজারা নেয়। ক্লাবের মাধ্যমে সাঁতারু তৈরি হয়। এমনকি জার্মানিতে দেখেছি, স্কুল কর্তৃপক্ষ সুইমিংপুল ভাড়া নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শেখায়। আমাদের দেশেও এসবের চর্চা শুরু করা দরকার। এতে পুলটা অন্তত এমন অচল পড়ে থাকবে না।’