নতুন বছরে ক্রীড়াঙ্গনে যত প্রত্যাশা

নাজমুল হোসেন, মিতুল মারমা, সাগর ইসলাম ও রাকিবুল হাসান
ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে বিদায় নিয়েছে আরেকটি বছর। নতুন বছর শুরু হলো আজ। ভালো–মন্দের মিশেলে ২০২৪ পার করা বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা আছেন নতুন শুরুর অপেক্ষায়। ক্রিকেট, ফুটবল, হকিসহ বিভিন্ন খেলার কয়েকজনের মুখে ২০২৫–এর প্রত্যাশার কথা।

বড় দলের বিপক্ষে বেশি সাফল্য চাই

নাজমুল হোসেন, অধিনায়ক, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল

নতুন বছরে আমার প্রথম চাওয়া, জাতীয় দল ও এর আশপাশে যে ২৫–৩০ জন ক্রিকেটার আছে, তারা সবাই যেন সুস্থ থাকে। ফিট থাকে। এটা বড় চাওয়া। টেস্টে ২০২৪ সালে আমরা তিনটি টেস্ট জিতেছি।

নতুন বছরে দেশে–বিদেশে চাইব টেস্ট জয়ের হার যেন আরও বাড়ে। সাদা বলের ক্রিকেটেও চাই জয়ের হার বাড়াতে, বিশেষ করে বড় দলের বিপক্ষে সাফল্য বেশি চাই। আমরা যেন নিয়মিত ৩২০–৩৩০ রান করতে পারি এবং প্রতিপক্ষকে তার আগে আটকাতে পারি। প্রতিপক্ষ এ রকম রান করলে যেন সেটা তাড়া করে জেতার সামর্থ্য দেখাতে পারি।

এ বছর চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আছে। সেখানেও ভালো কিছুরই প্রত্যাশা থাকবে। ব্যক্তিগতভাবে চাওয়া বড় ইনিংস নিয়মিত খেলা। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বেশি বেশি সেঞ্চুরি চাই, যেটা দলকে ম্যাচ জেতাবে।

হামজা ভাইয়ের কাছে অনেক শেখার থাকবে

মিতুল মারমা, জাতীয় ফুটবল দলের গোলকিপার

নতুন বছরে বাংলাদেশের ফুটবলে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে ভালো খেলা। ভারত, হংকং, সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ছয়টি ম্যাচ। এর ৫টিই নতুন বছরে। এই ম্যাচগুলোয় আমাদের লক্ষ্য থাকবে এমন কিছু করা, যাতে সামনের দিকে এগোনো যায়।

আনন্দের কথা, হাজমা চৌধুরী ভাইকে এই ম্যাচগুলোয় পাওয়া যাবে, আশা করছেন সবাই। এই প্রথম তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সিতে খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁর মতো ফুটবলারের সঙ্গে একই ড্রেসিংরুম ভাগাভাগি করব, ভাবতেই শিহরিত আমি।

ইংল্যান্ডের লেস্টার সিটির ফুটবলারের কাছে অনেক কিছু শেখার থাকবে। নতুন বছরে ঘরোয়া ফুটবল আরও জমজমাট হোক, মাঠে বেশি বেশি দর্শক আসুক, প্রত্যাশা থাকবে। আমি এবার আবাহনী লিমিটেডে খেলছি। আবাহনীতে বিদেশি খেলোয়াড় নেই। ফলে ব্যক্তিগতভাবে আমার এবং আমার দলের লড়াইটা অনেক কঠিনই হবে নতুন বছরে।

মেয়েদের লিগে বড় ক্লাবগুলো আসুক

ঋতুপর্ণা চাকমা, নারী সাফের সেরা খেলোয়াড়

চাওয়ার আসলে শেষ নেই। কোনটা রেখে কোনটা আগে বলি! তবে প্রথমেই বলব, মেয়েদের ঘরোয়া লিগটা যেন পেশাদারভাবে হয়। বড় ক্লাবগুলো যেন এই লিগে আসে। যেমন আবাহনী, মোহামেডান। বসুন্ধরা কিংস ফিরে আসুক, চাইব সেটাও।

বড় ক্লাবগুলো এলে লিগ জমবে। আর লিগ জমা মানে মেয়েরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে। সেটা খুব দরকারও। এ ছাড়া নতুন বছরের কাছে বেশি বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার আশা রাখছে। যত আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পাব ততই নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারব। ফিফা উইন্ডোগুলোয় নিয়মিত ম্যাচ হোক।

এ মুহূর্তে ছুটিতে রাঙামাটি নিজের বাড়িতে আছি। কবে বাফুফে ভবনে আমাদের আবাসিক ক্যাম্প শুরু হবে, ঠিক জানি না। আশা করি, দ্রুতই ক্যাম্প শুরু হবে এবং প্রস্তুতিতে নামতে পারব। নতুন বছরে ব্যক্তিগত লক্ষ্য থাকবে বিদেশি লিগে খেলা।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যেন ভালো খেলে

রাকিবুল হাসান, জাতীয় হকি দলের ফরোয়ার্ড

২০০৪ সালে ওমানে এশিয়ান অনূর্ধ্ব-২১ হকিতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৭ গোল করেছিলাম। টুর্নামেন্টে ৫ম হয়ে প্রথমবার হকির কোনো বিশ্বকাপের টিকিট পেয়েছে বাংলাদেশ। ওমানে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৭ গোল করেছিলাম।

২০২৫ সালের ডিসেম্বরে অনূর্ধ্ব-২১ যুব হকির বিশ্বকাপ হওয়ার কথা ভারতে। তাতে ভালো করার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে আমাদের। সবাই যেন আমাদের সমর্থন করে, পাশে থাকে। নতুন বছরের কাছে এটি আমার অন্যতম বড় চাওয়া।

তা ছাড়া বাংলাদেশে নিয়মিত ঘরোয়া হকি হয় না। ফলে খেলোয়াড়েরা বছরের বেশির ভাগ সময় বসেই থাকে। সেই আক্ষেপ নতুন বছরে দূর হলে খুশি হব। ঘরোয়া লিগ-টুর্নামেন্ট যেন নিয়মিত পাই। নিয়মিত ঘরোয়া খেলার সঙ্গে ব্যক্তিগত একটি চাওয়াও আছে। চোটমুক্ত থেকে নতুন বছরটা খেলতে চাই।

বিদেশে অনুশীলনের একটু আশা

মাহফুজুর রহমান, জাতীয় দলের অ্যাথলেট

২০১৯ সালে কাঠমান্ডুতে এসএ গেমসে হাইজাম্পে রুপা জিতেছিলাম। ২.১৬ মিটার লাফিয়েছিলাম সেবার। সেটাই এখনো বাংলাদেশের জাতীয় রেকর্ড। গত চার বছরে আমি আর রেকর্ড করতে পারিনি। তবে বিদায়ী বছরে এশিয়ান ইনডোরে হাইজাম্পে ব্রোঞ্জ জিতেছিলাম জাতীয় রেকর্ডের খুব কাছে গিয়ে। কিন্তু নেপালে পাওয়া সেই সাফল্যর পর আমি বা আমাদের যদি বিদেশে প্রশিক্ষণে জন্য পাঠাতে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন, তাহলে আরও ভালো কিছু হতে পারত।

নিজের চেষ্টা আর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সহায়তায় যতটা পারছি এগোচ্ছি। নতুন বছরে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন অ্যাথলেটদের বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণের একটুখানি আশা পূরণ করুক। ঘরোয়া অ্যাথলেটিকসে এমনিতেই মাত্র দুটি মিট আমাদের—জাতীয় আর সামার মিট। তাই খেলা বাড়ানোর দাবি থাকবে। খেলোয়াড়দের প্রাইজমানি বাড়ানোর দাবিও রাখছি।

ইলেকট্রনিক স্কোর বোর্ডটা সচল হোক

সামিউল ইসলাম, জাতীয় সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন

মিরপুর জাতীয় সাঁতার কমপ্লেক্সের ইলেকট্রনিক স্কোর বোর্ডটা অচল হয়ে আছে। নতুন বছরে এটিকে সচল দেখতে চাই। ইলেকট্রনিক টাইমিং না হলে আসলে অনেক সমস্যা। আন্তর্জাতিকভাবে হ্যান্ডটাইমিং মূল্যহীন। ফলে ইলেকট্রনিক বোর্ডটা ঠিক করা খুবই জরুরি।

পাশাপাশি জাতীয় দলের ক্যাম্পটা নিয়মিত হোক। ২০২৪ সালে ঘরোয়া সাঁতারে ৮টি সোনা পেয়েছি। তার মধ্যে ৪টি রেকর্ড। চাইব ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে। আগামী সপ্তাহেই আমি উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে থাইল্যান্ড ফিরে যাচ্ছি।

বিদায়ী বছরে হাঙেরিতে বিশ্ব সাঁতারে ৫০ ও ১০০ মিটার ব্যাক স্ট্রোকে ভালো টাইমিং করেছি। অল্পের জন্য বিশ্বসাঁতারে সরাসরি খেলার কোয়ালিফাইং টাইমিংটা করতে পারিনি। সরাসরি বিশ্ব সাঁতারে খেলতে পারলে অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের কোনো সাঁতারুর এই অর্জন নেই আজও। ফলে আমি সরাসরি বিশ্ব সাঁতারে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে চাই।

অলিম্পিকের লক্ষ্যে প্রথম ধাপ ২০২৫

Sha ha tanku

সাগর ইসলাম, প্যারিস অলিম্পিকে খেলা আর্চার

বিদায়ী বছরটা দারুণ কেটেছে আমার। সরাসরি খেলেছি প্যারিস অলিম্পিকে। ২০২৮ লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে খেলতে হলে ২০২৫ সালটা হবে প্রথম ধাপ। সেটি ব্যক্তিগত ও দলীয়—দুই দিক থেকেই। অলিম্পিক গেমসে আর্চারির কোনো দলীয় ইভেন্টে খেলার যোগ্যতা বাংলাদেশ আজও অর্জন করতে পারেনি। ২০২৮-এ সেই অতৃপ্তি ঘোচাতে চাই। আর সে পথে এগোতে ২০২৫ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বকাপ, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপসহ আর্চারির সব টুর্নামেন্টেই খুব ভালো করতে চাই আমরা। এ জন্য ঘরোয়া প্রতিযোগিতাগুলো আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে আশা করি। বিদায়ী বছরে দলীয়ভাবে (রিকার্ভ ইভেন্ট) অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতামান অর্জন করতে না পারায় সবাই হতাশ ছিলাম। কিন্তু এখন সবাই বুঝতে পারছে, ভুলগুলো কোথায় ছিল। ভুল শুধরে সবার চেষ্টা থাকবে পরের অলিম্পিকে ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে টিকিট পেতে।

চেষ্টা করে যাব জিএম হতে

মনন রেজা, বাংলাদেশের জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন

বিদায়ী বছরের অক্টোবরে ফিদে মাস্টার থেকে আন্তর্জাতিক মাস্টার হয়েছি। বছরটা ভালোই কেটেছে আমার। নতুন বছরে গ্র্যান্ডমাস্টার (জিএম) হওয়ার চেষ্টা করে যাব। কিন্তু এক বছরের মধ্যে জিএম হওয়াটা সহজ নয়। তিনটি নর্ম করতে হবে। আর নর্ম করতে খেলতে হবে অনেক আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন সেই ব্যবস্থা করে দেবে, এমনই প্রত্যাশা আমার।

পৃষ্ঠপোষকও লাগবে। বছরটা শেষ করেছি নিউইয়র্কে বিশ্ব র‍্যাপিড ও ব্লিৎজ দাবা। দেশের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছি আজ বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায়। নতুন বছরে চাইব দেশে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট যেন হয়। সব সময় এত খরচ করে বিদেশে গিয়ে খেলা সম্ভব হয় না। এই দিকটার প্রতি দাবা ফেডারেশন নজর দেবে, নতুন বছরে এটাও বড় চাওয়া।