আবাহনী ক্লাব যেন এক ধ্বংসস্তূপ
প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও তাঁর দেশত্যাগের পর দুর্বৃত্তের হামলায় আবাহনী ক্লাব এখন যেন এক বিধ্বস্ত জনপদ। শেখ হাসিনার ভাই ও বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের হাতে গড়া আবাহনীই শুধু নয়, বঙ্গবন্ধুর মেজ ছেলে শেখ জামালের নামে প্রতিষ্ঠিত শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবেও নারকীয় ভাঙচুর হয়েছে। গত সোমবার বিকেলে শেখ পরিবারঘনিষ্ঠ ক্লাব দুটিতে চলেছে ব্যাপক লুটপাটও। আবাহনী ক্লাব ভবনের সামনে থাকা ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের প্রতিকৃতিতে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে।
আবাহনী ক্রীড়া চক্র থেকে আবাহনী লিমিটেড নাম নেওয়া ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির পুরোনো ভবন ভেঙে শেখ কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্সের কাজ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ এগিয়েছে। নির্মীয়মান এই কমপ্লেক্সটি অক্ষত আছে। আক্রমণের হাত থেকে বাঁচানো গেছে খেলোয়াড়দের থাকার ২০ কক্ষের একতলা পুরোনো ভবনটিও। কোনো খেলারই ক্যাম্প চলছে না বলে এটিতে এখন কোনো খেলোয়াড় নেই। তবে অস্থায়ীভাবে তৈরি একতলা ক্লাব ভবনের ভাঙচুর আর লুটপাট রোখা যায়নি।
আজ বুধবার বিকেলে সরেজমিনে আবাহনী ক্লাবে দেখা গেছে, ক্লাব ভবনের ফটকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ক্লাবের শিরোপা জেতার কিছু ছবি, চেয়ার, টেবিল ও আলমারি। সবই বিধ্বস্ত ও ভাঙাচোরা। অফিস ভবনের আটটি কক্ষেই অবাধে ভাঙচুর ও লুটপাট চলেছে। এই কক্ষগুলোয় থাকা কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
ক্লাব ভবনের বিভিন্ন কক্ষে থাকা ১০টি শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র খুলে নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। লুট হয়েছে বিভিন্ন কক্ষে থাকা ১২টি কম্পিউটার, সঙ্গে দুটি ল্যাপটপ। দুর্বৃত্তরা ফ্যান নিয়েছে গোটা দশেক। এ ছাড়া দুটি ওভেন, চারটি প্রিন্টার ও তিনটি স্ক্যানার লুট হয়েছে। ক্রিকেট বল, ব্যাট, জার্সি, হেলমেটসহ সবই নিয়ে গেছে হামলাকারীরা।
স্টোররুমে থাকা খেলোয়াড়দের থাকার গোটা বিশেক লোহার সিঙ্গেল খাট নিয়ে গেছে। ক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ কাগজও রক্ষা পায়নি। কিছু কাগজপত্র এলোমেলা অবস্থায় পড়ে আছে। বোর্ড রুমের চেয়ার, টেবিল, টিভি—কিছুই রাখেনি। প্রধান নির্বাহীর রুমসহ সব কক্ষই তছনছ। ক্লাবের হিসাবরক্ষক জানান, একটি আলমারিতে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা নগদ ছিল। সেই আলমারিটাও নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙা হয়েছে। লাইট পর্যন্ত নিয়ে গেছে খুলে। ওয়াশরুমের কল, বেসিন—এমনকি কমোডও খুলে নিয়েছে লুটপাটকারীরা।
লুটের তালিকা থেকে বাদ যায়নি ক্লাবের ৫২ বছরের ইতিহাসে পাওয়া অমূল্য ট্রফিগুলোও। ক্রিকেট, ফুটবল, হকি ও টেবিল টেনিস পাওয়া চ্যাম্পিয়ন-রানার্সআপ মিলিয়ে দুই থেকে তিন শ ট্রফির সবই লুট হয়েছে। শোকেস পড়ে আছে বিধ্বস্ত অবস্থায়। ক্লাব–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবকিছুই আবার হয়তো নতুন করে কেনা যাবে। কিন্তু ট্রফিগুলোর কোনো বিকল্প নেই। এগুলো লুট হওয়া মানে দেশের খেলাধুলার ইতিহাসই অনেকটা মুছে যাওয়া। আর সেটা ভেবেই লুটপাটকারীদের কাছে ট্রফিগুলো ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন ক্লাব–সংশ্লিষ্টরা।
হামলার সময় ক্লাবে ছিলেন অনুশীলন করতে আসা ফুটবলার রায়হান হাসান, শহিদুল আলম, সাবেক ফুটবলার আলমগীর, আবাহনীর সমর্থক গোষ্ঠীর নেতা আসাদুজ্জামান বাদশা ও ক্রিকেট দলের ম্যানেজার শেখ মামুন। আজ ক্লাব ভবনে পাওয়া গেল প্রথম তিনজনকে। চার বছর আবাহনীতে খেলা জাতীয় দলের সাবেক ডিফেন্ডার রায়হান বলেছেন, ‘সোমবার বিকেল চারটা-সোয়া চারটার দিকে আবাহনী ক্লাবে আসি। এসে গোলকিপার সোহেলের সঙ্গে দেখা। আলমগীর ভাই আর তাঁর ছেলেও বসে ছিল।
এলাকার একদল লোক তখন ক্লাবে আসে হামলা করতে। তাদের বলি, আবাহনী একটি ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। এখানে ভাঙচুর করবেন না। তখন ওরা চলে যায়। কারণ, ওরা আমাদের চেনে। সোহেলকে বেশি চেনে। কিছু সময় পর আবার একদল ক্লাবের গেট ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সব তছনছ করে। বাধা দিলেও শোনেনি।’
গোলকিপার সোহেলের জীবনে ওই সময়টা হয়ে থাকবে দুঃসহ এক স্মৃতি, ‘ওরা লুট করার জন্য এসেছে। অনেককে সামাল দিয়েছি। কিন্তু মানুষ বেশি হওয়ায় পারিনি। যদ্দুর দেখেছি, বস্তির লোকজনই বেশি ছিল। আর এক ঘণ্টা সময় পেলে ইটও খুলে নিয়ে যেত। আমার বিশ্বাস, স্থানীয় লোকজন এসব করেনি। লুটপাট আর হামলা করেছে আসলে ছিনতাইকারী, টোকাইরা। লুটপাটে অনেক মহিলাও এসেছে। মনে হয়েছে, ওরা বাসাবাড়িতে কাজ করে।’
২৪ বছর আবাহনী ফুটবলে দলের কোচিং স্টাফের সঙ্গী মোহাম্মদ নেহালের মন খুব খারাপ। সেদিনের কথা মনে করে ব্যথিত নেহাল বলছিলেন, ‘এসেই ওরা ভাঙচুর, লুটপাট শুরু করে। এটা অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়।’ ক্লাবের ৪০ বছরের পুরোনো কর্মী রফিকুল ইসলাম ওরফে পাখির কণ্ঠে হাহাকার, ‘হামলাকারীরা এসে ক্রিকেটের মামুন ভাইকে গলা টিপে ধরে। ভয়ানক এক অবস্থায় পড়ে যাই আমরা।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও আবাহনী ক্লাবে হামলা হয়েছিল। তবে তার মাত্রা এবারের মতো ব্যাপক ছিল না। এই অবস্থা থেকে আবাহনী কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে কারও জানা নেই। দু–এক দিনের মধ্যে নতুন মৌসুমের জন্য ফুটবলারদের ক্যাম্পে ওঠার কথা ছিল। নতুন স্প্যানিশ কোচের অধীনে অনুশীলন শুরুর কথা ১৫ আগস্ট থেকে। কিন্তু এখন সবই অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে। ক্লাব–সংশ্লিষ্ট সবার চোখেমুখে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। টিকে থাকবে তো আবাহনী, এই প্রশ্নও তুলে দিচ্ছেন কেউ কেউ।