বিপিএলে প্রাপ্তির চেয়ে আক্ষেপই বেশি
বিপিএল ছিল একটা স্বপ্ন। আইপিএলের সমানতালে ক্রিকেট উৎসবে মেতে ওঠার স্বপ্ন। ফ্র্যাঞ্চাইজির মায়াজালে জড়িয়ে বাংলাদেশের ঘরোয়া ড্রেসিংরুমে বিদেশি ক্রিকেটারদের আটপৌরে করে তোলার স্বপ্ন। দেশের ক্রিকেটে মারকাটারি টি–টোয়েন্টির রোমাঞ্চ ছড়ানোর স্বপ্ন। নতুন টি–টোয়েন্টি প্রতিভা আবিষ্কারের স্বপ্ন।
২০১১ সালে শুরু হয়ে আজ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস–সিলেট স্ট্রাইকার্স ফাইনাল দিয়ে শেষ হচ্ছে বিপিএলের নবম আসর। তা নয়টি বসন্ত পার করে কতটা পূরণ হলো শুরুর সেই স্বপ্নগুলো?
এক বাক্যে উত্তর দিলে বলতে হয়, বিপিএল নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলোর বেশির ভাগই এখনো স্বপ্নই থেকে গেছে। বিপিএল হচ্ছে বিপিএলের মতো, যতটুকু না হলেই নয়, ততটুক। স্বপ্ন দেখিয়ে শুরু হওয়া ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টটা উল্টো যেন কখনো কখনো হাহাকারের প্রতিশব্দ। একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি টি–টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে যা যা হবে বলে ভাবা হয়, তা না হওয়ার নামই যেন বিপিএল!
বিসিবি বিপিএলকে আইপিএলের সমান্তরালে নিতে চেয়েছে, পারেনি। বিসিবি বিপিএলকে অর্থবিত্তের ক্রিকেট করতে চেয়েছে, পারেনি। বিসিবি চেয়েছে বিপিএলকে সব ধরনের চাপ ও প্রভাবমুক্ত রাখতে, সেটাও সব সময় পারেনি। বিপিএলকে একটা পেশাদার কাঠামো দেওয়াও সম্ভব হয়নি আজ পর্যন্ত। তবে এসবের দায় বিসিবির যেমন আছে, আছে ফ্র্যাঞ্চাইজিদেরও।
বিপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজিদের মধ্যে একমাত্র কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসই যা একটু পেশাদার। যার পুরস্কার এর আগে তিনবার ফাইনালে উঠে তিনবারই চ্যাম্পিয়ন হওয়া। স্থানীয় ক্রিকেটার ও কোচদের বছরের পর বছর ধরে রাখার চেষ্টা, তরুণ ক্রিকেটার তুলে আনা এবং ভালো বিদেশি ক্রিকেটার এনে শক্তিশালী দল গড়ার প্রবণতা থেকেই বোঝা যায় বিপিএল থেকে তারা ভালো কিছু চায়। রংপুর রাইডার্সও বিপিএলে নিজস্বতা ধরে রাখার কৃতিত্ব পাবে। তাদের তো এখন নিজেদের মাঠও আছে।
এর বাইরে অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিরা যেন ঠিক ফ্র্যাঞ্চাইজি হয়ে উঠতে পারেনি এখনো। যার যার দলের পৃষ্ঠপোষক মাত্র। বিপিএলের সঙ্গে মাত্র এক–দুই মৌসুমের সম্পর্কের এসব ফ্র্যাঞ্চাইজির কোনো কোনোটার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ধারণাটাই মেলে না। কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজির কর্মকাণ্ড বেশ সন্দেহজনকও।
এখানে বিসিবিও দায় এড়াতে পারে না। ফ্র্যাঞ্চাইজি কেনার ক্রেতা পাওয়া যায় না বলেই হয়তো নিয়ন্ত্রণের রশিটা একটু আলগা করে রাখতে হয়। তবে আশার কথা, এবারের বিপিএলে কিছু ব্যতিক্রম দেখা গেছে। লিগের মাঝপথে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির ফিকশ্চার পরিবর্তনের চাপে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল নতিস্বীকার করেনি। খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক সময়মতো পরিশোধের চাপ দিয়েছে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে, যাতে কিছুটা কাজও হয়েছে।
ফ্র্যাঞ্চাইজিরা পাল্টা বলতে পারে—বিপিএল খেলে তাদের আর্থিক লাভ কী? ভালো পৃষ্ঠপোষকের অভাব, তাই চাইলেও ভালো খেলোয়াড় এনে বড় দল গড়া যায় না। বিসিবিও বিপিএলের রাজস্বের ভাগ ফ্র্যাঞ্চাইজিদের দেয় না। তাহলে কেন খামাখা এর পেছনে পয়সা খরচ করা!
কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। বিপিএল থেকে বিসিবি, ফ্র্যাঞ্চাইজি, ক্রিকেটার এবং দেশের ক্রিকেট—লাভবান হতে হবে সবাইকেই। অথচ প্রতিবছরই বিপিএলের সময় যত ঘনিয়ে আসে, শুধু নেই আর নেই–ই শোনা যায়। বিসিবি–ফ্র্যাঞ্চাইজি–ক্রিকেটার ত্রিমুখী অভিযোগ আর সমালোচনার মধ্য দিয়েই এগোতে থাকে টুর্নামেন্ট। একসময় সেটা শেষও হয়ে যায় এবং সবাই ভুলে যায় এর ফাঁকফোকরগুলো। পরেরবার তাই আবার ঠিক সেসব অপূর্ণতা নিয়েই শুরু হয় বিপিএল।
বিপিএলের শুরুতে ডিআরএস না থাকাটা যেমন এখন নিয়মিত। এবার তো নতুন বিতর্ক হিসেবে যোগ হয়েছে টেলিভিশন ও অনলাইন সম্প্রচারে বেটিং–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে সমালোচনা হওয়ার পর সম্প্রচারকারীদের কঠোরভাবে চুক্তির শর্ত মনে করিয়ে দিয়ে অন্তত দেশের টেলিভিশন পর্দায় সেটা বন্ধ করতে পেরেছে বিসিবি।
কিন্তু আইএল টি–টোয়েন্টি ও এসএ টোয়েন্টির আবির্ভাব বিপিএলকে যে নতুন চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলছে, তার পরিণতি ভবিষ্যতে কী হবে, কে জানে। বিপিএল বছরের কোন সময়ে হবে, এমনিতেই ঠিকঠিকানা থাকে না। এই দুই টুর্নামেন্ট এখন সেই পরিস্থিতি আরও অনিশ্চিত করে তুলতে পারে। বিদেশি ক্রিকেটারদেরও নিশ্চিত বাংলাদেশের চেয়ে দুবাই–দক্ষিণ আফ্রিকাই বেশি টানবে।
তারকাদ্যুতি ছড়ানো বিদেশি ক্রিকেটারই যদি না আসেন, ফ্র্যাঞ্চাইজি টি–টোয়েন্টির তবে আর কিসের আকর্ষণ! ড্রেসিংরুমে টি–টোয়েন্টির বিশেষজ্ঞ থাকলেই না তাঁদের দেখে শিখবে নতুন প্রতিভারা। এই ‘নেই’–এর লম্বা তালিকা মানেই তো স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার দীর্ঘশ্বাস। ১১ বছর পেরিয়েও বিপিএল তাই যত না প্রাপ্তির, তার চেয়ে বেশি আক্ষেপের নাম।