ফুটবল নিয়ে ভাবেন না অভিমানী রকিব

রকিব হোসেন
রকিব হোসেন

তিনি বড় অভিমানী। কিছুটা একরোখাও। বেচাল একেবারেই পছন্দ করেন না। একসময় দেশের অন্যতম সেরা ফুটবলার ছিলেন। জাতীয় দলে লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করেছেন দীর্ঘ দিন। কিন্তু অভিমানে বিমূঢ় হয়ে তিনি এখন ফুটবল থেকে অনেক দূরে। খোঁজ রাখেন না একটা সময় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে যাওয়া দেশের ফুটবলের। অভিমানই তাঁকে দেশছাড়া করেছে। হাজার মাইল দূরের দেশ কানাডায় তিনি বেছে নিয়েছেন নিভৃত জীবন। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে তিনি এখন এমন এক জগতের বাসিন্দা, যেখানে ফুটবল ও ফুটবল-চিন্তা ছাপিয়ে জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজনের ব্যাপারগুলো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
রকিব হোসেনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। নব্বইয়ের দশকে দেশের ফুটবলাঙ্গনে যে কজন ‘প্লে-মেকার’ নিজেদের তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, রকিব তাঁদেরই একজন। খেলোয়াড়ি জীবনে আবাহনী, মোহামেডান, ব্রাদার্স, মুক্তিযোদ্ধা—দেশের সব বড় দলেই ছিল তাঁর দৃপ্ত পদচারণ। দুর্দান্ত পায়ের কাজ আর প্রতিভাময় দীপ্তি দিয়ে তিনি খুব অল্প দিনের মধ্যেই জয় করেছিলেন দেশের ফুটবলপ্রেমীদের হূদয়।প্রথম আলো ডটকমের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতা হলো ফোনে। দেশ ছেড়ে কানাডাপ্রবাসী হওয়ার নেপথ্য কারণ হিসেবে জানালেন ফুটবলের প্রতি তাঁর প্রচণ্ড অভিমানের কথা, ‘খেলোয়াড়ি জীবনের একেবারে শেষলগ্নে এসে এত নোংরা রাজনীতির শিকার হলাম যে দেশে থাকার আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছিলাম।’
একটি টেলিভিশন সাক্ষাত্কার ছিল তাঁর দেশছাড়ার নেপথ্যে। দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাত্কার দিয়ে তিনি ফাঁস করে দিয়েছিলেন দেশের বড় ক্লাবগুলোর খেলোয়াড়দের আর্থিক দিক দিয়ে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত করার ব্যাপারটি। টেলিভিশনে দেওয়া ওই সাক্ষাত্কারটি ভালোভাবে নেননি দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ক্লাবের কর্মকর্তা ও সমর্থকেরা। নানামুখী চাপে শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে কানাডাপ্রবাসী হওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন রকিব।

কানাডায় প্রবাস জীবনে থিতু হয়ে গেছেন রকিব। ব্যাপারটি নিয়ে আর ভাবতে চান না তিনি। দেশে সবাই থাকতে চায়, তাঁর মতো খেলোয়াড়ের দেশে থেকেই জীবন ভালোভাবে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার সব ধরনের সুবিধাই ছিল। কিন্তু তার পরও ফুটবলাঙ্গনের অযাচিত চাপ মানসিকভাবে তাঁকে ওই সময় বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল বলেই জানালেন তিনি, ‘বিদেশে আসার ভাবনা আমার ছিল না। তার পরও চলে এসেছি। একটা সময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এজন্য এখন আর কাউকেই দায়ী করি না। প্রবাসজীবন আমার ভাগ্যেই ছিল। আমি এখন ভালোই আছি।’

খেলোয়াড়ি জীবনে বরাবরই এক কথার মানুষ ছিলেন তিনি। কারও দয়ায় তিনি খেলোয়াড় হননি। শরীয়তপুর থেকে এসে নিজের যোগ্যতায়ই জায়গা করে নিয়েছিলেন ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কিন্তু খেলোয়াড়ি জীবনে অনেকবারই নানামুখী নোংরামির শিকার হয়েছেন। টাকা-পয়সার হিসাবে অনেকবারই ক্লাবের কর্তারা ঠকিয়েছেন তাঁকে। সব মিলিয়ে দেশের ফুটবলের প্রতি রকিব যে অনেকটা বীতশ্রদ্ধ, সেটা বোঝা গেল বেশ ভালোভাবেই।

রকিবের ফুটবলার হওয়ার শুরুর গল্পটাও বেশ চমকপ্রদ। ১৯৮৫ সালে শরীয়তপুর থেকে ঢাকায় এসে উঠেছিলেন বড় বোনের লালমাটিয়ার বাসায়। গ্রামের বাড়িতে সারা দিন মেতে থাকতেন ফুটবল নিয়ে, ঢাকা এসে সময় কাটত না তাঁর। প্রতিদিনই হেঁটে চলে যেতেন লালমাটিয়ার কাছেই আবাহনী মাঠে। দেশের সেরা ফুটবলারদের অনুশীলন দেখতেন। দেখতে দেখতে মনের গহিনে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নের বীজটা বুনে দিয়েছিলেন বেশ যত্নের সঙ্গেই।

আবাহনী মাঠে বরাবরের মতো তখনো ছিল কিশোর খেলোয়াড়দের পদচারণ। রকিবের সমবয়সীরা দল বেঁধে মেতে থাকত ফুটবল নিয়ে। একদিন এমনই একটা খেলা চলাকালীন রকিব এগিয়ে গেলেন আরেক কিশোরের দিকে। গিয়ে জানালেন, তিনি খেলতে চান। কিশোরটিও সানন্দে তাঁকে গ্রহণ করল। তিনি আবার মিশে গেলেন ফুটবলের সঙ্গে।

ওই কিশোরটি ছিলেন জুয়েল রানা। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক। জুয়েল তখন তৃতীয় বিভাগে খেলতেন। একই মাঠে খেলতেন জাতীয় দলের আরেক সাবেক ফুটবলার সাইফুল বারী টিটুও। খেলতে খেলতে তাঁদের মধ্যে হয়ে গেল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। রাস্তা খুলে গেল রকিবের ফুটবলার হয়ে ওঠার স্বপ্ন পূরণের।

পাইওনিয়ার, দ্বিতীয় বিভাগ ইত্যাদি খেলে রকিব প্রথম বিভাগে সুযোগ পান ১৯৯০ সালে। পিডব্লিউডি ক্লাবে। ক্লাবটি তখন তরুণ উদীয়মান ফুটবলারদের চারণক্ষেত্র। কোচ ছিলেন শ্রীলঙ্কান পাকির আলী। গাউস, স্বপন, শাহ আলমসহ অনেক নবীন প্রতিভার সঙ্গে লড়াই করেই রকিবকে জায়গা করে নিতে হয়েছিল ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে।

সুতীব্র সেই প্রতিযোগিতা তাঁর জীবনে কাজে এসেছে বলেই মনে করেন রকিব, ‘খেলোয়াড়ি জীবনের একেবারে শুরুতে পাকির আলীকে কোচ হিসেবে পেয়েছিলাম। অনেক ভালো খেলোয়াড়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে। ব্যাপারটি আমার জন্য দারুণ উপকারী প্রমাণিত হয়।’

১৯৯০ মৌসুমের দিকে বিদেশি খেলোয়াড় বন্ধ করে প্রতিটি দলের জন্যই দুজন করে তরুণ খেলোয়াড়কে প্রথম একাদশে খেলানোর ব্যাপারটি বাধ্যতামূলক করে বাফুফে। রকিব ওই পদ্ধতিরই আবিষ্কার। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

খুব অল্প দিনের মধ্যেই জাতীয় দলের দরজা খুলে গেল রকিবের সামনে। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপে তিনি বাংলাদেশ সবুজ দলে সুযোগ পেলেন। এরপর একই বছর জাতীয় দলের হয়ে খেলতে গেলেন জাপান ও আমিরাতে, বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইপর্বে।

১৯৯৩ সালে যোগ দেন ব্রাদার্সে। বড় দলে সুযোগ পেয়েই নিজেকে প্রমাণ করেন তিনি। এগিয়ে চলে রকিবের বড় ফুটবলার হয়ে ওঠার লড়াই। সেই লড়াই তাঁকে দিয়েছে এক সমৃদ্ধ ক্যারিয়ার।

অনেক খেলোয়াড়ের মতোই রকিবের আক্ষেপ জাতীয় দলের হয়ে বড় সাফল্যের ভাগীদার হতে না পারা, ‘জাতীয় দলে অনেক দিন খেলেছি। কিন্তু দেশকে বড় কিছু উপহার দিতে পারিনি। এটা নিয়ে আক্ষেপ তো হয়ই।’

পুরো ক্যারিয়ারে চারজন বিদেশি কোচের অধীনে খেলেছেন রকিব—ওল্ডরিখ সোয়াব, ম্যান ইয়ং ক্যাং, অটো ফিস্টার ও সামির শাকির। এই চার কোচের অধীনে ফুটবলের অনেক কিছুই শিখেছেন তিনি। তবে তাঁদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে ভালো কোচ মনে করেন সুইজারল্যান্ডের ওল্ডরিখ সোয়াবকেই।

‘জাতীয় দলের বেস্ট ইলেভেনে আমাকে প্রথম খেলিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের কোচ সোয়াবই। তিনি ছিলেন ভিন্ন প্রকৃতির কোচ। মাত্র একটি প্রতিযোগিতা, ১৯৯৩ সালের সাফ গেমসে তিনি জাতীয় দলকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা সেবারই সাফে সবচেয়ে বাজে ফল করেছিলাম। সোয়াবকেও চলে যেতে হয়েছিল সেই দায় মাথায় নিয়েই।’ প্রিয় গুরু সম্পর্কে বললেন রকিব।

সোয়াবকে ফুটবল কোচের চেয়ে ‘শিক্ষাগুরু’ই বেশি মনে হতো রকিবের, ‘তিনি আমাদের সঙ্গে ফুটবলের বাইরে জীবনবোধ নিয়েও কথা বলতেন। তাঁকে শিক্ষকের মতো মনে হতো আমাদের। নিয়মানুবর্তিতার ওপর খুব জোর দিতেন। এর বাইরে ক্যাম্পে খেলোয়াড়দের থাকা-খাওয়ার বিষয়ে মাথা ঘামাতেন। ফুটবলটাও তিনি অসাধারণ বোঝাতেন। একেবারে হাতে-কলমে। বাংলাদেশে এযাবত্কালে আসা কোচদের মধ্যে সেরা বেছে নিতে বললে বেশির ভাগই অটো ফিস্টারকে বেছে নেবেন। তবে আমি বেছে নেব সোয়াবকে। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা তাঁর সেবা বেশিদিন পাইনি।’

জাতীয় দলের হয়ে রকিবের সেরা ম্যাচ ১৯৯৫ সালে। মিয়ানমারে চার জাতি ফুটবলের ফাইনালে মিয়ানমারের বিপক্ষে তাঁর দেওয়া পাসেই দুটি গোল পেয়েছিল বাংলাদেশ। গোল করেছিলেন মামুন জোয়ারদার ও ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব।

১৯৯৩ সালের সাফ গেমসে গ্রুপ পর্যায়ে মালদ্বীপের বিপক্ষে ম্যাচটি কোনো দিন ভুলবেন না রকিব। মিয়ানমারের বিপক্ষে চার জাতি ফুটবলের ফাইনাল যেমন কোনো দিন ভুলবেন না, ঠিক তেমনি মালদ্বীপের বিপক্ষে ওই খেলাটিও ভুলবেন না। ভুলবেন না দুর্ভাগ্যের কারণে, ‘বিশ্বাস করুন, ওই দিন যে দুর্ভাগ্যের শিকার আমরা হয়েছিলাম, অমন দুর্ভাগ্যের শিকার হতে আমি কোনো দিন কোনো দলকে দেখিনি।’

মালদ্বীপের বিপক্ষে ঢাকার ওই খেলাটি গোলশূন্যভাবে শেষ হয়েছিল। অনেকের মতে, বাংলাদেশের ফুটবলের পতন শুরু হয়েছিল ওই খেলাটি থেকেই, ‘আমরা ওই ম্যাচে কমপক্ষে সাত-আট গোলে জিততে পারতাম। আমি ওপেন নেট মিস করেছিলাম। কায়সার ভাই পেনাল্টি মিস করেছিল। ম্যাচ শেষে মালদ্বীপের হাঙ্গেরীয় কোচও বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যের বিষয়টি স্বীকার করেছিলেন। খেলাটি আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে চিরদিন।’

দেশের ফুটবলের সঙ্গে বর্তমানে তেমন সম্পর্কযুক্ত নন রকিব। এখনকার বেশির ভাগ ফুটবলারকেই তিনি চেনেন না। তবে সামগ্রিকভাবে তাঁর উপলব্ধি, এখন ব্যক্তিগত স্কিল-নির্ভর ফুটবলার নেই। আর সে কারণেই দর্শকেরা ফুটবল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

ফুটবলের আগের জনপ্রিয়তা কোনোভাবেই ফেরানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন রকিব, ‘এটা সম্ভব নয়। যেটা গেছে, সেটা গেছে। যখন সময় ছিল, তখন বিষয়টা নিয়ে কাজ করা হয়নি। বৃহত্ কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। জাতীয় দলকে নামকাওয়াস্তে বিদেশে খেলতে পাঠানো হয়েছে। সে কারণে প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও আমাদের ফুটবল তখন সাফল্য পায়নি।’

ক্রিকেটকেও ফুটবলের বর্তমান অবস্থার অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করে তিনি, ‘ক্রিকেট তো অন্য লেভেলে চলে গেছে। ফুটবলে আমরা এশীয় পর্যায়েও নেই। ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলে, টেস্ট খেলে, ক্রিকেটের আবেদনটাই অন্যরকম। ফুটবলের তো কোনো সাফল্য নেই। ভালো খেলোয়াড় নেই। আপনি দর্শককে ফুটবলমুখী করবেন কীভাবে।’

এই মুহূর্তে ফুটবলে একটি আন্তর্জাতিক সাফল্য খুবই প্রয়োজন বলে মনে করেন রকিব, ‘জাতীয় দলকে নিয়ে কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সফল হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। বয়সভিত্তিক দলগুলোকে গড়ে তুলতে হবে। এসব নিয়ে সালাউদ্দিন ভাই যত্নবান। তিনি চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁর আশেপাশে থাকা লোকগুলো তাঁকে কতটুকু সাহায্য করছে, সেটা নিয়েই আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’