ফুটবলের 'ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর'
সবুজ মাঠের চৌহদ্দিতে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা বিলীন করে দেওয়া খেলার জগতের মানুষ কি সরকার উত্খাত করতে পারে? আজ থেকে ৩১ বছর আগে, বাংলাদেশের শীর্ষ চার ফুটবল তারকার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগই আনা হয়েছিল। সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট তিন দশক আগে হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি পরে জেলহাজতে যেতে হয়েছিল দেশের চার তারকা ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিন, আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, গোলাম রব্বানী হেলাল আর কাজী আনোয়ারকে। আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথে রেফারির একটি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ থেকে সৃষ্ট গোলযোগের সম্পূর্ণ দায়ভার এই চার খেলোয়াড়ের ঘাড়ে দিয়ে সামরিক আদালত সংক্ষিপ্ত বিচারের আনুষ্ঠানিকতা সেরে তাঁদের দণ্ডিত করেছেন বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডে। তাঁদের বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগপত্রে লেখা হয়েছিল, তাঁরা নাকি সামরিক সরকারকে উত্খাতের প্রাথমিক ষড়যন্ত্র করেছেন! বাংলাদেশের ফুটবল তো বটেই, জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি পরিয়ে আটকের ঘটনা বিশ্ব ফুটবলেও এক ন্যক্কারজনক ঘটনা হিসেবে অভিহিত হয়ে আছে।
নিরন্তর লজ্জার এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বর মাস। দেশে তখন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসন সবে ছয় মাস অতিক্রম করেছে। গোটা দেশই তখন পরিণত হয়েছে সুবিশাল এক কারাগারে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত বসিয়ে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী আর বিভিন্ন পেশার মানুষের দোষ-গুণ খোঁজা শুরু হয়। বিভিন্ন অভিযোগে সামরিক আইনের অধীনেই তাঁদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করা হয় বিভিন্ন মেয়াদি কারাদণ্ডের নির্দেশনা। শ্বাসরুদ্ধকর এই পরিস্থিতির শিকার যে ওই সময়কার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলোয়াড়েরাও হবেন, সেটা কিন্তু ছিল কল্পনারও অতীত।
সামরিক শাসনের অধীনে দেশের খেলাধুলা থেমে ছিল না। পূর্ণোদ্যমেই এগিয়ে চলছিল সিনিয়ন ডিভিশন ফুটবল লিগ। সত্তর-আশির দশকে বাংলাদেশের ফুটবলের সঙ্গে যাঁদের সখ্য ছিল, যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন ওই সময়ের ফুটবল উন্মাদনা, তাঁদের পক্ষেই কেবল অনুধাবন করা সম্ভব ওই সময়টাকে।
যা-ই হোক, লিগের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী ও মোহামেডান। দেশের সেরা ফুটবলাররাও একই সঙ্গে মুখোমুখি নিজেদের ক্রীড়াশৈলী উজাড় করে দিয়ে নিজ নিজ দলকে শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে জায়গা করে দিতে। পুরো দেশ বিভক্ত দুই শিবিরে। ঢাকা স্টেডিয়াম পরিপূর্ণ কানায় কানায়। রেডিওতে কান রেখে, টেলিভিশনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দেশের মানুষ ব্যাকুল প্রিয় দলের সাফল্যের সঙ্গী হতে। টান টান উত্তেজনার এই ম্যাচের একপর্যায়ে মোহামেডান এগিয়ে গেল এক গোলে। আবাহনীর খেলোয়াড়েরা তখন মরিয়া নীল-হলুদ জার্সির মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে। এমনই একটি পরিস্থিতিতে ঢাকা স্টেডিয়ামে ঘটে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা। আবাহনীর অধিনায়ক কাজী আনোয়ারের একটি ক্রস বাঁক খেয়ে গোলে প্রবেশের মুখে তা রুখে দেন মোহামেডানের তরুণ গোলরক্ষক মোহাম্মদ মহসীন। মহসীন ওই ম্যাচে দেশের ফুটবলের মহাতারকা কাজী সালাউদ্দিনের পেনাল্টি ঠেকিয়ে দারুণ উজ্জীবিত। মহসীন আনোয়ারের ক্রসটি ফিরিয়ে দিলেও তা মুহূর্তের জন্য গোললাইন স্পর্শ করেছিল। আবাহনীর খেলোয়াড়েরা মরিয়া হয়ে দাবি জানাতে থাকেন গোলের। কিন্তু রেফারি মুনীর হোসেন আর লাইন্সম্যান অনড় থাকেন তাঁদের সিদ্ধান্তে। খেলায় সৃষ্টি হয় নিদারুণ অচলাবস্থার। মাঠের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গ্যালারিতে। কাঁদানে গ্যাস ছোড়া শুরু করে পুলিশ সংঘর্ষরত সাপে-নেউলে আবাহনী আর মোহামেডান-সমর্থকদের ছত্রভঙ্গ করতে।উত্তেজিত সমর্থকেরা স্টেডিয়ামের বাইরে পল্টন-জিপিও, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, বিজয়নগর প্রভৃতি এলাকায়ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। অগ্নস্ফুিলিঙ্গের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সেই সন্ধ্যার ঢাকা। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজালো গন্ধে ঢেকে যায় ঢাকার আকাশ-বাতাস। বলাবাহুল্য, খেলাটি আর সমাপ্তির মুখ দেখেনি। লিগের আইন অনুযায়ী মোহামেডানকে ওই ম্যাচে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় ২-০ গোলে।
খেলার মাঠে সংঘর্ষ নতুন কোনো ঘটনা নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময় খেলাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, আবাহনী-মোহামেডানের ম্যাচের গোলযোগকে কেন্দ্র করে ৩১ বছর আগে এই বাংলাদেশে যা ঘটেছিল, তা ইতিহাসের এক বিরল ঘটনা।
মাঠের গোলযোগ একটু কমলে খেলোয়াড়েরা ফিরে যান যাঁর যাঁর অবস্থানে। ওই সময় স্টেডিয়ামসংলগ্ন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ভবনে ছিল জাতীয় ফুটবল দলের ক্যাম্প। লিগের ফাঁক-ফোকরে জাতীয় দলে ডাক পাওয়া ফুটবলাররা ক্যাম্পে অবস্থান করে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন দিল্লি এশিয়ান গেমসের। আবাহনী-মোহামেডানের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় ছিলেন জাতীয় দলের ক্যাম্পে। সেদিন মাঠে উপস্থিত কয়েকজন খেলোয়াড়ই ক্যাম্পে গিয়ে গা এলিয়ে দেন বিছানায়। অনেকেই চলে যান যাঁর যাঁর বাড়িতে। কেউ কেউ চলে যান নিজ ক্লাবে। কিন্তু তাঁরা তখনো জানতেন না, কী ভয়ংকর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে তাঁদের সামনে।
রাত গভীর হলে সেনাবাহিনী, বিডিআর আর পুলিশের একটি যৌথবাহিনী অভিযান চালায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জাতীয় দলের ক্যাম্পে। তাঁদের আরও একটি দল অভিযান চালায় ধানমন্ডির আবাহনী ক্লাবে। কাজী সালাউদ্দিনকে ধরতে যৌথবাহিনী অভিযান চালায় তাঁর গুলশানের বাড়িতে।
গোলাম রব্বানী হেলালসহ আবাহনীর প্রায় বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে আটক করা হয় আবাহনী ক্লাব থেকে। জাতীয় দলের ক্যাম্প থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় কাজী আনোয়ার আর আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নুকে। আগেই বলা হয়েছে, সালাউদ্দিনকে আটক করা হয় তাঁর গুলশানের বাসা থেকে।
প্রথম আলো ডটকমের কাছে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন গোলাম রব্বানী হেলাল। আবাহনী ক্লাবে খেলোয়াড়দের গ্রেপ্তার করতে যৌথবাহিনী ছিল রীতিমতো যুদ্ধসাজে, ‘আমি খেলার পর আবাহনী ক্লাবে ফিরে নিজের ঘরে শুয়ে ছিলাম। শরীরে বড় ম্যাচের ক্লান্তি। মনটাও খারাপ। গোলযোগের কারণে খেলা পণ্ড হয়ে যাওয়ায় লিগে আবাহনীর ভবিষ্যত্ নিয়ে ভাবছিলাম। হঠাত্ ক্লাবের আশপাশে বেশ কয়েকটা সামরিক ট্রাক, জিপ ইত্যাদির আওয়াজ শুনতে পাই। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, এলাহী অবস্থা! ক্লাবের চারপাশ পুলিশ আর সেনাসদস্যরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। তাঁরা এমন একটা ভাব করছিলেন, যেন ভয়ংকর কোনো অপরাধীকে ধরতে এসেছেন। তাঁরা যে আমাদেরই ধরতে এসেছেন, এটা বুঝতে অনেকটা সময় লেগেছিল। সেদিন রাতে আমিসহ আবাহনীর খেলোয়াড়দের নিয়ে যাওয়া হয় রমনা থানায়।’
পরদিন সকালে তাঁদের শাহবাগ পুলিশ নিয়ন্ত্রণকক্ষে এনে জড়ো করা হয়। হেলাল জানান, পুরো সময়টাতেই খেলোয়াড়দের হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি পরানো ছিল। আবাহনীতে ওই সময় খেলতেন দুই শ্রীলঙ্কান ফুটবলার—অশোকা রবীন্দ্র আর পাকির আলী। যৌথবাহিনীর হাতে নাকাল হতে হয় তাঁদেরও। শাহবাগ পুলিশ নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকেই সালাউদ্দিন, আনোয়ার, হেলাল ও চুন্নুকে আলাদা করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। শুরু হয় তাঁদের জেলজীবন।
সামরিক আদালতের বিচারে সালাউদ্দিন ও চুন্নুকে তিন মাসের জেল দেওয়া হয়। হেলালকে ছয় মাস আর কাজী আনোয়ারকে দেওয়া হয় এক বছরের কারাদণ্ড। ঢাকার বাইরে জেল খাটতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেশের এই শীর্ষ ফুটবলারদের।
হেলাল বলেন, ‘সামরিক আদালতে আমাদের বিরুদ্ধে যে রায় দেওয়া হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল, আমরা নাকি সামরিক সরকার উত্খাতের প্রথম ষড়যন্ত্রকারী। কী হাস্যকর অভিযোগ, ভেবে দেখুন।’
ওই সময় খেলোয়াড়দের মনের অবস্থা কী ছিল, সেটা নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই। হেলাল বলেন, ‘ওপর দিয়ে হাসি-খুশি থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ভেতর দিয়ে আমরা সবাই একেবারেই ভেঙে পড়েছিলাম। সালাউদ্দিন ভাই খুব বড় ঘরের ছেলে। তাঁর মতো মানুষকে থানায় সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে থাকতে হয়েছে। আনোয়ার, চুন্নু, আমি—কেউই এ ধরনের কষ্টকর জীবনে অভ্যস্ত ছিলাম না। সবচেয়ে অবাক লাগত যা, তা হলো, আমাদের বিরুদ্ধে সরকার উত্খাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছিল। আমরা সবাই ফুটবল নিয়েই থাকতাম। সারাক্ষণ ওটা নিয়েই ভাবতাম। আমরা কী করে সরকার উত্খাতের ষড়যন্ত্র করি!’
আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও হেলাল ওই সময়ের কথা ভেবে শিউরে ওঠেন, ‘দেশের হয়ে খেলার পুরস্কার পেয়েছি জেলে গিয়ে। সারা বিশ্বে ফুটবল ম্যাচে গোলযোগ খুব সাধারণ ঘটনা। কিন্তু গোলযোগের কারণে ফুটবলারদের হাতে হাতকড়া পড়েছে, এমন নজির বোধ হয় কোথাও নেই। সত্যিই আমরা এ ব্যাপারে ফুটবলবিশ্বে সবার চেয়ে এগিয়ে।’
কিছুদিন জেল খেটে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল এরশাদের নির্দেশে মুক্তি পান চার ফুটবলার। জেল থেকে বেরিয়ে কাজী সালাউদ্দিন নাকি অভিমানে নষ্ট করে ফেলেছিলেন তাঁর দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সব স্মারক। তিনি নাকি পুড়িয়ে ফেলেছিলেন তাঁর সংগ্রহে থাকা জাতীয় দলের সব জার্সি।
চার ফুটবলারের জেল কি ঠেকাতে পেরেছিল খেলার মাঠের গোলযোগ? ১৯৮২ সালের ওই ঘটনার পরও ঢাকার ফুটবল মাঠ অনেকবারই সাক্ষী হয়েছে বিভিন্ন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের। আবাহনী-মোহামেডানের খেলায় উত্তেজনায়-আক্রোশে প্রাণও দিয়েছেন অনেকে। এরপর কাউকে তো জেলে যেতে হয়নি। অপরাধীর মতো কারও হাতে হাতকড়া কিংবা পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরতে হয়নি। সব সম্ভবের দেশ এই বাংলাদেশে ওই চার ফুটবলার যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, সেটা আজ এত বছর পরও লজ্জা দিয়ে যায় আমাদের সবাইকে।
১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরকে তাই ফুটবলের ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ হিসেবে অভিহিত করাই যায়!