এই রুমি, সেই রুমি

রিজভী করিম রুমি
রিজভী করিম রুমি

রিজভী করিম রুমি। এ দেশের ফুটবলে তারকাদ্যুতিতে ঝলমলে এক নাম। আশির দশকের শেষ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ফুটবলে সত্যিকারের এক বরপুত্র। ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে বল নিয়ে রুমি যখন এগিয়ে যেতেন, তা ছিল দেখার মতো এক দৃশ্য। তাঁর পায়ের কাজ আর গোল করার অনন্যক্ষমতা আজও ফুটবলপ্রেমীদের স্মৃতিকাতর করে তোলে। মাঠে ২২ জন ফুটবলারের ভিড়ে আলাদা করে চেনা যায়, এমনই একজন খেলোয়াড় ছিলেন রুমি। আবাহনীর হয়ে দীর্ঘদিন দাপটের সঙ্গে খেলেছেন, খেলেছেন মুক্তিযোদ্ধায়। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অন্যতম নির্ভরতার প্রতীক কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই এক সময় নিজেকে ফুটবল থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বর্তমানে সুদূর কানাডায় প্রবাস জীবন-যাপনরত রুমি কথা বলেছেন প্রথম আলো ডটকমের সঙ্গে। দীর্ঘদিন পর দেশের কোনো সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি ফিরে গেছেন অতীতের স্মৃতিময় সময়ে। সেই সঙ্গে আলোকপাত করেছেন বর্তমান নিয়েও। দেশের ফুটবলের করুণ অবস্থা রুমিকে দুঃখিত করলেও তিনি এ ব্যাপারে যথেষ্ট বাস্তববাদী। তিনি মনে করেন, এ দেশের ফুটবলকে অতীতের জনপ্রিয়তার আসনে পুনরায় বসানো যে কারও জন্যই সত্যিকারের এক চ্যালেঞ্জ। তবে এ দেশের ফুটবলের কর্তা-ব্যক্তিদের কয়েকটি সিদ্ধান্ত এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দিনের পর দিন ব্যর্থতাই বাংলাদেশের ফুটবলকে ‘শেষ’ করে দিয়েছে বলে অভিমত তাঁর।
রুমি নিজেকে এ দেশের ফুটবলের অধঃপতনের সাক্ষীই মনে করেন, ‘চোখের সামনেই ফুটবলের জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকতে দেখলাম। খেলতে খেলতেই দেখলাম এ দেশের ফুটবল আর আগের জায়গায় নেই।’

ক্যারিয়ারের শুরুটা তাঁর হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। প্রথমে সাধারণ বীমা, এরপর বিআরটিসি। বাংলাদেশের ফুটবলে এই দুটি অফিস-দলের অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৯৮৮ সালে বিআরটিসির খেলোয়াড় থাকতেই বিশেষ ব্যবস্থায় নাম লিখিয়েছিলেন দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ক্লাব আবাহনীতে। ধানমন্ডির ক্লাবটিতে এসেই যেন রুমি নিজেকে চেনান। দেশের ফুটবল যেন আবাহনীর কাছ থেকেই সন্ধান পায় এক রত্নের। কোনো বয়সভিত্তিক দলে খেলার ‘সৌভাগ্য’ রুমির হয়নি। সরাসরিই খেলেছেন জাতীয় দলে। ১৯৮৮ সালে আবুধাবিতে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশের জার্সি প্রথম গায়ে তোলেন তিনি। প্রতিপক্ষ ছিল আমিরাত, চীন, ইয়েমেন, থাইল্যান্ড ও ভারত। এরপর টানা জাতীয় দলে খেলেছেন ১৯৯৪ পর্যন্ত। চোট-টোট বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা আর দীর্ঘায়িত করতে পারেননি। ধীরে ধীরে গোটা ফুটবল ক্যারিয়ারটাই গুটিয়ে নেন তিনি। নব্বইয়ের দশকের অনেক ফুটবলপ্রেমীই বলতে পারবেন না রুমি তাঁর শেষ ম্যাচটি কবে খেলেছিলেন। রুমির নিজের হিসাবে তাঁর শেষ অবশ্য ১৯৯৮ সালে। এরপর খুব সন্তর্পণেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে রুমি পাড়ি দেন দূরদেশ কানাডায়। ১৬ বছরের প্রবাসজীবন তাঁর। স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে ওখানেই থিতু তিনি। এককালের মাঠের ক্যারিশমাটিক রুমি এখন পুরোদস্তুর চাকুরে। প্রবাসী চাকুরেদের মতোই ব্যস্ত জীবন তাঁর। শনি-রোববার হাত-পাঝাড়া। পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে দেন এই দুটি দিন। টরন্টোর তুষার-শুত্র আকাশের দিকে চেয়ে হাতড়ে বেড়ান পুরোনো স্মৃতিগুলো। মনে করেন ওই সময়গুলোর কথা, যখন তাঁর পায়ে বল এলেই হুংকার উঠত স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে। ফুটবল যখন উত্তেজনায় কাঁপাত দেশের প্রতিটি মানুষকে।

‘ওই দিনগুলো কেবলই স্মৃতি। ওই সময়গুলো আর ফিরবে না।’ টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে রুমির কণ্ঠে ভেসে আসে দীর্ঘশ্বাস।

কেন ফিরবে না? এই প্রশ্নের উত্তরও আছে তাঁর কাছে, ‘দেখুন, আমাদের ফুটবল পিছিয়ে গেছে আমাদেরই কারণে। আমরা ফুটবলকে জনপ্রিয়তার আসনে বসিয়ে রাখতে পারিনি। বর্তমানে দেশের ক্রিকেট অনেকদূর এগিয়ে গেছে। ক্রিকেট এখন বিশ্ব পর্যায়ে লড়াই করে। দেশের মানুষের চেতনায় এখন ক্রিকেট। ফুটবলকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনাটা সত্যিই খুব কঠিন। এটা বলে দেওয়াই যায়, এ দেশের ফুটবল আর কোনো দিনও আগের অবস্থায় ফিরবে না।’

ঠিক কী কারণে ফুটবলের আজ এ অবস্থা, রুমি ব্যাখ্যা করলেন সেটাও, ‘মূলত নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, বিশেষ করে বললে ১৯৯৩ সালের পর বাংলাদেশের ফুটবল শেষ হয়ে গেছে। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। এক. আমরা নতুন করে ভালো খেলোয়াড়ের আবির্ভাব ঘটাতে পারিনি। দুই. ওই সময়ে ‘‘এক খেলোয়াড়, এক লিগ’’ প্রথা চালু করে ঢাকার তারকা ফুটবলারদের মফস্বলে খেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়; যা দেশব্যাপী ফুটবলে বিরাট শূন্যতা তৈরি করে। তিন. আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য না আসা। ১৯৯৩ সালে দেশের মাটিতে সাফে অভাবনীয় ব্যর্থতা মানুষকে নিদারুণ শোকগ্রস্ত করেছিল। দেশের মানুষ তখন ফুটবল থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেয়।’

রিজভী করিম রুমি
রিজভী করিম রুমি


রুমি ওই ‘এক খেলোয়াড়, এক লিগ’ প্রথাকেই ফুটবল ধ্বংসের সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে অভিহিত করতে চান, ‘আমরা ছোটবেলায় মফস্বলেই বড় হয়েছি। খুলনার মাঠে আসলাম ভাই, সালাম ভাইদের খেলা দেখে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ‘‘এক খেলোয়াড়, এক লিগ’’ প্রথা চালু করে ঢাকার বাইরে ঢাকার তারকা ফুটবলারদের খেলতে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকেই সারা দেশে ফুটবল ঝিমিয়ে পড়ে। এখন তো বোধ হয় ঢাকার বাইরের লিগও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।’
রুমির সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তার কিছুক্ষণ আগেই কানাডায় বসে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের কল্যাণে রুমি জেনেছেন এক ‘আবাহনী-মোহামেডান’ ম্যাচের কথা। ওই প্রসঙ্গ ধরেই বললেন, ‘আবাহনী-মোহামেডান খেলায় শূন্য গ্যালারি আমাকে পীড়া দিলেও অবাক করে না। দেশের ফুটবলের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি দলের খেলার জনপ্রিয়তাহানি আমার খেলোয়াড়ি জীবনেই শুরু হয়েছে। ১৯৯৩ সালে আমি আবাহনীর অধিনায়ক ছিলাম। তখন দেখেছি, এই খেলা নিয়ে কী উন্মাদনা, কী টেনশন। আবার ১৯৯৭-৯৮ সালে এই ম্যাচে খেলে দেখেছি তাঁর ঠিক উল্টো চিত্র। নব্বইয়ের দশকে এ দুটি ক্লাবই পুলপ্রথা চালু করেছিল। এ দেশের ফুটবল সেই পুলপ্রথার শিকার। আমরা বেশ কয়েকজন ফুটবলার ১৯৯৪ সালে পুলপ্রথা ভাঙতেই মুক্তিযোদ্ধায় গিয়েছিলাম। কিন্তু আখেরে ব্যাপারটি দেশের ফুটবলের কাল হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছে।’
আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে নিজের স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে রুমি খুঁজে  পেলেন ২৪ বছর আগের এক স্মৃতি, ‘১৯৯০ সালে স্বাধীনতা কাপে আমার দুই গোলে মোহামেডানকে হারিয়েছিল আবাহনী। ইনজুরির কারণে সেই ম্যাচে খেলেননি আসলাম ভাই। ওয়াসিম ভাইও ইনজুরড ছিলেন। একেবারেই দুর্বল দল নিয়ে আমরা খেলেছিলাম। তার পরও আমরা জিতেছিলাম।’
জাতীয় দলের হয়ে রুমির সেরা স্মৃতি জাপানের বিপক্ষে গোল। ১৯৯৩ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে দুবাইয়ে জাপানের বিপক্ষে ৪-১ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। টোকিওতে প্রথম লেগের ম্যাচে ৮-০ গোলে হারার পর কাজু মিউরা ও রয় র্যামোসের জাপানের বিপক্ষে গোল পেয়েছিলেন রুমি, ‘সেবার জাপান পুরো গ্রুপপর্বে ওই একটি গোলই হজম করেছিল। গোলটি করেছিলাম বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া এক শটে। আমার গোলে বাংলাদেশ ১-১ গোলে সমতায় ফিরেছিল। গোলের পর মুহূর্তেই আমারই বাড়িয়ে দেওয়া এক বলে ফাঁকা পোস্টে মিস করেছিল জাকির (মামুন জোয়ার্দারও হতে পারে)। পরের গোলটি পেয়ে গেলে আমরা এগিয়ে যাই।’
১৯৯১ সালে কলম্বো সাফ গেমসে ভারতের বিপক্ষে ২-১ গোলের জয়ে রুমির অবদান ছিল দুটি গোলই। ওই ম্যাচে রুমি দ্বিতীয় গোলটি করেছিলেন ২৫ গজ দূর থেকে নেওয়া অসাধারণ এক শটে।
আগেই বলা হয়েছে রুমি দেশের ঘরোয়া ফুটবলে আবাহনীতে খেলেছেন, মুক্তিযোদ্ধায় খেলেছেন। কিন্তু কোনোদিন মোহামেডানে খেলেননি। এর কারণ ব্যাখায় নিজের অপারগতার কথাই জানালেন রুমি, ‘কেন যেন খেলা হয়নি। অথচ, জানেন, বেশ কয়েকবার মোহামেডানের সঙ্গে আমার কথাবার্তা প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮৯ সালে মোহামেডানের ইরানি কোচ নাসের হেজাজি বাংলাদেশ জাতীয় দলেরও কোচ ছিলেন। ইসলামাবাদ সাফ গেমসের পরপরই দলবদল ছিল। মোহামেডানের কর্মকর্তারা আমাকে প্রায় তুলেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হেজাজি নাকি মানা করেছিলেন তাঁদের। তিনি বলেছিলেন, আমি জাতীয় দলের কোচ, মোহামেডানেরও কোচ। আবাহনীর অনুমতি ছাড়া রুমিকে যদি আমি মোহামেডানে নিয়ে আসি, তাহলে খুব অন্যায় করা হবে। এরপর মোহামেডানের কর্তারা আমার ব্যাপারে রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন।’
১৯৮৮ সালে ১৬ আগস্ট আবাহনীতে এসেছিলেন রুমি। সেদিন থেকেই প্রয়াত মোনেম মুন্না ছিলেন তাঁর ‘ফ্রেন্ড অ্যান্ড ফিলোসফার।’ মোনেম মুন্নার স্মৃতি আজও অলক্ষ্যে কাঁদায় রুমিকে, ‘মুন্না ভাই আমাকে খুব আদর করতেন। অথচ, উনি কিন্তু আমার চেয়ে বয়সে খুব বেশি বড় ছিলেন না। আবাহনীতে প্রথম দিন থেকে তিনি আমার রুমমেট। বিদেশে খেলতে গেলেও তিনিই হতেন আমার রুমমেট। কেন যেন প্রথম দিন থেকে একটা বড় ভাইসুলভ স্নেহ নিয়ে তিনি আমাকে আগলে রাখতেন। ফুটবলার হিসেবে মুন্না ভাই কী ছিলেন, সেটা আমি বলতে চাই না। তিনি কত বড় মাপের খেলোয়াড় ছিলেন, তার মূল্যায়ন দেশের মানুষ অবশ্যই করে।’
 ১৯৯১ সালে কলকাতার ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবে গিয়ে মাতিয়েছিলেন রুমি। সঙ্গে ছিলেন মোনেম মুন্না ও শেখ মোহাম্মদ আসলাম। সেই স্মৃতি তাঁকে আজও তৃপ্তি দেয়, ‘উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এই ক্লাবে খেলতে পারার স্মৃতি বিশেষ তো হবেই। তবে কলকাতায় মুন্না ভাই ছিলেন দারুণ সফল।’

ছেলে রিয়ান রিয়াসাত করিমের মধ্যে নিজের ছায়া খুঁজে পান রুমি। ব্যাপারটা তাঁকে দারুণ আনন্দও দেয়, ‘আমার ছেলে কানাডায় এসে কীভাবে ফুটবলের নেশায় মাতল, তা জানি না। তবে ওর খেলা দেখে খুব ভালো লাগে। আমার মনে হয় অসাধারণ প্রতিভা নিয়েই রিয়ান জন্মেছে। আমি কানাডায় যেখানে থাকি, সেখানকার একটি সেমি-প্রফেশনাল ক্লাবের সঙ্গে সে এখন প্র্যাকটিস করছে। ভবিষ্যতের কথা জানি না, তবে রিয়ান ফুটবলার হলে আমার খুবই ভালো লাগবে।’

সাক্ষাত্কার পর্বের শেষ লগ্নে এসে রুমি মূলত দিলেন সেরা চমকটা। ভবিষ্যতের রুমি তৈরি হচ্ছে খোদ তাঁর বাড়িতেই! সত্যিই এ দেশের ফুটবলের জন্য তা হবে বিরাট এক পাওয়া! বাংলাদেশের ফুটবলকে বাঁচাতে আরও একজন রুমির যে আজ বড় বেশি প্রয়োজন।