'সন্তানেরা কারাগারে, ঈদের আগে মুক্তি দিন'
শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হওয়ার পরপরই ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসে। ঘটনার সূত্রপাত ২৯ জুলাই, ২০১৮। সপ্তাহব্যাপী চলা সেই বিক্ষোভ যখন উত্তুঙ্গে তখন ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মীরা চড়াও হলেন শিক্ষার্থীদের ওপর। হামলা পর্ব শেষে শুরু হলো মামলার পর্ব। পত্রিকাজুড়ে তখন বড় বড় প্রিজন ভ্যানে শিক্ষার্থীদের জেলে যাওয়ার ছবি। আগস্টের শেষ সপ্তাহে এর সঙ্গে যুক্ত হলো ঈদের আগে শিক্ষার্থীরা মুক্তি পাবেন কি পাবেন না সেই নিয়ে শঙ্কা।
আন্দোলনের শুরু থেকে প্রথম আলোর খবরে–ছবিতে–সম্পাদকীয়–উপসম্পাদকীয়তে পাঠক তার মনের উদ্বেগ–আশঙ্কা–কষ্ট এ সব কিছুর প্রতিফলন দেখে। এর মধ্যে গত ১০ আগস্ট প্রথম আলোয় ‘ছাত্রদের চোখে জল, স্বজনেরা উদ্বেগাকুল’ শিরোনামে প্রতিবেদনের সঙ্গে ছাপা ছবি সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। প্রতিবেদনের শুরুটা ছিল এমন, ‘প্রিজন ভ্যানের ফাঁক গলে বাবা-বোন ও বন্ধুদের দেখতে পেয়েই কেঁদে ফেলেন সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের ছাত্র জাহিদুল হক। স্বজনেরা বাইরে থেকে আশ্বাস দেন—“চিন্তা করিস না। জামিন করিয়ে নিয়ে আসব”। জাহিদুল স্বজনদের কিছু বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কান্নার তোড় আর চারপাশের উচ্চ শব্দের মাঝে তাঁর কণ্ঠটি হারিয়ে গেল।’ প্রথম আলোর প্রতিবেদনে প্রকাশ, সে সময় ৫১টি মামলায় পুলিশ ৯৯ জনকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে ৫২ জনই শিক্ষার্থী। পত্রিকার কয়েকটি শিরোনামের কথা মনে পড়ছে, ‘স্কুল কলেজের ছাত্ররাও রেহাই পায়নি’, ২২ শিক্ষার্থীকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেই, ‘আট ছাত্রের জামিন আবেদন আবার নাকচ’, পুলিশ ‘ছুটছে কেবল গুজবের পেছনে’; উপসম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল এমন ‘তরুণেরা ভুল করে না’, ‘সন্তানেরা কারাগারে, ঈদের আগে মুক্তি দিন’, ‘শহিদুল আলমসহ অন্যদেরও জামিন হোক’। ঈদের আগে শেষ পর্যন্ত এই শিক্ষার্থীরা জামিন পেলেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের কথা বলতেই হয়। ধারাবাহিকভাবে প্রথম আলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়কার ঘটনাপ্রবাহ, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা হয়রানিমূলক মামলা, তাদের স্বজনদের উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা, শিক্ষকদের ভূমিকা, সরকারের অবস্থান দায়িত্বের সঙ্গে ছেপেছে।
আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানের মুক্তি চেয়ে তাঁর মায়ের যে মিনতি তার কথা অনেকেই মনে রেখেছেন। ক্যামেরার সামনে হাত জোড় করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মণিকে মাফ করে দাও, ভিক্ষা দাও।’
আসলে গত বছর সংবাদপত্রে যেসব শব্দ ঘুরেফিরে এসেছিল, তার মধ্যে ছিল ‘হয়রানিমূলক মামলা’ ও ‘গণগ্রেপ্তার’। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গণগ্রেপ্তারের শিকার হয়ে হাজার হাজার মানুষকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। সাজানো মামলায় এসব গ্রেপ্তারের লক্ষ্যই ছিল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও স্কুল–কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী শিক্ষার্থী। আর এই হয়রানিমূলক মামলা–গণগ্রেপ্তার নিয়ে প্রথম আলোর অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট। হাতকড়া পরা এক যুবককে টেনে আদালতে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ (২৫ ডিসেম্বর)। এক ফাঁকে পাশ ফিরে তিনি অপেক্ষমাণ স্ত্রীর কোলে থাকা ছেলেকে চুমু দেন। এ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিক হাসান রাজা। গণগ্রেপ্তারের শিকার হওয়া এই যুবক পিতার অপত্যস্নেহ সেদিন প্রথম আলোর সব পাঠককে স্পর্শ করেছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে তা ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র।