'ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে'
‘আচ্ছা, আপনিই তো ক্রেস্টের স্বর্ণ চুরির প্রতিবেদনটি করেছিলেন? এমন তথ্য কীভাবে পেলেন?’ ‘ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে’—এ প্রতিবেদন করার পর থেকে গত ছয় বছর এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি অনেকবার। আজ সেই খবর পাওয়ার গল্পটা বলছি।
২০১৪ সালে জানুয়ারি মাসে সচিবালয়ে ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে গেলাম একটি মজার তথ্য। তথ্য না বলে সেটাকে তথ্যের সূত্রই বলা ভালো। এক কর্মকর্তা বললেন, অফিসার্স ক্লাবের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, এমন কর্মকর্তাদের ব্যাপারে খোঁজ নিন। আরেক সূত্রে জানতে পারলাম, ওই নির্বাচন করছেন এমন একজন কর্মকর্তা, যিনি কিছুদিন আগে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছেন। পরদিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে দেখলাম এ সচিব চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দেননি। কিন্তু তিনি নিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সনদ। কারণ, মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখাতে পারলেই আরও এক বছর বেশি চাকরি করা যায়।
এরপর থেকে শুরু হলো খোঁজ। প্রথমে এক সচিবের কাছে গিয়ে তাঁর ব্যাপারে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘আমি একা নিয়েছি? আরও আছে।’ তিনি বললেন আরেকজনের নাম। পরেরজন বললেন আরেকজনের নাম। এভাবে বাড়তে থাকল নামের তালিকা। একসময় দেখি অবৈধভাবে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর লোভে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন চারজন সচিব, একজন যুগ্ম সচিব ও একজন সাবেক সচিব। জানতে পারলাম, এভাবে সনদ নিয়েছেন চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, ব্যাংকারসহ বিভিন্ন শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তারাও।
২২ জানুয়ারি ছাপা হলো সেই খবর। সেদিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিলেন ভুয়া সনদধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তদন্ত করে সত্যতা পেল। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ওই ছয় সচিবসহ তিন হাজার অমুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল হয়েছে।
গল্পটি এখানেই শেষ নয়। এভাবেই বেরিয়ে এল বিদেশি বন্ধুদের মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা ক্রেস্টের স্বর্ণ জালিয়াতির খবর। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে সরকার স্বাধীনতার চার দশক পূর্তি উপলক্ষে সাত পর্বে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু স্বনামধন্য ৩৩৮ বিদেশি ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনকে অন্য উপহারসামগ্রীর সঙ্গে একটি করে ক্রেস্ট দিয়েছিল। এক সূত্র জানাল, এই ক্রেস্টে সোনা দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) একটি প্রতিবেদনও হাতে এল। দেখা গেল, ক্রেস্টে দেওয়া হয়েছে পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত ধাতু।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর শুরু হলো নানা আলোচনা, মানববন্ধন, বিবৃতি দিল নানা সংগঠন। ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করল সরকার। ঘটনা প্রমাণিত হলো এবং তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হলো, ‘প্রথম আলোর প্রতিবেদনের সত্যতা মিলেছে।’ শহীদ পরিবারের সদস্য নাসরিন আহমেদের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ একটি রিটও করলেন। ক্রেস্ট সরবরাহকারী দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকের নামে মামলা করল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদন প্রকাশের পর অনেক কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হলো। ছয় বছর আগে এ প্রতিবেদন প্রকািশত হলেও এখনো তা গেঁথে রয়েছে প্রথম আলোর পাঠকদের মনে।