হারকিউলিসের সন্ধানে
জাতীয় নির্বাচনের ঠিক পরপরই দেশে কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা আলোচনায় আসে। এমন দুটি ঘটনায় অভিযুক্ত তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয় পরপর। ধর্ষক আখ্যা দিয়ে সবার গলায় ঝোলানো ছিল চিরকুট। এটা বিচারবহির্ভূত হত্যার নতুন ধরন কি না, সেই আলোচনা সামনে আসে। সর্বশেষ ঘটনায় চিরকুটে হারকিউলিসের নামে দায় স্বীকারের পর বিষয়টি বিদেশি গণমাধ্যমেও ব্যাপক প্রচার পায়। তবে কে বা কারা এই হারকিউলিস, তা শনাক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
প্রথম আলোতে আমি অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করছি। ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে আমাদের অপরাধবিষয়ক প্রধান প্রতিবেদক কামরুল হাসান ডেকে হাতে দুই পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন ধরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘আমরা যা চাই, তা এখানে নেই। আপনি একটু দেখেন বিষয়টা।’
প্রতিবেদনটি ছিল এ বছরের ১১ জানুয়ারি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার এক মাদ্রাসাছাত্রীর ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে। ভান্ডারিয়া থানায় করা মামলায় মাদ্রাসাছাত্রীর বাবা অভিযোগ করেন, ইশতিয়াক আহমেদ ওরফে সজল জোমাদ্দার (২৮) এবং কাবিত ইসলাম ওরফে রাকিব মোল্লা (২০) তাঁর মেয়েকে পানের বরজে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছেন। ইশতিয়াক কাজ করতেন একটি মুঠোফোন কোম্পানির টাওয়ারে আর কাবিত ছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁদের বাড়িও ভান্ডারিয়ায়। কাবিত ছিলেন ওই মাদ্রাসাছাত্রীর দূরসম্পর্কের আত্মীয়। ঘটনার ১৪ দিন পর ২৬ জানুয়ারি ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ার বেলতলা গ্রামের একটি বাগানে ইশতিয়াকের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। লাশের গলায় ঝোলানো ছিল কম্পিউটারে লেখা চিরকুট, ‘আমার নাম সযল, আমি...রের ধরসক, ইহাই আমার পরিনতি’ (বানান এ রকমই ছিল)। এর পাঁচ দিন পর কাবিতের লাশ পাওয়া যায় ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার আঙ্গারিয়া গ্রামে একটি ইটভাটার পাশে। তাঁর লাশের গলায়ও ঝোলানো একইভাবে লেখা চিরকুট। তবে কাবিতের চিরকুটটির শেষে বাড়তি লিখা ছিল ‘হারকিউলিস’। অর্থাৎ হারকিউলিস তাঁকে হত্যা করেছে।
প্রথমে খোঁজ নিতে গিয়েই জানতে পারি, মামলায় ধর্ষণের অভিযোগ আনা হলেও মাদ্রাসাছাত্রীর ডাক্তারি পরীক্ষায় জোর করে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, মামলার পর অভিযুক্ত ইশতিয়াক আহমেদকে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে সীতাকুণ্ড এলাকা থেকে ২২ জানুয়ারি একটি সাদা গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এর দুই দিন পর ২৪ জানুয়ারি রাতে কাবিত ইসলামকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সাভারের নবীনগর এলাকার ‘নিরিবিলি সড়ক’ থেকে। ঘটনা ধরে অনুসন্ধানে গিয়ে আরও নিশ্চিত হওয়া যায়, ইশতিয়াককে যে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটি ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সদর দপ্তরের নামে নিবন্ধন করা। গাড়িটির একটি ছবিও প্রথম আলোর হাতে পৌঁছায়। আর কাবিতের এক বন্ধু জানান, তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দেওয়া হয়েছিল।
ইশতিয়াক ও কাবিতের লাশ উদ্ধারের আগে তাঁদের আইশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রযুক্তিগত অনুসন্ধানেও। এই দুজনের মুঠোফোনের কললিস্ট সংগ্রহ করে দেখা যায়, তাঁদের অবস্থান শনাক্ত করার জন্য প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। তুলে নিয়ে যাওয়ার আগে তাঁদের মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হয়, যা সরকারের সংস্থা ছাড়া অন্য কারও দ্বারা সম্ভব নয়। প্রতিবেদনের উপসংহার ছিল এটাই।
প্রথম আলোর এই প্রতিবেদনের পর ধর্ষকদের তুলে নিয়ে হত্যার ঘটনা আর শোনা যায়নি। হারকিউলিসের নামে চিরকুট লিখে যাওয়ারও পুনরাবৃত্তি হয়নি। কিন্তু ইশতিয়াক বা কাবিতের পরিবার আজও জানতে পারেনি, কারা তাদের সন্তানদের তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করল। ইশতিয়াকের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী ও স্বজনেরা আর কাবিতের বাবা–মা এবং ভাই আজও খুঁজে ফেরেন তাঁদের স্বামী–সন্তানের হত্যাকারীদের।