সামনে আমাদের সতর্কভাবে চলতে হবে

আকবর আলি খান। ছবি: প্রথম আলো
আকবর আলি খান। ছবি: প্রথম আলো
সাবেক সচিব, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মননশীল লেখক ড. আকবর আলি খান মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের জন্য ক্ষমতার ভাগাভাগির ব্যবস্থা প্রয়োজন। বিদায়ী ২০১৬ সালে বৈশ্বিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের যে ইঙ্গিত মিলেছে সেদিকে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। তিনি মনে করেন, এত দিন যেভাবে চলেছে, সামনের দিনগুলো সেভাবে চলবে না। নতুন বছরে প্রবেশের মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক মশিউল আলম

মশিউল আলম: আমরা এখন একটা নতুন বছরের দ্বারপ্রান্তে। এই সাক্ষাৎকার যখন পাঠকের কাছে পৌঁছাবে তখন নতুন বছর ২০১৭ সালের পয়লা জানুয়ারির সকাল। আপনার কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা, বিগত বছরটা কেমন গেল?

আকবর আলি খান: ২০১৬ এক অর্থে ছিল একটা গতানুগতিক বছর। এ রকম বছর আগেও গেছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো আসবে। বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন এ বছর লক্ষ করা যায়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি হয়েছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে গেছি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

মশিউল আলম: এর মানে কি আমরা একটা জায়গায় থেমে আছি?

আকবর আলি খান: বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না হওয়ার দুটি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হতে পারে যে আমরা হয়তো এরপরে পেছনের দিকে চলে যাব, কারণ আমরা সামনের দিকে এগোতে পারছি না। অন্য অর্থ হতে পারে যে আমরা এখান থেকে গতি সঞ্চার করে সামনের দিকে এগিয়ে যাব।

মশিউল আলম: সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কোনো লক্ষণ বা আভাস কি আপনি দেখতে পেয়েছেন?

আকবর আলি খান: কোন দিকে যাব, তা নির্ভর করছে আমরা আগামী বছর কী ধরনের কাজ করি তার ওপর। কিন্তু সদ্য বিদায়ী বছর থেকে কোনো সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে না যে আমরা সামনের দিকে যাচ্ছি না পেছনের দিকে যাচ্ছি।

মশিউল আলম: আমরা প্রথমে যদি অর্থনীতির দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব যে বিনিয়োগ হচ্ছে না, কর্মসংস্থান বাড়ছে না, অনেক নতুন নতুন তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষা লাভ করে বেরিয়ে আসছেন, কিন্তু কাজ পাচ্ছেন না...

আকবর আলি খান: কর্মসংস্থান বাড়ছে না, এটা আমি বলব না। কর্মসংস্থান বাড়ছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশে বেকার সমস্যা প্রকট। আর বিনিয়োগ বাড়ছে না এটা ঠিক, কিন্তু মাথাপিছু আয় তো বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। সুতরাং কিছু ভালো খবর, কিছু খারাপ খবর আছে। যদি বিনিয়োগ বাড়ত এবং প্রবৃদ্ধি বাড়ত, তাহলে আমরা নিশ্চিত হতাম যে আমাদের ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে। আর যদি বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি বাড়ে, তাহলে সন্দেহ থাকবে যে এটা কি টিকবে নাকি টিকবে না। তবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আমরা এমন একটা পরিস্থিতিতে আছি, যেখানে আমাদের ওপরের দিকেও যাওয়া সম্ভব, নিচের দিকেও যাওয়া সম্ভব। কোন দিকে যাব, সেটা নির্ভর করছে আমরা কী ব্যবস্থা গ্রহণ করি তার ওপর। অর্থাৎ, আমরা বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কী ব্যবস্থা গ্রহণ করি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে আমরা সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য কী ব্যবস্থা গ্রহণ করি।

মশিউল আলম: এ প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। তার আগে একটা প্রশ্ন করি: আপনি রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আপনার কমিশন বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কী করা দরকার সে সুপারিশও করেছিল। আপনাদের সুপারিশগুলো কি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল?

আকবর আলি খান: সৌভাগ্যবশত আমাদের সুপারিশগুলোর মধ্যে অনেকগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিজেই বাস্তবায়ন করেছিল। দুএকটা আইন তারা জারি করেছিল অধ্যাদেশের মাধ্যমে, বর্তমান সরকার এসে সে আইনগুলো সংসদের মাধ্যমে অনুমোদন করিয়েছে। আসলে বাংলাদেশের সব কমিশনের দুর্ভাগ্য হলো, কমিশন কমিশনের মতো সুপারিশ করে, সরকার সরকারের মতো কাজ করে। ফলে কোনো কমিশনের সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় না। রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশনে আমরা বলেছিলাম যে আমরা এমন সুপারিশ করব না যেগুলো বাস্তবায়িত হবে না। আমরা চেয়েছি যে আমাদের সুপারিশগুলো যেন বাস্তবায়িত হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকগুলো সুপারিশ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাস্তবায়ন করেছিল, কিছু সুপারিশ বর্তমান সরকারও বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন শুধু কতকগুলো সুপারিশ পেশ করেই দায়িত্ব শেষ করতে চায়নি, আমরা চেয়েছি মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে, পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সংস্কার এগিয়ে যাক। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরে আর এ বিষয়ে সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। আমি পদত্যাগ করে চলে আসি, তারপরে সরকার এটার আর কোনো খোঁজও নেয়নি।

আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশ বিশ্বায়নের সুফল। ছবি: প্রথম আলো
আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশ বিশ্বায়নের সুফল। ছবি: প্রথম আলো

মশিউল আলম: একটু আগে আপনি সুশাসন নিশ্চিত করার প্রসঙ্গে বলতে চাইছিলেন। জনপ্রশাসনের দক্ষতা, কার্যকারিতা, জনমুখিতা কমে যাচ্ছে, দলীয়করণ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত আছে। জনপ্রশাসনের বাইরে প্রতিটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, সব পেশাজীবী সংগঠন, সিভিল সোসাইটি, রাষ্ট্রের প্রতিটা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত মাত্রায় দলীয়করণের শিকার। সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির সর্বময়তা রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটা স্তরে প্রকটতর হয়েছে...

আকবর আলি খান: এগুলো অবশ্যই দেশের মানুষের অধিকার হরণ করে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার একটা রাজনীতিমুক্ত আমলাতন্ত্র, যে আমলাতন্ত্র মানুষের জন্য কাজ করবে। সেসব দিক যদি বাদও দেন, জনপ্রশাসনের কাজ কী? অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। বাংলাদেশে জনপ্রশাসনের দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্য ক্রমেই কমে আসছে। কারণ প্রশাসনের নিয়মকানুন আমরা মানছি না। পদ নেই, আমরা অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিচ্ছি। আমাদের সচিবালয়ে পাকিস্তান আমল থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো চারটি পর্যায়ে: সেকশন অফিসার, ডেপুটি সেক্রেটারি, জয়েন্ট সেক্রেটারি এবং সেক্রেটারি। যেসব মন্ত্রণালয়ে কাজের চাপ খুব বেশি ছিল, সেখানে সচিবকে সহায়তা করার জন্য অতিরিক্ত সচিব ছিল। এখন বাংলাদেশে পাঁচটি পর্যায় করা হয়েছে: প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিবের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব যদি কিছু না-ও করেন, তবু তাঁর কাছে ফাইল যেতে এক দিন লাগবে, আসতে এক দিন লাগবে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত দুই দিন পিছিয়ে গেল। আরও একটা ব্যাপার ঘটেছে। পাকিস্তান আমলে সেকশন অফিসার ছাড়া কাউকে নোট লিখতে দেওয়া হতো না। এখন সেকশন অ্যাসিস্ট্যান্টরাও নোট লেখেন। অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে যেখানে চারটা পর্যায় ছিল, এখন হয়ে গেছে ছয়টা পর্যায়। এটা হলো আমলাতন্ত্রের পর্যায়ে। ওপরের দিকে শুধু মন্ত্রীর কাছে যে নথি যেত, সেটা প্রতিমন্ত্রীর কাছে যেত না। প্রতিমন্ত্রীর কাজ ছিল আলাদা। এখন উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রী আছেন, সুতরাং ফাইল সচিবের কাছ থেকে যাবে উপমন্ত্রীর কাছে, উপমন্ত্রীর কাছ থেকে প্রতিমন্ত্রীর কাছে, প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকে মন্ত্রীর কাছে। এভাবে সময় যে বেশি লাগছে, এটা নিয়ে আমাদের দেশে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। পৃথিবীর সব দেশে সুশাসন মানে হলো অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। আর আমাদের এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এবং সিদ্ধান্ত সব নেওয়া হয় ওপরের দিকে। নিচের পর্যায়ে কোনো ক্ষমতা নেই। এর সঙ্গে যদি রাজনৈতিকীকরণ, কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া—এসব যোগ করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলে মনে হয় না।

মশিউল আলম: রাজনীতির ক্ষেত্রে গেল বছরও বিরোধী দল আগের মতোই সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে তাদের একটা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাদের কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে দেওয়া হচ্ছে না; দমন-পীড়ন, মামলা-প্রেপ্তার, পুলিশি হয়রানি ইত্যাদি অব্যাহত...

আকবর আলি খান: এসব অভিযোগ আজকে যাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে করছেন, তাঁরা নিজেরা যখন সরকারে ছিলেন, তখন তাঁদের বিরুদ্ধে কিন্তু এসব অভিযোগই করত তখনকার বিরোধী দল অর্থাৎ আজকের সরকারি দল। বাংলাদেশে এই সংঘাতের রাজনীতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। সংঘাত আরও বাড়ছে, সংঘাত কমানোর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সংঘাত কমার ব্যবস্থার জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু সে রকম পরিবর্তনের কোনো চিহ্ন বা আভাস আমরা দেখতে পাচ্ছি না। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বাংলাদেশের সিভিল সমাজ রাজনৈতিক দলগুলোর মতোই বিভক্ত হয়ে গেছে। সিভিল সমাজে কোনো যুক্তিতর্ক নেই, রাজনীতিবিদেরা যে রকম আচরণ করেন, সিভিল সমাজেরও আচরণ সে রকম হয়ে গেছে।

মশিউল আলম: রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কোনো উপায়ই কি নেই?

আকবর আলি খান: একটা উপায় হতে পারত যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্ন উঠত। কিন্তু বাংলাদেশে এক দল ক্ষমতায় থাকে, অন্য দল ক্ষমতার বাইরে থাকে। ক্ষমতার ভাগাভাগি হতে পারত যদি আনুপাতিক হারে নির্বাচন হতো। তাহলে হয়তো তাদের কোয়ালিশন করার প্রয়োজন পড়ত। কিন্তু সেই ধরনের কোনো প্রয়োজনই বাংলাদেশে নেই। ফলে, এখন আমাদের বিদ্যমান পরিবেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা আমি দেখি না।

মশিউল আলম: আপনার প্রকাশিতব্য অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি বইতে আপনি বলেছেন, বাংলাদেশ একটা এক্সট্রিমলি হোমাজিনিয়াস দেশ, এ রকম সমরূপ দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ তার উল্টো, এই দেশকে আপনি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ‘অসাধারণ’ উদাহরণ বলেছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ রকম উল্টো ব্যাপার ঘটার ব্যাখ্যা কী?

আকবর আলি খান: এটার ব্যাখ্যা আমি আমার বইতে সুস্পষ্টভাবে দিতে পারিনি। আমি আটটি তত্ত্বের উল্লেখ করেছি, সেই তত্ত্বগুলোর আলোকে সমস্যাটা বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি। আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আজকে যত বেশি, অতীতে তত বেশি ছিল না। এটা হওয়ার একটা কারণ হতে পারে, আমরা যে শাসনতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছি, সেই কাঠামোতে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। যাঁরাই নির্বাচিত হন, তাঁরা ধরে নেন যে আগামী পাঁচ বছর তাঁরা যা খুশি করতে পারবেন, তাঁরা মৌরসিপাট্টা পেয়ে গেছেন। এ ধরনের আধিপত্য যেখানে প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেখানে আপস-সমঝোতার কোনো মনোভাব থাকে না। আমি মনে করি, আমাদের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যদি কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণভোট করা যায়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর হয়তো একটু হুঁশ আসবে যে আমাদের কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে কী করা হবে সেটা রাজনৈতিক দলগুলো কেন বলবে? জনগণের কাছে প্রশ্ন রাখলে তারাই বলে দেবে কী করতে হবে, তারা কী চায়। কিন্তু আমাদের গণভোটের কোনো বিধান নেই, আনুপাতিক হারে নির্বাচনের ব্যবস্থা নেই। ফলে এই ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো পথ এখানে দেখা যাচ্ছে না।

.
.

মশিউল আলম: কোনো পক্ষ থেকে এই দাবিগুলো তোলা ছাড়া তো রাজনৈতিক দলগুলো এসব করবে না...
আকবর আলি খান: কোনো পক্ষ থেকেই এ দাবিগুলো মোটেও উচ্চারিত হচ্ছে না, কারণ কোনো পক্ষের জন্যই এটা লাভজনক নয়। সরকারি দল কিংবা বিরোধী দল কেউই আনুপাতিক হারে নির্বাচন চাইবে না। কোনো পক্ষই কোনো ক্ষেত্রেই গণভোট চায় না।
মশিউল আলম: দাবিগুলো তো সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে উঠতে পারত...
আকবর আলি খান: সিভিল সোসাইটির যে অবস্থা, সিভিল সোসাইটিতে অসিভিল উপাদান বেশি। সিভিল সোসাইটিতে যত লোক আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি মাস্তান বাংলাদেশে আছে। সুতরাং মাস্তানদের যে আওয়াজ সেটাই আমরা শুনতে পাই, সিভিল সোসাইটির কণ্ঠ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে সিভিল সোসাইটির পক্ষে যে কাজগুলো করা সম্ভব ছিল, কিংবা বাংলাদেশেও সামরিক শাসনের আমলে সিভিল সোসাইটির পক্ষে যা করা সম্ভব হয়েছে সে কাজগুলো করার শক্তি এখন সিভিল সোসাইটির নেই।
মশিউল আলম: আমাদের কি তাহলে এভাবেই চলবে?
আকবর আলি খান: এ রকম পরিস্থিতি সব সময় থাকে না। এটা হয়তো একটা সাময়িক পরিস্থিতি। তারপরে হয়তো দেশের মানুষ এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় পেতে পারে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের কথা মনে হলেই আমার পাল বংশের উত্থানের ইতিহাস মনে পড়ে যায়। পাল বংশের উত্থানের আগে এ দেশে প্রায় ৫০ বছর ধরে অরাজকতা বিরাজ করছিল...

মশিউল আলম: মাৎস্যন্যায়?

আকবর আলি খান: হ্যাঁ, সেই মাৎস্যন্যায় ৫০ বছর চলেছে। তারপর দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছে যে এই অবস্থায় দেশ চালানো সম্ভব নয়। সুতরাং আমাদের এখানেও হয়তো মাৎস্যন্যায় দীর্ঘ সময় বিরাজ করতে পারে, তারপরে মানুষের চৈতন্যোদয় ঘটতে পারে।

মশিউল আলম: ২০১৬ সালে বড় দুটি দলেরই জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং মূল নেতৃত্বে যথারীতি কোনো পরিবর্তন আসেনি...

আকবর আলি খান: আমাদের এখানে রাজনীতি হলো বংশানুক্রমিক রাজনীতি। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা ক্যারিশম্যাটিক নেতাদের বংশধর এবং তাঁদের মধ্যেও ক্যারিশমা আছে বলে অনেকে মনে করেন। এই ধরনের রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু বর্তমান সময়ের মধ্যে বাস করে না, তারা বাস করে চিরন্তন অতীতের মধ্যে। অতীতকে নিয়েই তারা ব্যস্ত, বর্তমানকে নিয়ে নয়। সুতরাং এখানে পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাই নেই, যদি না তৃণমূল পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলো সংগঠিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে যারা তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠিত হচ্ছে, তারা মুরব্বিদের মক্কেল হিসেবে রাজনীতিতে আসছে। মুরব্বি-মক্কেল সম্পর্কটাই এখানে বড় হয়ে যাচ্ছে।

মশিউল আলম: একটা জেলায় বা একটা সংসদীয় আসনে প্রত্যেক দলের একজন নেতার পেছনে কয়েক শ তরুণ-যুবক সব সময় ঘোরেন। তাঁরা আশা করেন যে তাঁদের নেতা সাংসদ বা মন্ত্রী হলে তাঁরা সুযোগ-সুবিধা পাবেন, টেন্ডার পাবেন ইত্যাদি...

আকবর আলি খান: কাজেই তাঁরা কিন্তু রাজনীতি করেন নিজের স্বার্থের জন্য, আদর্শের জন্য নয়। আদর্শের জন্য যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা এখন গণতন্ত্রের শত্রু, কারণ তাঁরা চরমপন্থী। চরমপন্থীদের পক্ষে এই দেশে রাজনীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে কি না, আমার সন্দেহ আছে।

মশিউল আলম: দু-তিন বছর ধরে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর হাতে ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, অধ্যাপক, পুরোহিত, বিদেশি নাগরিক গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছিলেন। ২০১৬ সালে আমরা দেখলাম ভয়াবহ জঙ্গি হামলা, গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয়। এই জঙ্গিবাদকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আকবর আলি খান: এই সন্ত্রাসবাদ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের একটা ফল। বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আমরা শঙ্কিত, কিন্তু সন্ত্রাসবাদ নেই কোন দেশে? এই সন্ত্রাসবাদ সব দেশে গড়ে উঠছে এবং এটা ঘটছে মূলত ইন্টারনেটের মাধ্যমে, সাধারণ লেখাপড়ার মাধ্যমে এটা গড়ে উঠছে না। বাংলাদেশে যেসব ঘটনা ঘটছে তাতে আমরা নিশ্চয়ই আতঙ্কিত, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে আমাদের একার পক্ষে সন্ত্রাসবাদ থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হবে না। বিশ্বপরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের দেশের পরিস্থিতিরও পরিবর্তন ঘটবে। বিশ্বপরিস্থিতি যদি আরও খারাপ হয়, তাহলে আমাদের দেশেও সন্ত্রাসবাদী চেতনা আরও বেড়ে যাবে। আর বিশ্বপরিস্থিতির যদি উন্নতি হয় তাহলে বাংলাদেশেও সন্ত্রাসবাদ কমে যাবে। বাংলাদেশ আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে একা এটাকে কিছুটা দমন করে রাখতে পারবে, কিন্তু এটাকে নির্মূল করার ক্ষমতা বাংলাদেশের একার নেই।

মশিউল আলম: ২০১৬ সালে বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেশি লক্ষ করা গেছে। এ সমস্যা আগেও ছিল, কিন্তু গেল বছর নৃশংসতার মাত্রা বেড়েছে। এটা কিসের লক্ষণ?

আকবর আলি খান: ভারত ও পাকিস্তানেও কিন্তু এসব ঘটনা ঘটেছে। নারী নির্যাতন পাকিস্তানের সমাজব্যবস্থার মধ্যে গ্রথিত। দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতনের সমস্যা রয়েছে।

মশিউল আলম: গেল বছর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের বিষয়টাও বেশ আলোচিত। বিশেষত নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায় ও গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভ লক্ষ করা গেছে। দেখা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্ত রক্ষার ব্যাপারে খুব একটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে না।

আকবর আলি খান: আসলে, দেশে গণতন্ত্র থাকলে ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা সম্ভব। কারণ গণতন্ত্রের মৌল নীতি হলো যে আপনি অন্যের মতের প্রতি সহিষ্ণু থাকবেন, অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন। অন্যের মত ও অধিকার নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইবেন না। যেহেতু বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে না, সেহেতু এখানে বিভিন্ন আকারে ও বিভিন্ন রূপে ধর্মান্ধতা ও অন্যান্য মৌলবাদ আত্মপ্রকাশ করছে। আমরা যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারি, সহনশীলতা বাড়াতে পারি, তাহলে আমরা এসব কমাতে পারব। অন্যথায় পারব না।

মশিউল আলম: তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নিখোঁজ হওয়া গেল বছর বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের পরিচয়ে লোকজনকে বাসা থেকে কিংবা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং তারপর তাদের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া কিংবা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার অভিযোগ অনেক বেড়েছে। অভিযোগ বেশি পুলিশের বিরুদ্ধে। অনেক মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। এই সমস্যা থেকে কি বাংলাদেশের বেরোনোর কোনো উপায় নেই?

আকবর আলি খান: এসব আরও বাড়বে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ কীভাবে দমন করা হবে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আছে। কিন্তু বাংলাদেশে পুলিশের একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে। আগে যখন নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগ থেকে পৃথক ছিল না, তখন পুলিশের ওপর ম্যাজিস্ট্রেটদের একটা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ছিল। ব্রিটিশ আমলে ব্যবস্থাটা অত্যন্ত সুদৃঢ় ছিল। পাকিস্তান আমলে সেটা অনেক দুর্বল হয়ে যায়। তবু, সামান্য হলেও কিছুটা নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু এখন যেহেতু বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে গেছে, পুলিশের ওপর বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ যেহেতু নির্বাহী বিভাগ মানতে চাইবে না, সেহেতু পুলিশ কার্যত স্বাধীন হয়ে গেছে, পুলিশের ওপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ক্ষমতাই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নেই।

মশিউল আলম: পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কোনো উপায় নেই?

আকবর আলি খান: আমরা আগের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় ফিরে যেতে পারব না, কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশে যে ব্যবস্থা আছে তা হলো, পুলিশের ওপরে একটা বাইরের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।

মশিউল আলম: পুলিশ কমিশন?

আকবর আলি খান: পুলিশ কমিশন গঠন করা যায়, কিন্তু পুলিশ বিভাগের লোকদের দিয়ে সেটা গঠন করলে চলবে না। পুলিশের বাইরের লোকদের সমন্বয়ে সে কমিশন গঠন করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে পুলিশ কমিশন গঠন করার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেখানে পুলিশের লোক দিয়ে তা গঠন করার কথা বলা হয়েছে। এটা অর্থহীন হবে। যতক্ষণ বাইরের লোকদের দিয়ে পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে আমার মনে হয় না।

মশিউল আলম: ইউরোপে মন্দা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়া, ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া, পৃথিবীজুড়ে একদিকে সহিংসতা-সন্ত্রাসবাদ, অন্যদিকে প্রকট জাত্যভিমান, ধর্মাভিমান, সংকীর্ণ পপুলিজম বেড়ে যাওয়া—এই বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশকে ভালোভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে কী কী ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নিতে হবে?

আকবর আলি খান: বিশ্বপরিস্থিতি বর্তমানে জটিল। বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে। তিনি যদি সত্যি সত্যিই বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে যেতে চান, তাহলে পৃথিবীর সর্বত্র সমস্যা দেখা দেবে। আমার মনে হয় না তিনি যতটা ব্যবস্থা নেবেন বলে দাবি করেছেন, ততটা ব্যবস্থা তিনি নিতে পারবেন। কিন্তু না নিতে পারলেও বিশ্বব্যাপী যে পরিবর্তন হবে, সেটার জন্য সবার প্রস্তুত হওয়া দরকার। বাংলাদেশেরও এ সম্পর্কে সতর্ক হওয়া দরকার। আমরা যদি মনে করি যে অতীতে যা ঘটেছে, আগামী পাঁচ বছর একই রকমের বিশ্বপরিস্থিতি হবে, তাহলে সেটা ঠিক হবে না এবং আমরা যদি সেভাবেই কাজ করি, তাহলে কিন্তু সমস্যায় পড়ে যেতে পারি। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সতর্কভাবে কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে, যদি বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, তাহলে আমরা যেভাবে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করছি এবং বিদেশিদের বিভিন্ন কন্ট্রাক্ট ও সুবিধা দিচ্ছি, সেগুলো আমরা শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পারব কি না, সেই প্রশ্ন উঠবে। কারণ বাংলাদেশ কিন্তু বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়ায় লাভবান হয়েছে। আমাদের এক কোটির বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করেন। আমাদের গার্মেন্টস শিল্প বিশ্বের মধ্যে প্রায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতে যাচ্ছে। বিশ্বায়নের ফলেই আমাদের এসব বড় অর্জন সম্ভব হয়েছে। এখন যদি বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়া পেছনে চলে যায়, তাহলে এই অর্জনগুলো ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে। সে জন্য আমাদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অর্থনীতি পর্যালোচনা করা উচিত। মনে রাখতে হবে যে আমাদের সম্পদের অভাব রয়েছে। আমাদের অসীম সম্পদ রয়েছে, এই দৃঢ় প্রত্যয়ে আমরা যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি তাহলে আমাদের বড় সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা আছে।

মশিউল আলম: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আকবর আলি খান: ধন্যবাদ।