দুই দিন ধরে চলত ঈদের প্রস্তুতি
আমি আমার জীবনে শেরওয়ানি পরেছি দুবার। দ্বিতীয়বার আমার বিয়ের সময়। আর প্রথমবার কোনো এক ঈদে। তখন আমার চার কি সাড়ে চার বছর বয়স। বাবা আমাকে এবং আমার বড় ভাইকে শেরওয়ানি এনে দিলেন। আমারটা সোনালি রঙের। বড় ভাইয়েরটার রং এখন আর মনে নেই, কিন্তু এটুকু মনে আছে, ফুল ফুল ছোপ ছিল। শেরওয়ানির জন্যই কি না কে জানে, জীবনের প্রথম ঈদের স্মৃতি বলতে ওই ঈদটার কথাই মনে আছে।
তখন আমরা সিলেটে থাকি। সদ্যই পাকিস্তান আলাদা হয়েছে। জিন্নাহ টুপির সে সময় খুব প্রচলন। শেরওয়ানি পরে, জিন্নাহ টুপি মাথায় দিয়ে বাবার সঙ্গে প্রথম ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। যত দূর মনে পড়ে, খুব একটা গন্ডগোল করিনি। বাচ্চারা যেমন অনেক সময় ঈদের নামাজ পড়তে গেলে কান্নাকাটি শুরু করে, সেসব একদমই করিনি।
১৯৪৯ সালে আমরা ময়মনসিংহে চলে গেলাম। তখন কোনো একটা ঈদে অবশ্য কান্নাকাটি করেছিলাম। যেমনটা হয় আরকি, সবাই সেজদায় চলে গেল, আর একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে আশপাশে তাকিয়ে চিৎকার করে কান্না শুরু করল!
এর পরেরবার বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন, আমাকে আর ঈদগাহে নেবেন না। ময়মনসিংহে তখন বড় ঈদগাহ ছিল। জায়গাটার নাম সম্ভবত কাঁচিঝুলি। সেখানে ঈদগাহের পাশেই একজন অতিরিক্ত জেলা জজের বাড়ি ছিল। বাবা আমাকে সেখানে রেখে গেলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম, সবাই ঈদের নামাজ পড়ছে।
তখন ঈদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত দুই দিন আগে থেকে। সেমাই কিনতে পাওয়া যেত না, মা-খালারা বাড়িতেই তৈরি করতেন। একটা হাতে চালানো যন্ত্র ছিল। তার মধ্যে ময়দা ঢেলে চিকন, মোটা আর মাঝারি—তিন ধরনের সেমাই পাওয়া যেত। রোদে শুকানোর পর রান্নার উপযোগী হতো সেই সেমাই। এ ছাড়া তৈরি হতো নানা রকম মিষ্টান্ন। সেসব মিষ্টান্নতে নারকেল দেওয়ার চল ছিল।
সেমাই বানানো শুরু হওয়ারও আগে ঈদের আমেজ পাওয়া যেত বাড়িতে খলিফা এলে। খলিফা মানে দরজি। প্রতিটি বাড়িরই একজন চেনা খলিফা ছিলেন। তিনি বাড়ি এসে সবার জামার মাপ নিয়ে যেতেন। লম্বা থান কাপড়ে বাড়ির সব পুরুষ মানুষের এক রকম শার্ট হয়ে যেত। সেই জামা আবার ঈদের আগে কোনোভাবেই পরা যাবে না। পরতে হবে ঈদের দিন সকালে, কয়লার ইস্তিরি দিয়ে ইস্তিরি করে। এখনকার মতো ঢোলা পায়জামা আমরা পরতাম না। চোস্ত পায়জামা পরতাম। সেই পায়জামার নিচের অংশ এত টাইট যে পরার সময় গোড়ালির কাছে আটকে যেত। তখন কাগজ দিয়ে পরতে হতো।
গরুর হাটে যাওয়ার আগ্রহ আমার কখনোই ছিল না। জীবনে বোধ হয় দুই কি তিনবার হাটে গিয়েছি। তবে পুরো প্রক্রিয়াটাতে আনন্দ পেতাম। গরু নিয়ে কী ভীষণ ছোটাছুটি! মজাই লাগত। কাটাকাটিতে অবশ্য কখনোই সেভাবে হাত লাগাইনি। কসাই আসত। এ ছাড়া বাসায় অনেক কাজের লোক ছিল, ছিল মামা ও চাচাতো ভাইবোন—ওরাই সব করত। গরিব মানুষ আর স্বজনদের দিয়ে মাংস যা থাকত, মোটামুটি দুই দিনেই খেয়ে শেষ করে ফেলতে হতো। তখন এখনকার মতো ডিপ ফ্রিজ তো আর ছিল না।
স্বজনদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে মাংস দেওয়া, সেটাও ছিল আনন্দের বিষয়। ১৯৫২ সালে ঢাকায় চলে আসার পর মতিঝিল, আজিমপুর ঘুরে ঘুরে আত্মীয়দের বাসায় মাংস দিতাম। তাঁরাও দিতেন। পুরো কাজটাই খুব নিয়মমাফিক হতো। কোন কোন আত্মীয়ের বাসায় মাংস দেওয়া হবে, প্রথমে তাদের নামের তালিকা করতাম আমরা, কেউ যেন বাদ পড়ে না যায়। তারপর ছোট-বড় প্যাকেট করে প্রতিটি প্যাকেটের ওপর আবার নাম লিখে রাখা হতো। কারও পরিবারে সদস্যসংখ্যা বেশি, কারও কম। সেই হিসাবে মাংসের পরিমাণ কম-বেশি হতো। এখন বোধ হয় মাংস দেওয়া-নেওয়ার এই প্রচলন একটু কমে এসেছে। আবার এখন যেমন ছোট বাচ্চাদের ঈদি দেওয়ার জন্য নতুন টাকা বাড়িতে রাখা হয়, আমার ছোটবেলায় এমনটা খুব একটা দেখিনি। সে সময় বাচ্চাদের হাতে টাকা দেওয়া হতো না।
আরেকটা বিশেষ রীতি হলো, ঈদের দিন সকালে নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে একটু বিশেষ নাশতা। অন্য সময় হয়তো আটার রুটি তৈরি হতো। ঈদের দিন সকালে আমরা খেতাম পরোটা। সেই চল আমাদের বাড়িতে এখনো আছে। (অনুলিখিত)
জামিলুর রেজা চৌধুরী: জাতীয় অধ্যাপক ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য।