শালগড় অ্যামবুশ অপারেশন

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাঙালি অসীম সাহসে মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে। ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। বীরত্বপূর্ণ সেসব সম্মুখযুদ্ধ উজ্জ্বল হয়ে আছে স্বাধীনতার স্বপ্নে, আত্মত্যাগের মহিমায়। মুক্তিযুদ্ধের বহুল আলোচিত কয়েকটি যুদ্ধ নিয়ে প্রথম আলোর এ আয়োজন।

আবদুল ওহাব বীর বিক্রম

দেবীপুর ক্যাম্পে অবস্থানকালেই সুবেদার ওহাব [আবদুল ওহাব বীর বিক্রম] জানতে পারেন যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কপথটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রায়ই সেনা কনভয় নিয়ে কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রাতে এবং দিনে আসা-যাওয়া করে। প্রতিটি সেনা কনভয়ে ১৫ থেকে ২০টি করে গাড়ি থাকে।
সুবেদার ওহাব কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে গমনাগমনরত এ ধরনের দু-একটি সেনা কনভয়ে অ্যামবুশ অপারেশন পরিচালনার অভিপ্রায় জানালেন কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন [পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল] আবদুল গাফফারকে [এম এইচ এ গাফফার , বীর উত্তম]।

সীমান্ত থেকে ২০-২৫ মাইল অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এ ধরনের অপারেশন পরিচালনা ছিল আত্মঘাতী এবং বিপৎসংকুল। মুক্তিবাহিনীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যও এ ধরনের অপারেশনের প্রয়োজন ছিল অপরিসীম। সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর অব্যাহত অগ্রযাত্রায় জনমনে হতাশা নেমে এসেছিল। তাদের একটি অংশ পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন করতে শুরু করে দিয়েছিল।

সুবেদার ওহাব উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের অতি অভ্যন্তরে অ্যামবুশ ধরনের অপারেশন পরিচালনার গুরুত্ব প্রসঙ্গে কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন গাফফারের সঙ্গে আলোচনা করেন। ক্যাপ্টেন গাফফার এ ধরনের অপারেশনে যাওয়ার সম্মতি প্রদান করেন।

সম্মতি পেয়ে ২৫ এপ্রিল সুবেদার ওহাব ২৮ জনের একটি সেনাদল নিয়ে কুমিল্লা-ব্রাহ্মিণবাড়িয়া সড়কসংলগ্ন এলাকার উদ্দেশে রওনা দেন। করাতি ও কাঠমিস্ত্রির ছদ্মবেশে দলের সবাই রওনা দেন। অস্ত্রগুলো রাখেন পাটের গাঁটের ভেতর লুকিয়ে। গোলাবারুদগুলোও চটের বস্তার ভেতর লুকিয়ে নেন। রাস্তায় কেউ জিজ্ঞেস করলেই জানিয়ে দেন যে তাঁরা কাঠ ব্যবসায়ীর দল: সিলেট গিয়ে গন্ডগোলে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন। এখন দেবীদ্বারে নিজ গ্রামে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন।

কঠিন গোপনীয়তার মধ্যে পথ চলে এদিন বিকেল চারটার দিকে সুবেদার ওহাব তাঁর দল নিয়ে চান্দলা নামক গ্রামে পৌঁছান। দিনটি ছিল বাজারের দিন। চান্দলা বাজারে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল। সুবেদার ওহাব তাঁর দলের লোকজনকে গ্রামের পূর্ব পাশে পুকুরপাড়ের জঙ্গলে আত্মগোপন করে থাকার নির্দেশ দিয়ে নিজে ছদ্মবেশে বাজারে যান। উদ্দেশ্য, পরিচিত কাউকে পেলে দলের লোকজনের রাতের খাবার ও থাকার ব্যবস্থা করা। এই গ্রামের কয়েকজন ছাত্র ও যুবকের দেবীপুর ক্যাম্পে আসা-যাওয়া ছিল। ওদের কাউকে পেলে সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব।

কিছুক্ষণ বাজারে ঘোরাফেরা করতেই সুবেদার ওহাব পূর্বপরিচিত সিদ্দিক মেম্বার এবং সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোরের নায়েক জামালকে পেয়ে যান। নায়েক জামাল তখনো মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়নি। কেবল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। এদিকে সুবেদার ওহাব তাঁর দলের লোকদের চান্দলা গ্রামের পূর্ব প্রান্তের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে অবস্থান নেওয়ার সংবাদ দেন।

স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার সিদ্দিক এবং নায়েক জামাল সুবেদার ওহাবকে তাঁর লোকজন নিয়ে রাতের অন্ধকারে চান্দলা উচ্চবিদ্যালয়ের রুমের ভেতরে আত্মগোপন করার পরামর্শ দেন। তাঁরা দুজন সুবেদার ওহাবের লোকজনের রাতের খাবার স্কুলঘরে নিয়ে পৌঁছাবেন বলে আশ্বাস দেন। সে অনুযায়ী সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে সুবেদার ওহাব তাঁর লোকজন নিয়ে স্কুলঘরে গিয়ে অবস্থান নেন।

রাতে স্থানীয় কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি গোপনে স্কুলঘরে গিয়ে সুবেদার ওহাবের সঙ্গে দেখা করে সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দেন। কিন্তু বাজারের দিন ছিল বলেই অন্য এলাকার অনেকেই হয়তো তাঁদের আগমনের সংবাদ জেনে থাকতে পারে। তাই নিরাপত্তার জন্য শেষ রাতে এই গ্রাম ছেড়ে পাশের সিদলাই গ্রামে গিয়ে চান্দ মিয়া মেম্বারের বাড়িতে আশ্রয় নিতে পরামর্শ দেন। সিদ্দিক মেম্বার ও নায়েক জামাল একই মতামত প্রকাশ করেন। রাতের খাবার শেষে সুবেদার ওহাব তাঁর দলের লোকজনকে বিশ্রামের নির্দেশ দেন। নায়েক মোজাম্মেল, সিদ্দিক মেম্বারসহ কয়েকজন সুবেদার ওহাবের লোকজনের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে চারদিকে পাহারার ব্যবস্থা করেন।
শেষ রাতে সুবেদার ওহাব তাঁর দলের ২৮ জন সেনাসদস্যকে নিয়ে সিদলাই গ্রামে চান্দ মিয়া মেম্বারের বাড়িতে পৌঁছান। চান্দ মিয়া মেম্বার আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে ছিলেন। প্রধান ঘর খালি করে তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের রান্নাঘরে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন।

চান্দ মিয়া মেম্বার ভোর হতেই তাঁর বাড়িতে অপরিচিত লোকজনের আগমন বন্ধ করে দেন। বাড়ির চারদিকে পাহারাদার নিযুক্ত করেন। সকালে চান্দ মিয়া মেম্বারের বিশ্বস্ত কয়েকজন স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তি সুবেদার ওহাবের সঙ্গে দেখা করে সব রকম সাহায্য এবং সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তাঁদের মধ্যে স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং আবদুর রব মাস্টারের নাম উল্লেখযোগ্য।

২৬ এপ্রিল ১৯৭১। এদিক বেলা ১১টার দিকে খাবারদাবার সেরে সুবেদার ওহাব চান্দ মিয়া মেম্বারের দেওয়া একজন বিশ্বস্ত লোককে সঙ্গে নিয়ে কৃষকের ছদ্মবেশে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কপথে অ্যামবুশ স্থাপনের উপযুক্ত জায়গা নির্বাচনে রেকি করতে বেরিয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ গ্রামের মাঠ হয়ে পথচলার পরই সড়কপথে উঠে পড়েন। পাকিস্তানি বাহিনীর দু-একটি করে গাড়ি সড়কপথ ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কুমিল্লার দিকে অথবা কুমিল্লার দিক থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশে দ্রুত বেগে যেতে দেখেন।
সুবেদার ওহাব দূর থেকেই গাড়ি দেখে রাস্তা ছেড়ে মাঠে নেমে পড়েন। শালগড় নামক গ্রামে পৌঁছাতেই দেখতে পান যে এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরেই পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। গ্রামটি একেবারেই কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কসংলগ্ন। প্রধান সড়কে সফল অ্যামবুশ স্থাপনের জন্য এই গ্রামকেই সুবেদার ওহাব নির্বাচন করলেন। গ্রামের দু-একজন লোকের সঙ্গে কৌশলে আলাপ করে সুবেদার ওহাব জানতে পারলেন যে ওরা সবাই মুসলিম লীগপন্থী। ওদের নেতা মফিজউদ্দিন খান মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা এবং কেন্দ্রের একজন মন্ত্রী। ওদের নেতা মফিজউদ্দিন সাহেব চান না যে দেশটা ভেঙে যাক এবং পূর্ব পাকিস্তান ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হোক। কাজেই পাকিস্তানি বাহিনীকে তারা সব রকম সহায়তা করতে প্রস্তুত।

শালগড় অ্যামবুশ

সুবেদার ওহাব গ্রামের সাধারণ লোকদের মতামত জেনে অপারেশনটির গোপনীয়তা রক্ষায় সর্বাধিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। গ্রামের ঘনবসতি এলাকায় অবস্থান না নিয়ে মাঠের ভেতর উঁচু ভিটা এবং পরিত্যক্ত বাড়িগুলোতে অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। গ্রামের লোকদের কাছে সুবেদার ওহাব নিজেকে দেবীদ্বারের মরিচা গ্রামের বাসিন্দা বলে পরিচয় দেন। ছোট ভাই স্থানীয় গোডাউনের চৌকিদারের চাকরি করত বলে জানান। দুই মাস ধরে তার কোনো খোঁজখবর নেই। তাই ছোট ভাইকে খুঁজতে এসেছেন বলে ওদের জানান।

অ্যামবুশ স্থানের রেকির কাজ শেষ করে বিকেল চারটার দিকে সুবেদার ওহাব সিদলাই গ্রামে চান্দ মিয়া মেম্বারের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছান। বিকেল আনুমানিক পাঁচটার সময় ওই গ্রামের ‘জলিল ফকির’ নামের একজন ফকির ধরনের লোক এসে জানায় যে ওই রাতে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিঅ্যান্ডবি সড়ক এবং সড়কসংলগ্ন এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। এ সংবাদে সুবেদার ওহাব নিশ্চিত হন যে ওই রাতে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কপথে বড় ধরনের সেনা কনভয় চলাচল করবে। তিনি ওই রাতেই অ্যামবুশ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন।


জলিল ফকির সুবেদার ওহাবের সঙ্গে গাইড হিসেবে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। সুবেদার ওহাব তাতে সম্মতি জানালেন। সন্ধ্যার খাবারদাবারের কাজ সেরে সুবেদার ওহাব চারজন সৈনিককে চান্দ মিয়া মেম্বারের বাড়িতে ভারী মালামালসহ থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। দলের বাকি ২৪ জন সদস্যকে প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিলেন। এই অপারেশনে সিদলাই গ্রামের চান্দ মিয়া মেম্বারের বাড়িকে রিয়ার হেডকোয়ার্টার হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। অপারেশন শেষে রিয়ার অ্যাসেমব্লি [সমবেত হওয়ার স্থান] এরিয়া হিসেবেও সবাইকে এই স্থানে একত্র হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ফরোয়ার্ড অ্যাসেমব্লি এরিয়া হিসেবে শালগড় থেকে প্রায় দেড় মাইল পূর্বে সৈয়দপুর হাইস্কুলকে নির্বাচন করা হয়। অপারেশনের স্থায়িত্বকাল চার মিনিটের মতো হবে বলেও সুবেদার ওহাব দলের সবাইকে জানিয়ে দেন।

শালগড় গ্রামের অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানপন্থী হওয়ার কারণে ওই গ্রামসংলগ্ন মাঠঘাটে অ্যামবুশ স্থাপনের সিদ্ধান্ত সুবেদার ওহাব আগে থেকে নিয়েছিলেন। দেশের অতি অভ্যন্তরে এই আত্মঘাতী অপারেশনটির গোপনীয়তা এবং অপারেশনে অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সুবেদার ওহাব সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। অপারেশন পূর্বকালীন ও চলাকালীন এবং অপারেশন-পরবর্তী খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তিনি দলের সদস্যদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করলেন।

রাত ৯টা ৩০ মিনিটের দিকে সিদলাই গ্রামের চান্দ মিয়া মেম্বারের বাড়ি থেকে শালগড় গ্রামের উদ্দেশে ২৪ জনের সেনাদলটিকে নিয়ে সুবেদার ওহাব রওনা দেন। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য মাঠের মধ্য দিয়ে পথ চলতে শুরু করেন। গ্রামের মধ্য দিয়ে পথ চলতে গেলে লোকজনের সামনে পড়তে হবে। তা ছাড়া কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাকেও গোপনীয়তা রক্ষা হবে না। তাই এ ব্যবস্থা তাঁকে নিতে হয়েছিল।

রাত ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে সুবেদার ওহাব শালগড় গ্রামের উপকণ্ঠে পৌঁছান। একটি মাঠে দলের সবাইকে নিশ্ছিদ্র নীরবতার মধ্যে অবস্থান নিতে বলেন। দলটিকে তিনি চার ভাগে ভাগ করেন। প্রথম দলটিকে শালগড় গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে, মূল আক্রমণকারী দলকে গ্রামের মাঝখানে, তৃতীয় দলটিকে গ্রামের উত্তর প্রান্তে এবং চতুর্থ দলটিকে কাভারিং ফায়ার দেওয়ার জন্য আরও উত্তরে অবস্থান নিতে হবে বলে জানিয়ে দেন।

পাকিস্তানি সেনা কনভয়টি দক্ষিণে কুমিল্লার দিক থেকেই আসবে বলে সুবেদার ওহাব ধারণা করে নিয়েছিলেন। তাই সেনাদলের পজিশন নেওয়ার ব্যাপারে এহেন সিদ্ধান্ত নিলেন। এক এক করে দলনায়কদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ অবস্থান দেখিয়ে দিলেন। সুবেদার ওহাব নিজের অবস্থান বেছে নিলেন প্রধান সড়ক থেকে মাত্র ২৫-৩০ গজ দূরে একটি বিদ্যুতের পিলারসংলগ্ন উঁচু স্থানের আড়ালে।

চারটি দলের অধিনায়কদের নিজ নিজ অবস্থান দেখিয়ে দেওয়ার পর সবাইকে নিয়ে আবার একই স্থানে একত্র হলেন। শত্রুর কনভয়ের গাড়ির হেডলাইটের আলো অনেক দূর থেকেই দেখা যাবে। কাজেই নিজ নিজ অবস্থানে যেতে খুব একটা সময় লাগবে না। তা ছাড়া শত্রু যদি দক্ষিণ দিক থেকে না এসে উত্তর দিক থেকে আসে, তাহলে অবস্থানের কিছুটা রদবদল হবে। ওই রূপ পরিস্থিতিতে কে কোথায় অবস্থান নেবেন, তাও তিনি দলনায়কদের জানিয়ে দেন।


সেনাদলটিকে একত্রে রাখার পেছনে আরও কারণ ছিল। সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ জেসিও সুবেদার ওহাব জানতেন যে অপারেশনের অনেক আগে সেনাদল নিজ নিজ অবস্থানে চলে গেলে ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’-এ চিড় ধরতে পারে। শত্রুর আগমনের সময় দীর্ঘায়িত হলে নিজ নিজ অবস্থানে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়তে পারে। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কেউ কেউ আবার আগাম গুলিগোলা নিক্ষেপ শুরু করে দিতে পারে।

রাত ১২টার দিকে দক্ষিণ দিক থেকে অনেকগুলো গাড়ির হেডলাইটের আলোয় পুরো এলাকা আলোকিত হতে লাগল। সুবেদার ওহাব দলনায়কদের নিজ নিজ অবস্থানে গিয়ে পজিশন নিতে নির্দেশ দিলেন। সুবেদার ওহাব দলনায়কদের সবাইকেই সতর্ক করে দিলেন তারা যেন তার আগে কোনো ফায়ার না করে। সুবেদার ওহাব প্রথমে তাঁর এলএমজিটি থেকে গুলি ছুড়বেন। তারপরই অন্যরা গুলি ছুড়বে। তা ছাড়া উইথড্রয়ালের জন্য তাঁর ভ্যারি লাইট পিস্তলটি থেকে পরপর দুবার গ্রিন ওভার গ্রিন বুলেট ছোড়ার পরই সেনারা অবস্থান ছেড়ে সৈয়দপুর স্কুল এলাকার দিকে সতর্কতার সঙ্গে দ্রুতগতিতে চলে যাবে। ফায়ার কাভারিং পার্টি উইথড্রয়ালের নির্দিষ্ট সিগন্যাল দেখার পরও ৫ মিনিট সময় কাভারিং ফায়ার দিয়ে যাবে।

যথারীতি প্রতিটি দলই নিজ নিজ অবস্থানে চলে গেল। সুবেদার ওহাব সড়কসংলগ্ন বিদ্যুতের পিলারের নিচে অবস্থান নিলেন। সুবেদার ওহাবের বাঁয়ে উত্তর দিকে ছিল দুটি এলএমজি পজিশন। আরও উত্তরে নায়েক তোফাজ্জল হোসেন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে একটি এলএমজি দিয়ে অন্য একটি দলকে পাঠানো হয়। জলিল ফকিরকে এই দলের সঙ্গে পাঠানো হয়। একেবারে উত্তর দিকের অবস্থানে উইথড্রয়ালের সময় কাভারিং ফায়ার দেওয়ার জন্য একজন ল্যান্স নায়েকের নেতৃত্বে একটি দল পাঠানো হয়। সব দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর কনভয়টিকে অ্যামবুশ করার জন্য সুবেদার ওহাব তৈরি হয়ে যান।

কনভয়টি ধীর গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একেবারে শালগড় গ্রাম এলাকায় কনভয়টির প্রথম দিককার ৮-১০টি জিপ, পিকআপ ও ট্রাক এসে পৌঁছায়। কনভয়টি শালগড় গ্রাম পেরিয়ে আসতেই সুবেদার ওহাব গণনা করে দেখলেন যে ওই কনভয়টিতে মোট ২৭টি গাড়ি রয়েছে। এত বড় একটি শত্রুসেনা কনভয়ের ওপর মাত্র ২৪ জন সৈনিক নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা ছিল দুঃসাহসিক ব্যাপার। কিন্তু সুবেদার ওহাব মোটেও ঘাবড়ালেন না। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে তিনি আক্রমণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেন।

শত্রুর কনভয়ের প্রায় সব কটি গাড়িই যখন ফাঁদ এলাকার ভেতরে এসে পৌঁছাল, তখনই সুবেদার ওহাব তাঁর অবস্থান থেকে প্রথম গুলি ছুড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে সব কটি অস্ত্র থেকেই একযোগে গুলি নিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়। উভয় পক্ষের ব্যাপক গুলি ও গোলাবিনিময় শুরু হয়। দুই ইঞ্চি মর্টারের গোলাগুলো শত্রুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করতে থাকে। শত্রুর কনভয়টি অগ্রভাগের জিপটি ফায়ারিং রেঞ্জের বাইরে চলে যাওয়ার কারণে তা নায়েক তোফাজ্জল নিক্ষিপ্ত গুলির আঘাত থেকে রক্ষা পায়। বাকি ২৬টি গাড়িই সুবেদার ওহাবের অ্যামবুশ পার্টির টার্গেটে পরিণত হয়। আনুমানিক চার মিনিট ব্যাপক গুলিগোলা নিক্ষেপের পর সুবেদার ওহাব তাঁর ভ্যারি লাইট পিস্তল থেকে পরপর দুটি গ্রিন ট্রেসার বুলেট নিক্ষেপ করেন। ট্রেসার বুলেট নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরপরই অ্যামবুশ পার্টির সদস্যরা সৈয়দপুর স্কুল এলাকার দিকে পশ্চাদপসরণ শুরু করে দেয়। কাভারিং পার্টি ফায়ার কাভার দিয়ে যায়।

পশ্চাদপসরণের সময় অ্যামবুশ দল শালগড় গ্রামের বাড়িঘর ও গাছপালার কাভারে পথ চলে। উভয় পক্ষের গুলিগোলা নিক্ষেপের কারণে গ্রামবাসী তাদের নিজ নিজ ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে অবস্থান নিয়েছিল। কাজেই গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে তখন কোনো প্রকার বাধা পাওয়ার আশঙ্কা ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যামবুশ পার্টির একজন ল্যান্স নায়েক ও গাইড জলিল ফকির ছাড়া সব সদস্যই সৈয়দপুর স্কুলে একত্র হয়। এরপর দুই মাইলের মতো গ্রাম্য হাঁটাপথ ধরে সবাই সিদলাই গ্রামের চান্দ মিয়া মেম্বারের বাড়িতে পৌঁছান। এখানে পৌঁছার পর ওই ল্যান্স নায়েক এসে পৌঁছায়।

নায়েক তোফাজ্জল শত্রুর ব্যাপক গোলাগুলির মধ্যে তার এলএমজিটি একটি বাঁশঝাড়ের ভেতর ফেলে এসেছিল। এই অপারেশনের নিজ পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ছিল এটিই। সিদলাই গ্রামের লোকজন জলিল ফকিরের সহযোগিতায় এই এলএমজি উদ্ধার করে দেবীপুর ক্যাম্পে সুবেদার ওহাবের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

সিদলাই গ্রামে চান্দ মিয়া মেম্বারের বাড়িতে পৌঁছাতেই দেখা গেল যে গ্রামবাসী সুবেদার ওহাবের দলের জন্য চা-নাশতা তৈরি করে অপেক্ষা করছেন। নাশতা-পানির কাজ শেষ করেই সুবেদার ওহাব তাঁর দল নিয়ে দেবীপুর ক্যাম্পের উদ্দেশে রওনা দেন। যাত্রাকালে সিদলাই গ্রামের লোকজনকে বলে যান যে তাঁরা যেন পাকিস্তানি বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির সংবাদটি দেবীপুর ক্যাম্পে পৌঁছান। সুবেদার ওহাবের দলটি চান্দলা হয়ে যখন মন্দভাগের কাছে ক্যাম্পে পৌঁছায়, তখন পূর্বাকাশ ধীরে ধীরে ফর্সা হতে শুরু করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া সংবাদে জানা যায়, এই অভিযানে শত্রুর দুটি গাড়িতে আগুন ধরে যায় এবং মোট ১৮টি গাড়ি কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১০টি গাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়। উঁচু রাস্তার আড়ালে অবস্থান নেওয়ার কারণে লোকবলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, পাকিস্তানি বাহিনীর ১৫ জনের মতো হতাহত হয়েছিল। উঁচু রাস্তার পশ্চিম পাশে আশ্রয় নেওয়ার কারণে গুলির আঘাত থেকে অধিকাংশই রক্ষা পায়। পরদিন ব্রেকডাউন এনে খালে যেসব গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গিয়েছিল, সেগুলো উদ্ধার করে নিয়ে যায়।

পরদিন রাস্তায় যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল। উল্লেখ্য, আগুনে পোড়া একটি গাড়ি স্বাধীনতার দীর্ঘ ৩০ বছর পর এখনো খালের তলায় পড়ে আছে। বড় শালগড় (নোহাটি) গ্রামের নসু মিয়া, বসু মিয়া, যোগেন্দ্র চন্দ্র সূত্রধর, ওদুদ মিয়াসহ শালগড় এলাকার অনেকেই এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী। মাত্র ২৪ জনের একটি ক্ষুদ্র দলের অ্যামবুশের ফলে শত্রুর উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়। (ঈষৎ পরিমার্জিত)
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।