বাংলাদেশের রূপকার
তরুণ রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত না হলেও দেশটার জন্ম ঠেকে থাকত না, কিন্তু তিনি না থাকলে বাংলাদেশের জন্মই হতো না। পাকিস্তান যে বাঙালি জাতির বিকাশে অনুকূল স্থান হবে না, তা তিনি দেশটির জন্মের পরপরই উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীতে এই উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে।
রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও তাঁর মৃত্যুর পরে কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাব তাঁর মনে যুগপৎ হতাশা ও স্বপ্ন তৈরি করেছিল। শেখ মুজিব বরাবর আত্মপ্রত্যয়ী এবং কখনো হাল ছাড়ার পাত্র নন। দুটি বিষয় তিনি তখনই উপলব্ধি করেছিলেন—পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং মুসলিম লীগ বাঙালির ভবিষ্যৎ নির্মাণের উপযুক্ত রাজনৈতিক দল নয়। ফলে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সামনে রেখে ১৯৪৯ সালেই জোতদার-উমেদারদের প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী দলটি থেকে বেরিয়ে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি জনগণের মুসলিম লীগ বা আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করলেন। তরুণ শেখ মুজিব দলের সামনের কাতারে বর্ষীয়ান নেতাদের রাখলেও এর চালিকা শক্তি যে তিনিই ছিলেন, তা পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়।
বায়ান্নর ঘটনাবলির পরে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রদেশের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ক্রমে মুসলিম জাতীয়তাকে ডিঙিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তার চেতনা জোরদার হয়েছে। এই প্রবণতার স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে—মুসলিম লীগ পূর্ববঙ্গ থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। তখন থেকেই এই প্রদেশে ধর্মভিত্তিকের পরিবর্তে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের একচ্ছত্র বিকাশ নিশ্চিত হয়েছে। মুজিব ও তাঁর অনুসারীরা তখনই দল থেকে সাম্প্রদায়িক পরিচয় মুছে দিলেন। আওয়ামী লীগ তখন পুরোপুরি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দলে পরিণত হয়েছে।
ষাটের দশকে সারা বিশ্বের মতো এ দেশের ছাত্র-তরুণ, শিল্পী-সাহিত্যিক, শিক্ষক–বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বামপন্থার দিকে ঝোঁক বেড়েছিল। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষদের মধ্যে তখন এই ধারার প্রভাব বেড়েছে। শোষণ-বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা-ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও সব সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে এই ধারাতে যে রাজনীতি, তার সঙ্গে শেখ মুজিব তাঁর জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে যুক্ত করতে সক্ষম হন। ছয় দফায় পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরা হলেও তাতে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখাও অনুক্ত থাকেনি। তত দিনে ছাত্র-তরুণ, শিল্পী-বুদ্ধিজীবী, সেনাসদস্য-আমলা—সমাজের কার্যকর নানা স্তরে বাঙালির স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পক্ষে উদ্দীপনা দেখা গেছে। ছাত্র-তরুণদের স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস কিংবা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ এরই বহিঃপ্রকাশ। শেখ মুজিব এই দুটি এবং এ রকম সব উদ্যোগের বিষয়ে জানতেন, এতে যুক্ত হয়েছেন। এ ধরনের বিপ্লবী চিন্তা ও কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেও তিনি নিজে বিপ্লবের রাজনীতি বা সংগঠন নিয়ে মাথা ঘামাননি। এই ধারা তাঁর একান্ত নিজের নয়।
উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পরে তিনি বঙ্গবন্ধু, জনগণের আস্থাভাজন প্রিয় নেতা এবং সবাইকে ছাপিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, এই জনপদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহানায়ক। এই সময়ে তাঁর নেতৃত্বের পেছনে দেশের মানুষ কাতারবন্দী হতে থাকে। তিনি মাঠপর্যায়ের তখনকার সময়ের শক্তিশালী প্রগতিশীল বামধারার রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী, ছাত্র-তরুণ ও শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফাভিত্তিক আন্দোলন তাঁর ছয় দফার পরিপূরক হয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে গতি ও তীক্ষ্ণতা দিয়েছিল। এই ঐক্য ও সংগ্রামী চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফলে।
একাত্তরের শুরুতে জুলফিকার আলী ভুট্টো সামরিক কর্তাদের যোগসাজশে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ ও বিজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টি করে সংঘাতের পথ রচনায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তবে এই নির্বাচনের ফলাফলেও পাকিস্তানের দুই প্রদেশের ঐক্য যে অবাস্তব এবং দেশটির ঐক্যবদ্ধ ভবিষ্যৎ যে সংকটাপন্ন, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও ২৬৭টি অর্থাৎ সব কটি আসনই জিতেছে পূর্ব পাকিস্তানে। আবার ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির কোনো ভিত্তিই ছিল না দেশের পূর্বাংশে। দুই প্রদেশে প্রতিনিধিত্বকারী কনভেনশন মুসলিম লীগ আগেই কাগুজে দলে পরিণত হয়েছিল এবং এই বাংলায় চিরকালের জন্য দলটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে বাঙালির ভবিষ্যৎ নিয়ে শেখ মুজিবের চিন্তার দূরদর্শিতা স্পষ্ট বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু কালের যাত্রাপথে নানা সংকটে-বিপদে-বিপর্যয়ে অবিচল থেকে একে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। সেদিক থেকে তিনি বাংলাদেশের রূপকার, জনক।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনিবার্যতা আগেই বুঝেছিলেন বলে স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। ছয় দফা, মাঠের রাজনীতি এবং তাঁর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু তাঁর যাত্রাপথ স্পষ্টই রেখেছিলেন। নির্বাচনে বিজয়ী শক্তিশালী বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এতটাই ভয় পেয়েছিল যে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা তারা ভাবতেই চায়নি। এটাও ঠিক যে তারা বাঙালি মুসলমানদের কখনো সমকক্ষ নাগরিক ভাবতে পারেনি। এদের দ্বারা শাসিত হওয়ার বিষয়ে তাদের চরম অনীহা প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি তারা বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে ব্যর্থতার দায় চাপানোর চক্রান্তের পুরোনো কৌশল প্রয়োগের সাহসও করেনি। তারা সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি নেতারা স্বাধীনতার বিষয়ে আপসহীন অবস্থানে অটল থাকলেও এবং তাঁদের পেছনে জাগ্রত জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ালেও তাঁরা নিশ্চয়ই সত্যিকারের যুদ্ধ বেধে যাওয়ার কথা ভাবেননি। তবে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্রের’ প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অবহিত ছিলেন এবং তাতে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি ছিল। তা সত্ত্বেও বলা যায়, বাঙালি রাজনীতিবিদ ও জনগণ বাস্তবের সামরিক অভিযান বা যুদ্ধের রূপ ও তার সঙ্গে যুক্ত জনদুর্ভোগের ব্যাপ্তি, গভীরতা ও মাত্রা সম্পর্কে এতটা সচেতন ছিল না।
বঙ্গবন্ধু আত্মগোপন বা গা ঢাকা দিয়ে প্রতিবেশী সম্ভাব্য বন্ধুরাষ্ট্রে গিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম চালানোর চেয়ে প্রতিপক্ষের হাতে বন্দী হওয়াকেই নিজের ভাগ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর মতো ক্যারিশম্যাটিক জনপ্রিয় নেতার জন্য হয়তো এটাই স্বাভাবিক পদক্ষেপ। তবে তাজউদ্দীন আহমদসহ সতীর্থ সবাইকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার এবং তাঁর অনুগামী জনগণকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। শুধু তা–ই নয়, তিনি বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। অপ্রস্তুত জাতির ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীই বস্তুত যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু তারপর বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব রূপকথার মতো অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। নিষ্ঠুর আক্রমণের মুখে লাখো লাখো নিরস্ত্র মানুষ যেমন ঘরবাড়ি, সহায়সম্পদ দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল, তেমনি আবার বাঙালি সেনা এবং কিশোর থেকে বৃদ্ধ—নানা বয়সের হাজারো মানুষ যুদ্ধে যাওয়ার জন্য পাগলপারা হয়েছে। এ এক রূপান্তরের কাহিনি। যে বাঙালি আড্ডাবাজ, অলস–প্রকৃতির, ঘরকুনো, কলহপ্রবণ এবং ভিতু স্বভাবের বলে পরিচিত-সমালোচিত বরাবর, তারাই হয়ে উঠল দেশের বীর সন্তান, রণক্ষেত্রের কিংবা গেরিলা আক্রমণের সাহসী যোদ্ধা, আত্মত্যাগে পিছপা নয় তারা।
অবশ্যই ভারতের সহায়তার কথা বলতেই হবে। তাদের সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরার জনগণ অকুণ্ঠ সহযোগিতা দিয়েছে। কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, প্রবাসী সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করেছে এবং প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্রের জোগান, রণাঙ্গনে সহায়তাদান, পরে বাংলাদেশের সঙ্গে মিত্রবাহিনী গঠন করে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে বাঙালির বহুকালের স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছে। এভাবেই মাত্র ৯ মাসের মধ্যে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে বাঙালি বিজয়ের আনন্দ ও মর্যাদা পেয়েছে। বলতেই হবে, ভারত বন্দী মুজিবের ওপরই ভরসা রেখেছিল এবং তাঁর মুক্তির জন্য ইন্দিরা গান্ধী সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুই মূলধারার রাজনীতিবিদ, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন প্রথম থেকেই লালন করেছিলেন। কারণ, তিনি জানতেন, পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাঙালির বিকাশ সম্ভব নয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি কেবল স্বপ্ন দেখেননি, তিনি এর বাস্তব সম্ভাবনাও দেখেছেন। তিনিই সেই রাজনীতিবিদ, যিনি এই স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অবিরাম রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।
বিজয়ী বাংলাদেশকে তিনি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর দলে ব্যবসায়ী-জমিদার শ্রেণির মানুষ থাকলেও রাজনীতিতে তিনি বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে ছিলেন। তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন, জগৎ শোষক ও শোষিতে বিভক্ত এবং শোষিতের পক্ষেই থাকবেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি শোষণ-বৈষম্যমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চেয়েছিলেন বলেই রাষ্ট্রের মূল নীতিতে সমাজতন্ত্র যুক্ত করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর আমলেও তোষামোদকারীর দল ছিল আশপাশে, কিন্তু তাঁর সতীর্থ হিসেবে তাজউদ্দীনের মতো মানুষ এবং কেন্দ্রে ও জেলায় জেলায় মর্যাদাসম্পন্ন নীতিমান মানুষও ছিলেন; আর সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নত নৈতিকতার শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরাও সক্রিয় ছিলেন। এখন সবটা মিলিয়ে মানুষের মান নেমে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেন নিজ দেশে বাঙালি মাথা উঁচু করে বিকশিত হতে পারে। তা কি ঘটছে?
তাঁর কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলায় অশিক্ষা, দুর্নীতি, বৈষম্য, বেকারত্ব এবং ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িকতার স্থান থাকার কথা নয়। আমাদের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল হচ্ছে। উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ রয়েছে। স্কুলে প্রতিবছর ৩৫ কোটি নতুন বই বিতরণ হচ্ছে। কিন্তু এসবই যে মানুষের জন্য, যাদের জন্য স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের রাজনীতি, তারা কিন্তু তাঁর স্বপ্নপূরণের উপযোগী হয়ে গড়ে উঠছে না। মানুষের অন্তরে দেশচেতনা ও দেশপ্রেমের সলতে কি জ্বলছে? নিজের ও পরিজনের চিন্তায় বিভোর মানুষের বাড়বাড়ন্তের মধ্যে দেশভাবনা তলিয়ে যাচ্ছে, দূরদর্শিতার প্রমাণ মেলে না, আন্তরিকতা-দক্ষতার ঘাটতি প্রকট। এ অবস্থা কেন এবং কী করণীয়, তাঁর কন্যাকে সে ভাবনাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আবুল মোমেন সাংবাদিক ও লেখক