খেলায় খেলায় ২০২০
‘তাপ, তাপ, তাপ, তাপ, তাপ। গতি, গতি, গতি, গতি, গতি...’—জয় গোস্বামীর একটি কবিতার শুরু এটা। এক বছরের ক্রীড়া সূচির ঠিকুজি লিখতে গিয়ে কবিতাটি মনে পড়ে গেল। খেলা তো এমনই। উত্তাপ আর গতি—এই তো খেলার রোমাঞ্চ।
ক্রীড়া পঞ্জিকায় যেকোনো বড় আসরের আবির্ভাব ৪ বছর পর পর। অলিম্পিক, বিশ্বকাপ, ইউরো—জমকালো সব বড় আসরই বসে চার বছর অন্তর। যেবার যে প্রতিযোগিতাটি হয় ক্রীড়া বিশ্বে সেবার সেই বছরটি হয়ে সেই প্রতিযোগিতার। বিশ্বকাপ হলে বিশ্বকাপের বছর, অলিম্পিক হলে অলিম্পিকের...এ রকম আর কী। সেই হিসেবে এবারের বছরটা অলিম্পিকের। অবশ্য ইউরো আর ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততর সংস্করণ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আছে। কিন্তু অলিম্পিক তো অলিম্পিকই। ৩৩টি খেলার ৩৩৯টি ইভেন্টের লড়াই হবে। অংশ নেবেন বিশ্বের ২০৬টি দেশের ১১০৯১ জন অ্যাথলেট। এর চেয়ে ক্রীড়া মহাযজ্ঞ আর কোনটাই বা আছে এ জগতে। তাই তো অলিম্পিককে বলা হয়ে থাকে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’।
টোকিওতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞ অলিম্পিক শুরু হবে জুলাইয়ের শেষ ভাগে। বিশ্বজোড়া অ্যাথলেটদের এই মহামিলনের বিদায়ের বিউগল বাজবে আগস্টের প্রথম ভাগে। খেলাধুলায় যে গতি আর রোমাঞ্চ ছড়িয়ে তা আকণ্ঠ পান করতে তো শুধু বড় বড় ক্রীড়াযজ্ঞে চোখ রাখলেই চলবে না, ঘুরে আসতে হবে গলি-ঘুপচিও। সেই গলি-ঘুপচি ঘুরতে গিয়ে বছরের শুরুতে জানুয়ারিতে উত্তাপটা একটু কমই পাবেন বিশ্বজোড়া ক্রীড়াপ্রেমীরা। জানুয়ারির মাঝামাঝি মরুর বুকে উত্তাপ ছড়াবে স্পেনের ঘরোয়া ফুটবলের এক অঙ্কের একটা নাটক। স্প্যানিশ সুপার কাপের ২০১৯-২০ মৌসুমের ফাইনালটা যে হবে সৌদি আরবে। আর জানুয়ারির শেষভাগে থাকছে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের রোমাঞ্চ। এরই ফাঁকে অস্ট্রিয়াতে আবার সৌরভ ছড়াবে নান্দনিক খেলা ফিগার স্কেটিং।
বাংলাদেশের ক্রিকেট রোমান্টিকদের জন্য বছরে রোমাঞ্চে ভেসে যাওয়ার জন্য অনেক রসদই আছে। জানুয়ারিটা অবশ্য শুরু হচ্ছে একটা দোটানা নিয়ে—জানুয়ারিতে পাকিস্তান সফরে যাবে তো বাংলাদেশ দল? ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে আসার কথা অস্ট্রেলিয়ার। জিম্বাবুয়ে আসবে মার্চে, জুলাই-আগস্টে মুশফিক-মাহমুদউল্লাহরা যাবেন শ্রীলঙ্কা সফরে। তিনটি ওয়ানডে খেলতে শ্রীলঙ্কা আবার ডিসেম্বরে আসবে বাংলাদেশে। এর আগে মার্চ-এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ায় মেয়েদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, একই দেশে অক্টোবর-নভেম্বরে ছেলেদের টি-টোয়েন্টি। সেপ্টেম্বরে উত্তাপ ছড়াবে এশিয়া কাপ।
ক্রিকেটের ফাঁকে ফাঁকে ফুটবলপ্রেমিকদের জন্যও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রোমাঞ্চ। ১২ জুন ইউরোপ মেতে উঠবে ইউরোর আনন্দে। ইউরোপ সেরার লড়াইয়ে নামবে ২৪টি দেশ। ১২ জুলাই পর্যন্ত ফুটবল সৌরভ ছড়াবে ইউরোপের ১২টি দেশে। একই সময়ে (১২ জুন থেকে ১২ জুলাই) ফুটবল উত্তেজনার রেণু গায়ে মাখবে দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলপ্রেমীরাও। এই সময়েই যে বসবে কোপা আমেরিকার আরেকটি আসর। যেটির শুরু হবে ‘লিওনেল মেসি কি এবার আর্জেন্টিনার হয়ে শিরোপা-খরা কাটাতে পারবেন’ প্রশ্ন নিয়ে। ফুটবলের বরপুত্রকে ফুটবল দেবতা ক্লাব ফুটবলে অঞ্জলি ভরে দিলেও আন্তর্জাতিক ফুটবলে করে রেখেছেন রিক্ত!
এর আগেই অবশ্য জানা হয়ে যাবে কার মাথায় উঠেছে ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। ৩০ মে তুরস্কের আতাতুর্ক অলিম্পিক স্টেডিয়ামে হবে এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল। ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাবে বিভিন্ন দেশের লিগগুলো। সবাই জেনে যাবেন স্প্যানিশ ফুটবলের এবারের সেরা কে—রিয়াল মাদ্রিদ, নাকি বার্সেলোনা। নাকি মুকুটটি পরেছে নতুন কোনো দল! জানা হয়ে যাবে টানা আটবার সিরি ‘আ’র শিরোপা জেতা জুভেন্টাসের রাজদণ্ড কি এবার কেড়ে নিতে পেরেছে ইন্টার মিলান বা এএস রোমা! অথবা প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুলের তিন দশকের শিরোপা-খরা ঘুচবে কি না!
ক্রিকেট-ফুটবলের মধ্যে প্রতিবারের মতো রোমাঞ্চ ছড়াবে টেনিসও। জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়া ওপেন, মে-জুনে ফ্রেঞ্চ ওপেন, জুন-জুলাইয়ে উইম্বলডন আর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে থাকছে ইউএস ওপেন। বছরের শুরু থেকেই টেনিস রোমান্টিকদের মাথায় একটি প্রশ্ন ঘুরবে—সেরেনা উইলিয়ামস কি পারবেন মার্গারেট কোর্টের সর্বোচ্চ ২৪টি গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা জয়ের রেকর্ড স্পর্শ করতে। অস্ট্রেলিয়া ওপেনেই যদি সেটা হয়ে যায় তাহলে অপেক্ষা থাকবে পরের টুর্নামেন্টে রেকর্ডটা তিনি একার অধিকারে নিতে পারবেন কি না!
তীব্র গতিতে ছোটা ক্রীড়াবর্ষটি এভাবেই উত্তাপ ছড়াতে ছড়াতে পা রাখবে ডিসেম্বরে। মনে হবে অবশেষে ফুরাল সব আয়োজন! কিন্তু তখনই হয়তো অনেকেরই মনে পড়ে যাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমিয় বাণী—শেষ হয়েও হইল না শেষ। রোমাঞ্চ যে থাকছে বছরের শেষ পাটেও। বছরটা যে শেষ হবে মেসি-রোনালদোর শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই দিয়ে। ফিফা দ্য বেস্ট আর ব্যালন ডি’অর পুরস্কার ঘোষণা করা হবে এ মাসে।
এরপর? ফুরাবে ২০২০ ক্রীড়াবর্ষের সব লেনদেন! শুরু হবে আগামী বছরের পঞ্জিকা পাওয়ার অপেক্ষা।