নলিনীকান্ত ভট্টশালী ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ জাদুঘরবিশারদ, মূর্তিতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ, মুদ্রাতাত্ত্বিক, প্রাচীন হস্তলিপিবিশারদ, পুঁথি সংগ্রাহক, সাহিত্যিক, সর্বোপরি দেশপ্রেমিক বাঙালি গবেষক।
বাংলাদেশের শিকড়-সন্ধানী মাঠপর্যায় গবেষক নলিনীকান্ত ভট্টশালী ইতিহাসের স্বর্ণভূমি বিক্রমপুরের সন্তান। পাইকপাড়া গ্রামের রোহিণীকান্ত ভট্টশালীর ও শরৎকামিনী দেবীর পুত্র নলিনীকান্ত ভট্টশালীর জন্ম হয় ১৮৮৮ সালে।
মাত্র চার বছর বয়সে পিতৃহারা বালক ভট্টশালী স্কুলশিক্ষক কাকা অক্ষয়কান্তর অভিভাবকত্বে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। নিজ গ্রামে পাঠশালা শুরু করলেও কাকার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে পূর্ববঙ্গের অনেক স্কুলে পড়তে হয়েছে তাঁকে। নলিনীকান্ত বলতেন, কাকার সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর ফলেই দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয় তাঁর। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯১২ সালে ইতিহাস নিয়ে এমএ করেন। ঢাকা কলেজেই তাঁর সাহিত্যপ্রতিভা প্রকাশ পায়। প্রথমে হাতে লিখে ও পরে ছাপিয়ে উদ্যান নামে একটি পত্রিকা বের করেন।
চাকরির প্রথম জীবনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯১৩ সালে ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯১৪ সালে প্রথম কিউরেটর নিযুক্ত হন। মৃত্যুর আগে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন। এই সময়ে ঢাকার সাহিত্যাঙ্গনে ঢাকা সাহিত্য পরিষদের প্রতিভা ও ঢাকা সাহিত্য সমাজের ঢাকা রিভিউ পত্রিকার মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত। ভট্টশালী দুটি পত্রিকাতেই নিয়মিত লিখতেন। তাঁর লেখা প্রবাসী, শনিবারের চিঠি, এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, জার্নাল অব দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, ইসলামিক কালচার প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
সাহিত্যচর্চা দিয়ে লেখালেখি শুরু হলেও তাঁর মেধার যে স্বীকৃতি এবং প্রতিভার যে প্রতিষ্ঠা তা এসেছে প্রত্নতত্ত্ব থেকে। ঢাকা জাদুঘর ছিল তাঁর সমস্ত কাজের কেন্দ্রবিন্দু। মাত্র দুজন কর্মচারী নিয়ে তিনি জাদুঘর চালাতেন। নিজে প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করতেন, সংরক্ষণ করতেন, ছবি তুলতেন, গবেষণা করতেন, প্রদর্শনী ও প্রকাশনা করতেন। পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল ঘুরে জাদুঘরের জন্য প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করতেন। সাভার, বিক্রমপুর প্রভৃতি প্রত্নস্থানে তিনি সীমিত উৎখননও করেন। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন বিষয়ে নলিনীকান্ত ভট্টশালীর আগ্রহ ছিল অপরিসীম। তাঁর নিজের কথায়, ‘মনে অহরহ ইচ্ছা জাগিতেছে যে, স্বহস্তে কোদাল ধরিয়া সমস্ত উচ্চভূমি খুঁড়িয়া সমান করিয়া দিই। প্রাচীন পুকুরগুলিকে প্রাচীন কটাহের মত ধরিয়া তুলি এবং উল্টাইয়া ফেলিয়া দিই, দেখি তাহাদের অভ্যন্তরে কী আছে। কিন্তু দুর্বৃত্ত উদর দুই বেলা যথাসময়ে চোঁ চোঁ করিয়া জানাইয়া দেয় যে রাজা অশোকের কটা ছিল হাতি তাহা না জানিলেও পৃথিবীর বিশেষ ক্ষতি হইবে না। তথাপি “নেশা যারে ধরে তারে পাগল করে”। প্রত্নতত্ত্বের নেশাগ্রস্ত হতভাগ্যগণ আমার কথার সত্যতা সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিবেন।’
পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিক না হয়েও তিনি জানতেন দেশের প্রাচীন ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ছাড়া বিকল্প নেই। প্রত্নবস্তু সংগ্রহে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবাদতুল্য। তাম্রশাসনের খণ্ডিত অংশ উদ্ধারের জন্য তিনি নিজে একনাগাড়ে চার দিন পুকুরপাড়ে বসে ছিলেন।
আমাদের দেশের ঐতিহাসিকেরা সাধারণত লেখেন, বিক্রমপুরের কীর্তি কীর্তিনাশা পদ্মা ধ্বংস করেছে। আসল ঘটনা হলো, তাঁরা বিক্রমপুর ভ্রমণ না করেই এ জাতীয় মন্তব্য করেন। বিক্রমপুর অঞ্চল থেকে বিভিন্ন সময় মূর্তি, ভাস্কর্য, তাম্রশাসন, ইট বা ইটের দেয়াল পাওয়া গেছে। দূরদর্শী গবেষক ভট্টশালী জোর দিয়ে বলতেন, বিক্রমপুরের রামপাল অঞ্চলই ছিল বাংলার প্রাচীন রাজধানী। বাংলাদেশের ইতিহাস বিনির্মাণের অপার সম্ভাবনাময় বিক্রমপুরে ভট্টশালীর জরিপ, খনন ও ব্যাখ্যা শত বছর পরও সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। ভট্টশালী-নির্দেশিত রামপাল-বজ্রযোগিনী-নাটেশ্বর এলাকায় ২০১০ সাল থেকে আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাচীন রাজধানীর বৌদ্ধবিহার, স্তূপ, মন্দির, রাস্তা প্রভৃতি আবিষ্কৃত হচ্ছে। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত উয়ারী-বটেশ্বরের ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা নিয়ে ভট্টশালীর লেখা উয়ারী-বটেশ্বর নিয়ে আমাদের সাম্প্রতিক গবেষণার অনেক জটিল রহস্য উন্মোচনে অসাধারণ সাহায্য করছে।
>প্রত্নতাত্ত্বিক খনন বিষয়ে নলিনীকান্ত ভট্টশালীর আগ্রহ ছিল অপরিসীম। তাঁর নিজের কথায়, ‘মনে অহরহ ইচ্ছা জাগিতেছে যে, স্বহস্তে কোদাল ধরিয়া সমস্ত উচ্চভূমি খুঁড়িয়া সমান করিয়া দিই।’
আমাদের দেশের ইতিহাসচর্চার একদেশদর্শিতার কথা চোখে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে ভট্টশালী প্রবাসী পত্রিকায় ‘ভারতের ইতিহাসে প্রকৃতির প্রভাব’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। বিদেশিদের ভারত জয়ের মূলে এখানকার ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ু দায়ী-ম্যাট্রিকুলেশনের পাঠ্যপুস্তকে উল্লিখিত রমেশচন্দ্র মজুমদার ও খগেন্দ্রনাথ মিত্রের এ বক্তব্যকে অসার প্রমাণিত করেন তিনি। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কীভাবে গ্রিক সেলিউকসকে পরাজিত করেন, মহাবীর স্কন্দ গুপ্ত কীভাবে হুনদের বিতাড়িত করেন, পৃথ্বীরাজ কীভাবে প্রথম তরাইনের যুদ্ধে ঘোরীকে পরাজিত করেন—এসব উদাহরণ দিয়ে দেখান। ইতিহাসের জটিল বিষয়কে তিনি প্রামাণিক ও সহজ-সরল ভাষায় প্রকাশ করেন।
ভট্টশালী শুধু প্রত্নবস্তু সংগ্রহ ও জাদুঘরে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত হননি। গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে প্রকাশ করেন চারটি মৌলিক গ্রন্থ। আইকনোগ্রাফি অব বুড্ডিস্ট স্কাল্পচার ইন দ্য ঢাকা মিউজিয়াম (১৯২৯) তাঁর একটি মাইলফলক গ্রন্থ। শুধু হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসন ও সংস্কৃতি নিয়ে তিনি গবেষণা সীমাবদ্ধ রাখেননি। ঢাকা জাদুঘরের সংগৃহীত মুসলিম শাসকদের মুদ্রা নিয়ে লেখা তাঁর কয়েনস অ্যান্ড ক্রনোলজি অব দ্য আর্লি ইনডিপেনডেন্ট সুলতানস অব বেঙ্গল (১৯২২) এ বিষয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। দ্য রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি মুদ্রাবিষয়ক গ্রন্থটি প্রকাশের জন্য প্রহণ করেছিল, কিন্তু যথেষ্ট তহবিল না থাকায় প্রকাশনার কাজ বিলম্বিত হয়। নিজের আর্থিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও ভট্টশালী নিজ খরচেই গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। দেশের ইতিহাসের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ হলে এ রকম কাজ করা সম্ভব, তা সহজে অনুমেয়।
চারটি মৌলিক বই ছাড়াও ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা বিষয় নিয়ে ভট্টশালী শতাধিক প্রবন্ধ লেখেন। তিনি প্রাচীন হস্তলিপিবিশারদও ছিলেন। মূর্তিলিপি ও তাম্রশাসনের পাঠোদ্ধার করে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের বহু শূন্যস্থান পূরণ করেন এবং নতুন বিশ্লেষণে তা সমৃদ্ধ করেন। তাঁর সময় পর্যন্ত গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশ সর্বভারতীয় খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের মনোযোগ তেমন আকর্ষণ করতে পারেনি। তাই নলিনীকান্ত ভট্টশালীকেই এ ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগেই ভট্টশালীর প্রচেষ্টায় ঢাকা জাদুঘর ইতিহাস পাঠ ও গবেষণার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। মূলত তাঁর প্রচেষ্টাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য একটি কেন্দ্র সৃষ্টি করা হয়েছিল। এক বছরের মধ্যে দান গ্রহণ বা ক্রয় করে ৩০০টি অমূল্য পুঁথি সংগৃহীত হয়েছে। ঢাকা জাদুঘরের জন্যও তালপত্র ও তুলট কাগজে লেখা বেশ কিছু দুর্লভ পুঁথি তিনি সংগ্রহ করেন। তিনি বেশ কিছু পুঁথি পাঠোদ্ধার ও সম্পাদনার কাজ করেন। ময়নামতির গান, মীনচেতন, গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস ইত্যাদি তাঁর সম্পাদিত পুঁথি। ভূমিকা অংশে তিনি পুঁথিগুলো নিয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন।
মীনচেতন পুঁথিটি ভট্টশালী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘মীনচেতন বইখানি পাইয়া উপকৃত হইলাম। বাঙ্গালা ভাষার শব্দতত্ত্ব আলোচনায় আমার স্বাভাবিক ঔৎসুক্য আছে। সেই কারণে এ বইখানি আমার কাছে বিশেষ মূল্যবান। এরূপ আবিষ্কার ও প্রচার করিয়া ঢাকা সাহিত্য পরিষৎ গৌরব লাভ করিতেছেন এবং এই উদ্যোগে আপনি যে কৃতিত্ব দেখাইয়াছেন, সে জন্য স্বদেশের হইয়া আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞতা নিবেদন করিলাম।’
ভট্টশালীর সম্পাদিত পুঁথি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। খণ্ডকালীন পড়াতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্য বিষয়ে। ১৯২২ সালে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত গ্রিফিথ পুরস্কার অর্জন করেন। দেশের ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ও শিল্পকলা নিয়ে গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৪ সালে তাঁকে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়। প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন ন্যুমিসম্যাটিক সোসাইটি ও ঢাকা সাহিত্য পরিষদের সম্পাদকমণ্ডলীর সম্মানিত সদস্যের পদ।
ভট্টশালী বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশের ইতিহাস, শিল্পকলা, স্থাপত্য, সাহিত্য, দর্শন প্রাচীনকাল থেকে সমৃদ্ধ; প্রাচীন ঐতিহ্য খুঁজে বের করা গেলে বাংলাদেশে প্রকৃত রেনেসাঁস হওয়া সম্ভব। সেই লক্ষ্যে তিনি খ্যাপা পাগলের মতো সারা জীবন পথে-ঘাটে ছুটে বেড়িয়েছেন। আমৃত্যু ঢাকা জাদুঘর ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা-তপস্যার স্থল।
ভট্টশালী ছাত্রজীবনে টিউশনি করে অর্থ উপার্জন করে লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছেন। সারা জীবন আর্থিক টানাপোড়েনেই কাটিয়েছেন।
তাঁর কন্যার চিঠি থেকে জানা যায়, সন্ধ্যার পরও তিনি জাদুঘরে বসে কাজ করতেন। ১৯৪০-এর দশকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণে বহু মানুষ ভিটে-মাটি ছেড়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ভট্টশালীর আত্মীয়স্বজন তাঁকেও ভারতে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করে। তিনি হাত ওপরে তুলে বলতেন, এ দেশ তাঁর জন্মভূমি, এ দেশ ছেড়ে তিনি কোথাও যাবেন না। কিংবদন্তিতুল্য দেশপ্রেমিক এই গবেষক ঢাকা জাদুঘরের কম্পাউন্ডে ১৯৪৭ সালে দেহত্যাগ করেন।
নবীন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকদের কাছে নলিনীকান্ত ভট্টশালী অনুপ্রেরণার এক অমূল্য উৎস। তাঁকে অনুসরণ করে এখনো মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা প্রত্নবস্তুর সিকি ভাগও আবিষ্কার ও গবেষণা করতে পারলে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য আরও সমৃদ্ধ হবে। বাঙালির শিকড়-সন্ধানী এই গবেষককে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
সুফি মোস্তাফিজুর রহমান: অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।