স্বপ্ন দেখি আকাশ ছোঁয়ার

রাইসুল কবির। ছবি: সাইফুল ইসলাম
রাইসুল কবির। ছবি: সাইফুল ইসলাম

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তির আগে থেকে আমি পার্টটাইম কাজ করতাম শেখার জন্য। ভর্তির পর টিউশনিও করতাম। আমার প্রথম চাকরির বেতন ছিল দুই হাজার টাকা। একসময় টিউশনি ছেড়ে দিয়ে শুধু চাকরি করা শুরু করলাম। কারণ, প্রোগ্রামিংয়ের কাজ করতে ভালো লাগত। যদিও টিউশনিতে টাকা অনেক বেশি ছিল। অবশ্য তখন টাকার তেমন একটা দরকার ছিল না।
কাজ করতে করতে ‘প্যারাডাইম’ নামের একটা কোম্পানির সঙ্গে মিলে ‘প্যারাডাইম নিওমিডিয়া’ নামে নতুন কোম্পানি শুরু করলাম। পরে ঠিকমতো চালাতে না পারার কারণে বন্ধ করে দিই। বুয়েটের চতুর্থ বছরের শুরুর দিকে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি। আমি ফ্ল্যাশে প্রোগ্রামিং করতাম। বেশি মানুষ এটা পারত না, তাই অনেক কাজ পেতাম। ভাবছিলাম, যদি একটা কোম্পানি দেওয়া যায়।
চতুর্থ বছরের শেষের দিকে চিন্তা করছিলাম কী করব। পড়েছি ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, অন্যদিকে প্রোগ্রামিংয়ে ছয় বছরের অভিজ্ঞতা। একদিকে ভালো চাকরি, ভালো বেতনের হাতছানি, আরেক দিকে অনিশ্চয়তা—খুব ভালো কিছু করার বা ব্যর্থ হওয়ার।
বুয়েটের এক বড় ভাই ছিলেন, গোলাম মহিউদ্দিন। তাঁর কোম্পানি ‘ল্যাটিটিউড-২৩’-এ আমি কিছু কাজ করে দিয়েছিলাম। তাদের অফিস পরিচালনার সফটওয়্যার আমি বানিয়ে দিয়েছিলাম। ওই প্রতিষ্ঠানটি এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো থ্রিডি ভিজ্যুয়ালাইজেশন কোম্পানি এবং দেশের বাইরের কাজও করছে। তাদের বিদেশের কিছু ক্রেতা সফটওয়্যারের কাজ করাতে চাইছিল। তারা আমার সঙ্গে নতুন একটি কোম্পানি করার কথা চিন্তা করছিল। তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ভারতের বিখ্যাত ‘ইনফোসিস’-এর কথা শুনলাম। ইনফোসিস তখন ৫৬ হাজার মানুষের বিশাল কোম্পানি। আমি ভাবলাম, যদি এর দশ ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষের একটা কোম্পানিও করা যায়, তাহলেও বিশাল ব্যাপার হবে। দেশে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আসবে। আর অনেক মানুষের কর্মসংস্থানও হবে।
আমার মা-বাবা দুজনেই স্কুলশিক্ষক। খুব প্রাচুর্য যেমন দেখিনি, খুব অভাবও দেখিনি। তাই অনেক টাকার প্রতি আকর্ষণ ছিল না। আবার দারিদ্র্যের ভয়ও ছিল না। তরুণ চেতনা, দেশের জন্য কিছু করতে চাইছিলাম। চিন্তা করলাম ঝুঁকিটা নিই। যদি ব্যর্থ হই, ফ্রিল্যান্সিং করে চালিয়ে দেব।
শুরু করে দিলাম ‘ব্রেইন স্টেশন-২৩’-এর কাজ। আমার পার্টনাররা খুবই ভালো ছিলেন। তাঁদের অসাধারণ দিকনির্দেশনা আর উৎসাহে আমি এগিয়ে গেলাম। খুবই ভালো কিছু সহকারী পেলাম, তাঁদের অসাধারণ সাহায্যের ফলে আরও সহজ হয়ে গেল পথচলা। সত্যি কথা বলতে কি, আমি খুবই ভাগ্যবান ছিলাম। তাই এখানে আসতে পেরেছি। এখন ব্রেইন স্টেশন-২৩ বাংলাদেশের শীর্ষ ১০টি কোম্পানির একটি। ৮০ জন প্রকৌশলীর পাশাপাশি মোট ১০০ জন মানুষ এখানে কাজ করেন। সেরা আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বেসিসের (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস) পুরস্কার পেয়েছে ব্রেইন স্টেশন-২৩। ২০১২ সালে এইচএসবিসি ব্যাংকের এক্সপোর্ট একসেলেন্স পুরস্কার পেয়েছি আমরা।

আমি তেমন একটা মেধাবী ছিলাম না। সত্যি কথা বলতে, বুয়েটে পড়ার তেমন একটা সম্ভাবনাও আমার ছিল না। কিন্তু আমার ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা ছিল পড়ার। পড়া দিয়ে নিজের অযোগ্যতা কিছুটা ঢাকার চেষ্টা করি

শুরু থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল বড় কোম্পানি করা, যেখানে অনেক মানুষ কাজ করবে। যখনই কিছু লাভ করেছি, আরও মানুষ নিয়েছি, প্রতিষ্ঠানকে আরও বড় করার চেষ্টা করেছি। আমার খুব লোভ ভালো মেধাবী কর্মীর প্রতি। যখনই কোনো ভালো মেধাবী প্রোগ্রামার পেয়েছি, নিয়ে নিয়েছি, কাজ না থাকলেও নিয়েছি।
শুরুর প্রথম এক বছর আমি অর্ধেক সময় ব্রেইন স্টেশনে কাজ করতাম আর বাকি অর্ধেক সময় ‘পেজফ্লেক্স’ নামের আরেকটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করতাম। কোটি মানুষের ব্যবহার করার মতো একটা ওয়েবসাইট কীভাবে বানাতে হয়, চালাতে হয়—এসব কিছু ওখান থেকে শিখেছি। তখন ব্রেইন স্টেশন থেকে কোনো বেতন নিতাম না। এক বছর পরে যখন পুরো সময় ব্রেইন স্টেশনে দেওয়া শুরু করলাম, তখন খুব সামান্য বেতন নিতে থাকলাম। প্রথম চার বছর কোনো লাভ নিইনি। সব টাকাই ব্রেইন স্টেশনে ব্যবহার করেছি, যদিও প্রথম বছর থেকেই লাভ ছিল। লাভের টাকা দিয়ে নতুন নতুন মেধাবী প্রোগ্রামার নিতাম, যতটুকু সামর্থ্য ছিল।
মনে আছে, ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে আমরা সব পার্টনার যখন একসঙ্গে বসলাম, দেখি এক মাসের বেশি বেতন দেওয়ার টাকা নেই। তারপর থেকে একটু সাবধান হলাম, যেন বেতন দেওয়ার মতো কিছু সঞ্চয় থাকে। আমাদের একটা সুবিধা ছিল, যেহেতু আমার লক্ষ্য ছিল বড় আউটসোর্সিং কোম্পানি করার, তাই বেশির ভাগ মাসিক কাজের গ্রাহক নেওয়ার চেষ্টা করতাম, যেন নিয়মিত টাকা পাই। তাই আমাদের বিপদ তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম ছিল। বিশেষ করে আমাদের প্রোগ্রামাররা মেধাবী ও সৎ ছিলেন। তাই কখনো কোনো ক্লায়েন্ট আমাদের ছেড়ে যাননি।
২০০৭ সালে এমবিএ পড়া শুরু করলাম। নিজে প্রকৌশলী ছিলাম, ব্যবসা পরিচালনা করার তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই ব্যবসার মৌলিক বিষয়গুলো শেখার জন্য এমবিএ পড়লাম। তারপর পিএমপি, জেডসিই, সিএসএমের মতো আরও কিছু বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে সার্টিফিকেট নিলাম, যাতে ব্যবহারিক জ্ঞানের পাশাপাশি দরকারি পুঁথিগত জ্ঞানও থাকে। বিশেষ করে আমি যেহেতু কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার না, এই জ্ঞানগুলো আরও বেশি দরকার ছিল।
আমি মনে করি, ভালো করার জন্য পড়াটা খুব দরকারি। আমি তেমন একটা মেধাবী ছিলাম না। সত্যি কথা বলতে, বুয়েটে পড়ার তেমন একটা সম্ভাবনাও আমার ছিল না। কিন্তু আমার ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা ছিল পড়ার। পড়া দিয়ে নিজের অযোগ্যতা কিছুটা ঢাকার চেষ্টা করি।
যেকোনো একটা বিষয়ের প্রতি আমি সব সময় চেষ্টা করতাম খুব ফোকাসড (নির্দিষ্ট লক্ষাভিমুখী) থাকার। যেমন আমরা শুরুতে শুধু বিদেশের কাজ করার চেষ্টা করতাম। অন্য কোনো কাজ করতাম না। আমি ব্যবসার পাশাপাশি আর কিছু করিনি, করেছি শুধু এটার সঙ্গে সম্পর্কিত কাজ।
শুরুতে এইচআর (মানবসম্পদ) নিয়ে খুব সমস্যার মুখে পড়তাম। পরে শুধু এটাতে মনোযোগ দিই, যাতে সহজে ভালো মেধাবী প্রকৌশলী পেতে পারি এবং তাঁরা আমাদের সঙ্গে অনেক দিন থাকেন।
মেধাবীরা শেখার সুযোগ চান, চ্যালেঞ্জ চান, সুযোগ-সুবিধা চান, সম্মান চান। আমরা এসব বিষয়ে কাজ করে একটা সুন্দর মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা তৈরি করি। এখন আমাদের সঙ্গে মেধাবী প্রোগ্রামাররা অনেক দিন থাকেন। এভাবে একটা জায়গায় কাজ করার চেষ্টা করি।
আমাদের আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো সততা ও বিশ্বস্ততা। আমরা আমাদের কর্মীদের খুব বিশ্বাস করি এবং সব কাজে সততা বজায় রাখি। কাজের ক্ষেত্রে খুব পীড়াদায়ক মাত্রায় স্বচ্ছতা ও সততা বজায় রাখার চেষ্টা করি।
আমরা গ্রাহকদেরও প্রচণ্ড বিশ্বাস করি এবং তাঁদের সঙ্গে কর্মীদের সরাসরি কাজ করার সুযোগ দিই। এভাবে নানা কাজের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। দু–চেখে কেবল স্বপ্ন, স্বপ্ন দেখি আকাশ ছোঁয়ার। আমি মনে করি, পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে। আজকাল শেখাটা খুব সহজ, তাই নতুন কিছু করতে গেলে, নতুন স্বপ্ন দেখতে গেলে শেখার মনোভাবটাও জরুরি।
রাইসুল কবির: প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্রেইন স্টেশন-২৩