জামদানি বাংলাদেশের ঐতিহ্য

সেই মধ্যযুগ থেকে উনিশ শতকের শুরু পর্যন্ত আজকের বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ নিয়ে গোটা অঞ্চলটাই ছিল বৈশ্বিক বস্ত্রবাণিজ্যের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। অমসৃণ, মোটা বাফতা থেকে শুরু করে মিহিন মখমল পর্যন্ত তৈরি হয়েছে এই বাংলার গ্রামে গ্রামে, স্থানীয় বয়নশিল্পীদের নৈপুণ্যে। এই ভূখণ্ডে হাতে কাটা সুতায় হস্তচালিত তাঁতে তৈরি বস্ত্রের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বব্যাপী। কৌশলগত নৈপুণ্য, সূক্ষ্মতা, বয়নদক্ষতা, নান্দনিক সৌন্দর্য আর গুণগত মানে সেই বস্ত্র ছিল তুলনাহীন। সেই কাপড়ই অতীতে মসলিন নামে বিশ্বজুড়ে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।
প্রাচীন বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য জামদানি বুনন এবং এর নকশা। জামদানি বাংলার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। জামদানি নকশা সূচিকর্মে ফুটিয়ে তোলা হয় না, ছাপাও হয় না। এর বুনন এক বিস্ময়কর বয়নকৌশল, যা শ্রুতি ও স্মৃতিনির্ভর। এই নকশা সরাসরি তাঁতে বোনা। স্বচ্ছ জমিনে অস্বচ্ছতার মোহনীয়তায় প্রতিটি নকশাই স্বতন্ত্র্, অনন্য আর সূক্ষ্ম। নকশাগুলোতে দেখা যায় জ্যামিতিক প্যাটার্নের ব্যবহার।
বাবা থেকে ছেলে, ওস্তাদ থেকে সাগরেদ—শ্রুতি ইতিহাস আর হাতে–কলমে শেখার মধ্য দিয়ে পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে এই বয়নশিল্প। একেবারে সহজ ও আদি গর্ত-তাঁতে (পিট লুম) কাপড় বোনার সময় বয়নশিল্পীরা নকশা তৈরি করেছেন। এর নেপথ্যে রয়েছে এই শিল্পীদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অর্জন করা নিরন্তর সূক্ষ্ম কাজের অনুশীলন। স্মৃতি এবং মেধার বিস্ময়কর ধারণক্ষমতা।
জামদানির আদি নকশা অর্থাৎ দীর্ঘ সময়ের সৃজনে সমৃদ্ধ নান্দনিক অলংকরণের মৌলিক ও যৌগিক মোটিফগুলো আমরা পুরোনো জামদানি বস্ত্রসম্ভারে দেখি। যার প্রধান বৈশিষ্ট্য এর পাড়, আঁচল, বুটি, তেরছি, জাল ও কলকার সমন্বয়ে আনুপাতিক আয়তন, ধরন ও অবস্থানের সামঞ্জস্য।
জামদানি শিল্প ধ্বংসের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ জামদানি বয়নশিল্পীদের নেই সরাসরি বাজারসংযোগ। তুলনামূলক কম উৎপাদন খরচের যন্ত্রচালিত তাঁতের শাড়ির সঙ্গে এর রয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা। হতাশাজনক মজুরির বিষয় তো আছেই।
ক্রেতার নিম্নগামী মূল্যমানের ধারণা এবং বিক্রেতার সব ধরনের ক্রেতাকে বিক্রয়মূল্যে সন্তুষ্ট করার মনোভাবও এ জন্য দায়ী। আরও আছে প্রথা অনুসরণে শিক্ষা ও ঐতিহ্যগত জামদানি নকশার প্রতি ওস্তাদ–কারিগরদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাসের অভাব।
জামদানির চাহিদা একটু একটু বাড়তে দেখা যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত ভোক্তা চাহিদার পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বয়নশিল্পীরা নিজেদের সৃজনশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। এসব কারণে ক্ষয়িষ্ণু জামদানির চাহিদা এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে। নগরীতে উল্লেখ করার মতো বুটিক ও বস্ত্রবিতান গড়ে উঠেছে। ইদানীং আবার জামদানির চাহিদা একটু একটু বাড়তে দেখা যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত ভোক্তা চাহিদার পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বয়নশিল্পীরা নিজেদের সৃজনশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। এসব কারণে ক্ষয়িষ্ণু জামদানির চাহিদা এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে। নগরীতে উল্লেখ করার মতো বুটিক ও বস্ত্রবিতান গড়ে উঠেছে। এসব দোকান কিংবা কারুপণ্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এখন বয়নশিল্পীদের সরাসরি যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। ওস্তাদ–কারিগরদের অনেকেই তাঁদের কাছ থেকে অর্ডারের বিপরীতে অগ্রিম নিয়ে কাজ করছেন। বহুমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়ন অথবা বর্তমান চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বয়নশিল্পীরা নিজেদের উদ্ভাবনী দক্ষতার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। নারীরাও এখন ছেলেদের মতোই তাঁতে বসেন। ভোক্তার চাহিদা মেটাতে বয়নশিল্পীরা পণ্য বহুমুখীকরণে সফল হয়েছেন। শীর্ষ ফ্যাশন হাউসগুলোর কয়েকটিতে শাড়ির পাশাপাশি তাই মিলছে জামদানির কামিজ, ফতুয়া ও ওড়না। মোটা আর অমসৃণ সুতা ব্যবহার করে জামদানি নকশায় বোনা হচ্ছে পর্দার কাপড় ও হোম ফার্নিশিং। এসব আবার রপ্তানিও হচ্ছে। তা সত্ত্বেও বলতেই হবে, এখনো চাহিদার শীর্ষেই রয়েছে শাড়ি।
বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের উদ্যোগে এখন প্রক্রিয়া চলছে সোনারগাঁর লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে একটি নলেজ সেন্টার বা জ্ঞান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার। সেখানে জামদানি নকশা, নকশার বর্ণনা ও অ্যানালজি স্থায়ীভাবে তুলে ধরা হবে, যাতে সেখান থেকে মানুষ জামদানি–বিষয়ক জ্ঞান পাবে। ইতিমধ্যে মোট ৪০০ জন বয়নশিল্পীর সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ১১টি বিষয়কে শনাক্ত করা গেছে। সংগৃহীত হয়েছে ৩৫৯টি নকশা। পাড়, বুটি, তেছরি, জাল, ছিটা, আঁচল, হাইসা—এমন নানা নামের বিচিত্র নকশা সংরক্ষণ করা হয়েছে।
পুরো প্রকল্প তিন পর্বে বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল গবেষণা ও সংরক্ষণ। এই কাজ করতে গিয়ে নানা বয়সের অসংখ্য বয়নশিল্পীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। জানা গেছে ডিজাইন মোটিফের নকল নাম এবং উদ্ধার করা হয়েছে এর সঠিক নাম, যা এই বয়ন এলাকায় পরিচিত। প্রাপ্ত তথ্যকে সঠিকভাবে সংরক্ষণের জন্য নথিভুক্ত করা হচ্ছে। অথচ এই প্রকল্প শুরুর আগ পর্যন্ত আবহমান কাল ধরে এই প্রক্রিয়া মুখে মুখে প্রচলিত ছিল।
দ্বিতীয় পর্বে চারটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়, যেখানে ১৫৭ জন শীর্ষস্থানীয় বয়নশিল্পীর উপস্থিতিতে নকশার আকার, নাম ইত্যাদির বিশুদ্ধতা নিরূপণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে ২১ জন বয়নশিল্পী স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের জন্য ৮৪টি বিশুদ্ধ নকশা-নমুনা বুনে দিয়েছেন।
তৃতীয় পর্ব শেষ হয়েছে জাতীয় পর্যায়ের সেমিনার আয়োজনের মধ্য দিয়ে। ‘জামদানি নকশা এবং বাংলাদেশের সংকটাপন্ন বয়নশিল্প’ শিরোনামের এই সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন জামদানি গ্রামের অন্তত ৩৫০ জন তাঁতশিল্পী। নকশা সংগ্রহ, সেগুলোর নমুনা তৈরি এবং সেগুলো সঠিকভাবে নথিভুক্তি করা হয়েছে। এই প্রকল্পের কল্যাণে এই সংরক্ষণ টেকসই এবং অধিগম্য হচ্ছে। উপরন্তু এই প্রক্রিয়া নীতিমালা সুপারিশ, সচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ ও স্থানীয় গ্যালারি প্রতিষ্ঠাকে ত্বরান্বিত করেছে।
এদিকে ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) সুরক্ষা আইন জামদানিকে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ইউনেসকো বাংলাদেশের জামদানি বয়নশিল্পকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই স্বীকৃতির ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বয়নশিল্পীদের সম্পৃক্ত করে জামদানি সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখা সম্ভব। এমনকি জামদানির বয়ন ও বিপণন ব্যবস্থা–সম্পর্কিত জ্ঞান তাঁতিদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াও যায়।
বংশপরম্পরায় জামদানি বয়নশিল্পীরা তাঁদের পেশায় রয়ে গেছেন। একে বলা যেতে পারে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ বয়ন উত্তরাধিকারের এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। এই ধারাবাহিকতায় এই শিল্পের ঐতিহাসিক মূল্য আরও স্পষ্ট। জামদানি নকশা এবং বয়নকৌশলগত জ্ঞানের চর্চা ও বয়নশিল্পীদের দক্ষতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের সামাজিক-সাংস্কৃতিক গুরুত্বের দৃশ্যমানতা ও সচেতনতা নিশ্চিত হবে। বস্তুত এ ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো এই সৃজনদক্ষতা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ভোক্তাদের জামদানির প্রতি উৎসাহিত করবে; যা পরোক্ষভাবে বিশ্বের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অংশ হিসেবেই জামদানিকে টিকিয়ে রাখবে।
বাংলাদেশের সমৃদ্ধ বয়ন ঐতিহ্যের অংশ জামদানিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের যৌথ উদ্যোগে ঐতিহ্যের জামদানি নকশা বই প্রকাশিত হয়েছে চলতি বছরের ১ জুলাই। এই বই তরুণ জামদানি বয়নশিল্পীদের একটি ভিত্তি তৈরি করে দেবে বলে আমাদের বিশ্বাস। অন্যদিকে ডিজাইনাররা জামদানির মৌলিক নকশা, সূক্ষ্ম বয়নকৌশল এবং এই বয়নশিল্পের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্যক অবহিত হয়ে তাঁদের জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করতে পারবেন।
শাহিদ হোসেন শামীম : বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সাবেক সভাপতি