অপেক্ষায় আছি, অপেক্ষায় থাকব

অং রাখাইন। ছবি: আশরাফুল আলম
অং রাখাইন। ছবি: আশরাফুল আলম

আমার জন্ম হয়েছে গ্রামে। কক্সবাজারের চকরিয়ার হারবাংয়ের রাখাইনপাড়ায়। অন্যান্য রাখাইনপাড়া থেকে এ অঞ্চল কিছুটা ভিন্ন। অর্থনৈতিকভাবে তেমন সচ্ছল না হলেও এলাকাটি নিয়মিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মেতে থাকে। ছোটবেলা থেকে আমি স্থানীয় গানগুলো শুনেছি, স্থানীয় থিয়েটার দেখেছি। পরে রাখাইন বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে নিজেই যুক্ত হয়ে পড়ি।
সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত আমি গ্রামেই ছিলাম। এরপর চলে আসি চট্টগ্রাম শহরে। নবম শ্রেণিতে আবার রাঙামাটির একটি স্কুলে ভর্তি হই, সেখান থেকেই মাধ্যমিক পাস করি। ছোটবেলায় পড়ালেখায় তেমন একটা মনোযোগ ছিল না। অনেক ফাঁকিবাজি করতাম। তবে স্বপ্ন দেখতাম অনেক। কখনো ভাবতাম সংগীতশিল্পী হব। কখনো আবার সমাজ সংগঠক বা চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্নও দেখতাম। রাঙামাটিতে থাকার সময় সেখানকার জীবনযাত্রা দেখে খুব প্রভাবিত হই। অনেকগুলো নৃগোষ্ঠী সেখানে—চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা। একেবারে কাছ থেকে তাদের জীবন দেখেছি। বলা যেতে পারে, পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র বানাতে এসে এই অভিজ্ঞতা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।
ওই পাহাড়ি গ্রামে কখনো চাকার গাড়ি যায়নি। সেখানকার বহু মানুষই চাকার গাড়ি দেখেনি। সেই গ্রামে একদিন একটি সাইকেল এসে হাজির। সাইকেল দেখে গ্রামের মানুষদের মধ্যে সে কী উল্লাস। সে উল্লাস দেখে তখনই চিন্তা করি, এটা নিয়ে একটা গল্পই লিখে ফেলি না কেন! আমার মর থেংগারি চলচ্চিত্রের গল্পটি এভাবে আস্তে আস্তে আমার মাথায় দানা বাঁধতে থাকে। অবশ্য তখনো কিন্তু একদমই মনে হয়নি যে এটা নিয়ে কখনো কোনো চলচ্চিত্র বানাব।
২০০১ সালে মাধ্যমিক পাসের পর আমি বান্দরবানের লামা মাতামুহূরী ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হই। পড়ালেখায় মনোযোগ ছিল না বলে প্রথমবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পিছলে পড়ি। সেটাই হওয়ার কথা ছিল। তখন আমি সারা দিন ঘোরাঘুরি করতাম। একটুও পড়তাম না। পরীক্ষায় ফেল করার পর আমার বড় ভাই ঠিক করলেন, আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেবেন। বড় ভাইকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। তাঁর কথামতো তাঁর সঙ্গেই ২০০৩ সালে ঢাকায় আসি। আসার পর তিনি বললেন, ‘তোমাকে হোটেল ম্যানেজমেন্টে পড়াব।’ যেখানে খোঁজ নেওয়া হলো, সেখানে ওই বছরের কোর্স শুরু হয়ে গেছে। আবার এক বছর পর আরেকটা কোর্স চালু হবে। বড় ভাই আমাকে বলেন, এক বছর তো বসে থাকা যাবে না। দেরি না করে ভর্তি করিয়ে দিলেন নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইনস্টিটিউট আর্ট কলেজে। নিজের পছন্দের একটি বিষয়ে পড়তে পারছি বলে আমারও ভালো লাগছিল।
আর্ট কলেজে পড়ার সময় দ্বিতীয় বর্ষে আমি যুক্ত হই সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সমগীত সংস্কৃতি প্রাঙ্গণ’-এর সঙ্গে। এ যোগ থেকেই একসময় সুযোগ পেলাম ‘প্রাচ্যনাট’–এর একটি কোর্সে ভর্তি হওয়ার। এই কোর্সটি করতে করতেই আর্ট কলেজের পড়া শেষ হয়ে যায়। এরপর আমি ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভে (ইউডা) চারুকলায় অনার্সে ভর্তি হয়ে যাই। বিষয় নিই পেইন্টিং।

অনেকেই প্রশ্ন করেন, রাখাইন হয়ে আমি কেন চাকমা ভাষায় ছবি করেছি। বাংলাদেশে ৪০ টির বেশি নৃগোষ্ঠী বাস করে। এ কারণেই প্রথমে আমি চাকমা ভাষায় ছবি বানিয়েছি

কোর্স শেষ হওয়ার পর প্রাচ্যনাট আমাকে তাদের দলের সদস্য করে নেয়। এখনো সদস্য আছি। প্রাচ্যনাট থেকে যা শিখেছিলাম, তার ওপর ভর করেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি থিয়েটার করব আর সিনেমা বানাব।
ইউডাতে পড়াশোনার দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই আমি ফটোগ্রাফি শুরু করেছিলাম। তৃতীয় বর্ষে গিয়ে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটে (নিমকো) চলচ্চিত্র পরিচালনার ওপর চার মাসের একটি কোর্স করার সুযোগ পাই। তখনই চলচ্চিত্র জগতের কিছু বন্ধুবান্ধব হয়। তাঁরা আমাকে ছবি বানানোর ব্যাপারে উৎসাহ দেন। আমি সিদ্ধান্ত নিই, শুরুর দিকে ছোটখাটো কাজ করব। প্রথমে আমি রাখাইন নববর্ষ নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র বানাই। তারপর বায়োস্কোপ নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র ওরে কায়দা ও তেল-গ্যাস রক্ষার আন্দোলন নিয়ে সম্পদ রক্ষার আন্দোলন নামে প্রামাণ্যচিত্রগুলো তৈরি করি।
এসব করতে করতেই চলচ্চিত্র-নির্মাতা নুরুল আলম আতিকের সঙ্গে ফেসবুকে আমার পরিচয়। একদিন তিনি ফোন করে আমাকে তাঁর সঙ্গে কাজ করতে বলেন। তিনিই আমাকে হাতে ধরে চলচ্চিত্রের প্রতিটি বিভাগের কাজ শেখান।
নারায়ণগঞ্জ আর্ট কলেজে পড়ার সময় থেকেই আমি আস্তে আস্তে সাইকেলের সেই গল্পটি তৈরি করতে থাকি। এবার গল্পটিকে চিত্রনাট্যে রূপ দেওয়া শুরু করি। আতিক ভাইয়ের সঙ্গে দুই বছর কাজ করতে করতে একসময় ঠিক করলাম, এই গল্প দিয়েই সিনেমা বানাব। তখন ২০১২ সাল। ছবির জন্য টাকা জোগাড় করতে শুরু করলাম। একজন বলেছিলেন, টাকা দেবেন। পরে আর দিলেন না। তখন আমার কাছের মানুষেরা এগিয়ে এলেন। বড় ভাই, ছোট ভাই, বন্ধু, আমার স্ত্রী—এঁরা সবাই আমাকে টাকা দিলেন। প্রায় ২০ জন। সবাই আমাকে উৎসাহ দিলেন। আমার স্ত্রী তাঁর গয়না বিক্রি করে আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তাঁর পরিবার থেকেও আমি অনেক সাহায্য পেলাম।
শুটিং শুরু করার ১০ দিন পর টাকা শেষ হয়ে যায়। আবার আমাকে টাকা দেন স্বজনেরা। আবার সাত দিন শুটিং করি। শুটিং শেষ করি দুই ধাপে। যাঁরা ক্যামেরার পেছনে কাজ করেছেন, তাঁরা কেউ কোনো টাকা নেননি। অভিনয়শিল্পীরাও নামমাত্র অর্থ নিয়েছেন। তাঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
ছবিটি শেষ হওয়ার পর এর প্রিমিয়ার হয় গত বছরের ডিসেম্বরে, ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ও ইনডিপেনডেন্ট ফেস্টিভ্যালে। দর্শকদের কাছ থেকে এত সাড়া পেয়েছিলাম যে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। সব কৃতিত্ব দর্শকেরই। কোনো সিনেমা ভালো কি খারাপ, সেটা নির্ধারণ করেন দর্শকই। প্রিমিয়ারে সাড়া পেয়ে আমি সীমিত পরিসরে ছবিটির কিছু অবাণিজ্যিক প্রদর্শনী করি। চট্টগ্রামে সাউথ এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ আয়োজিত ‘আমার ভাষার চলচ্চিত্র’, রাঙামাটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ছাড়াও ঘরোয়াভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছয়-সাতটি প্রদর্শনী করি। এরই মধ্যে ছবিটি যুক্তরাজ্যের রেইনবো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও ইতালিতে রিলিজিয়ন টুডে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয়।
এসব প্রদর্শনীর পর সেন্সর বোর্ড একটি চিঠি দিয়ে জানায়, সেন্সর ছাড়া কেন সিনেমাটির প্রদর্শনী হচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও আপত্তি জানায়। তবে আপত্তির বিষয়টি আমাকে জানানো হয়নি। চিঠির উত্তরে বলেছিলাম, আমি তো কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রদর্শনী করিনি। এ কারণে সেন্সর বোর্ডের সনদ নিইনি।
যা হোক, এরপর সেন্সর বোর্ডে ছবি জমা দিতে গেলাম। সেন্সর বোর্ডে ছবি জমা দেওয়া এক বিরাট কাণ্ড! ছবির সঙ্গে আনুষঙ্গিক আরও বহু কাগজপত্র জমা দিতে হবে। পরিচালক ও প্রযোজক সমিতির সদস্য হতে হবে, চলচ্চিত্রটি নিবন্ধন করতে হবে—এ রকম নানা কাগজপত্র। কথা হলো, একজন স্বাধীন নির্মাতা হয়ে আমি কেন এসব করতে যাব? আমি তো কোনো সমিতির কোনো সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ছবিটি বানাইনি।
বিশ্বের অনেক দেশে তো এখন সেন্সর বোর্ড বলেই কিছু নেই। চলচ্চিত্রের সেখানে গ্রেডিং হয়। এসব অযথা নিয়মকানুন আমাদের চলচ্চিত্রকে পেছন থেকে টেনে রেখেছে। সামনে এগিয়ে যেতে দিচ্ছে না। আমার কথা হলো, জহির রায়হান যদি পাকিস্তান আমলে জীবন থেকে নেয়া তৈরি করতে পারেন, তাহলে স্বাধীন দেশে এ সময়ে এসে কেন সেন্সরের কারণে প্রথায় ছবি আটকে থাকবে? কেন মুক্তভাবে আমরা সিনেমা বানাতে পারব না? তা ছাড়া আমি তো কোনো রাজনৈতিক ছবিও বানাইনি।
যা হোক, কাগজপত্র ছাড়াই আমি ছবি জমা দিই। এ বছরের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সেন্সর বোর্ড ছবি জমাও নেয়। আমাকে লিখিতভাবে জানানো হয়, ২২ মে সেন্সর বোর্ডে সিনেমাটির স্ক্রিনিং ডেট ঠিক হয়েছে। ২১ মে আবার জানানো হয়, স্ক্রিনিং স্থগিত হয়েছে। কী কারণে, সেটা তারা বলেননি। সাধারণত দুই মাসের মধ্যেই যেকোনো ছবি সেন্সর সার্টিফিকেট পেয়ে যায়, কিন্তু আমার ছবি সেটা পায়নি।
তবু আমি খুবই আশাবাদী যে ছবিটি তাড়াতাড়ি ছাড়পত্র পাবে। কারণ, দর্শক সিনেমাটির জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রতিদিন অসংখ্য ফোন আসে। অনেকে ফেসবুকে ছবি দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা জানান। কেউ কেউ বলেন, ছবিটি ইউটিউবে দিয়ে দেন। কিন্তু আমি পণ করেছি, আমি অপেক্ষা করব।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, রাখাইন হয়ে আমি কেন চাকমা ভাষায় ছবি করেছি। বাংলাদেশে ৪০ টির বেশি নৃগোষ্ঠী বাস করে। তাদের মধ্যে চাকমারা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। এদের ওপর দিয়ে ঝড়ঝাপটাও গেছে সবচেয়ে বেশি। এ কারণেই প্রথমে আমি চাকমা ভাষায় ছবি বানিয়েছি। ভবিষ্যতে এ দেশের অন্য নৃগোষ্ঠীদের নিয়েও কাজ করতে চাই।
১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরাদের ভূমিকা ছিল অসামান্য। এ বিষয়টি নিয়ে আমি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের কাজ করছি। ইচ্ছা আছে, আগামী বছরের জুলাইয়ে শুটিং করব। ছবির চিত্রনাট্য এখন মাঝপথে। আশা করি, ডিসেম্বরের মধ্যে লেখার কাজ শেষ হবে। লেখার পাশাপাশি অর্থ সংগ্রহের কাজও চলছে। যাঁরা সিনেমা ভালোবাসেন, শিল্প ভালোবাসেন, ভালো কাজের সঙ্গে থাকতে চান, আমার ছবির অর্থ লগ্নিকারক হিসেবে আমি তাঁদের কাছে আবেদন রাখছি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ চলচ্চিত্রটি আমার বাণিজ্যিকভাবে প্রচার করার ইচ্ছা। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্যান্য চলচ্চিত্র থেকে এটি একটু ভিন্ন রকমের হবে। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের আরও একটি দিক এখানে দেখতে পাবে। ছবিটি হবে ত্রিপুরা ভাষায়। এই ছবিটি দিয়ে আমি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের বাজারে প্রবেশ করতে চাই। এরপর মারমা ও রাখাইন ভাষায়ও আমার ছবি নির্মাণের পরিকল্পনা আছে।
আমরা মনে করি না, ছবি বানাতে বেশি টাকা লাগে। ত্যাগের মনোভাব নিয়ে শুধু নেমে পড়তে হয়। তখন অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী পাশে এসে দাঁড়ান। বাংলাদেশে আরও অনেক বেশি বেশি চলচ্চিত্র তৈরি হওয়া দরকার। ছবি নির্মাণে নতুনদের আরও এগিয়ে আসতে হবে। অনেকে যুক্ত হলে ভালো কিছু না হয়ে কি পারে?
অং রাখাইন: রাখাইন চলচ্চিত্র-নির্মাতা