ভার্চ্যুয়াল সংলাপ
সহজলভ্য হোক স্যানিটারি ন্যাপকিন
মাসিক নিয়ে পরিবার ও সমাজে খোলাখুলি আলোচনার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। অন্তর্ভুক্ত করতে হবে পুরুষ সদস্যদেরও
মাসিকের সময়ে প্রয়োজনীয় পণ্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম এখনো অনেকের নাগালের বাইরে। ন্যাপকিন সম্পর্কে জানে না অনেকে। তাই মাসিক ব্যবস্থাপনায় অনেকেই পড়ছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।
আজ শুক্রবার মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস। এ উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার স্টে সেফের আয়োজনে ও প্রথম আলোর সহযোগিতায় ‘লক্ষ্য অর্জনে পিরিয়ড কখনো বাধা হতে পারে না’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। তাঁরা মাসিক নিয়ে পরিবার ও সমাজে খোলাখুলি আলোচনার পরিবেশ গড়ে তোলারও আহ্বান জানান।
ভার্চ্যুয়াল সভায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, একসময় মাসিক নিয়ে খোলাখুলি আলোচনার সুযোগ ছিল না, এখন তা শুরু হয়েছে। এগুলো নিয়ে বেশি বেশি কথা বলতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, তিনি মাসিকের বিষয়ে প্রথম জেনেছেন দাদির কাছে। দাদি–নানিদেরও এসব বিষয়ের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন বলে জানান। তিনি আরও বলেন, মাসিকজনিত সমস্যায় নারীরা রক্তশূন্যতায় ভোগে। ফলে শিশু অপুষ্টির শিকার হতে পারে। মাসিকের সময়টাতে সচেতন থাকতে হবে। নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও বিষয়টি আরও সহজভাবে বোঝার জন্য সহপাঠ্য হিসেবে নানান উপকরণ দিতে হবে। কমিকের মতো শিক্ষামূলক কোনো সহপাঠ্য তৈরি করা যেতে পারে। তিনি এ ব্যাপারে ইউনিসেফের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, অনলাইনে টেলিমেডিসিন সেবা বাড়লেও এখনো গ্রামে নারীর প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ কম। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে যখন ত্রাণ দেওয়া হয়, সেখানে স্যানিটারি ন্যাপকিনও দেওয়া উচিত। পরিবারের পাশাপাশি গণসচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম সবার নাগালের মধ্যে আনতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের চেয়ারপারসন তাওহিদা জাহান আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন।
আলোচনায় বাংলাদেশ ধাত্রী ও গাইনোকোলজি সোসাইটির (ওজিএসবি) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও এন্ডোমেট্রিওসিস সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ইএসবি) প্রেসিডেন্ট সামিনা চৌধুরী বলেন, মাসিক নিয়ে ধীরে ধীরে অনেক ট্যাবু (কুসংস্কার) থেকে মানুষ সরে আসছে। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই নিজেদের শরীর সম্পর্কে জানার অধিকার আছে। তাদের জানানোর দায়িত্বও সবার। নিজেদের কীভাবে সুরক্ষিত রাখতে হবে, তা তাদের জানাতে হবে।
স্যানিটারি ন্যাপকিনের দামের প্রসঙ্গে এই চিকিৎসক বলেন, অল্প দামে না পাওয়া গেলে এর ব্যবহার বাড়বে না। আর কাপড় ব্যবহার করলে তা ভালোভাবে পরিষ্কার করে রোদে শুকাতে হবে। ছায়ায় শুকালে তাতে ছত্রাক জমতে পারে। তিনি বলেন, মাসিকের আগে আগে বা ওই সময়ে অনেকের শারীরিক ও মানসিক কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। এসবের জন্য কাউন্সেলিং বেশি প্রয়োজন।
মাসিকের আলোচনায় ছেলে বা পুরুষদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে জানান ইউনিসেফ বাংলাদেশের কিশোরী স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিভাগের চিকিৎসক ফারহানা শামস। তিনি বলেন, সবার অংশগ্রহণ থাকলে বিষয়টি আরও স্বাভাবিক হয়ে যাবে। শহরে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও গ্রামে মেয়েরা নিজেদের মধ্যেই মাসিক নিয়ে আলোচনা করতে পারে না।
ফারহানা শামস বলেন, শুধু স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের কথা বললেই হবে না, এটার সঠিক ব্যবহার, ব্যবহারের পর কোথায় ফেলতে হবে—এই বিষয়গুলোও জানাতে হবে। ন্যাপকিন সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এলেই কেবল এর ব্যবহার বাড়বে।
অভিনয়শিল্পী মৌটুসী বিশ্বাস বলেন, সুবিধাভোগী নারীরা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সচেতন। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ের নারীরা সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সমাজের সব নারীর জন্য মাসিকের সময়টাতে পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধা তৈরি করতে না পারলে লক্ষ্য অর্জিত হবে না।
ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মানসী সাহা ৬৪টি জেলায় ঘুরেছেন এবং মাসিক সচেতনতা নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি সুনামগঞ্জের একটি উপজেলায় গিয়ে প্রয়োজনের সময় স্যানিটারি প্যাড না পাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, সেখানে বাজারগুলোতে এই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দুর্লভ। বেশির ভাগ নারী পণ্যটি সম্পর্কে জানে না এবং যে দামে কিনতে হয়, তা দিয়ে সংসারের বাজার হয়ে যায় বলে জানায়।
অনলাইনে মাসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে মানসী সাহা বলেন, বর্তমান মহামারির প্রেক্ষাপটে টেলিমেডিসিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মাসিকের সময়ে অনেক নারীই নানান সমস্যা বোধ করেন এবং মানসিকভাবে ঘাবড়ে যান। এ সময়টাতে তাঁরা যদি অন্তত ফোনে প্রাথমিক সেবাটা পান, তাহলে সচেতন থাকতে পারবেন।
পিরিয়ড–সচেতনতা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ঋতুর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক শারমিন কবির বলেন, মাসিকের সময়টাতে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে মেয়েদের অনেকে চুপসে যায়, নিজেকে গুটিয়ে নেয়। কিন্তু এ সময় একটা মেয়ের সাপোর্ট প্রয়োজন। মাসিকের বিষয় স্বাভাবিক করতে হলে পরিবারের সবাইকে এই আলোচনায় আনতে হবে। বিষয়টি শুধু একটি মেয়েরই না, যেকোনো পরিবেশে একজন নারী যেন তার মাসিকের প্রসঙ্গে কথা বলতে পারে, তাই ছেলেদের এই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী সাফা জেরিন নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, প্রথম যখন তার মাসিক হয়, সে তখন স্কুলে ছিল। সে সময় শিক্ষক তাকে বলেছিলেন, তার শরীর খারাপ হয়েছে। বাসায় ফেরার পর মা তাকে মাসিক সম্পর্কে বুঝিয়ে বলেন। সাফা বলে, স্কুলগুলোতে এ বিষয়ে সঠিক ধারণা দেওয়া প্রয়োজন এবং স্যানিটারি প্যাডের ব্যবস্থা থাকতে হবে। মাসিক নিয়ে শিক্ষক ও সহপাঠীরা যেন খোলাখুলি কথা বলতে পারে, তেমন পরিবেশ প্রয়োজন।