প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হলেও চা-বাগানের কর্মীদের বড় অংশ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বাইরে থেকে যাচ্ছে। অন্তঃসত্ত্বা ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় রয়েছেন চা-বাগানের মাত্র ১২ শতাংশ মা। চা-বাগানে মালিকপক্ষের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত স্কুল বেশি থাকায় সেখানে বেশির ভাগ শিশু শিক্ষা উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ অবস্থায় চা-কর্মীদের জীবনের মানোন্নয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা আরও বাড়াতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত পদক্ষেপকে আরও জোরদার করতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত সংলাপে চা-বাগানের কর্মীদের এসব সমস্যা ও তা সমাধানে সুপারিশের কথা উঠে আসে।
জাতিসংঘ বাংলাদেশের জয়েন্ট এসডিজি ফান্ড কর্মসূচির আওতায় ‘চা-বাগানের নারী ও শিশুদের সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা জোরদারে করণীয়’ শিরোনামে এ সংলাপের আয়োজন করে ইউনিসেফ, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) ও প্রথম আলো।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, জাতীয় পর্যায়ে ২৮ শতাংশ পরিবার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অন্তত একটির আওতায় থাকলেও চা-বাগানের ১২ শতাংশের কম কর্মী এর আওতায়। অথচ চা-বাগানের পরিবারগুলো দারিদ্র্য ও বৈষম্যের মধ্যে বসবাস করে। জাতীয় পর্যায়ের চেয়ে চা-বাগানে চরম দারিদ্র্যের হার ৩ গুণের বেশি—প্রায় ৪৩ শতাংশ। নারী প্রধান পরিবারগুলোতে দারিদ্র্যের হার তুলনামূলক বেশি। এর মধ্যে করোনাকালে চা-বাগানের প্রায় ৭ শতাংশ মেয়েশিশু আর স্কুলে ফিরে আসেনি। এ ছাড়া চা-বাগানের স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মীদের মধ্যে আয়, বাসস্থান, ভর্তুকি মূল্যের খাবার ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। দেশে নিবন্ধিত চা-বাগানের সংখ্যা ১৬৬। এর মধ্যে ১৩৫টি সিলেট বিভাগে। ১ লাখ ৪০ হাজার কর্মীর ৭৪ শতাংশ স্থায়ী, বাকিরা অস্থায়ী। কর্মীদের ৫০ শতাংশ নারী। বৈঠকে সিলেট বিভাগের ৩৫টি চা-বাগানের কর্মীদের জীবনযাপনের ওপর ভিত্তি করে এসব তথ্য উপস্থাপন করেন ইউনিসেফের সামাজিক নীতি বিভাগের প্রধান মেকোনেন ওল্ডগোর্গিস এবং র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, সব প্রান্তিক মানুষের কাছে উন্নয়ন পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার। ক্রমান্বয়ে ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। এখন বাজেটের ১৭ শতাংশের বেশি ব্যয় হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা খাতে। এটা দেশের জন্য সুখবর। তিনি বলেন, সামাজিক সুরক্ষা খাতে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ব্যয় বর্তমানে ৩ শতাংশের ওপরে রয়েছে এবং তা ক্রমান্বয়ে আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। চা-বাগানের কর্মীসহ জীবনচক্রে ঝুঁকিতে রয়েছে, এমন মানুষদের আরও সহায়তার আওতায় আনা হবে।
ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিকে শুধু মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা না করে একে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। চা-বাগানের কর্মীদের বেশির ভাগই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় নেই। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি খাতে সব শিশু সুরক্ষা পাচ্ছে না। চা-বাগানগুলোতে বাল্যবিবাহের প্রচলন অনেক বেশি। তিনি চা-বাগানের তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান ও দক্ষতা উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য (অর্থ ও বাণিজ্য) যুগ্ম সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী বলেন, সরকার একেকটি শিল্পের জন্য প্রয়োজন অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা নেয়। ২৪ কেজি চা-পাতা তোলার জন্য একজন কর্মী দৈনিক ন্যূনতম ১২০ টাকা পান। তবে মৌসুমে অতিরিক্ত চা-পাতা তোলার জন্য একজন কর্মী দৈনিক ৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। চা-বাগানে মা ও শিশু স্বাস্থ্য, নারীর কল্যাণ, শিশুর শিক্ষায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নানা উদ্যোগ চলমান।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, চা-বাগানে স্থায়ী কর্মীদের মতো অস্থায়ী কর্মীরা সমান সুবিধা পান না। এ কারণে এ খাতে বাজেট বাড়ানো হচ্ছে। আটটি শ্রমকল্যাণকেন্দ্রের মাধ্যমে চা-বাগানে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চা-কর্মীদের জীবনমানের আরও উন্নয়ন করা সম্ভব।
চা-বাগানের কর্মীদের কথা বিবেচনায় রেখে সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতা বাড়ানো হবে বলে জানান সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (কার্যক্রম অধিশাখা) কামরুল হাসান খান। তিনি বলেন, সরকারের বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা চা-বাগানের কর্মীরাও পান।
মহিলা-বিষয়ক অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (উপসচিব) শেখ মুসলিমা মুন বলেন, সমস্যাগুলো উত্তরণে সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেককে যার যার জায়গা থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে। গণমাধ্যমকেও সক্রিয় হতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সামাজিক সুরক্ষা, দারিদ্র্যসীমা, শিক্ষা উপবৃত্তি—সব ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ের চেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে চা-বাগানের মানুষেরা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যেও আরও প্রান্তিকে থাকা এই মানুষদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়েমা হক বিদিশা বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আসার জন্য কিছু শর্ত মানতে হয়। দেখা যায়, বাল্যবিবাহের শিকার ও দুইয়ের বেশি সন্তান ধারণ করা মেয়েরা শর্ত অনুসারে বাদ পড়ে যান। চা-বাগানের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে এই বিপুলসংখ্যক মেয়েকে সুরক্ষার আওতায় আনতে শর্ত কিছুটা শিথিল করা যেতে পারে।
হাসপাতাল, চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত ধাত্রীসেবা, ৮ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়ার মাধ্যমে নারী কর্মীদের স্বাস্থ্যসেবার দিকে নজরদারি রয়েছে বলে অনুষ্ঠানে জানান বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান শাহ আলম। তিনি বলেন, কর্মী ছাড়া চা-বাগান চলবে না। সেটি বিবেচনায় রেখেই মালিকেরা কর্মীদের দেখাশোনা করেন।
জাতিসংঘের যৌথ কর্মসূচির সমন্বয়ক অ্যালেক্সিউস চিছাম বলেন, চা-বাগানভেদে কর্মীদের সুবিধাপ্রাপ্তির তারতম্য রয়েছে। অনেক আলোচনা হলেও মাত্র কয়েকটি কারখানায় গোষ্ঠী বিমা চালু করা হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মিতালী দত্ত চা-বাগানে নারী কর্মীদের বিশ্রাম, পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা চালু এবং মাসিক ব্যবস্থাপনায় স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।
ফ্রেন্ডস ইন ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক বজলে মুস্তাফা রাজী জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে চা-বাগানের কর্মীদের অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর আহ্বান জানান।
ইউএনএফপিএর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ দেওয়ান মো. এমদাদ হক বলেন, সেবাদাতা ও ওষুধের অভাবে চা-বাগানের দুর্গম এলাকাগুলোতে চিকিৎসাসেবা যথাযথভাবে পৌঁছায় না। এদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের সামাজিক নীতি বিশেষজ্ঞ হাসিনা বেগম, র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আবু ইউসুফ ও ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা কর্মকর্তা আবুল খায়ের।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।