ইলিশ, সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও জেলেদের জীবিকা
ইউএসএআইডির সহযোগিতায় ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘ইলিশ, সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও জেলেদের জীবিকা’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৭ অক্টোবর ২০২১। গোলটেবিল আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।
অংশগ্রহণকারী
ড. আব্দুস সাত্তার মণ্ডল
ইমেরিটাস অধ্যাপক; সাবেক উপাচার্য, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য (সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ)।
মো. তৌফিকুল আরিফ
অতিরিক্ত সচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
ড. সৈয়দ আরিফ আজাদ
সাবেক মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর।
কিথ মেজনার
ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক (পরিবেশ, এনার্জি এবং এন্টারপ্রাইজ), ইউএসএআইডি বাংলাদেশ অফিস।
শাহীন আনাম
নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
আশরাফুল হক
প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট (এনভায়রনমেন্ট), অফিস অব ইকোনমিক গ্রোথ, ইউএসএআইডি, বাংলাদেশ।
ড. মো. আব্দুল ওহাব
টিম লিডার, ইকোফিশ ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশ;
সাবেক অধ্যাপক, ফিশারিজ অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
সুপারিশ
■ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শক্তিশালী অর্থনীতির জন্য সামুদ্রিক সম্পদের সর্বোত্তম ও টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি
■ সমুদ্র অর্থনীতির অন্যান্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক মাছ নিয়ে গবেষণা ও আহরণের ওপর জোর দেওয়া দরকার
■ গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন
■ মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকার সময়ে সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় জেলেদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যসহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে
■ মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞাগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
■ ইলিশের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটা স্বতন্ত্র ইলিশ ইউনিট তৈরি করা প্রয়োজন
■ জেলে সম্প্রদায়কে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে যেকোনো ধরনের পরিকল্পনা নিতে হবে
■ জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা দরকার
■ জেলে পরিবারে নারীদের প্রতি বৈষম্য, বঞ্চনা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন
■ ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে অভ্যন্তরীণ নদী মোহনার পানি ব্যবস্থাপনা ও মান নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
■ ইলিশকেন্দ্রিক প্রকল্প ও কার্যক্রমগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
সমুদ্রের ইলিশ ডিম পাড়ার সময় নদীতে আসে। ইলিশ এখন একটি বৈশ্বিক সম্পদ। এর অনেক চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদা পূরণে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং মা ইলিশ রক্ষা করতে হবে। মা ইলিশ রক্ষার জন্য বছরের একটা সময় ইলিশ ধরা বন্ধ রাখা হয়। পাশাপাশি এ সময়ে জেলেরা যেন জীবিকার সংকটে না পড়ে, সেটাও আমাদের দেখতে হবে।
আব্দুস সাত্তার মণ্ডল
ইলিশ, সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও জেলেদের জীবিকায়ন বিষয়টি আলোচনা করা আমাদের জন্য সুবিধাজনক হয়েছে। কারণ, প্রথমত সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সাগর জলের উচ্চায়ন ও তীরাঞ্চলের নিমজ্জন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবিকায়ন প্রভৃতি বিষয় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক ফোরামে বিশেষ গুরুত্বসহকারে আলোচনা হচ্ছে। কাজেই বিশ্ব বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা ও তৎপরতা আমাদের পক্ষে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে নজর দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত জগৎ আমাদের অনুকূলে রয়েছে। যদিও আমরা এদিকে খুব একটা দৃষ্টি দিইনি। নদীমাতৃক দেশের সর্বশেষ গন্তব্যস্থল থাকে সাগর। তাই সাগর বাঁচিয়ে রেখে সম্পদ আহরণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়ত, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সরকার প্রণীত বিভিন্ন উন্নয়ন দলিলে বিষয়টি আনা হয়েছে। তবে এ জন্য বিস্তারিত কোনো পরিকল্পনা হয়নি।
বিশ্বের মানুষ এক–পঞ্চমাংশ প্রোটিন সরবরাহ পেয়ে থাকে মৎস্যসম্পদ থেকে। পৃথিবীর প্রায় এক শ কোটি মানুষ সাগর ও মৎস্যকেন্দ্রিক জীবিকায়নের ওপর নির্ভরশীল। নদীমাতৃক বাংলাদেশের এক–চতুর্থাংশ মানুষ সাগর উপকূল অঞ্চলে বসবাস করে। বিশ্ব বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনের ৮০ শতাংশ সাগরপথে হয়। বাংলাদেশের অনেক নদ-নদী এখন শুকিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো পণ্য পরিবহনের একটা বড় অংশ নদীপথে হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে নৌবন্দর আরও বাড়ছে। পায়রা নৌবন্দর যার সর্বশেষ উদাহরণ। ফলে পরিবহন ও বাণিজ্য আরও বাড়বে। সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতির মূল সম্পদ কী? সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতির অনেকগুলো সম্পদ এখনো আহরণ করা হয়নি। কেবল চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের নদীবান্ধব পরিবেশ একটি বড় সম্পদ। দেশের হাওর এলাকাগুলো কেবল পর্যটনকেন্দ্র নয়, সেখানে এক বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ বিশেষ মাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সাগরের জলের সঙ্গে মিশে আছে। এর পাশাপাশি সাগরে বিভিন্ন খনিজ দ্রব্য, আবিষ্কৃত ও অনাবিষ্কৃত গ্যাস এবং তেলসম্পদ রয়েছে। সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের আয়তনকে কার্যত অনেক বিশাল করার একটি সুযোগ আমরা পেয়েছি।
কৌশলগত অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আছে। আমরা সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতিকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত হিসেবে সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছি। এ নিয়ে অগ্রসর হওয়ার জন্য অগ্রাধিকারগুলো নির্ধারণ করতে হবে। এ খাতে বহু উপখাত থাকতে পারে। সেসব তালিকাভুক্ত করতে হবে। আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের নীলনকশা করা অত্যন্ত জরুরি। বিষয়টি শুধু দলিলে থাকলে হবে না, এটাকে অগ্রাধিকার তালিকায় চিহ্নিত করে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। তাহলে সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি এক নবদিগন্তের সূচনা করবে।
সৈয়দ আরিফ আজাদ
সারা দেশে এখন ইলিশ ধরা, বিক্রয় ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা চলছে। তাই এ সময় আলোচনাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আলোচনায় সাগরের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও জীবন-জীবিকায় সেসবের প্রভাবের বিষয়গুলো এসেছে। আমাদের জাতীয় জিডিপির ১ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এ রকম এক বিশেষ মাছ থেকে এত জিডিপি আসে না। বিশ্বে সাধারণত উপকূলীয় অঞ্চলে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি হয়। বাংলাদেশে এ সংখ্যা আরও বেশি। দেশে ২৪ লাখের বেশি মানুষ ইলিশকেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহ করেন। ৫ লাখের বেশি জেলে পরিবার মাছ আহরণ করে। অন্যরা মাছ সংরক্ষণ, পরিবহন, বিপণনসহ ইলিশ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। ইলিশ আমাদের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ও পরিমণ্ডলে জীবন–জীবিকার উপাদান।
আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, খাদ্যচয়ন—সবকিছুতেই ইলিশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পুরো জনগোষ্ঠীই ইলিশ ব্যবস্থাপনা পরিমণ্ডলের সঙ্গে জড়িত। ইলিশ মাছের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে। ইলিশ অনেক বিচরণপ্রবণ মাছ (হাইলি মাইগ্রেটরি)। এক জায়গায় স্থির থাকে না। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, আরব সাগরসহ নানা জায়গায় ইলিশের বিচরণ। ইলিশ রক্ষা, আহরণের জন্য পরিবেশ তৈরি, আন্তমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়—সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ অনন্য।
এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক উদ্যোগেও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশ নিজস্ব পরিমণ্ডলের পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক কাজ আছে। আমাদের জীবন, জীবিকা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, অর্থনীতি—সবকিছুর সঙ্গেই ইলিশ জড়িত। কানাডায় নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি লবস্টার চাষ ভেঙে পড়েছিল; যা পুনরুজ্জীবিত হতে ১২ বছরের বেশি সময় লেগেছিল। বাংলাদেশে ২০০২–০৩ সালের দিকে ইলিশ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু ২০০৭-০৮ এর মধ্যেই আমরা তা পুনরুদ্ধার করে ফেলেছি।
তারপর থেকে উৎপাদন বৃদ্ধি লক্ষ করেছি। তাই বলা যায়, ইলিশ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ অনন্য অবস্থান গ্রহণ করতে পেরেছে। এই অবস্থান ধরে রাখতে হবে। মাছ ধরা নিষিদ্ধের সময় সহায়তার অপ্রতুলতার বিষয়টি এসেছে। আগে নিষেধাজ্ঞার সময় মাত্র ৬ হাজার ৯০০ মানুষ ১০ কেজি করে খাদ্যসহায়তা পেত। বর্তমান সরকার তা অনেক বাড়িয়েছে। এখন মাছ ধরা নিষিদ্ধের সময় ৪ লাখ মানুষ প্রতি মাসে ৪০ কেজি করে খাদ্যসহায়তা পাচ্ছেন। সরকারের একটা সীমাবদ্ধতা আছে, সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে।
তৌফিকুল আরিফ
একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত ইলিশ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এর বাইরে তা সম্ভব নয়। এ ছাড়া নদীতে ইলিশ ঢোকার চ্যানেলগুলো কতটুকু প্রতিবন্ধকতামুক্ত করতে পারছি, তা গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এ চ্যানেলগুলো মোটামুটি ঠিক আছে। কিন্তু এবার জলবায়ুর পরিবর্তন একটা বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে। প্রতিনিয়ত ইলিশের উৎপাদন বাড়তে থাকবে, বিষয়টি এমন নয়। মাঝেমধ্যে ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ কমতেও পারে। সে বিষয়টিও আমলে নিতে হবে।
সমুদ্রে ইলিশসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যসম্পদ রয়েছে। সেসব সম্পদ আহরণেও জোর দিতে হবে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ইলিশ এককভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কিন্তু সব কটি সম্পদ নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে। শুধু এক জাতের মৎস্যসম্পদ নিয়ে কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো খাতে ধস নামতে পারে। সে জন্য বিকল্প চিন্তাভাবনা করে রাখতে হবে।
সে ক্ষেত্রে সমুদ্র অর্থনীতির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক মাছ নিয়ে গবেষণা, চাষবাস পদ্ধতি উদ্ভাবন ও মেরিকালচারের প্রবর্তন করা যেতে পারে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে ২০১৫ সালে সমুদ্র অর্থনীতির একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছিল। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছের ৬০ শতাংশ হলো ইলিশ। বাকি ৪০ শতাংশ অন্যান্য মাছ। আবার আহরিত এই ইলিশের ৯৩ শতাংশ আর্টিজনাল নৌকাভিত্তিক) ফিশারি থেকে আহরণ করছি। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার মাত্র ৭ শতাংশ ইলিশ আহরণ করছে।
একদম প্রান্তিক জেলেরা এই আর্টিজনাল ফিশারির সঙ্গে সংযুক্ত। তাঁদের জীবন-জীবিকায় ইলিশ অনেক বড় ভূমিকা রাখছে। সমুদ্রে মৎস্য আহরণের জন্য চারটি ক্ষেত্র নির্ধারণ করা আছে। আমরা এ চারটি ক্ষেত্র থেকেও ঠিকমতো মৎস্য আহরণ করছি না। আমাদের মৎস্য আহরণের এলাকা উপকূল থেকে মাত্র ২৬০ কিলোমিটারে সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ ৪৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত অনায়াসেই যাওয়া যায়। আমাদের সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা, সক্ষমতা ও বিনিয়োগ নেই। গভীর সমুদ্রে আমাদের অর্জিত এলাকায় আমরা বিচরণ করতে পারছি না। ফলে আমাদের এলাকা থেকে অন্যদের মাছ আহরণের অভিযোগ প্রায়ই আসে।
মন্ত্রণালয় থেকে চার বছর ধরে গভীর সমুদ্রে বিনিয়োগের চেষ্টা করা হচ্ছে। গভীর সমুদ্রে যাওয়া ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে টুনা ও প্যালাজিক জাতীয় মাছ আহরণের আর কোনো সুযোগ নেই। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও আর্টিজনাল ট্রলারগুলো ১০০ মিটার গভীর পর্যন্ত মাছ আহরণ করছে। যদিও ২০০ মিটার পর্যন্ত অনুমতি দেওয়া হয়। সে জন্য গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
টুনা আহরণে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প নিয়েছে। যেন তা গভীর সমুদ্রে ব্যক্তিগত বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে। জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার প্রথম থেকেই সচেষ্ট। মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকার সময়ে সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় জেলেদের জন্য খাদ্যসহায়তার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া আমাদের একাধিক প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পের অধীনে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকার সময়ে জেলেদের জীবিকায়নের জন্য বিকল্প আয়বর্ধকের ব্যবস্থা করা হয়। তাদের সন্তানদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও যুব প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছি।
জেলেদের দাদন ব্যবসা থেকে বের করে আনার জন্য সরকার ভাবছে। মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকার সময়ে খাদ্যসহায়তার পাশাপাশি নগদ অর্থ প্রদান বা খাদ্যসহায়তার পরিমাণ বাড়ানোর ব্যাপারে সরকার সচেষ্ট আছে।
শাহীন আনাম
মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বনন্দিত। মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। কিন্তু এখনো বাংলাদেশে মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত বিশাল একটি জনগোষ্ঠী দরিদ্র; বিশেষ করে ছোট নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা নানানভাবে প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন সরকারি সেবা থেকে তাঁরা বঞ্চিত। এ বিষয়ে সরকারের সচেষ্ট থাকার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকার সময়ে সামাজিক সুরক্ষা খাতের অধীনে তাঁদের সহায়তা দেওয়া হয়। সামুদ্রিক জেলেদের ওপরে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ডেনিশ ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান রাইটসের সঙ্গে একটি গবেষণা করেছে। এ গবেষণায় এসেছে, মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকার সময় জেলেদের যে সহায়তা দেওয়া হয়, তা তঁাদের জন্য যথেষ্ট নয়।
দারিদ্র্যের প্রভাব নারীদের ওপর একটু অন্যভাবে পড়ে। নারীদের সংসারের কাজগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অদৃশ্য থেকে যায়। সংসারের কাজের কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নারীর এসব অদৃশ্যমান কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে। মৎস্যজীবীদের সঙ্গে জড়িত নারীদের কাজগুলোর আলাদা মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। এখন অনেক নারী মাছ ধরতে সমুদ্রে যাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে তঁারা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পান না। নারীরা সহযোগিতামূলক কাজগুলো না করলে এ শিল্পের ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো হতো না। এসব নারীর ক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে নজর দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।
সরকার টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করতে চাইলে কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না।
কিথ মেজনার
বাংলাদেশ পরিবেশগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ও জীববৈচিত্র্যপূর্ণ। এ দেশে ১৬ কোটির বেশি মানুষের বসবাস। ফলে এটি পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ ইউএসএআইডির ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলের অংশীদার।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই ইউএসএআইডি বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার। সে থেকে এখন পর্যন্ত ইউএসএআইডি বাংলাদেশে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি মানবিক ও উন্নয়ন সহায়তা দিয়েছে। ১৯৯৮ সাল থেকে ইউএসএআইডি বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। বর্তমানে ইউএসএআইডি জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার, সচেতন নাগরিক সমাজ ও স্থানীয় কমিউনিটির সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করছে।
মৎস্য সহ-ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ১৯৯৮ সালে ইউএসএআইডি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিনিয়োগ শুরু করে। পরবর্তী সময়ে যা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিস্তৃত হয়। সুনীল অর্থনীতি (ব্লু ইকোনমি) একটি উদীয়মান ধারণা। যা সামুদ্রিক সম্পদের সর্বোচ্চ রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি জোর দেয়। সুনীল অর্থনীতির লক্ষ্য মানুষের কল্যাণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক সমতার উন্নয়ন করা। একই সঙ্গে পরিবেশগত ঝুঁকি কমিয়ে আনা। যার সঙ্গে বাংলাদেশে ইউএসএআইডির উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মিল রয়েছে।
বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শক্তিশালী অর্থনীতির জন্য সামুদ্রিক সম্পদের সর্বোত্তম ও টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫ সালে ইউএসএআইডি উপকূলীয় মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণে টেকসই ও অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনায় জোর দিয়ে ইকোফিশের মাধ্যমে সুনীল অর্থনীতিকে উৎসাহিত করা শুরু করে। এখন ইকোফিশ কার্যক্রমের দ্বিতীয় ধাপ চলমান রয়েছে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত এটি চলবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একক প্রজাতি ইলিশ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনার প্রতি ইউএসএআইডি জোর দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউএসএআইডি উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য সংরক্ষণের বিস্তৃত সুযোগের দিকে মনোনিবেশ করছে।
আশরাফুল হক
২০১৫ সাল থেকে ইউএসএআইডি ইকোফিশ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১৯ সালে এর প্রথম পর্যায় শেষ হয়েছে। ২০২০ সালের শুরু থেকে আমরা এর দ্বিতীয় ধাপ বাস্তবায়ন করছি। এ কার্যক্রম উপকূলীয় জেলেদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের স্থিতিস্থাপকতা রক্ষার চেষ্টা করছে। এর পাশাপাশি জেলে সম্প্রদায়ের খাদ্য, পুষ্টি ও আয়বর্ধনে গুরুত্ব দিচ্ছে।
ইকোফিশ উপকূলীয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের অবস্থার নিয়মিত মূল্যায়ন ও তদারক করছে। যেন আমরা উপকূলীয় বাস্তুসংস্থানের অবস্থা বুঝতে পারি। এ বিষয়ে ইকোফিশ প্রতিনিয়ত কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করছে। সেগুলো সরকারকে জানানো হয়। ইকোফিশ জেলেদের আয়ের উৎসে বৈচিত্র্য আনার ওপর জোর দিচ্ছে; পাশাপাশি নারী জেলেদের সক্ষমতা বাড়ানো, প্রশিক্ষণ প্রদান, উন্নত প্রযুক্তি ও বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা চলছে। যেন তাঁরা মৎস্য আহরণ ছাড়াও বিকল্প পেশায় ভাগ্যোন্নয়ন করতে পারেন।
এ ছাড়া ইলিশ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (হিলসা ফিশ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান) বাস্তবায়নে ইকোফিশ সহযোগিতা করছে। জেলে সম্প্রদায়ের মানুষেরাই ইকোফিশ প্রকল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইলিশ মাছ ও উপকূলীয় বাস্তুসংস্থান রক্ষার্থে ইকোফিশ সিটিজেন সায়েন্টিস্ট নামে একটা দলকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ইকোফিশ ৪০০ জেলেকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। যাঁরা মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকার সময়ে মৎস্য অধিদপ্তরসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে কাজ করে থাকেন।
এ ছাড়া প্রকল্পটির অধীনে জেলে পরিবারের তরুণদের প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। তঁারা প্রতিনিয়ত নদী ও সাগরপাড়ের প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন আবর্জনা পরিষ্কার করছেন। এসবের মাধ্যমে সামুদ্রিক মাছ ও বাস্তুসংস্থান রক্ষার্থে ইকোফিশ সরাসরি কমিউনিটির মানুষদের যুক্ত করছে। ইকোফিশ ইলিশ সংরক্ষণে প্রায় ৫৭৫ দল তৈরি করেছে। এ ছাড়া ১৩৩টির মতো মৎস্য ব্যবস্থাপনা কমিটি করা হয়েছে। প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকেরা এ কমিটিগুলোর সদস্য।
এ কমিটিগুলো ইকোফিশ সহব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এ প্রকল্প নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়। প্রায় ১৪৮টি সেভিংস গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। যেগুলোর অধীনে নারী জেলেদের প্রশিক্ষণসহ ব্যবসা ব্যবস্থাপনা শেখানো হচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমানোর পর ইকোফিশ প্রকল্প থেকে তাঁদের জমানো টাকার সমপরিমাণ তহবিল দেওয়া হচ্ছে। যেন তাঁরা ক্ষুদ্র বা ছোট আকারের ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
মো. আব্দুল ওহাব
দেশে বর্তমানে ২২ দিনের মা ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম চলছে। আমরা সব মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে চাই। সব মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত দেখতে চাই। শুধু স্থলজ কৃষির ওপর নির্ভরশীল হয়ে সারা বিশ্বের মানুষকে রক্ষা করা যাবে না। তাই এখন মানবজাতিকে বাঁচাতে সাগরের গুরুত্বের বিষয়
সামনে এসেছে।
সাগর দেবে উন্নত খাবার ও সুন্দর পরিবেশ, তাই সাগরের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব এসেছে। ইউএসএআইডি ২০১৪ সালে ইকোফিশ প্রকল্প হাতে নেয়, যা ২০১৫ সাল থেকে ব্যাপক কাজ শুরু করে। ইলিশ মাছ কখন আসে ও কখন সাগরে ফিরে যায়, তা এখন সবাই জানে। দেশের মানুষের খাবার ছাড়াও সাগরের বাস্তুসংস্থানের জন্য ইলিশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইলিশ ও জাটকা রক্ষা করতে হবে। ইকোফিশ ও মৎস্য অধিদপ্তরের যৌথভাবে পরিচালিত প্রকল্পের ইলিশ ব্যবস্থাপনার মডেল এখন পৃথিবীর রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। তাই মডেলটি হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না, ইলিশকেও হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। ইলিশ সামুদ্রিক অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইকোফিশ সমুদ্রতীরে জমা প্লাস্টিক বোতল, নাইলন জাল ও নানা ময়লা দ্রব্য সংগ্রহ করার জন্য ব্লু গার্ড চালু করেছে। ইতিমধ্যে ১০০ ব্লু গার্ড নিয়োগ করা হয়েছে। আগামী তিন বছরে ২০০ ব্লু গার্ড নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রতি সপ্তাহে তারা সমুদ্রপাড় থেকে এসব প্লাস্টিক, ছেঁড়া জাল ও ময়লা দ্রব্য সংগ্রহ করছে। এটা আগামী দিনে চলমান রাখতে হবে। জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষার জন্য যে ৪০০ কমিউনিটি ফিশ গার্ড নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোও ধরে রাখতে হবে। প্রশাসননির্ভর ব্যবস্থাপনা না করে জনসম্পৃক্ত ‘সহ-ব্যবস্থাপনা’ ইলিশ এবং সব ধরনের মৎস্য ব্যবস্থাপনার জন্য অধিক কার্যকর বলে বিভিন্ন দেশে প্রমাণিত হয়েছে। ইকোফিশ প্রকল্পে মাঝি ও জেলেদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যেন তাঁরা দায়িত্বসম্পন্নভাবে মাছ ধরে ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করেন।
মৎস্য অধিদপ্তর ও ইকোফিশের যৌথ উদ্যোগে মেঘনা নদীর নিচে সাগর অববাহিকায় ইলিশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য ৩ হাজার ১৮৮ বর্গকিলোমিটারজুড়ে একটি এমপিএ (মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া) ঘোষণা করা হয়েছে। নাফ নদীর মোহনা ও বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন ঘিরে ২ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ এলাকা নিয়ে আর একটি ‘নাফ–সেন্ট মার্টিন এমপিএ’ ঘোষণার জন্য ইতিমধ্যেই কারিগরি গবেষণা সম্পন্ন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে একটি রিপোর্ট বিবেচনার জন্য সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। ইকোফিশ প্রকল্পের মাধ্যমে আর্টিজনাল মৎস্যসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা ছাড়াও সমুদ্র উপকূলে সমাজভিত্তিক সি-উইড ও সবুজ ঝিনুক চাষ, সমুদ্রের পেলাজিক ছোট মাছের শুঁটকি ও পাউডার উৎপাদন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, একসময় পেলাজিক ছোট মাছ ফেলে দেওয়া হতো বা প্রাণিসম্পদের খাবারে ব্যবহার করা হতো।
এক হাজার জেলেবধূকে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে পেলাজিক মাছের শুঁটকি ও মাছের পাউডার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময় আমরা তিন হাজার পরিবারকে এক কেজি করে এই শুঁটকি ও পাউডার দেওয়া হয়েছে, যা পাঁচ কেজি মাছের সমপরিমাণ। জেলে সম্প্রদায়ের আর্থসামাজিক উন্নয়নের দৃষ্টান্ত হিসেবে চাঁদপুর, ভোলা ও শরীয়তপুরের তিনটি গ্রামকে মডেল গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলোর আদলে ভবিষ্যতে অন্য জেলে গ্রামগুলোকেও উন্নয়নের আওতায় নিয়ে আসা খুব জরুরি।
আব্দুস সাত্তার মণ্ডল
ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে অভ্যন্তরীণ নদী মোহনার পানি ব্যবস্থাপনা ও পানির মান নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকার সময় জেলেদের আর্থিক দুর্গতি হয়। তঁাদের সহায়তার জন্য সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। আগামী দিনেও এ সহায়তা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু এটা সর্বরোগের ওষুধ নয়।
জেলে সম্প্রদায়কে নতুন আঙ্গিকে ইলিশকেন্দ্রিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করতে সরকার, এনজিও এবং বেসরকারি খাত মিলে একটা নতুন চিন্তা করা প্রয়োজন। ইলিশ আমাদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এটার গুরুত্ব ও উন্নয়ন সমুন্নত রাখতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা সেলে একটা স্বতন্ত্র ইলিশ ইউনিট তৈরি করা যেতে পারে; যাদের কাজই হবে ইলিশকেন্দ্রিক প্রকল্প এবং কার্যক্রমগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সামনে নিয়ে আসা।
জাতীয় পর্যায়ে অনেক রকম পদক দেওয়া হয়। প্রথম আলোর মতো অগ্রগামী কোনো পত্রিকা, ওয়ার্ল্ডফিশসহ আরও অনেকে যুক্ত হয়ে একটা জাতীয় ইলিশ পদক প্রবর্তন করার কথা বিবেচনা করা যায়, যা ইলিশ অর্থনীতি সম্পর্কে জাতীয় পর্যায়ে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
ইলিশ কেবল অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এর একটা রপ্তানি বাজার আছে। সেখানে প্রক্রিয়াজাত ইলিশের একটা বাজারও তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে নজর দিতে হবে। ইলিশ মাছের মতো দুষ্প্রাপ্য অভিজাত সুস্বাদু মাছ ক্রয়ে একটু বাড়তি দাম দেওয়ার জন্য আমাদের মনোজগতে প্রস্তুতি থাকতে হবে। তাহলে বাজার সব সময় চাঙা থাকবে এবং ইলিশ উৎপাদন ও ইলিশ অর্থনীতির কর্মকাণ্ড আরও বৃদ্ধি পাবে।
তৌফিকুল আরিফ
আলোচনায় অনেকগুলো যৌক্তিক প্রস্তাব এসেছে। আমরা সব জেলেকে নিবন্ধনের আওতাভুক্ত করছি। কিন্তু নারীরা জেলে হিসেবে নিবন্ধন করতে চান না। এ ক্ষেত্রে তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও আগ্রহী নন। সে জন্য প্রকৃত জেলে হিসেবে তাঁদের চিহ্নিত করা এবং কার্ড দেওয়ার সুযোগ হয় না। আমরা তাঁদের সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখে থাকি।
অবসর সময়ে তাঁরা যেন কিছু করতে পারেন, তাঁদের কল্যাণার্থে শুধু সমুদ্রকেন্দ্রিক জেলে সম্প্রদায়ের জন্য ৫০০ কোটি টাকার একটি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইকোফিশ থেকে চালু করা কমিউনিটি গ্রামের ধারণা আমরা নিয়েছি। সেটা আমরা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করছি। প্রায় ২০ হাজার যুবক-যুবতীকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দিচ্ছি।
সরকার জেলে ও জেলে পরিবারের দিকে বিশেষ নজর রাখছে। জেলে পেশা থেকে যেন অন্য পেশায়ও যাওয়া যায়, সেদিকে সরকারের দৃষ্টি রয়েছে। ইলিশ গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। ভালো জিনিস পেতে হলে ভালো মূল্য দিতে হবে। ইলিশের দাম বেড়ে গেল বলে হইহই করলে ইলিশ সম্পদ রক্ষা করা যাবে না। ইলিশ আহরণের জন্য খুব স্বল্প সময় থাকে। ইলিশ আহরণে সম্পৃক্ত জেলেরা উপযুক্ত মূল্য না পেলে তাঁরা ইলিশ আহরণ থেকে নিবৃত্ত হয়ে যাবেন। বিশেষ ক্ষেত্র বাদে আমাদের মন্ত্রণালয় নীতিগত ইলিশ রপ্তানি না করার পক্ষে আছে।
বর্তমানে আমাদের ক্যারিং ক্যাপাসিটি প্রায় ৭ লাখ মেট্রিক টন। এখন আমাদের উৎপাদন সাড়ে ৫ লাখ মেট্রিক টন। দেড় লাখ মেট্রিক টন হয়তো বাড়বে। ৬ লাখ মেট্রিক টনের বেশি ইলিশ উৎপাদন হলে বাকিটা রপ্তানি করব; যা আমাদের অর্থনীতিতে বেশ ভালো অবদান রাখবে। সবকিছু সরকারি দায়িত্ব না ভেবে বেসরকারি খাতেরও কিছু দায়িত্ব নিতে হবে।
আমাদের নতুন আইন অনুযায়ী সব আর্টিজনাল ফিশারি নৌকাগুলো নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসব। আজকের আলোচনার সুপারিশগুলো মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে সম্পূরক তথ্য ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করবে।
ফিরোজ চৌধুরী
আজকের গোলটেবিল আলোচনায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ এসেছে। আশা করা যায়, নীতিনির্ধারকেরা তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।