কোভিডের প্রকোপ কমেছে, বাল্যবিবাহ কি কমবে?
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘কোভিডের প্রকোপ কমেছে, বাল্যবিবাহ কি কমবে?’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২। এ আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
অংশগ্রহণকারী
এম এ মান্নান এমপি
মাননীয় মন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
শামীম হায়াদার পাটোয়ারী
সংসদ সদস্য ও সদস্য, আইন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
রুমিন ফারহানা
সংসদ সদস্য
গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার
সংসদ সদস্য
টনি মাইকেল গোমেজ
পরিচালক, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ
নাসিমা আক্তার জলি
সম্পাদক, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম
মনিরা হাসান
শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ, বাংলাদেশ
আনিসুল হক
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো; সম্পাদক, কিশোর আলো
মো. ইকবাল হোসেন
মহাসচিব, বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতি
নবনীতা চৌধুরী
পরিচালক, জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি, ব্র্যাক
কাশফিয়া ফিরোজ
পরিচালক (গার্লস রাইটস), প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ
সভাপতি ঢাকা জেলা, বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতি
সোমনূর মনির কোনাল
সংগীতশিল্পী
নিশাত সুলতানা
উপপরিচালক, অ্যাডভোকেসি, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
কোভিডের আগে বাল্যবিবাহ কিছুটা কমেছিল। কোভিডের সময় সেটা বেড়ে যায়। স্কুল থেকে অনেক মেয়েশিশু ঝরে পড়েছে। বাল্যবিবাহের কারণে অসুস্থ শিশু জন্ম নেয়, পুষ্টির অভাব হয়। ১৮ বছরের নিচে যেন মেয়েদের বিয়ে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বাল্যবিবাহ নিরসনে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা নিয়েই আজ আলোচনা হবে।
নিশাত সুলতানা
বাল্যবিবাহপ্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। করোনাকালে সারা বিশ্বেই বাল্যবিবাহ বেড়েছে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে এখনকার মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি জানে। তাই জেনেশুনেও পরিবারগুলো কেন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তার অভাব প্রকটভাবে বিরাজমান। সেই সঙ্গে আছে দারিদ্র্য ও যৌতুকপ্রথা। বাল্যবিবাহ রুখতে হলে বাল্যবিবাহের বিকল্প পথগুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন।
ওয়ার্ল্ড ভিশন সারা বিশ্বে পিছিয়ে পড়া শিশুদের অধিকার ও সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ তার বর্তমান পঞ্চবার্ষিক কান্ট্রি স্ট্র্যাটেজিতে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ‘ইট টেকস মি টু এন্ড চাইল্ড ম্যারেজ’ বা ‘আমিই পারি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে’ ক্যাম্পেইনের অধীন সারা দেশে শিশু ও তরুণদের বাল্যবিবাহবিরোধী বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রমে একীভূত করেছে।
নিজ উদ্যোগে কিংবা দলগত প্রচেষ্টায় অনেক বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সম্পৃক্ত শিশুরা। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে অ্যাডভোকেসি অ্যাজেন্ডা হিসেবে ওয়ার্ল্ড ভিশন যে বিষয়গুলো গুরুত্ব দিচ্ছে, তা হলো বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সারা দেশে মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে স্থানীয় পর্যায়ে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭–এর ১৯ ধারার অধীন বিয়ের জন্য সর্বনিম্ন বয়স নির্ধারণ করা, বাল্যবিবাহের শিকার শিশুরা যেন শিক্ষাসহ তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটি নিশ্চিত করা এবং বাল্যবিবাহকে প্রতিহত করতে পারে—এ ধরনের সব ন্যাশনাল হেল্পলাইন নম্বর যেমন ১০৯, ১০৯৮, ৯৯৯ জনপ্রিয় করা।
বাল্যবিবাহ রুখতে হলে শুধু সচেতনতা সৃষ্টিই যথেষ্ট নয়। বরং এ ক্ষেত্রে নারীর জন্য অনুকূল শিক্ষাও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যা মেয়েশিশুকে নিয়ে মা–বাবার মনের শঙ্কাকে দূরে সরাবে এবং নারীকে করবে বলিষ্ঠ ও আত্মপ্রত্যয়ী।
এম এ মান্নান এমপি
আজকের আলোচনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাল্যবিবাহের বিষয়টি অনেক গভীরে। কোভিডের সঙ্গে এর খুব বেশি সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। এর সঙ্গে দারিদ্র্য, বিশ্বাস ও বিভিন্ন বিষয় জড়িত।
নিজের সঙ্গে যখন তুলনা করি, তখন অনেক ক্ষেত্রে আমরা ভালো করেছি। কিন্তু যখন অন্যের সঙ্গে তুলনা করি, তখন অবস্থা ততটা ভালো মনে হয় না। ২০০ রাষ্ট্রের মধ্যে বিশ্বে বাল্যবিবাহে আমরা যদি চতুর্থ হই আর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম হই, সেটা আমাদের জন্য মোটেই ভালো না।
আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। বাল্যবিবাহ রোধে সবচেয়ে বড় দরকার সচেতনতা। সাবই মিলে জাতীয়ভাবে এটা মোকাবিলার জন্য কাজ করতে হবে। মাঝেমধ্যে প্রশাসনের কেউ বা কোনো মেয়ে নিজেই তার বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করে। এটা ভালো কাজ। কিন্তু এটা সমাধান নয়। সরকার একা এটা পারবে না। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় আছে সবাইকে নিয়ে এগোতে হবে। এটা অনেক কঠিন। কিন্তু আমাদের সেই কঠিন কাজটিই করতে হবে।
সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমরা নিরক্ষরতা প্রায় দূর করতে পেরেছি। এখন আমাদের সাক্ষরতার হার ৮০ শতাংশের বেশি। দারিদ্র্য প্রায় ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। আমরা যত কথাই বলি না কেন, মনে হয় বাল্যবিবাহের প্রধান কারণ দারিদ্র্য। আমি আমার এলাকায় গ্রামে যাই। সেখানকার মানুষের চাহিদা ব্রিজ, কালভার্ট, পাকা টয়লেট, টিউবওয়েল, ভিজিডি কার্ড ইত্যাদি। আমরা যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করি, এসব তাদের চিন্তার মধ্যে নেই।
বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম ভয়ংকর ব্যাধি। আবার সব ব্যাধির মূল হচ্ছে দারিদ্র্য। এসব আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। সুশীল সমাজকে অনুরোধ করব, যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন, সে জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্যসহ এসব বিষয় নিয়ে যেন তাঁরা কথা বলেন।
বাল্যবিবাহ সমাজের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করছে। শহর ও গ্রামের মানুষের চিন্তার পার্থক্য দূর করতে হবে।
নবনীতা চৌধুরী
যেকোনো বিষয় সমাধানের জন্য জাতীয় স্বীকৃতির প্রয়োজন। দেশে ৫৪ শতাংশের বেশি মেয়ের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়। সবচেয়ে বেশি বিয়ে হয় ১৩ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। জাতীয় পরিসংখ্যানে বাল্যবিবাহের বিষয়টি ঠিকভাবে আসছে না। সরাসরিভাবে কিছু জেলা, উপজেলাকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। কতগুলো বাল্যবিবাহ রোধ করা গেছে, সরকার সে তথ্য রাখছে। কিন্তু কতটি বাল্যবিবাহ হচ্ছে, তাদের কাছে সে তথ্য নেই।
বাল্যবিবাহের আমরা যে পরিসংখ্যান দিই, সরকার সেটা গ্রহণ করে না। আবার বাল্যবিবাহ নিবন্ধন না হওয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে আমরা প্রমাণ হাজির করতে পারি না। অনেক ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ রোধ করা হচ্ছে। সেটা আবার অন্য এলাকায় নিয়ে বা গোপনে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে বাল্যবিবাহের সঠিক পরিসংখ্যানের সমস্যা রয়েছে। সরকার কিছু জেলাকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করেছে। এরই মধ্যে কোভিড এসেছে। বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়েছে। কোভিড শেষে কত মেয়ে স্কুলে ফেরেনি, সেই পরিসংখ্যান নেই। আবার কোনো স্কুলও এই সংখ্যা জানাতে চায় না। কারণ, এতে তাদের অনেক সমস্যা হয়। একমাত্র সরকারি উদ্যোগ ছাড়া পরিসংখ্যান পাওয়ার কোনো উপায় নেই।
কোভিডের জন্য কয়েক হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। এসব স্কুলে কত মেয়ে পড়ত, এর কোনো হিসাব কারও কাছে নেই। একটি মেয়ে নিজে, একজন জনপ্রতিনিধি বা ইউএনও একটি বাল্যবিবাহ রোধ করাকে একধরনের রোমান্টিসাইজ করা হচ্ছে। এটা কোনো সমাধান নয়। সত্যিকারভাবে বাল্যবিবাহ রোধের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। বাল্যবিবাহের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় আমরা মনে করছি বাল্যবিবাহমুক্ত হচ্ছি। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ আলাদা।
কাশফিয়া ফিরোজ
বিশ্বব্যাপী বাল্যবিবাহ রোধে প্ল্যান থেকে বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বাল্যবিবাহ রোধে আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন এবং জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের বিনিয়োগ ছিল। আমরা কুড়িগ্রাম জেলা বাল্যবিবাহমুক্ত করতে কাজ করি। তখন করোনা শুরু হয়। সবার অগ্রাধিকার তালিকায় চলে যায় স্বাস্থ্য।
দরিদ্র পরিবারগুলো মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চায়। কিন্তু তারা ভাবছে না যে ছোট মেয়েটাকে বিয়ে দিলে স্বামীর বাড়িতে সে বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হতে পারে এবং আবার পরিবারেই ফিরে আসতে হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার শূন্য শতাংশে আনার কথা বলেছিলেন।
কুড়িগ্রামে কোভিডের সময় আমরা বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েও ৬ শতাংশের নিচে আনতে পারিনি। আবার শুধু মেয়েদের না, ছেলেদেরও বাল্যবিবাহ হচ্ছে। সরকারের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে কেন বাল্যবিবাহ রোধের বিষয়টি অগ্রাধিকার পাচ্ছে না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
যেসব মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়েই গেছে, তাদের আবার কীভাবে স্কুলে বা কাজে ফিরিয়ে আনা যায়, সে ব্যাপারে সবার একসঙ্গে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। অধিকাংশ অভিভাবক তাঁদের মেয়েদের স্কুলের পিকনিক, বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এমনকি কোচিংয়ে যেতে দেন না। একটা মেয়েকে যখন ছোটবেলায় এভাবে তার সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তাহলে সে কীভাবে বড় হবে। বাল্যবিবাহ রোধ করতে হলে সরকারের সব পরিকল্পনায় মেয়েশিশুদের উন্নয়নের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আনিসুল হক
এটা খুবই লজ্জার ব্যাপার যে আমরা শিশুবিবাহ এবং বাল্যবিবাহে পৃথিবীতে এত পিছিয়ে। অনেক উন্নতি হয়েছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে। টিকাদান কর্মসূচিতে সাফল্য অর্জন করেছি। কিন্তু বাল্যবিবাহে আমরা পিছিয়ে আছি। অথচ খুব কম দেশের মানুষ বাংলাদেশের মানুষের মতো প্র্যাকটিক্যালি এত ইহজাগতিক। যদি তারা জানে যে বাল্যবিবাহ রোধ করলে তাদের বৈষয়িক উন্নতি, স্বাস্থ্যের উন্নতি, অর্থনৈতিক উন্নতি হবে, তাহলে তারা সেটা গ্রহণ করবে। বাংলাদেশের মানুষের মতো গ্রহণ করার আশ্চর্য ক্ষমতা পৃথিবীর কম দেশের মানুষের আছে।
স্কুলে শিশুদের দুপুরে গরম খাবার দিতে হবে। এটা খুব উপকার দেবে। আমি গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখেছি যে এখনো শিশুদের চোখমুখে পুষ্টিহীনতার চিহ্ন। এখনো গ্রামের অনেক শিশু পেটপুরে খেতে পায় কি না, আবার পেলেও সেটা পুষ্টিসমৃদ্ধ কি না, সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যদি আমরা দেশের সব স্কুলে গরম খাবার দিই, সেটাও অনেক কাজে লাগবে।
গণমাধ্যম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আছে। আমরা যখন লিখি, সাত সাহসী কিশোরী বাল্যবিবাহ রোধ করেছে, তখন সমাজে এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। আবার যখন কোনো তারকার আত্মহত্যার খবর লিখি, তখনো এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
আমাদের কাছে উদাহরণ হলো খাওয়ার স্যালাইন। এটা ব্যাপকভাবে প্রচার করতে পেরেছি। কিন্তু তখন বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল ছিল না। এখন ফেসবুক, মোবাইলে প্রচার করতে পারি। আপনারা গণমাধ্যমের জন্য কিছু বাজেট রাখেন।
আর এক বা দুটি আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। আপনারা জানেন, যখন ওয়ান–ইলেভেন হলো, তখন অনেক দামি গাড়ি যেখানে–সেখানে পড়ে থাকতে দেখেছি। বস্তার মধ্যে টাকাও পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কঠোর শাস্তির ভয় থাকলে সবাই সচেতন হবে। আপনার যদি এই কাজের সঙ্গে কিশোর আলোকে যুক্ত করতে চান, তাহলে আমরা সেটা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করব।
মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ
জন্মনিবন্ধনে যে বয়স আছে, এর বাইরে আমরা কিছু করতে পারি না। কিন্তু বাল্যবিবাহ যে হচ্ছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেক অভিভাবক কম্পিউটারে এডিট করে কৌশলে জন্মনিবন্ধনের বয়স কমিয়ে আনে। বিশেষ করে গ্রামের কাজিদের জন্মনিবন্ধনের তারিখ প্রমাণের ডিভাইস থাকে না। জন্মনিবন্ধনের তারিখ সঠিক কি না, সেটা প্রমাণের জন্য সরকারের দিক থেকে কাজদের ডিভাইস দেওয়া প্রয়োজন।
মনিরা হাসান
সরকারের সঙ্গে আমরা নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত কাজ করি। ২০১৯ সালের এক জরিপমতে, দেশে বাল্যবিবাহের হার ৫১ শতাংশ। ২০১৯ সাল থেকে বাল্যবিবাহ কমার প্রবণতার দিকে যাচ্ছিলাম। তখনই কোভিড এসে আমাদের আবার পিছিয়ে দিল। ২০১৯ সালে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। এখানে আমরা বাল্যবিবাহ নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দিয়েছি। এটা সরকার গ্রহণ করেছে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল ১৫ বছরের নিচে যত মেয়ের বিয়ে হয়, তাদের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনা। ২০২০ সালে আমরা একটা কিশোর–কিশোরী কৌশলপত্র তৈরি করেছি। এই কৌশলপত্রের সঙ্গে ২৪টি মন্ত্রণালয় ছিল। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯ এবং শিশুদের জন্য বিশেষায়িত নম্বর ১০৯৮-এ দুটি নম্বর নিয়ে আমরা কাজ করছি। বাল্যবিবাহ রোধে ২৪টি মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা আছে। এখানে সবাই সমন্বিতভাবে কাজ না করলে ভালো ফল আসবে না।
আমরা এই ২৪টি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করছি। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে এ খাতে বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। তা না হলে যতই কথা বলি, মাঠে কিন্তু কাজ হবে না। বিভাগ থেকে উপজেলা পর্যন্ত বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি আছে। এই কমিটিকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। কারণ, অনেক সময় গ্রামের কোনো স্কুল টিচার, মুরব্বি বিয়ে পড়িয়ে দেন। প্রশিক্ষণে বলেছি, এভাবে যিনি বিয়ে পড়াবেন, তিনি একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং আমরা সারা দেশে প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার ক্লাব পরিচালনা করি। এর মাধ্যমে তিন লাখ কিশোর–কিশোরীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। কিশোর-কিশোরীদের জন্য বিনিয়োগ করলে বাল্যবিবাহ অবশ্যই কমে আসবে।
মো. ইকবাল হোসেন
কাজি সাহেবরা বাল্যবিবাহ পড়ান না। এরপরও বাল্যবিবাহ হচ্ছে। কিন্তু এ জন্য দায়ী কারা। এটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। কোনো কাজি যদি বাল্যবিবাহ পড়ান, এটা যদি কর্তৃপক্ষ জানতে পারে, তাহলে তাঁর লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। কোনো কাজি এই ঝুঁকি নেবেন না। কাজিরা যখন কোনো কিশোর–কিশোরীর বিয়ে না পড়ান, তখন তারা নোটারি পাবলিক করে বিয়ে করে। কারা নোটারি করে, এটা পুলিশকে পাহারা দিতে হবে।
এখন যারা অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েদের নোটারি পাবলিক করে দেয়, তাদেরও লাইসেন্স বাতিল হচ্ছে। এরপরও অনেকে করছেন। এটা আমি প্রায় জোর দিয়ে বলতে পারি যে বাংলাদেশের প্রায় কোনো কাজি বাল্যবিবাহ পড়ান না। বাল্যবিবাহ পড়ানোর জন্য কাজিদেরই সবাই দোষারোপ করেন। এটা ঠিক না। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই, আমাদের কাজিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক। জন্মনিবন্ধন চেক করার ডিভাইস দেওয়া হোক।
নাসিমা আক্তার জলি
আমরা প্রায় ১৯৬টি সংগঠন একত্রে কাজ করি। এর উদ্দেশ্য হলো সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কারণ, এই সমস্যা সারা দেশে সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়েছে। প্রথমত, আমাদের স্বীকার করা দরকার, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ আছে। মন্ত্রণালয়ে গেলে সেখান থেকে বলা হয়, বাল্যবিবাহের হার ৫১ শতাংশ নয়; বরং ৪০ শতাংশের নিচে। কিন্তু ২০২০ সালে যখন বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার কথা হচ্ছিল, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল—তারা শুধু ২৩১টি বাল্যবিবাহের ঘটনার কথা শুনেছে। এ ছাড়া ২৬৬টি বাল্যবিবাহ আটকাতে পেরেছে।
সে সময় ব্র্যাক জরিপ চালিয়ে দেখেছে, প্রচুর বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বলেছে, প্রায় ১৩ হাজার বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের চালানো জরিপে সর্বমোট ১৩৬টি ইউনিয়নে বাল্যবিবাহের হার ছিল ২০ দশমিক ১১ শতাংশ। বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী ভর্তি বা উপস্থিতির ওপর শতকরা হিসাবে অনুদান পায়। এ জন্য এখান থেকে সঠিক তথ্য দেয় না।
তথ্য কীভাবে আসবে, কোথা থেকে আসবে? সেটা ইউনিয়ন পরিষদ ভালো জানে। আমাদের ইউনিয়ন পরিষদগুলো কি আসলেই তথ্য দিচ্ছে? চেয়ারম্যানরা সব জানেন। কিন্তু এর সঙ্গে রাজনীতি আছে, ভোটের বিষয় আছে। আমি মনে করি, প্রত্যেক স্তরে জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।
সোমনূর মনির কোনাল
আমি আমাকে দিয়ে ভাবছি, আমার মা–বাবা যদি ছোটবেলা থেকে আমাকে স্বাধীনতা, সুযোগ-সুবিধা না দিতেন, তাহলে আমি আজ কোথায় থাকতাম? তাই আমি মনে করি, এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মা–বাবার। ওয়াসফিয়া নাজরীনের দেশ কেন বাল্যবিবাহের সূচকে চতুর্থ হবে?
তারকাদের কিংবা অ্যাথলেটদের সাফল্যের গল্প যেভাবে সামনে আনা হয়, ঠিক তেমনি মা–বাবার সাফল্যও উদাহরণ হিসেবে সামনে আনা প্রয়োজন। মা–বাবা একজন মেয়েকে কীভাবে গড়ে তুলেছে, কেন পড়াশোনা করানো প্রয়োজন মনে করেছেন—এসব বিষয় উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা উচিত।
বাল্যবিবাহ কত কমল বা বাড়ল, এর চেয়ে বড় কথা হলো একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা এখনো বাল্যবিবাহ নিয়ে কথা বলছি—এ বিষয়টিই দুঃখজনক। শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে তথ্যগত পার্থক্য অনেক। মাঠপর্যায়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের তুলনায় আমরা অনেক কিছুই জানি না। আমার মনে হয়, এই পার্থক্য কমিয়ে আনা দরকার। একটি মেয়েশিশুকে বাল্যকাল থেকে তার নিজের পরিচয়ে বড় করা উচিত। যখন তার একটি নিজস্ব পরিচয় থাকে, তখন অন্যজনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার প্রবণতা কমে যায়।
রুমিন ফারহানা
বাল্যবিবাহ যে হচ্ছে, সেটা আগে স্বীকার করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত স্বীকার করে নেওয়া হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাধানের প্রশ্নই ওঠে না। বাল্যবিবাহের হারে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থা একেবারে সামনে। এ ছাড়া বিশ্বের যে ১০টি দেশে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হয়, বাংলাদেশ সেগুলোর একটি। এটাই বাস্তব, এটাই সমস্যা।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে সরকার একটি ধারা যুক্ত করতে চেয়েছে, যেখানে মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর থেকে কমিয়ে ১৬ বছর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর কারণ হলো, বয়স ১৬ বছর হয়ে গেলেই আইন অনুযায়ী তা আর বাল্যবিবাহ হবে না। এতে বাল্যবিবাহের হার কমিয়ে দেখানো যাবে। যখন বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র সমালোচনা হলো, তখন সরকার আইনে আরও একটি ভয়াবহ ধারা যুক্ত করল। ১৯ নম্বর সেই ধারাটি হলো—
‘এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছু থাকুক না কেন, বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশ এবং পিতা–মাতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীনে অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।’
দেখুন, এখানে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপট’, ‘অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থ’সহ এ ধরনের পরিভাষাগুলো খুব অস্পষ্ট। এখানে বাল্যবিবাহের অবারিত সুযোগ রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়সও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। যদি কোনো দরিদ্র পরিবারের মা–বাবা ৯-১০ বছরের কন্যাকে বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চান কিংবা কোনো পরিবার নিরাপত্তাশঙ্কায় তাদের সুন্দরী অল্পবয়স্ক মেয়েটিকে বিয়ে দিতে চায়, সে ক্ষেত্রে এই আইনের অধীনে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
শামীম হায়দার পাটোয়ারী
আমাদের একটা বড় সমস্যা হলো তথ্যের ঘাটতি। সঠিক তথ্য প্রায় কখনো পাওয়া যায় না। বাল্যবিবাহ বন্ধ হলে আমাদের স্বাস্থ্য সমস্যা অনেক কমে যাবে। শিক্ষার হার বেড়ে যাবে। কিশোর-কিশোরীদের দক্ষতা বাড়বে।
বাল্যবিবাহ রোধ হলে অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি করব। কিন্তু সরকার এখানে পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ করছে না। সরকার সঠিক পদক্ষেপ নিলে ২০২৫ বা ২০৩০ সালে বাল্যবিবাহ শূন্যের কোঠায় আনতে পারব। ১৮ বছরের আগে একজন মানুষ ভোট দিতে পারেন না, বাবার সম্পত্তি বিক্রি করতে পারেন না, আইনবিষয়ক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। অথচ বিয়ের মতো সারা জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছেন।
১৮ বছরের আগে বিশেষ শর্তে বিয়ের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেটা মানা হচ্ছে না। সংসদ থেকে যে বিষয়গুলো সরাসরি তদারক করা হয়, তার মধ্যে বাল্যবিবাহের বিষয়টিও আছে। এখানে আমি মেয়েদের বিয়ের বয়স ২১ বছর করার কথা বলেছি।
কাজিদের দোষ না। অনেকে পালিয়ে একসঙ্গে থাকেন। তারপর কাজিদের কাছে আসেন। তাঁরা কী করবেন। কোনো কোনো শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, কাজি তাঁদের রক্ষা করার জন্য একটি সনদ দিচ্ছেন। এটা তাদের সর্বনাশ করছে।
সনদে ১৮ থাকলেও কাজিদের যদি সন্দেহ হয়, তিনি কোর্টের আদেশ আনতে বলতে পারেন। সরকারি খরচে মেয়েদের ১৮ বছর পর্যন্ত পড়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে সরকারের ১০ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে। মেয়েদের শিক্ষা দেন। তারা শিক্ষিত হয়ে দেশের অর্থনীতিতে যে অবদান রাখবে, তা দিয়ে ১০টি মেগা প্রকল্প করা যাবে।
দেশে ৩০ হাজার নির্বাচিত প্রতিনিধি আছেন। তঁাদের বাজেট দিয়ে বলেন যে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাল্যবিবাহ কমিয়ে আনতে হবে। এটা দারুণ কাজ করবে বলে মনে করি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো সরকার এভাবে কাজ করে না।
রাষ্ট্র থেকে কোনো ক্যাম্পেইন নেই যে ১৮ বছরের আগে বিয়ে না, ২১ বছরের আগে শ্বশুরবাড়ি না, ২৩ বছরের আগে মা না ইত্যাদি। সামাজিক, প্রিন্টিং ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমকে বাজেট দিতে হবে এসব প্রচারের জন্য। কম অর্থে অনেক বেশি কাজ হবে। বাল্যবিবাহ কমাতে হলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়িত্ব দিতে হবে।
গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার
বাল্যবিবাহ আগেও ছিল, এখনো আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গর্ভবতী মায়েদের ভাতার ব্যবস্থা করেছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে নানা ধরনের ভাতা দিয়ে দারিদ্র্যমুক্তিতে ভূমিকা রাখছেন। প্রধানমন্ত্রী আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন নারী, শিশু এবং কিশোর–কিশোরীদের নিয়ে যেন আমরা কাজ করি।
দেশের ৬৪ জেলায় প্রায় ৭০ হাজার নারী উদ্যোক্তা আছেন। দেশের প্রতিটি পরিবারকে সচেতন হতে হবে। পরিবার যদি অল্প বয়সে তাদের সন্তানদের বিয়ে না দেয়, তাহলে কারও ক্ষমতা নেই বিয়ে দেওয়ার। প্রতিটি সম্প্রদায়ের উৎসবগুলোয় বাল্যবিবাহ নিয়ে নাটক করতে হবে। সে নাটকে বাল্যবিবাহের ক্ষতি, অভিভাবকের ভূমিকা, প্রশাসনের ভূমিকা, সমাজের দায়িত্ব—সবকিছু দেখাতে হবে। ২০৪১ সালে যদি ৫০ জন ছেলে অফিসে কাজ করে, তাহলে ৫০ জন মেয়েও সেখানে কাজ করবে। আমাদের সরকার এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে।
শেষ কথা হলো আমাদের সবার এমনভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে, যেন ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে পারি।
টনি মাইকেল গোমেজ
আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু ‘কোভিড কমেছে। বাল্যবিবাহ কি কমবে?’ এতক্ষণের আলোচনা শুনে আমি আশাবাদী হতে পারিনি। আমার কাছে মনে হয়েছে বাল্যবিবাহের সমস্যা বাংলাদেশে ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এর কারণ অনেক গভীরে। একজন আলোচক এরই মধ্যে বলেছেন, অনেক কিছু করার পরও কুড়িগ্রাম বাল্যবিবাহমুক্ত হয়নি। আজকের আলোচনায় যে প্রস্তাব এসেছে, তার কিছু যদি বাস্তবায়িত হতো, তাহলে বাল্যবিবাহের ভয়াবহতা সামান্য হলেও কমত।
তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আমরা এত দিন ধরে যা করছি, তা–ই যদি করতে থাকি, তাহলে বাল্যবিবাহ কখনোই কমবে না। তাই প্রচারণার নতুন কৌশল নিয়ে ভাবতে হবে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিভিন্ন সহযোগী উন্নয়ন সংস্থার সাফল্যের দারুণ গল্প আছে। সরকার সেখান থেকে ধারণা নিতে পারে এবং সফলতার গল্পগুলো সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে পারে। ডায়রিয়া প্রতিরোধে কিংবা পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে এনজিওরা একসময় যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিল, তা আজও অনুকরণীয় হয়ে আছে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায়।
আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয়, যখন কোনো মেয়ে নিজের বাল্যবিবাহ নিজেই ঠেকাচ্ছে, তখন নানা প্রচার–প্রচারণার মাধ্যমে আমরা সেই মেয়েটিকে যেন তারকায় পরিণত করছি। এ ধরনের প্রচারণার একদিকে যেমন ইতিবাচক দিক আছে, ঠিক তেমনি এর একটি নেতিবাচক প্রভাবও আছে। নিজের বিয়ে নিজে ঠেকানো নিশ্চয়ই অনেক সাহসিকতার বিষয়। তবে ভেবে দেখতে হবে, এর মাধ্যমে আমরা কী নিজের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের দায়িত্বটুকুও মেয়েটির ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছি কি না?
বাল্যবিবাহ ও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষদের সচেতনতা ও তাদের ভূমিকা নিয়ে সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে অনেক বেশি কাজ করতে হবে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা যে বাল্যবিবাহের অন্যতম বড় কারণ, সেটি স্বীকার করতে হবে এবং এই মানসিকতা প্রতিরোধে সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
ফিরোজ চৌধুরী
নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বাল্যবিবাহ রোধে জোরালো ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
সুপারিশ
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে
মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
বাল্যবিবাহ রোধে যৌতুক বন্ধ ও দারিদ্র্য দূর করতে হবে।
সারা দেশে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
সারা দেশে শিশু ও তরুণদের বাল্যবিবাহবিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রমে যুক্ত করা জরুরি।
বাল্যবিবাহ রোধে সাহায্যকারী ন্যাশনাল হেল্পলাইন নম্বর ১০৯, ১০৯৮, ৯৯৯ সবার মধ্যে জনপ্রিয় করা প্রয়োজন।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে মন্ত্রণালয় বাজেট কোড প্রণয়ন করবে ও প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করবে।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭–এর ১৯ ধারার অধীন বিয়ের জন্য সর্বনিম্ন বয়স নির্ধারণ করতে হবে।
বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে, এমন শিশুরা যেন শিক্ষাসহ তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি।