ডায়াবেটিস গবেষণায় গুরুত্ব দিতে হবে

ডায়াবেটিস পরিস্থিতি জানার মতো জাতীয় জরিপ নেই। গবেষণায় গুরুত্ব ও বরাদ্দ কম।

‘বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা: বর্তমান প্রেক্ষাপট ও গবেষণা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। গতকাল ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো

বহু বছর ধরে নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশে ডায়াবেটিসের প্রকোপ কমছে না। দেশের বাস্তব পরিস্থিতি জানার জন্য জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো জরিপের তথ্যও নেই। এই রোগের ব্যাপারে বাংলাদেশে কোনো জাতীয় নীতি নেই।

গতকাল সোমবার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে ডায়াবেটিস–বিশেষজ্ঞরা এই কথা বলেন। ‘বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা: বর্তমান প্রেক্ষাপট ও গবেষণা’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। আয়োজনের সায়েন্টিফিক পার্টনার ছিল ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দি এক্‌মি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড।

গোলটেবিল বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, বিশেষজ্ঞদের তৈরি ডায়াবেটিসবিষয়ক জাতীয় নীতির খসড়া সরকারের কাছে অনেক আগেই জমা দেওয়া আছে। সরকার সেটা গ্রহণ করছে না বা চূড়ান্ত করছে না। এই প্রবীণ ডায়াবেটিস–বিশেষজ্ঞ বলেন, মানুষ অনেক কিছু জানে কিন্তু মানে না। মানার মতো করে বার্তা দেওয়া প্রয়োজন। মানুষের মনে ধরে, এমন স্লোগান তৈরি করা দরকার। এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রধান।

অনুষ্ঠানের একাধিক বিশেষজ্ঞ দেশের ডায়াবেটিস পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং বলেন যে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। দেশে এখন প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি চারজনের একজন ডায়াবেটিসের পূর্বাবস্থায় আছে। দেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি উল্লেখ করে বারডেম একাডেমির পরিচালক ও বিশিষ্ট ডায়াবেটিস–বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফারুক পাঠান বলেন, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক রূপান্তর হচ্ছে। এই রূপান্তরের কারণে নগরায়ণ হচ্ছে, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন হচ্ছে, মানুষ, বিশেষ করে কম বয়সীরা ফাস্ট ফুডে অভ্যস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি মানুষ কায়িক পরিশ্রম কম করছে। মানুষের মধ্যে স্থূলতা বাড়ছে। এসবই ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ।

বয়স ৩০ বছর হলেই মানুষ ডায়াবেটিসের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ও ইউনাইটেড হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক অধ্যাপক হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, উচ্চ রক্তচাপ আছে, ওজন বেশি আছে, হৃদ্‌রোগ আছে, স্ট্রোক করেছে, ঘন ঘন প্রস্রাব করে, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস ধরা পড়েছিল, বয়স বেশি হয়েছে—এগুলোর যেকোনো একটি থাকলেই তার ডায়াবেটিসের ঝুঁকি আছে। তাকে অবশ্যই ডায়াবেটিস শনাক্তের আওতায় আনতে হবে।

বিষয় শিশু ও নারীর ডায়াবেটিস

গোলটেবিল বৈঠকে শিশুদের বিষয়ে সতর্ক হওয়া এবং গর্ভাবস্থায় নারীদের ডায়াবেটিসের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বারডেমের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. ফিরোজ আমিন বলেন, ১৩ থেকে ১৪ বছরের ছেলেমেয়েদের ফ্যাটি লিভার দেখা যাচ্ছে। ক্রেডিট কার্ড সংস্কৃতির কারণে অল্পবয়সীরা সহজে ফাস্ট ফুড খাচ্ছে। ক্যালরি পুড়িয়ে ফেলার মতো শরীরচর্চা, কায়িক পরিশ্রম তারা করছে না। তিনি বলেন, স্কুলের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ফাস্ট ফুড বিক্রি না হওয়ার বিষয়ে বিধিনিষেধ চালু করতে হবে।

বারডেমের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ফারিয়া আফসানা গর্ভাবস্থায় নারীদের ডায়াবেটিস বিষয়ে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারী গর্ভধারণ করলে অথবা গর্ভধারণের পর ডায়াবেটিস ধরা পড়লে—দুটি ক্ষেত্রেই সতর্কতা খুবই জরুরি। এই ধরনের রোগী এখন অনেক বেশি পাওয়া যাচ্ছে। একটি পরিসংখ্যান বলছে, ১০ থেকে ২৫ শতাংশ নারীর গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস দেখা যাচ্ছে।

বারডেম গর্ভাবস্থায় নারীদের ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিয়েছে উল্লেখ করে ফারিয়া আফসানা বলেন, সারা দেশে ৫৪টি কেন্দ্র খোলা হয়েছে, যেখানে গর্ভধারণের আগের সেবা দেওয়া হয়। এসব কেন্দ্রে কম মূল্যে সেবা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস থাকলে মা ও সন্তান দুজনেরই ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।

গবেষণা পরিস্থিতি

গোলটেবিল বৈঠকের একটি মূল বিষয় ছিল ডায়াবেটিস গবেষণা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহাজাদা সেলিম। তিনি বলেন, বৈশ্বিকভাবে দেখা যায় ডায়াবেটিস নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে বরাদ্দও প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে। বাংলাদেশে রোগের বোঝা যত বড় সেই তুলনায় এই রোগ নিয়ে গবেষণায় বরাদ্দ কম, গবেষণাও কম। এখন পর্যন্ত এই রোগ নিয়ে জাতীয়ভিত্তিক কোনো তথ্য–উপাত্ত নেই। অনুমিত বা প্রাক্কলিত তথ্য–উপাত্ত ব্যবহার করা হয়। সেই অনুসারে দেশের মানুষের ১৪ দশমিক ২ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

শাহাজাদা সেলিম বলে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বিপুলসংখ্যক মানুষের চিকিৎসা দেওয়ার সামর্থ্য স্বাস্থ্য বিভাগের আদৌ আছে কি না, তা নিয়ে গবেষণা দরকার। ডায়াবেটিস নিয়ে গবেষণায় বরাদ্দ শূন্যের কাছাকাছি মন্তব্য করে তিনি বলেন, কারা গবেষণা করবে, গবেষণা করে কী লাভ হবে, এসব প্রশ্নের উত্তর জরুরি। আবার কিছু ক্ষেত্রে দেথা যায়, পদের নাম গবেষক। এসব পদে বসে তারা কী গবেষণা করছে, তারও মূল্যায়ন হওয়া দরকার। তবে গবেষণা বা গবেষণা ফলাফলের ব্যাপারে নীতিনির্ধারকেরা গুরুত্ব কম দেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

খাবার বিষয়ে ১০ নির্দেশনা

ডায়াবেটিক রোগীদের খাবার বা খাদ্যতালিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খাওয়া নিয়ে ১০টি নিয়ম বা নির্দেশনার কথা বলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক এম সাইফুদ্দিন। এর মধ্যে আছে সুষম খাবার, সময়মতো খাওয়া, পরিমাণমতো খাওয়া, ফাস্ট বা জাঙ্ক ফুড না খাওয়া, আঁশযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া, প্রয়োজনীয় অণুপুষ্টি কণা গ্রহণ করা, অবৈজ্ঞানিক খাদ্য নির্দেশনা না মানা (যেমন কিটো), দুধ–ডিম খাওয়া, লবণ পরিমিত খাওয়া এবং ভরপেট না খাওয়া।

ডায়াবেটিস একবার হলে তা সারা জীবনের রোগ। একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারা জীবন চেষ্টা চালাতে হয় বা ওষুধ খেতে হয়। এটা অনেকেরই মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে বলে মন্তব্য করেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের সহকারী অধ্যাপক আফসার আহমেদ। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ডায়াবেটিস ও ক্যানসার, ডায়াবেটিস ও বন্ধ্যাত্ব, ডায়াবেটিস ও সংক্রামক রোগ—এসব খুব আলোচিত বিষয়। এক–চতুর্থাংশ রোগীর ডায়াবেটিস ডিপ্রেশন আছে।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মির্জা শরীফুজ্জামান বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিস রোগীর নানা রকম অক্ষমতা দেখা দেয়। শুধু রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক রাখাই ডায়াবেটিসের চিকিৎসা নয়। নতুন কী কী জটিলতা তৈরি হয় বা হতে পারে, তার চিকিৎসা বা ঝুঁকি কমানো জরুরি।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন দি এক্‌মি ল্যাবরেটরিজের নির্বাহী পরিচালক (বিক্রয় ও বিকরণ) ফেরদৌস খান ও ঊর্ধ্বতন মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন। গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।