+অংশগ্রহণকারী:
ডা. তাহমিদ আহমেদ
নির্বাহী পরিচালক, আইসিডিডিআরবি
ডা. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন
চেয়ারম্যান, কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ সাপোর্ট ট্রাস্ট; সদস্য, স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন
ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা
অধ্যাপক, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল
অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী
অধ্যক্ষ, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ
খায়রুল ইসলাম
আঞ্চলিক পরিচালক, ওয়াটারএইড সাউথ এশিয়া
অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান
প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)
অধ্যাপক ডা. আনজুমান আরা সুলতানা
লাইন ডিরেক্টর, জাতীয় পুষ্টি সেবঅধ্যাপক ডা. মো. মাহবুবুল হক
পরিচালক, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট
ডা. মো. মজিবুর রহমান
পরিচালক, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
ডা. মো. আকতার ইমাম
উপপরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ
ডা. শ্যামল কুমার রায়
ল্যাবরেটরি প্রধান, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান
ফারিয়া শবনম
ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার, মাতৃ ও শিশু পুষ্টি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
সঞ্চালনা:
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
ডা. তাহমিদ আহমেদ
নির্বাহী পরিচালক, আইসিডিডিআরবি
বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে উচ্চতা বৃদ্ধি না পাওয়াকে বলা হয় স্টান্টিং বা খর্বকায় হওয়া। এটি অপুষ্টির একটি ফলাফল। এ ধরনের শিশুর অসুস্থতার হার অনেক বেশি। তাদের অকালে মৃত্যুর হারও বেশি। গবেষণয় দেখা গেছে, অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের মুখে খাওয়া টিকার কার্যকারিতা কম। যেসব শিশু খর্বাকৃতির হয়, তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ কম হয়। আমাদের দেশে অতি কৃশকায় শিশুর সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ। এদের মৃত্যুঝুঁকি ১১ থেকে ১২ গুণ বেশি।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) অন্যতম একটি লক্ষ্য হচ্ছে পুষ্টি। আমাদের শিশুদের খর্বাকৃতি ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে কৃশকায় হওয়ার হার ৫ শতাংশের কম হতে হবে। বাংলাদেশে এটি এখন আছে ১১ শতাংশ। আর ১৫ শতাংশ হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি অবস্থার কথা বলেছে। আমরা তা থেকে খুব বেশি পিছিয়ে নেই। শিশুর জন্মের পর থেকে তিন মাসের মধ্যে খর্বাকৃতির প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। সারা পৃথিবীর তুলনায় দক্ষিণ এশিয়া খর্বাকৃতির হার বেশি।
যেসব দেশে স্বাস্থ্য খাতের মোট বাজেটের বড় অংশ খরচ হয় পুষ্টিতে, সেখানে খর্বাকৃতি, কৃশকায়, অপরিণত নবজাতক জন্ম, কম ওজনের নবজাতক জন্মের হার কম। সুতরাং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাজেট তৈরির সময় এই জায়গায় আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। ১০ বছর আগে বিশ্বব্যাপী কয়েকটি দেশের উপাত্ত নিয়ে খর্বাকায় শিশুদের নিয়ে গবেষণা করেছি। তাতে দেখা যায়, শিশু জন্মের সময় তার ওজন কেমন তা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ওজন কম হলে তার খর্বাকৃতির বা কৃশকায় হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। মা অপুষ্টিতে ভুগলে শিশুর অপুষ্টিতে ভোগার ঝুঁকি থেকেই যায়। শিশু যখন মায়ের গর্ভে থাকে তখন থেকেই তার পুষ্টি গ্রহণ শুরু হয়ে যায়। গর্ভাবস্থা থেকে শুরু করে তার প্রথম এক হাজার দিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময় শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ সবচেয়ে বেশি হয়। এই জায়গায় ভূমিকা রাখলে অপুষ্টি দূর করা সম্ভব হবে।
আমাদের স্বাস্থ্য খাতের মোট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। ইন্দোনেশিয়া বা থাইল্যান্ডের মতো যেসব দেশে পুষ্টির অবস্থা আগে খারাপ ছিল কিন্তু এখন ভালো হয়েছে, সেসব দেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে, তৃণমূলে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিশোরীদের পুষ্টির দিকে নজর দিতে হবে। গর্ভাবস্থায় এমএমএস (মাল্টিপল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সাপ্লিমেন্ট) দিতে হবে। এটি মা ও তার গর্ভের শিশু, উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রেস্ট ফিডিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ—এটি আমাদের দেশে আরও বাড়াতে হবে। অনেক উন্নত দেশেও এ হার আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। তারা এটি করতে পারলে আমরা কেন পারব না।
তোলা খাবার বা পরিপূরক খাবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর খাবারের মধ্যে সবজি থাকতে হবে। তাকে অর্ধেকটা হলেও ডিম দিতে হবে। বাকি অর্ধেক মা খেতে পারেন। মায়েরও পুষ্টির প্রয়োজন। খাবার অল্প হলেও ছোট মাছ রাখতে হবে। ইপিআই কর্নার থেকেও এ বিষয়ে কিছুটা কাউন্সেলিং করা যেতে পারে। কমিউিনটিভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা জরুরি। কিশোরীদের পুষ্টিজ্ঞান বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যালয়ে খাবারের বৈচিত্র্য সম্পর্কে শেখাতে হবে। এ বিষয়টি শিক্ষাক্রমে যুক্ত করতে হবে এবং প্রাথমিকের শিক্ষকদের কার্যকর ও অর্থবহ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
শহরের বস্তিতে অনেক বেশি মানুষের বসবাস। তাদের এখানে স্যানিটেশন থেকে শুরু করে কোনো ব্যবস্থাই স্বাস্থ্যকর নয়। বস্তিতে খর্বাকৃতির হার জাতীয় গড়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। শহরের বস্তির শিশুদের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিশেষ নজর দেবেন। সারা দেশের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ওএমএস কর্মসূচি চালু রাখতে হবে, অনেক মানুষ এ থেকে উপকৃত হয়। ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধির দিতে নজর দিতে হবে। আমাদের স্বাস্থ্যকর নাশতার প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করতে হবে। আইসিডিডিআরবির পক্ষ থেকে আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি।
ডা. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন
চেয়ারম্যান, কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ সাপোর্ট ট্রাস্ট; সদস্য, স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন
অপুষ্টির কারণে শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয় না। শিশুর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থাসহ তার প্রথম এক হাজার দিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় শিশুর পুষ্টির ঘাটতিতে যে ক্ষতি হয়, তা কখনোই পূরণ হয় না। শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে এ ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে এবং বিনিয়োগ করতে হবে। এখানে মায়েদের সম্পৃক্ত করতে হবে। শিশুর পুষ্টি নিশ্চিতে তাঁরাই বড় ভূমিকা নিতে পারেন।
বাংলাদেশে অপুষ্টির কারণে প্রতিবছর কমপক্ষে সাত হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। শিশুর অপুষ্টি দূর করতে বহু পক্ষের সমন্বয় প্রয়োজন। অনেক অর্থ খরচ করার পরও এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিংয়ের হার এখনো ৫০ শতাংশে আটকে আছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন বেশ কিছু সুপারিশ নিয়ে কাজ করছে।
মা ও শিশুর পুষ্টি নিশ্চিতে কমিউনিটি পর্যায়ে এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্য খাতের অনেকগুলো জরিপের উপাত্ত পুরোপুরি সঠিক নয়। স্বাস্থ্য ও পুষ্টির প্রশিক্ষণও অর্থবহ নয়। অর্থবহ প্রশিক্ষণ ও যথাযথ উপাত্ত না পেলে ভালো পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়, বাস্তবায়নও সম্ভব হবে না। সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণার উপকরণে যেসব বার্তা থাকে, তা সহজ ভাষায় সবার বোঝার উপযোগী করে তৈরি করা জরুরি। আমাদের চিকিৎসক বা প্রান্তিক পর্যায়ে যে কর্মীরা আছেন, তাঁদেরকে গণযোগাযোগের কৌশলের ওপর জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশে কমিউনিটি পর্যায়ে যাঁরা আছেন, তাঁরা সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করেন। ফলে সব ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সেবা প্রদান সম্ভব হয় না। তাঁদের ভূমিকা নির্দিষ্ট করে আরও সুনির্দিষ্টভাবে সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আশা করি, খুব তাড়াতাড়ি একটি সমাধান পাওয়া যাবে।
ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা
অধ্যাপক, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল
শিশুর জীবনের প্রথম ২৪ মাসে পুষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশু প্রথমত মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে পুষ্টি পায়। শিশুর বয়স ছয় মাস হলে মাতৃদুগ্ধের পাশাপাশি পরিপূরক খাদ্যও দিতে হবে। এ ধরনের খাদ্য কেমন হওয়া উচিত? এই খাবার কঠিন, অর্ধকঠিন বা তরলও হতে পারে। তবে এতে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে বিভিন্ন খাদ্য উপাদান, যেমন আমিষ, স্নেহ, শর্করা, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ থাকা প্রয়োজন। এই খাদ্যের মাধ্যমে শিশু সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে, একই সঙ্গে তার মস্তিষ্কের বৃদ্ধিও নিশ্চিত হবে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় অপুষ্টির কারণে অনেক শিশু খর্বকায় ও কৃশকায় হচ্ছে। এ ধরনের শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল থাকে, ফলে মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। বাংলাদেশে শিশু অপুষ্টির কারণ হতে পারে প্রথমত, আমরা যে মানসম্পন্ন খাদ্যের কথা বলছি, তা আমাদের শিশুরা পাচ্ছে না। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, যে পরিমাণে খাদ্য তাদের পাওয়ার কথা ছিল, সে পরিমাণে তারা পাচ্ছে না। এটা ক্রয়ক্ষমতা বা অন্য যেকোনো কারণে হতে পারে। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যে বৈচিত্র্য কম।
শিশুদের খাদ্যের মান কেমন হবে, খাবারের বৈচিত্র্যতা, কতবার সে খাবে, কতটুকু খেতে পারবে, সে জন্য একটা সূচক রয়েছে, যা সরকারের উদ্যোগে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এটি হয়তো সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। আমরা যে জায়গায় পৌঁছাতে চাই, তা থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে অবস্থান করছি। সুতরাং এ কথা বলা যায়, দুই বছর পর্যন্ত শিশুদের পরিপূরক খাদ্য খুবই অপ্রতুল। এ বিষয়টি বিবেচনা করে আমাদের পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ, পুষ্টিবিষয়ক শিক্ষা ও বরাদ্দের মতো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটি করা গেলে আমাদের সন্তানেরা স্বাস্থ্যকরভাবে ও সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠবে।
অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী
অধ্যক্ষ, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শিশু বৃদ্ধির মানগুলোর গড়ের চেয়ে শিশুর বয়স অনুযায়ী উচ্চতার কমপক্ষে দুটি মানের বিচ্যুতি ঘটলে তাকে খর্বাকৃতি বলা হয়। আর তিনটি মানে বিচ্যুতি ঘটলে তাকে বলা হয় তীব্র খর্বাকৃতি। শিশুর দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টিহীনতার ফলাফলই হচ্ছে খর্বাকৃতি। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, ৫ বছরের নিচে ২৪ শতাংশ শিশু খর্বকায়। যার মধ্যে ৬ শতাংশ তীব্র খর্বকায়।
২০২২ সালে নর্থ ডেকোটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এক গবেষণা মতে, অপরিণত নবজাতক ও গ্রামাঞ্চলের শিশুরা বেশি খর্বকায় হয়। আয়োডিনের অভাবেও শিশু খর্বকায় হতে পারে। এ ছাড়া জরিপে দেখা গেছে যে শিশু পরিবারের তৃতীয় বা চতুর্থ সন্তান সে অন্যদের চেয়ে বেশি খর্বকায়। সাধারণত মায়ের বুকের দুধ না পেলে, মা ১৮ বছরের কম বয়সী হলে, মা অপুষ্টিতে ভুগলে, মা–বাবা অসচেতন হলে, গর্ভাবস্থায় অ্যান্টিনেটাল চেকআপ না পেলে শিশুর খর্বকায় হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। সমন্বিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় না এলে বা ভিটামিন এ ক্যাপসুল গ্রহণ না করলেও এটি হতে পারে।
শিশুদের খর্বাকৃতি হওয়ার স্বল্পমেয়াদি প্রভাবগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘনঘন অসুস্থ হওয়া, রক্তস্বল্পতা, চিকিৎসা সম্পৃক্ত ব্যয় বৃদ্ধিসহ এমনকি অকালমৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়ে যায়। আর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে এসব শিশুর বুদ্ধিমত্তা কম হয়, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে কম দক্ষ হয়। সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার, মা খাটো হলে প্রসব জটিলতা বেড়ে যায়। পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগসহ নানান রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে মা ও শিশুর পুষ্টি সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। বিশুদ্ধ পানি ও উন্নত পয়োনিষ্কাশন নিশ্চিত করতে হবে। মাতৃদুগ্ধ পানে জোর দিতে হবে।
খায়রুল ইসলাম
আঞ্চলিক পরিচালক, ওয়াটারএইড সাউথ এশিয়া
বাংলাদেশে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে খর্বাকায় হওয়ার হার বেশি। এর বড় কারণ স্বাস্থ্যকর পানির ব্যবহার না করা। এ দেশে পানির প্রাপ্যতা নিয়ে সমস্যা না থাকলেও ব্যবহার্য পানির দুই–তৃতীয়াংশ নমুনাতেই মলের জীবাণু ফেকাল কলিফর্মের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এ দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ পরিবেশগত স্যানিটেশন ব্যবস্থা অস্বাস্থ্যকর হওয়ার ফলে একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে যায়, যা থেকে সে কোনো দিনই বের হতে পারে না। ফলে তাকে যতই পুষ্টি নিয়ে সচেতন করা হয়, তাতে কোনো লাভ হয় না। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা।
প্রবহমান ধারার জন্য নলের পানি সবচেয়ে ভালো। কিন্তু এই পানি পায় দেশের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ। শহরে এ সুবিধা পায় ৪০ শতাংশ মানুষ, আর গ্রামে পায় ৩ থেকে ৪ শতাংশ মানুষ। আমরা শহরের ক্ষেত্রে পরিকল্পনার সময় প্রবহমান পানির ব্যবস্থা করলেও গ্রাম বা বস্তির ক্ষেত্রে তা এড়িয়ে যাই। আমাদের পাশের দেশ ভারত তাদের স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পের মাধ্যমে পাঁচ বছরে স্যানিটেশন ব্যবস্থায় অনেক উন্নতি করেছে। ২০২৪ সালের মধ্যে তারা প্রতি ঘরে প্রবহমান পানির ব্যবস্থা করেছে।
একটা অপ্রিয় সত্য কথা হলো, আমাদের দেশে শিশুদের জন্য মায়ের আঁচল হচ্ছে ব্যাকটেরিয়ার খনি। বেশির ভাগ মা সারা দিন প্রতিটি কাজ শেষে ঘাম ও হাত মোছেন আঁচলে। আর সেই অপরিষ্কার আঁচল দিয়েই শিশুর মুখ পরিষ্কার করেন। সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে আঁচল দিয়ে মুছলে কোনো লাভই হবে না। এ রকম ছোট ছোট বিষয়ে মনোযোগী হওয়া ও সঠিক বার্তা দেওয়া খুবই জরুরি। শিশুর পুষ্টি নিশ্চিতে শিশুদের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রথাগত চিন্তার বাইরে গিয়ে আমাদের উদ্ভাবনী চিন্তা করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান
প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ
শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে হলে আগে মায়ের পুষ্টির প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে হবে। মা নিজে অপুষ্টির শিকার হলে তাঁর গর্ভের সন্তানের ওপরও সে প্রভাব পড়বে। সুতরাং মা শুধু নিজের জন্য খাচ্ছেন না, তিনি তাঁর শিশুর জন্য খাচ্ছেন এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। শুধু গর্ভাবস্থায় নয়, শিশুকে স্তন্যপান করানোর সময়ও মায়ের পুষ্টির প্রয়োজন আছে। একই সঙ্গে মায়ের অতিরিক্ত ওজনও কিন্তু ক্ষতিকর। এর কারণে শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয়, যা পরবর্তী সময় শৈশব স্থূলতার কারণ হতে পারে। এ ছাড়া মা উচ্চ রক্তচাপে ভুগতে পারেন। শিশুর ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সঠিক পরিমাণে সুষম খাদ্য গ্রহণ করলে মা ও শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করা সম্ভব।
মা অপুষ্টিতে ভুগলে প্রথমত তাঁর নিজেরই কিছু সমস্যা তৈরি হয়। যেমন মায়ের রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। তাঁর শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যেতে পারে। ফলে বারবার তাঁর শরীরের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। অকালিক প্রসব (প্রিটার্ম ডেলিভারি) হতে পারে। আর শিশুর ক্ষেত্রে খর্বকায় ও কৃশকায় হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে গর্ভপাতও হতে পারে।
আমাদের দেশে অপুষ্টির অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয় দারিদ্র্যতা। এটা ঠিক যে অনেক মানুষ অর্থাভাবে সুষম খাবার কিনে খেতে পারে না। কিন্তু এটিই একমাত্র কারণ নয়। অনেক ক্ষেত্রে মা জানেনই না কোন খাবারে কোন উপাদান রয়েছে। আমাদের দেশে অনেক বিত্তবান পরিবারের নারীরাও অপুষ্টিতে ভোগেন। কারণ, তাঁরা সুষম খাদ্যের বিষয়ে জানেন না। আবার খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু কুসংস্কারও রয়েছে। মায়েরা কেউ মাছ খান না, আবার কেউ মাংস বা ডাল খান না। এসব কারণে পুষ্টির ঘাটতি তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে।
অধ্যাপক ডা. আনজুমান আরা সুলতানা
লাইন ডিরেক্টর, জাতীয় পুষ্টিসেবা
বর্তমানে শিশুদের অপুষ্টির মতো অতিরিক্ত ওজন বড় একটি সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। সব বয়সী মানুষই এ সমস্যায় ভুগছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মায়েরা সন্তান ধারণের সময় স্থূল হয়ে যাচ্ছেন। যার প্রভাব পড়ছে শিশুর ওপর। শিশু জন্মাচ্ছে নানা রকম রোগ নিয়ে। বিশেষত, শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেনের শিশুদের ওজন বেশি। গ্রামের তুলনায় শহরের নারীরা তুলনামূলক বেশি ওজনজনিত সমস্যায় ভুগছেন। এ সমস্যার মূলে রয়েছে অসচেতনতা। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের পুষ্টি সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই।
এখন অনেকে মনে করেন বার্গার, পিৎজা বা এ জাতীয় ফাস্ট ফুড খেলে সামাজিক মর্যাদা বাড়ে। শুনতে আশ্চর্য মনে হলেও অনেকে এমন ভাবনা থেকে শিশুদের বুকের দুধ না পান করিয়ে কৌটার দুধ পান করান। এ ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজনেরাও অনেকে কৌটার দুধ খাওয়াতে উৎসাহিত করেন। এটি কোনোভাবেই ঠিক কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে পরিবারকে সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। নবজাতকের মায়ের দৃঢ়তা প্রয়োজন যে আমি আমার সন্তানকে ছয় মাস পর্যন্ত কেবল বুকের দুধই খাওয়াব। ছয় মাস পর অন্যান্য সুষম খাবার খাওয়ানো শুরু করতে হবে। যেসব পুষ্টিকর খাবার সহজে বাড়িতেই তৈরি করা যায়, সেগুলোই শিশুকে দিতে হবে।
করোনা মহামারির পর জাঙ্ক ফুড খাওয়ার প্রবণতা অনেক গুণ বেড়েছে বলে মনে হয়। শিশুরা অর্ডার করা খাবার ছাড়া খেতে চায় না। এ চর্চা কমাতে না পারলে আমাদের সামনে অনেক বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আমাদের কিছু ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। কেবল মুখে বললে হবে না, বাস্তবায়ন করতেও হবে। মাতৃদুগ্ধ পান করানোসংক্রান্ত বিষয়ে প্রচারণার পাশাপাশি কৌটাজাত শিশুখাদ্য হিসেবে দুধের উৎপাদনও বন্ধ করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মো. মাহবুবুল হক
পরিচালক, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট
বাংলাদেশে অপরিণত নবজাতকের জন্মের হার আশঙ্কাজনক। অন্যদিকে সময়মতো শিশুর জন্ম হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ওজনে কম হচ্ছে। এসব শিশু জন্ম থেকেই অপুষ্টিতে ভুগছে। মায়ের পেটে থাকতেই যে অপুষ্টির শিকার হচ্ছে শিশু পরবর্তী সময়ে সেটি কাটিয়ে ওটা অনেক কঠিন। দেশে শিশুর উচ্চতার তুলনায় ওজন কম হওয়া বা কৃশকায় শিশুর সংখ্যাও কম নয়। এর বড় কারণ হলো মায়ের অপুষ্টিতে ভোগা। এ জন্য গর্ভাবস্থা থেকেই শিশু ও মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শুধু মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতি পারলেই যে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, বিষয়টি এমন নয়। বাল্যবিবাহও অপরিণত ও অপুষ্টিতে ভোগা শিশু জন্মের অন্যতম কারণ। অল্প বয়সে বিয়ে হলে কার্যত একটি অপরিণত শিশুর জন্ম দেয় আরেকটি শিশু। এটি বন্ধ করতে হলে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে।
১৯৯০ সালের দিকেও বাংলাদেশে তীব্র অপুষ্টির যে চিত্র ছিল, সচেতনতা সৃষ্টির ফলে এটা কমে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার নতুন করে এসব সামনে আসছে। বর্তমানে আমাদের দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে অথবা আমাদের কোনো কোনো কর্মসূচি ঠিকভাবে কাজ করছে না। আমাদের এসব মোকাবিলা করতে হবে সম্মিলিতভাবে। শিশুদের খাদ্যনিরাপত্তায় জোর দিতে হবে। এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিংয়ের হার ৫০ শতাংশ থেকে বাড়াতে হবে! এ ক্ষেত্রে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা সচেতনতা তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। শিশুকে প্রথম ছয় মাস যদি কেবল মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো যায়, তাহলে তীব্র অপুষ্টি কমে আসবে।
ডা. মো. মজিবুর রহমান
পরিচালক, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
অপরিণত নবজাতকের জন্মের পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থানে আছে। কম ওজনের শিশু জন্মের পরিসংখ্যানে এ দেশ দ্বিতীয় অবস্থানে। অন্যদিকে বাংলাদেশে পথনবজাতকের সংখ্যাও কম নয়। পথনবজাতক–সংক্রান্ত কোনো বড় পরিসরে পরিসংখ্যান আমাদের নেই। তবে সমাজসেবা অধিদপ্তর, শিশু অধিকার ফোরাম ও বিভিন্ন এনজিওর উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বর্তমানে প্রতি লাখে প্রায় তিনজন পথনবজাতক রয়েছে।
দুনিয়ায় সবচেয়ে হতভাগা হচ্ছে পথনবজাতকেরা। কম ওজনের নবজাতক ভবিষ্যতে অপুষ্টির শিকার জনগোষ্ঠীর একটা অংশ। আর পথনবজাতক এর সঙ্গে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত। তার তো মা–বাবা নেই। তাকে মাতৃদুগ্ধ কে পান করাবে! তার জন্য অবশ্যই বিকল্প বুকের দুধের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য সমাধান একটাই। তা হচ্ছে শরিয়াহ মোতাবেক বাংলাদেশে মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা। এটি করা গেলে এ নবজাতকেরা যেমন বেঁচে যাবে, ভবিষ্যতে অপুষ্টির শিকার হবে না, একই সঙ্গে কর্মজীবী মায়েরাও উপকৃত হবেন। তাঁরা যখন মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে অফিস-আদালতে ফিরে যান, সেখানে দুধ পান করানোর যথেষ্ট সুবিধা নেই। ফলে তাঁরা আগেই দুধ সংরক্ষণ করতে পারবেন। এভাবে দুধ ১৮ মাস পর্যন্ত ভালো থাকে। এর মাধ্যমে জীবন রক্ষায় অনেক বড় ভূমিকা রাখা সম্ভব।
মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতামত পেয়েছি। এখন ধর্ম মন্ত্রণালয়ে সবুজসংকেত পেলে আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করতে পারব। যদিও অনানুষ্ঠানিকভাবে আমরা এটি শুরু করেছি। বরাদ্দ ও অপুষ্টি নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি এ জায়গায়ও আমাদের নজর দেওয়া জরুরি।
ডা. মো. আকতার ইমাম
উপপরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ
জাতীয়ভাবে আমাদের খর্বতার হার ২৪ শতাংশ। আর বস্তির ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। এখানে অবশ্যই অণুপুষ্টিকণা স্বল্পতার একটা ভূমিকা রয়েছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) বলছে, আমাদের দেশের ৭০ শতাংশের মতো মানুষের ভিটামিন ডি স্বল্পতা রয়েছে। শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতায় জিংকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের পাতে সব সময় থাকে ভাত, এতে প্রাকৃতিকভাবে জিংকের পরিমাণ খুবই কম থাকে। আমাদের এ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রক্তশূন্যতা একটা বড় সমস্যা। মাতৃত্বকালীন রক্তস্বল্পতা অপরিণত নবজাতকের জন্মের বড় একটি কারণ। এর কারণেই আন্তপ্রজন্ম রক্তশূন্যতার চক্র সৃষ্টি হয়।
রক্তশূন্যতা কেবল আয়রনের কারণে হয় বিষয়টি এমন নয়। বাংলাদেশে যে ভূগর্ভস্থ পানি আছে, তা আয়রনসমৃদ্ধ। এখন অন্যান্য খাবারের সঙ্গে আমরা যখন আয়রন বা ফলিক অ্যাসিড দিচ্ছি, এটি ঠিকভাবে খাপ খাচ্ছে কি না, তা উদ্বেগের বিষয়। প্রজননক্ষম নারীদের ৩০ শতাংশ রক্তশূন্যতায় ভুগছেন। ২০২৫ সালের মধ্যে আমাদের রক্তশূন্যতা ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। অপুষ্টি বা দেশের মানুষের মধ্যে অণুপুষ্টিকণার পরিস্থিতি বা তার কারণ জানার জন্য নিয়মিত জরিপ হওয়া দরকার। এ–সংক্রান্ত প্রথম জরিপ হয়েছিল ২০১১ সালে৷ এরপর ২০১৯-২০ সালে হয়েছিল। এর মধ্যে আমরা খুব ভালো উপাত্ত পাইনি। ফলে উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। তবে উপাত্ত থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের অবস্থা আগের মতোই আছে, খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি।
ডা. শ্যামল কুমার রায়
বিভাগীয় প্রধান (ল্যাব), জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান
শিশুর জন্মের পর প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের দুধই শিশুর একমাত্র খাবার। একে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং (ইবিএফ) বলা হয়। মা সঠিকভাবে শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করালে শিশু অনেক ঝুঁকি থেকে রক্ষা পায়। মায়ের দুধের মাধ্যমে শিশুর শরীরে অ্যান্টিবডি প্রবেশ করে। পাশাপাশি সব খাদ্য উপাদান এর মাধ্যমেই পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ইবিএফের হার কমে ৫২ শতাংশে নেমে এসেছে। এ হার কমার পেছনে উপাত্ত সংগ্রহে সমস্যা থাকতে পারে। আবার এমনও হতে পারে, করোনার পর মায়েরা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় মাতৃদুগ্ধ ঠিকমতো দিতে পারেননি। সঠিক উপাত্ত সংগ্রহ ও প্রকাশের ক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ে আরও উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
শিশুদের নিয়ম মেনে সুষম খাদ্য দিতে পারলে পুষ্টি নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তার কারণ নেই। তবে এ ক্ষেত্রে যিনি মা হতে যাচ্ছেন, তাঁর পুষ্টির জ্ঞান থাকা জরুরি। কারণ, শিশুর অপুষ্টি শুরু হয় মায়ের গর্ভাবস্থা থেকেই। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, গর্ভধারণের আগেই যদি নারীরা আয়রন ও ফলিক গ্রহণ করেন, তাহলে পরবর্তী সময়ে শিশুর বৃদ্ধি ভালো হয়। জন্মের পর তার অপুষ্টিতে ভোগার আশঙ্কা খুবই কম।
আমাদের দেশে কর্মজীবী নারীরা মাতৃদুগ্ধ পান কর্নার না থাকার কারণে তাঁদের শিশুদের সময়মতো দুধ পান করাতে পারেন না। দায়িত্বশীলদের এ বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। মাতৃদুগ্ধ পান করানো নিয়ে অনেক মায়ের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। তাঁরা মনে করেন, এর কারণে তাঁদের শারীরিক সমস্যা হতে পারে। এটি মোটেও ঠিক নয়। এ বিষয়ে মায়েদের সচেতন করে তুলতে হবে।
ফারিয়া শবনম
ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার, মাতৃ ও শিশু পুষ্টি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
আমাদের ৫ বছরের নিচের শিশুদের ২ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু স্থূলতার শিকার। অথচ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অনুসারে এটি বাড়ারই কথা ছিল না। ঢাকায় এ প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের কেবল মাতৃদুগ্ধের পাশাপাশি পরিপূরক খাদ্য দেওয়ার কথা, সেখানে ৩২ শতাংশ শিশু সুইটেন্ড বেভারেজ গ্রহণ করছে। ৪৯ শতাংশ অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করেছে। সপ্তাহে সাতবারের বেশি প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার গ্রহণ করা কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা বেড়েছে ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এ ধরনের জাঙ্ক ফুড গ্রহণের পরিণতি সম্পর্কে পরিবারগুলো সচেতন নয়। জরিপে দেখা গেছে, শহরাঞ্চলের ৬০ শতাংশ স্কুল ক্যাফেটেরিয়ায় জাঙ্ক ফুড সরবরাহ করা হয়।
এসব খাবারের নির্মাতারা অনেক বেশি আধুনিক। তারা এসবের বিজ্ঞাপনে প্রথাগত পদ্ধতি অনুসরণ করে না। এসব খাবারের প্রচার সবচেয়ে বেশি হয় ইলেকট্রনিক মাধ্যমে। বিজ্ঞাপনের ব্যাপকতায় ঘরের খাবারের বিষয়গুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে, সাধারণ খাবারের ধারণা বদলে যাচ্ছে। এসব খাবারের বিজ্ঞাপন যতটা প্রচারিত হয় তার সিকি ভাগও মাতৃদুগ্ধ পান, কোনো কিছুই প্রচারিত হয় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চারটি দেশের টিভি বিজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা করেছে। তাতে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় এ ধরনের অস্বাস্থ্যকর খাবারের বিজ্ঞাপন দেখিয়েছে ৬ মিনিট করে, যা শিশুদের বিরাট প্রভাবিত করে। শিশুদের বাণিজ্যিক খাবার খাওয়া আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এক বছরের শিশুকেও বাণিজ্যিক খাবার খাওয়ানো হচ্ছে। এসব খাবারে অতিরিক্ত চর্বি, অতিরিক্ত চিনি ও অতিরিক্ত লবণ থাকে, যা শিশু পুষ্টি নিশ্চিতে বাধা সৃষ্টি করছে।
সুপারিশ:
স্টানটিং বা খর্বকায় হওয়া মস্তিষ্কের বিকাশকে প্রভাবিত করে, এটি মৃত্যুর ঝুঁকিও বৃদ্ধি করে।
শিশুর জন্মের সময় কম ওজন এবং মায়ের অপুষ্টি শিশুদের খর্বকায় হওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
আমাদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে মোট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
তৃণমূল স্তরে আরও কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী প্রয়োজন, যারা শিশুদের পুষ্টিগত অবস্থা মূল্যায়ন করবেন, মায়েদের ও পরিবারের সদস্যদের পরামর্শ দেবেন।
সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগে পরিপূরক খাবার বা পুষ্টিসংক্রান্ত প্রচার–প্রচারণা বৃদ্ধি করতে হবে।
গর্ভাবস্থায় একাধিক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সম্পূরক গ্রহণ শুরু করা প্রয়োজন।
আমরা কমিউনিটিতে মাতৃ ক্লাব শুরু করতে পারি, যেখানে স্তন্যপান ও সম্পূরক খাদ্য সম্পর্কে আলোচনা করা যাবে।
সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস উন্নত করতে হবে।
দরিদ্র, বস্তিবাসী, চরবাসী ও বন্যাক্রান্ত জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে৷
তীব্র অপুষ্টির কমিউনিটি ভিত্তিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা উচিত।
তীব্র অপুষ্টি ব্যবস্থাপনার জন্য মাইক্রোবায়োটা-নির্দেশিত খাদ্য বিবেচনা করা যেতে পারে।
শিশুদের অস্বাস্থ্যকর অতিরিক্ত চর্বি, চিনি ও লবণযুক্ত বাণিজ্যিক খাবারের প্রচারণা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।