পুরুষের অংশগ্রহণে নারীর প্রতি বৈষম্য-সহিংসতা কমবে 

‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষ ও পরিবারের সম্পৃক্ততা’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজক প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও প্রথম আলো

‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষ ও পরিবারের সম্পৃক্ততা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) তাহেরুল হক চৌহান,কবিতা বোস, শবনম মোস্তারী (যুগ্ম সচিব), হালিদা হানুম আখতার, শবনম মোস্তারী ও হ্যাকান অ্যারাল্ড গুলব্র্যান্ডসেন। গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়েছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

বৈষম্যমূলক সামাজিক রীতিনীতি থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা শুরু হয়। ঘরের কাজ ও সন্তানের যত্নে পুরুষ অংশ নিলে পারিবারিক বন্ধন বাড়ে। এর ফলে বৈষম্য কমে, সহিংসতাও কমে। সেই পরিবারের সন্তানও জেন্ডারভিত্তিক সমতার ধারণা নিয়ে বড় হয়। গতকাল শনিবার প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এ কথাগুলো বলেন বক্তারা।

‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষ ও পরিবারের সম্পৃক্ততা’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে। বক্তারা আরও বলেন, সমাজে নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করলে উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যায়। 

গোলটেবিল বৈঠকে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য হালিদা হানুম আখতার বলেন, নারীর প্রতি বৈষম্যের প্রতিকার শুরু করতে হবে পরিবার থেকে। এ ক্ষেত্রে পুরুষকে ভূমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে নারীর প্রতি বিভেদ সৃষ্টি এবং বিদ্বেষমূলক মনোভাব ও সহিংসতা বন্ধ হবে না। একটি পরিবারে এমন বাবা দরকার, যিনি মেয়েকে মর্যাদা দেবেন, সমানভাবে পড়াশোনা করতে দেবেন, চাকরি করতে দেবেন, এগিয়ে যেতে দেবেন।

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের যুগ্ম সচিব শবনম মোস্তারী বলেন, পরিবার ও সমাজে জেন্ডার–সমতা তৈরি এবং সহিংসতা নিরসনের যেকোনো কার্যক্রমে শুধু নারী নয়, পুরুষদের বেশি করে সম্পৃক্ত করা দরকার। কারণ, পুরুষদের কাছ থেকে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তাদের জেন্ডার সংবেদনশীল করতে হবে। প্রত্যেককে জানাতে হবে যে পরিবারে বৈষম্য থাকলে তা শিশুর বিকাশে বড় ধরনের বাধার সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হ্যাকান অ্যারাল্ড গুলব্র্যান্ডসেন বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার মূল কারণগুলোকে উৎপাটন করতে হবে। পুরুষকে সব সময় অপরাধী ও নির্যাতনকারী হিসেবে না দেখে তাদের সমস্যার সমাধানকারী হিসেবেও কাজে লাগাতে হবে। শিশুর যত্নে পিতৃতান্ত্রিক ছুটি বাধ্যতামূলক করতে হবে। সন্তানের যত্নে মা–বাবাকে সমানভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলে জেন্ডার–সমতা অর্জন সম্ভব।

গোলটেবিল বৈঠকে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) তাহেরুল হক চৌহান বলেন, আইনিভাবে যতটুকু অধিকার আছে, ততটুকুও নারী পাচ্ছে না। অর্থনৈতিক অসমতা নারীর আইনি ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।

বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বলেন, ইসলাম নারীকে স্বাধীনতা ও অধিকার দিয়েছে। ইসলামের প্রকৃত বিজ্ঞ ব্যক্তিদের দিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালালে ধর্মকে অপব্যবহার করে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে।

যাঁরা অনলাইনে যুক্ত হন, এমন ৭০ শতাংশ নারী নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে জানান তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের এসপায়ার টু ইনোভেশন (এটুআই) কর্মসূচির ডিজিটাল স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান শবনম মোস্তারী। তিনি বলেন, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে নারীদের বড় অংশ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছে। হয়রানির মাধ্যমে তাদের দমিয়ে রাখা হলে দেশ এগিয়ে যেতে পারবে না।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) নির্বাহী প্রধান শাহীন আনাম বলেন, পুরুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে না। পরিবারে নারীর প্রতি মর্যাদাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আনতে হবে। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুরুষের ওপরও যে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, সে সম্পর্কেও পুরুষকে বোঝাতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সানজিদা আখতার বলেন, বৈষম্যমূলক সামাজিক রীতিতে পরিবর্তন আনতে সমাজ ও পরিবারের কাঠামো ঠিক করতে হবে। পাঠ্যবইয়ে কিছু উপাদান পরিবর্তনে তিনি নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনকে নজর দিতে বলেন।

অসমতা ও সহিংসতা দূর করতে সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন দরকার বলে মন্তব্য করেন ব্রিটিশ হাইকমিশন ঢাকার সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা তাহেরা জাবিন। তিনি বলেন, মেয়েদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করলে বাল্যবিবাহ বন্ধ হবে।

সূচনা বক্তব্যে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক নিশাত সুলতানা বলেন, পুরুষতন্ত্রের চর্চা ও পেশিশক্তির প্রয়োগ পুরুষেরও শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এখন সময় এসেছে ‘পুরুষ’ শব্দটির ধারণা বদলে দেওয়ার।

‘মেয়েরা শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে বৈশ্বিক পরিবর্তন আনছে’ শিরোনামে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের উপপরিচালক (কর্মসূচি) নীলিমা ইয়াসমীন। মূল প্রবন্ধে জানানো হয়, সংস্থাটি শিশুর বিকাশ, পরিবার ও সম্প্রদায়ে সমতার পরিবেশ তৈরি, নারী নির্যাতন ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এলাকার ধর্মীয় নেতাদের সমর্থন গড়ে তোলা এবং তরুণদের সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করতে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ, মা–বাবাকে নিয়ে বৈঠক, বাবাদের নিয়ে ‘ফাদারস ক্যাফে’ এবং দাদা-দাদি বা নানা-নানিদের নিয়ে ‘গ্র্যান্ডপ্যারেন্টস ক্লাব’ গঠনের মাধ্যমে বৈষম্যমূলক সামাজিক রীতি পরিবর্তন ও জেন্ডার–সমতা নিশ্চিতে কাজ করা হচ্ছে।

সমাপনী বক্তব্যে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর কবিতা বোস বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে বৈষম্য থেকে। সমাজে কিশোরীকে বাল্যবিবাহ দিয়ে, শিক্ষার পথ বন্ধ করে যেন বাধা সৃষ্টি করা না হয়। একইভাবে সেই পুরুষকে ধিক্কার দিতে হবে, যে নারীর চলার পথে বাধার সৃষ্টি করে। 

আরও বক্তব্য দেন নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর সায়কা সিরাজ, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, যমুনা টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাহফুজ মিশু, ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শাশ্বতী বিপ্লব, কেয়ার বাংলাদেশের অপরাজিতা প্রকল্পের কারিগরি সমন্বয়কারী মাহমুদুর রহমান খান এবং তিনজন কিশোরী প্রতিনিধি।

বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।