খুলনা ও সুন্দরবন অঞ্চলে যক্ষ্মা চিকিৎসা: বেসরকারি খাতের ভূমিকা
স্টপ টিবি পার্টনারশিপের সহযোগিতায় আইসিডিডিআরবি ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘যক্ষ্মা চিকিৎসায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় খুলনার সিএসএস আভা সেন্টারে। গত ২৩ অক্টোবর ২০২৪ অনুষ্ঠিত গোলটেবিল আলোচনার সারমর্ম এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
অংশগ্রহণকারী
ডা. মো. মনজুরুল মুরশিদ
পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, খুলনা
অধ্যাপক ডা. দীন উল ইসলাম
অধ্যক্ষ, খুলনা মেডিকেল কলেজ
ডা. আনোয়ারুল আজাদ
সাবেক বিভাগীয় যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ
ডা. গাজী মিজানুর রহমান
চেয়ারম্যান, গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ডা. শাহ মেহেদী বিন জহুর
বিভাগীয় যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ, এনটিপি
অধ্যাপক ডা. খসরুল আলম মল্লিক
অধ্যাপক, বক্ষব্যাধি বিভাগ, খুলনা মেডিকেল কলেজ
ডা. সৈয়দা রুখশানা পারভীন
বিভাগীয় প্রধান, শিশু বিভাগ, খুলনা মেডিকেল কলেজ
রওনক হাসান রণ
সহকারী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
ডা. মোস্তফা কামাল
পরিচালক, সিটি মেডিকেল কলেজ
ডা. মো. রাশেদ আল রাজি
ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, ল্যাব এইড হাসপাতাল
অধ্যাপক ডা. মনিমোহন সাহা
কনসালট্যান্ট প্যাথলজি, পপুলার ডায়াগনোস্টিক সেন্টার
মো. আসাদুজ্জামান
বিভাগীয় ব্যবস্থাপক, ব্র্যাক
সাজ্জাদুর রহিম পান্থ
পরিচালক, সিএসএস, খুলনা
মো. জাকারিয়া
ব্যবস্থাপক, ল্যাব এইড খুলনা
ডা. শাহরিয়ার আহমেদ
সহকারী বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআরবি
ডা. আবু তালেব
পিপিএম অ্যাডভাইজর, আইসিডিডিআরবি
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
ডা. মো. মনজুরুল মুরশিদ
বিভাগীয় পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, খুলনা
এখন আমাদের শিশুদের যক্ষ্মা এবং টিবি প্রিভেন্টিভ থেরাপির (টিপিটি) প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমরা ইপিআই প্রোগ্রাম সফল করতে পেরেছি। একইভাবে টিপিটি প্রোগ্রাম সফল করতে পারলে ২০৩৫ সালের মধ্যে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব।
প্রতি লাখে এখন সংক্রমণের সংখ্যা ২১৮। এ সংখ্যা ১৮তে নিয়ে আসতে হবে। তাত্ত্বিকভাবে হয়তো এটি সম্ভব, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এটি বেশ চ্যালেঞ্জিং।
অনেকগুলো মেডিকেল কলেজে আমরা অনুষ্ঠান করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, প্রোগ্রামের শুরুতে দেখা যায় ২০ জন উপস্থিত; কিন্তু শেষে দেখা যায় ১৫ জনই নেই, চিকিৎসকেরা উঠে চলে যাচ্ছেন। আমরা তো তাঁদের ধরে–বেঁধে রাখতে পারি না। এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের আন্তরিকতা বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়াও বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানে জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের কর্মকর্তা, মসজিদের ইমামদেরও অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
আমাদের দেশে যত ফার্মেসি আছে, তার মধ্যে এক শতাংশ ক্ষেত্রেও রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্ট নেই। তাঁরা কোনো চিকিৎসকের অধীনে কয়েক দিন কাজ করার পর নিজেরাই চিকিৎসক বনে যান। এ ধরনের জায়গা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
আমরা বর্তমানে যেসব এক্স-রে রিপোর্ট পাই, তার অধিকাংশই হচ্ছে অনলাইন রিপোর্টিং। অনলাইন রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্র দায়িত্বশীলতা বাড়ানো প্রয়োজন। এখানে ডাক্তার সরাসরি সংযুক্ত থাকতে হবে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের একটু তৎপর হতে হবে।
যক্ষ্মা–সংক্রান্ত যেসব কর্মসূচি চলছে, তা যেন পিছিয়ে না আসে; বরং এসব কর্মসূচি আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। আর প্রচার–প্রচারণার দিকে আমাদের আরেকটু গুরুত্ব দিতে হবে।
ডা. গাজী মিজানুর রহমান
চেয়ারম্যান, গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা
সত্যি কথা বলতে, বেসরকারি খাত এখনো অনেক অগোছালো। এটি গোছানো না হলে যক্ষ্মার মতো সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা কষ্টসাধ্য। এখানে হাতুড়ে ডাক্তাররা চিকিৎসা করছেন; পুরোপুরি বেসরকারিভাবে ব্যক্তিগত ক্লিনিকে চিকিৎসকেরা চিকিৎসা করছেন; সরকারি চিকিৎসকেরা দিনের একটা সময় বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করছেন। সবাইকে এক করা অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ বলে আমার কাছে মনে হয়।
সুতরাং স্বাস্থ্য খাতকে একীভূত না করতে পারলে আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী বা সরকারি-বেসরকারি কর্মজীবীদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিবছর স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। তাতে অবশ্যই কফ পরীক্ষা বা যক্ষ্মা শনাক্তের পরীক্ষা থাকবে। এটি করা গেলে মিসিং কেসের সংখ্যা অনেক কমে আসবে।
ফুসফুস–বহির্ভূত যে যক্ষ্মা, তলপেটে হয়, বন্ধ্যাত্ব হয়—এমন যক্ষ্মাও আমরা দেখি। সাধারণভাবে এগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে জিন এক্সপার্ট মেশিন, আরটি-পিসিআর মেশিন প্রয়োজন হয়। যেখানে জিন এক্সপার্ট মেশিন আছে, সেখানে স্যাম্পল প্রসেসিং দক্ষতা বাড়াতে হবে।
বেসরকারি খাতে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো একটা বড় নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। এসব সেন্টারে প্রাথমিকভাবে যক্ষ্মা শনাক্ত করা হয়। জানাও অ্যাপের মাধ্যমে শনাক্তকৃত রোগীর নোটিফাইয়ের বিষয়টি বলা হচ্ছে। এটি একটি চমৎকার আইডিয়া। বিষয়টি যদি বাস্তবায়ন করা যায় আমার মনে হয়, সেখান থেকে একটি ভালো ফল আসা সম্ভব।
অধ্যাপক ডা. দীন উল ইসলাম
অধ্যক্ষ, খুলনা মেডিকেল কলেজ
বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট প্রস্তুতি আমাদের আছে। কিন্তু আমাদের কিছুটা সমন্বয় ও প্রচারণার অভাব আছে।সারা বিশ্বে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হচ্ছে আমাদের এ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। আবার এই অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ আরও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে। অন্যান্য দেশে ৩০ শতাংশের মতো আক্রান্ত হলেও আমাদের দেশে তা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়।
যক্ষ্মার জীবাণু বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। যে ফ্যাক্টরগুলো যক্ষ্মার জন্য দায়ী তার মধ্যে আছে দারিদ্র্য, অপুষ্টি, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, সচেতনতার অভাব। এ বিষয়গুলো যে অঞ্চলে আছে, সেখানে সংক্রমণের হার বেশি।
আমাদের জনসংখ্যার ৯০ শতাংই কোনো না কোনো সময়ে এর সংস্পর্শে এসেছে। সবার ক্ষেত্রে উপসর্গ দেখা যায় না, উপসর্গ নিয়ে আসেন মাত্র ১০ শতাংশ।
আমাদের দেশে যক্ষ্মা–সংক্রান্ত সব সুবিধা সবার জানা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ফার্মেসিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, মানুষের কাশি হলে সবার প্রথমে সে ফার্মেসিতে যান। সুতরাং ফার্মেসির দোকানে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বোঝাতে হবে এ রকম উপসর্গ নিয়ে এলে তাঁকে যেন অবশ্যই যক্ষ্মা সেন্টারে পাঠানো হয়।
বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও একইভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। যক্ষ্মা–সংক্রান্ত মৌলিক তথ্যগুলো; অর্থাৎ কীভাবে ছড়ায় ও উপসর্গ দেখা দিলে কী করতে হবে, তা বেশি বেশি করে গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে। যেসব জায়গায় পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা আছে, সেখানে যক্ষ্মার জীবাণু ভেসে বেড়াতে পারে না। আবার সূর্যের আলোয় এ জীবাণু বাঁচতে পারে না। এ রকম বিষয়গুলো সবাইকে জানাতে হবে।
ডা. আনোয়ারুল আজাদ
সাবেক বিভাগীয় যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ
সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বয় শুরু হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে সরকার দেখল, তার মানবসম্পদের ঘাটতি আছে, তখন এনজিওকে যুক্ত করল। যখন দেখল তার অর্থায়নের ঘাটতি আছে, তখন এগিয়ে এল বৈশ্বিক তহবিল।
আমাদের অনেকগুলো ভালো কাজ হচ্ছে। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, আমাদের সব ধরনের গাইডলাইন আছে। এমনকি আমাদের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণবিষয়ক গাইডলাইনও রয়েছে। একই সঙ্গে এনজিওর সহয়তায় ডায়াগনস্টিক সেবাকে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীদের সাহায্যে রোগীর কাছেই আমরা চিকিৎসাসেবাকে নিয়ে গেছি।
এখন আমরা যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করছি, তা যেন মুখ থুবড়ে না পড়ে, এদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এখন কিছু ডটলাইন তৈরি হয়েছে, প্রয়োজন কেবল এদের সংযুক্ত করার। আমাদের সবাইকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। ইতিবাচক মনোভাব ধারণকারী মানবসম্পদকে প্রশিক্ষণ দিলে কর্মসূচি বাস্তবায়ন সফল হবে।
ডা. শাহ মেহেদী বিন জহুর
বিভাগীয় যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ, এনটিপি
বিশ্বে যক্ষ্মা ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে একসঙ্গে কাজ না করলে কোনো উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখবে না। ২০৩৫ সালের মধ্যে আমরা তিনটি মূল উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করতে চাই। একটি হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে যক্ষ্মার মৃত্যুহার কমানো। আরেকটি হচ্ছে, প্রতি লাখে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমানো। যক্ষ্মায় কোনো পরিবার বা ব্যক্তি যেন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হযন, সে জন্য সরকার–বেসরকারি খাতকে সঙ্গে নিয়ে প্রস্তুত আছে।
যক্ষ্মা একটি সংক্রামক রোগ। এ রোগ মূলত দুই ধরনের—ফুসফুসের ও ফুসফুস–বহির্ভূত। ফুসফুসে আক্রান্তের লক্ষ্মণ নিয়ে যেসব রোগী আসেন, তাঁদের বর্তমানে জিন এক্সপার্ট, ট্রুনাট, মাইক্রোস্কোপ ইত্যাদি মেশিনের মাধ্যমে থুতু পরীক্ষা করা হয়। চুল ও নখ বাদে শরীরের যেসব স্থানে রক্তসঞ্চালন আছে, তার সব জায়গাতেই যক্ষ্মা হতে পারে। এ রকম ফুসফুস–বহির্ভূত যক্ষ্মা শনাক্তে বেসরকারি খাতের একটা বড় অবদান প্রয়োজন। প্রতিবছর অসংখ্য রোগী মারা যাচ্ছেন।
যে পরিমাণ রোগী শনাক্ত হচ্ছে, এর ৯৫ শতাংশের ক্ষেত্রেই চিকিৎসা সফলতা পাওয়া গেছে।
ডা. মোস্তফা কামাল
পরিচালক, সিটি মেডিকেল কলেজ, খুলনা
যক্ষ্মা নিয়ে আমাদের সফলতা অনেক। কিন্তু যে ৩০ শতাংশ কেস মিসিং হচ্ছে, তা কীভাবে চিকিৎসার আওতায় আনা যায়, এটা নিয়ে ভাবতে হবে। কমিউনিটি মবিলাইজেশনে আমাদের দেশে সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে অনেক উদ্যোগ রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করছেন। এ ধরনের কার্যক্রমগুলোকে আরও বাড়ানো প্রয়োজন। যাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন, তাঁদের অবশ্যই শনাক্তের জন্য চিকিৎসাকেন্দ্রে আনা প্রয়োজন।
যাঁরা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসছেন, তাঁরা চিকিৎসা নিতে চান না। তাঁরা ভাবেন, আমাদের তো যক্ষ্মা হয়নি। জানাও অ্যাপ্লিকেশনটির বিষয়ে আমি নিজেও জানতাম না। এটি খুব বেশি প্রচলিত হয়নি। যাঁরা ব্যস্ত চিকিৎসক, তাঁদের কেবল এটি সম্পর্কে জানালেই তাঁরা ব্যবহার করবেন না। তাঁদের ফোনে এটি ইনস্টল করিয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি তাঁকে বলে দিতে হবে, তিনি যদি সময় না–ও পান, তাহলে এ ধরনের কোনো কেস এলে অন্তত যেন তাঁর অ্যাপসে সেই তথ্য দেন।
এসব উদ্যোগের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলে কাজ করলে ২০৩৫ সালের মধ্য যক্ষ্মার সংক্রমণ ৯৫ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব।
ডা. মো. রাশেদ আল রাজি
ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, ল্যাব এইড হাসপাতাল
এখন পর্যন্ত ফুসফুসে ক্যানসার নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, যক্ষ্মা নিয়ে ততটা আলোচনা হয় না। অথচ যক্ষ্মায় মৃত্যুর সংখ্যা ফুসফুসে ক্যানসারের মৃত্যুর তিন গুণ বেশি। যেহেতু বেসরকারি খাতে অনেক বেশি এক্স–রে হচ্ছে, সেহেতু এখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কোনো কিছু করা যায় কি না, ভাবতে হবে। যাঁরা উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের এক্স–রেগুলোকে যক্ষ্মার জন্য স্ক্রিনিং করা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর থেকে চিকিৎসা শুরু হতে প্রায় ৪৭ দিন সময় লাগে। এদিকেও আমাদের নজর দিতে হবে।
আমাদের জনসংখ্যার বেশির ভাগ মানুষের প্রবণতা হচ্ছে, তাঁরা বেসরকারি খাত থেকে স্বাস্থ্যসেবা পেতে চান। যক্ষ্মার ক্ষেত্রে আমি ব্যক্তিগতভাবে দুটি চ্যালেঞ্জের কথা বলতে চাই। প্রথমটি হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তিরা শনাক্ত না হওয়া, তাঁরা কিন্তু বাহক হিসেবে কাজ করছেন। আরেকটি মিসিং কেস, শনাক্ত হওয়ার পর তাঁরা চিকিৎসাসেবার আওতায় থাকছেন না বা চিকিৎসায় গ্যাপ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।
ডা. সৈয়দা রুখশানা পারভীন
বিভাগীয় প্রধান, শিশু বিভাগ, খুলনা মেডিকেল কলেজ
কোনো শিশুকে আমাদের কাছে যক্ষ্মার লক্ষণ নিয়ে এলে তা শনাক্ত করে চিকিৎসা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়। যাঁরা চিকিৎসা নেন, আমি তাঁদের মাঝেমধ্যে আসতে বলি। তাঁরা ঠিকমতো ওষুধ খাচ্ছেন কি না, তা দেখতে চাই৷ কিন্তু এটা এনটিপি রেজিস্ট্রারের মধ্যে কতটুকু আসে, তা আমি
জানি না।
আবার কোনো শিশু হয়তো যক্ষ্মার লক্ষণ নিয়ে আমাদের কাছে এল, আমরা পরীক্ষা করে জানতে পারলাম, এটা যক্ষ্মা। খবর নিলে দেখতে পাই, ওই বাড়ির চাচা, দাদা, নানা কেউ না কেউ আক্রান্ত আছেন। ওই বাড়িতে দুই-তিন বছরের আরও কয়েকটি শিশু আছে। তখন আমাদের কাউন্সেলিং করতে হয়। তাদের টিবি প্রিভেন্টিভ থেরাপি সম্পর্কে বোঝাতে হয়।
দুই সপ্তাহের বেশি কাশি বা জ্বর, ওজন বাড়ছে না, চটপটে ভাব কমে গেছে, তাহলে শিশুর যক্ষ্মা পরীক্ষা করান।
অধ্যাপক ডা. খসরুল আলম মল্লিক
অধ্যাপক, বক্ষব্যাধি বিভাগ, খুলনা মেডিকেল কলেজ
খুলনার মতো বড় একটা জায়গায় এখনো কফ মাইক্রোস্কপি করা হয় বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিকে। মাইক্রোস্কপির মাধ্যমে মাত্র ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কেস শনাক্ত করতে পারে। অন্যদিকে জিন এক্সপার্ট মেশিনের মাধ্যমে ৯৫ শতাংশের বেশি কেস শনাক্ত করতে পারে।
সরকারের পাশাপাশি অনেক বেসরকারি সংস্থা যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সরকারের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে। স্কুলপর্যায়ে পাঠ্যবইতে যক্ষ্মা, এর উপসর্গগুলো ও করণীয় সম্পর্কে লিখতে হবে।
ফোনের কলার টিউনেও অল্প সময়ের মধ্যে যক্ষ্মা সম্পর্কে তথ্য দেওয়া যেতে পারে। এখন মানুষ বেশির ভাগ যেসব বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে যান। এক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা পরিধি বাড়াতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মনিমোহন সাহা
কনসালট্যান্ট প্যাথলজি, পপুলার ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, খুলনা
দেশের দুই-তৃতীয়াংশ চিকিৎসাসেবা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে আসে। বেসরকারি চিকিৎসাসেবা দিন দিন বিকশিত হচ্ছে। মানুষ এখন ওয়ান–স্টপ সার্ভিস চান; অর্থাৎ এক জায়গায় গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেখানেই চিকিৎসা পেতে চান। যেখানে জিন এক্সপার্ট মেশিন দেওয়া হয়েছে, সেখানে ফুসফুস–বহির্ভূত যক্ষ্মার ক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহের জন্য পর্যাপ্ত লোকবল নেই। সরকারি বক্ষব্যাধি ক্লিনিক থেকে নমুনা সংগ্রহের জন্য সেখানে পাঠানো হয়।
সুতরাং আমার একটি অনুরোধ থাকবে, বেসরকারি পর্যায়ে জিন এক্সপার্ট মেশিন দেওয়ার পাশাপাশি যেন একজন করে নমুনা সংগ্রহকারী দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে এফএনএসি নামের পরীক্ষার করার জন্য একজন লোক থাকলে আরও ভালো হয়। তাহলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ডায়াগনসিসের ক্ষেত্রে আরও বেশি সাহায্য করতে পারবে।
রওনক হাসান রণ
সহকারী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
আমার মনে হয়, যক্ষ্মা নির্মূলে সচেতনতার বিকল্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিবছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ক্যাম্পেইন করা যেতে পারে। পোস্টারিং, কার্টুনের মাধ্যমে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা যেতে পারে।
কার্টুন এখন অনেক শক্তিশালী মাধ্যম। আর এ সময়ে শিক্ষার্থীরা অনেক সংবেদনশীল থাকে, তাদের শেখার আগ্রহ থাকে। করোনার সময় সচেতনতামূলক অনেক কার্যক্রম আমরা পরিচালনা করেছি। সেখান থেকে আমার মনে হয়েছে, এটি অনেক বেশি কার্যকর হবে। কারণ, নতুন বাংলাদেশ গঠনের মূল কারিগর তারাই।
মাঠপর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুই-তিনটি গ্রাম নিয়ে এ রকম যক্ষ্মা সচেতনতামূলক ছোট নাটক, পালাগান কিংবা গম্ভীরার মতো উদ্যোগ নিলে ফলপ্রসূ হবে বলে মনে করি।
মো. আসাদুজ্জামান
বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (খুলনা), ব্র্যাক
ব্র্যাকের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যকর্মীরা যক্ষ্মার লক্ষণধারীদের স্ক্রিনিংয়ের আওতায় নিয়ে আসেন। কিন্তু লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও যেসব যক্ষ্মারোগী শনাক্ত হয় না, সে রকম প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষকে আমরা ফ্যাসিলিটি পর্যন্ত আনতে পারি না। ব্র্যাক গ্লোবাল ফান্ডের অর্থায়নে অনেককেই যাতায়াত খরচ দিয়ে সেন্টার পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে; কিন্তু সেটা অপ্রতুল।
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সক্রিয় ভূমিকা অনেক জরুরি। খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় আইসিডিডিআরবি থেকে প্রতিটি সেন্টারে জনবল প্রদান করেছে। যক্ষ্মা কার্যক্রমে বৈশ্বিক অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এটি হলে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ কীভাবে এর নেতৃত্ব দেবে, বেসরকারি খাত কতখানি সাহায্য করতে পারবে, এনজিওকর্মীরা কীভাবে অবদান রাখবেন, সে–সংক্রান্ত লেখালেখি জরুরি।
সাজ্জাদুর রহিম পান্থ
পরিচালক, সিএসএস, খুলনা
স্বাস্থ্যের নানা বিষয় নিয়ে আমরা মাঠপর্যায়ে কাজ করি। সরাসরি আমরা যক্ষ্মা নিয়ে কাজ করি না। সরাসরি যক্ষ্মা নিয়ে না কাজ করলেও এর যমজ ভাই কুষ্ঠরোগ নিয়ে কাজ করি। লেপ্রসি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে আমরা বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনায় মাঠপর্যায়ে কাজ করি। মাঠপর্যায়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে মানুষকে জানানো, কোথায় তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা একেবারে দোরগোড়ায় গিয়ে জরিপের মাধ্যমে কাজ করি।
এ ধরনের উদ্যোগ সরকারের সহযোগিতায় বেসরকারি খাত থেকে নেওয়া সম্ভব। যক্ষ্মার স্বাস্থ্যসেবা যে পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছে, তা খুবই প্রশংসনীয়। অনেক জায়গায় কারিগরি লোকবলের অভাব রয়েছে। জানাও অ্যাপসের ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে ভালো কাভারেজ দেওয়া সম্ভব।
ডা. শাহরিয়ার আহমেদ
সহকারী বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআরবি
সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সমন্বয়েই আমরা অনেক দূর এসেছি। এক সময় আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে হিসাব তার অর্ধেক সংখ্যক যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করতে পারতাম। সেখান থেকে আমরা এখন ৮০ শতাংশতে উন্নীত হয়েছি। আমরা এখন শেষের পথটুকু অতিক্রম করছি। আমরা এখন স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছি। এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দাতাদের অর্থায়নও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, আমাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন খাতে সরকারের ভর্তুকি কমে আসছে।
এক সময় বাংলাদেশের অনেক জায়গায় সরকারের ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি থাকলেও এখন চারটি জেলা ছাড়া কোথাও নেই। তাই বলে কি দেশের অন্য জায়গায় কারো ম্যালেরিয়া হচ্ছে না? হচ্ছে। তারা চিকিৎসা নিচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতালে। বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে যেন তারা ভবিষ্যতে ম্যালেরিয়ার মত যক্ষ্মা চিকিৎসার দায়িত্বটা নিতে পারেন।
আলোচনায় জানাও অ্যাপসের কথা এসেছে। আমরা এটি নিয়ে খুলনায় কাজ করব। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি পরিচালিত ন্যাশনাল প্রিভ্যালেন্স সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, ৪৭ শতাংশ মানুষ প্রথমবার কাশি হওয়ার পর সে স্বাস্থ্যসেবা নিতে ফার্মেসিতে গিয়েছে। ৩০ শতাংশ মানুষ বেসরকারি হাসপাতাল বা চিকিৎসকদের কাছে গিয়েছেন। আর বাকি ২৩ শতাংশ সরকারি জায়গাগুলো থেকে সেবা নিয়েছেন।
বলা হচ্ছে, বেসরকারি খাত অনেক জটিল। কিন্তু এ খাতকে সাথে নিয়েই যক্ষ্মা নির্মূল করতে হবে। তাদের না নিয়ে আসলে আমরা এই শেষের পথটুকু অতিক্রম করতে পারব না। বড় বড় চেইন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও স্থানীয় পর্যায়ের বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেক রোগী আসেন। মানুষ এখন ওয়ান স্টপ সার্ভিস চায়। আপনাদের এখানে যে রোগী আসবে সে যেন আপনাদের কাছেই সকল সেবা পায়। কিন্তু, তার তথ্যগুলো যেন জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কাছে আসে। বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যেন আমাদের রেকর্ডিং এবং রিপোর্টিংয়ে সাহায্য করেন।
সুপারিশ
খুলনা অঞ্চলে যক্ষ্মা প্রতিরোধে এনজিও ও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের একত্র করে একটি সমন্বিত আঞ্চলিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি।
খুলনার বেসরকারি খাতে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো একটা বড় নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। যক্ষ্মা চিকিৎসায় এই নেটওয়ার্ক কাজে লাগানো যেতে পারে।
স্থানীয় অর্থায়নের মাধ্যমে তহবিল গড়ে তোলা, যা টেকসই স্বাস্থ্যসেবার জন্য ব্যবহার হবে।
গণমাধ্যমের ভূমিকা বাড়াতে হবে।
জানাও অ্যাপের মাধ্যমে এনটিপিকে শনাক্তকৃত রোগী নোটিফিকেশনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
ইনফরমাল হেলথ প্রোভাইডারদের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে জোরালো ভাবে সম্পৃক্ত করা।