বাংলাদেশে জেন্ডার সমতা, প্রয়োজন কাঠামোগত পরিবর্তন

বাংলাদেশে নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন ও অর্জনের পরও এ দেশের নারীরা এখনো সমতা, প্রতিনিধিত্ব ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কাঠামোগত বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী গণ-আন্দোলন—সর্বত্রই ছিল নারীর অপ্রতিরোধ্য  ভূমিকা। তা সত্ত্বেও নারীর প্রতি সহিংসতা যেমন কমছে না, তেমনি দেশের নাগরিক এবং পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে মিলছে না সম্মান ও অধিকার। পরিবর্তিত বাংলাদেশে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করার জোর পদক্ষেপ তাই এখন সময়ের দাবি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নারীর প্রতি চলমান বৈষম্য এবং ক্রমবর্ধমান লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সামনে রেখে নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে দুটি দাবিনামা তৈরি করা হয়েছে। সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বহ্নিশিখা এবং নারীপক্ষের মতো নারী অধিকার সংগঠনের সহায়তায় এই দাবিনামাগুলো তৈরি হয়েছে। তাৎক্ষণিক আইনি সুরক্ষা থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে দুটি দাবিনামা থেকে উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে নিচে ধরা হয়েছে, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা আশা করছি।

সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বহ্নিশিখা এবং নারীপক্ষের মতো নারী অধিকার সংগঠনের সহায়তায় এই দাবিনামাগুলো তৈরি হয়েছেছবি: প্রথম আলো

প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের নারীরা মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক সংহতি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে সামাজিক পরিবর্তনে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন নারীদের প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করার জন্য জাতিসংঘ সিডও (CEDAW) চুক্তির প্রতি প্রতিশ্রুতি আরও দৃঢ় করে। এটি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং আইনি সংস্কারের বিষয়ে আন্দোলনকে আরও ত্বরান্বিত করে।

১৯৯১ সাল থেকে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে বিভিন্ন দফায় নারীরা দায়িত্ব পালন করলেও দেশের সর্বস্তরে নারীর অবস্থান এবং ক্ষমতায়ন সমভাবে দৃশ্যমান হয়নি। নারীর প্রতি অবিচার এবং ঘরে-বাইরে সর্বত্র যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছিল। ফলে ২০২০ সালে বাংলাদেশে নারীবাদী আন্দোলন এবং জনরোষের শক্তিশালী উত্থান ঘটে, যা মূলত ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ক্রমবর্ধমান ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছিল। সাম্প্রতিক ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’-এর মাধ্যমে নারীদের জন্য নির্ধারিত ১০ শতাংশ কোটা বাতিল করা হয়েছে, যা কাঠামোগত বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDGs) লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। এর ফলে নারীরা আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন।

২০২৪-এর যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সরকার পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছিল, সেখানেও নারীরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংস্কার কমিশনে ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব পাননি, বিশেষ করে তরুণ নারীরা আরও উপেক্ষিত হয়েছেন। তাই নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গসমতা এবং নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য চলমান আন্দোলন আরও জোরদার করা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

দেশে নারী আন্দোলনের পূর্ববর্তী সাফল্যকে সম্মান জানিয়ে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, লিঙ্গ সংবেদনশীল ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও বহ্নিশিখা, ইউএন উইমেনের সহায়তায় একটি দাবিনামা তৈরি করেছে। বিভিন্ন পর্যায়ের ও প্রজন্মের নারীদের একত্র করে, বিশেষত যাঁরা প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, তাঁদের সমান অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এই চার্টার প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও আন্তপ্রজন্মভিত্তিক পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে জাতীয় থেকে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন অংশীদারের শতভাগ অংশগ্রহণ ও মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

নারী ও কন্যাশিশুর অধিকার

এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বিষয়বস্তু  হলো, ‘সকল নারী ও মেয়েদের জন্য: অধিকার, সমতা এবং ক্ষমতায়ন। ইউএন উইমেনের বেইজিং ডিক্লারেশন এবং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশনের ৩০তম বার্ষিকী উপলক্ষে বৈশ্বিক প্রচারণার আওতায় ‘সকল নারী ও মেয়েদের জন্য’ বিষয়বস্তুর অধীনে এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসে একটি জোরালো আহ্বান জানানো হয়। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জোর দেওয়া হচ্ছে, যা হলো নারী এবং কন্যাশিশুদের অধিকার উন্নীত করা, নারী ও কন্যাশিশুদের পূর্ণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া এবং সব ধরনের সহিংসতা, বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলা—

১। নারী ও মেয়েদের অধিকারের অগ্রগতি: সব ধরনের সহিংসতা, বৈষম্য এবং শোষণকে চ্যালেঞ্জ করে নারী ও মেয়েদের পূর্ণাঙ্গ মানবাধিকারের জন্য নিরলসভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়া।

২। লিঙ্গসমতা প্রচার: কাঠামোগত বাধা দূর করা, পিতৃতন্ত্র ভাঙা, চিরাচরিত বৈষম্য দূর করা এবং প্রান্তিক নারী ও কন্যাশিশু, বিশেষ করে তরুণীদের কণ্ঠ তুলে ধরা করা, যাতে অন্তর্ভুক্তি এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা যায়।

৩। ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি: শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নেতৃত্ব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে ক্ষমতা কাঠামো পুনর্নির্ধারণ। তরুণী ও মেয়েদের নেতৃত্ব ও উদ্ভাবনের সুযোগকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

জুলাইয়ের আন্দোলনের পর নারীপক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারকে মোট ৮টি ক্যাটাগরিকে প্রাধান্য দিয়ে একটি দাবিনামা উপস্থাপন করে। বিভাগীয় পর্যায়ে অংশীজনদের সঙ্গে বিস্তর আলোচনার মাধ্যমে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারা স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রস্তাবনা দেয়। আটটি বিভাগের মধ্যে রয়েছে: সহিংসতা থেকে নারীদের মুক্তি, নারীদের অর্থনৈতিক অধিকার, নারীদের রাজনৈতিক অধিকার, নারীদের স্বাস্থ্য অধিকার, নারীদের শিক্ষা, জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষা, প্রান্তিক নারীদের অধিকার এবং সাম্প্রদায়িক ঐক্য প্রতিষ্ঠা।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং বহ্নিশিখা সম্মিলিতভাবে যে দাবিনামাটি তৈরি করেছে, তা ছয়টি প্রধান বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে—শিক্ষা, যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, স্বাস্থ্য, আইন সংস্কার ও ন্যায়বিচারের প্রাপ্যতা, নারীদের অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং অবৈতনিক কাজ; জেন্ডার বাজেট এবং সুশাসন। নারী এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলোর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য নির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে এই ক্ষেত্রগুলোর অধীনে; যা স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য বাস্তবায়নযোগ্য।

ফওজিয়া মোসলেম

সভাপ্রধান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

‘রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারীদের নেতৃত্বে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন শুধু নারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং এটি জাতীয় উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে মূলধারার রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।’

গীতা দাস

সভানেত্রী, নারীপক্ষ

‘১৯৮৩ সাল থেকে নারীদের অবস্থানে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে নারীপক্ষ সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়ে যাচ্ছে। আমরা এই পরিবর্তনগুলো পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের আইনে চাই। আমরা সম্পদ এবং সন্তানদের ক্ষেত্রে সমান অধিকার দাবি করি। এ জন্য আমরা সরকারের প্রতি জোরালোভাবে আহ্বান জানাই, যেন তারা সিডওর ২ এবং ১৬-১(গ) ধারার সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে। আমরা নারীদের সহিংসতামুক্ত জীবন দেখতে চাই। তবে এটি অর্জন করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নারীদের শারীরিক গঠনকে গুরুত্ব না দিয়ে তাঁদের যোগ্যতাকে মুখ্য করে দেখা। এর জন্য দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রয়োজন। নারীপক্ষ চায় যে নারীদের নাগরিক হিসেবে অধিকার প্রদান এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। আমাদের প্রত্যাশা একটি জাগতিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমাজ।’

তাসাফ্ফী হোসেন

প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বহ্নিশিখা

‘যত দিন এই দেশের প্রত্যেক নাগরিক সংবিধান দ্বারা নিশ্চিত সমান অধিকার না পাবে, তত দিন কোনো সংস্কার, যতই সদিচ্ছাপূর্ণ হোক না কেন, প্রকৃত পরিবর্তন আনতে পারবে না। নীতি ও আইন থাকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে যথাযথ বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহি ছাড়া তাদের প্রভাব সীমিতই থেকে যায়। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে স্বৈরতন্ত্র, দুর্নীতি ও একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালানো হয়েছে, যেখানে নারীরা এবং সামাজিকভাবে বঞ্চিত জনগোষ্ঠী কখনো নেতৃত্ব দিয়েছে আর কখনো সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। সেই হিসাবে এত দিনে আমাদের সমাজে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু প্রতিবারই দেখা গেছে যে একবার জাতীয় দাবি পূরণ হয়ে গেলে নারীদের ভূমিকা ও অধিকারের বিষয়গুলো সব আলোচনা থেকে হারিয়ে যায়। এর কারণ আমাদের সংগ্রাম সুবিধাভোগীদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না।

পরিবর্তন তখনই আসবে, যখন নারীদের সমান নাগরিক এবং মানবিক সত্তা হিসেবে দেখা হবে। আমরা শুধু মা, বোন বা মেয়ে নই, যাদের সর্বদা সুরক্ষার প্রয়োজন। আমাদের প্রয়োজন কাঠামোগত এবং মানসিকতার পরিবর্তন। নারী, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এবং লিঙ্গবৈচিত্র্য সম্প্রদায়ের মানুষকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নেতৃত্ব, নীতি ও সংস্কারপ্রক্রিয়ায় শুধু প্রতীকী হিসেবে না

রেখে সক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। আমাদের দাবি খুবই সাধারণ: আমার দেশের পুরুষদের যা আছে, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়—সমান অধিকার, মর্যাদা, ন্যায়বিচার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমান প্রতিনিধিত্ব।’

অবিলম্বে (স্বল্পমেয়াদে) ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি

এই দাবিগুলো নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর প্রভাব ফেলছে এমন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের জন্য অবিলম্বে বাস্তবায়ন করার জন্য সুপারিশ করা হচ্ছে—

  • যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনে বুলিইং এবং যৌন হয়রানি রোধে সুরক্ষা নীতিমালাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হাইকোর্টের রিট পিটিশন নং ৫৯১৬/২০০৮৮-এর ভিত্তিতে রায় বাস্তবায়ন করুন। সবার জন্য, বিশেষ করে নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও লিঙ্গবৈচিত্র্যময় মানুষের জন্য সহিংসতামুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র এবং সব জনপরিসরকে কার্যকর করতে একটি বিস্তারিত যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করুন।

  • নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করতে সিডওর ধারা ২ এবং ১৬.১(গ) থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার।

  • ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭’-এর বিশেষ বিধান বাতিল করুন, যা শিশুকে ‘বিশেষ ক্ষেত্রে’ বিবাহের অনুমতি দেয়।

  • মানুষের বৈচিত্র্যময় সত্তা এবং সর্বজনীন অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে ধর্ষণ আইন সংশোধন করুন: বৈবাহিক ধর্ষণসহ সম্মতিহীন যেকোনো যৌন আচরণকে ধর্ষণের আওতায় আনতে ধর্ষণের সংজ্ঞা প্রসারিত করুন এবং এই সংজ্ঞা যেন সব লিঙ্গ পরিচয়ের ব্যাপারে প্রযোজ্য হয়, তা নিশ্চিত করুন।

  • সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ (সংশোধিত) এর ধারা ১৪৬(৩) পর্যালোচনা করুন।

  • আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি নতুন ডিজিটাল/সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করুন। বিদ্যমান নিরাপত্তা হুমকি বিবেচনায় এআই সম্পর্কিত সমস্যা নিরূপণে সাইবার আইনের সংজ্ঞা পরিমার্জন করুন।

  • সংবিধান সংশোধন করে এমন একটি কাঠামো সমুন্নত রাখতে হবে, যা সব নাগরিকের বৈচিত্র্যময় বিশ্বাসকে সম্মান করে, এ ছাড়া সংবিধানে বাংলার পাশাপাশি আরও ৪১টি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।

  • ‘ইন্ডিজিনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন ১৯৫৭’-এর ১০৭ নম্বর সনদ অনুসরণ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার সমুন্নত রাখতে ‘আদিবাসী’ হিসেবে তাদের স্বীকৃতি অব্যাহত রাখুন।

  • ২০২৪ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত কোটা পদ্ধতি সংশোধন করে নারীদের জন্য সরকারি চাকরিতে আলাদা কোটা পুনঃপ্রবর্তন করুন; এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত কোটা থেকে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের কোটা আলাদা করুন। ট্রান্সজেন্ডার, লিঙ্গবৈচিত্র্যময় এবং আন্তলিঙ্গের ব্যক্তিদের জন্য একটি পৃথক কোটা প্রতিষ্ঠা করুন। সেই সঙ্গে আদিবাসী, দলিত, নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং যৌনকর্মীদের সন্তান, চা–শ্রমিকদের সন্তানদের মতো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য পৃথক কোটার ব্যবস্থা করুন।

  • কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি দূরীকরণে আইএলওর সি১৯০ সনদ অনুমোদন করুন।

  • পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও নিবিড় তদারকি নিশ্চিত করার মাধ্যমে জেন্ডার-প্রতিক্রিয়াশীল বাজেটের কার্যকর বাস্তবায়ন করে অর্থবহ, টেকসই পরিবর্তন নিশ্চিত করুন। নারী, লিঙ্গবৈচিত্র্যময় ব্যক্তি, নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীসহ বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থসামাজিক অগ্রগতি, জীবনযাত্রার মান খাতে পর্যাপ্ত জাতীয় বাজেট নির্ধারণে অগ্রাধিকার দিন।

মধ্যমেয়াদি কার্যক্রমের জন্য দাবি

মধ্য মেয়াদে এসব দাবি পূরণে কাজ করতে হবে এবং যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা, সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কিছু পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে হবে—

  • কৃষি খাতে নারী কৃষক ও মৎস্যচাষিদের স্বীকৃতি নিশ্চিত করুন এবং জাতীয় আদমশুমারির মাধ্যমে আলাদাভাবে তথ্য সংগ্রহ করে বাংলাদেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে তাঁদের অবদান তুলে ধরুন।

  • বাংলাদেশের কোনো নাগরিক যাতে ধর্ম, ভাষা, জাতি, বর্ণ, নারী-পুরুষ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্যের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে বৈষম্যবিরোধী বিলটি পুনর্বিবেচনা করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা ও বাসস্থানের সুযোগ দেওয়া হোক।

  • গৃহকর্মে শিশুশ্রম প্রতিরোধে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, ২০১৫-এর পূর্ণ বাস্তবায়ন করুন।

  • সব ধর্মের বিয়ে ও আন্তধর্মীয় বিবাহের নিবন্ধন নিশ্চিত করুন।

  • যৌন নির্যাতনের মামলা কার্যকরভাবে তদন্ত ও বিচারের জন্য আইন প্রয়োগকারী এবং আইনি পেশাদারদের প্রশিক্ষণ দিন।

  • ২০১৬ সালের সিডও কমিটির অনুরোধ অনুসারে জমি দখল–সম্পর্কিত লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা তদন্ত করুন।

  • জেলা পর্যায়ে সাইবার সুরক্ষা শাখা স্থাপন করুন এবং দ্রুত তদন্ত নিশ্চিত করুন।

  • দণ্ডবিধির অধীন ধারা ৩১২ এবং ৩১৬–এর সংস্কার যা কোনো নারীর শারীরিক স্বাধিকারকে স্বীকৃতি দেয় না।

  • সংরক্ষিত আসনে নারীদের প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়া যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক হয়, তা নিশ্চিত করুন এবং সংসদে ন্যূনতম ৫০ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করুন।

  • রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্তি এবং বৈচিত্র্যের প্রয়োজনীয়তা প্রতিষ্ঠা করুন। এর জন্য দলের কাঠামোতে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারীকে নেতৃত্বের ভূমিকায় রাখার বাধ্যবাধকতা রাখুন।

  • নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বাজেট ব্যয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি নিশ্চিত করুন।

  • সমাজ এবং নারী নেতৃত্বাধীন সমাধানকে উৎসাহ জোগাতে বিশেষ করে দুর্বলতর জনগোষ্ঠীর জন্য একটি জলবায়ু এবং জেন্ডারবিষয়ক বাজেট প্রতিষ্ঠা করুন।

  • সর্বজনীন অন্তর্ভুক্তি এবং মানুষের বিভিন্ন সত্তার প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করার জন্য ভর্তি ফরমে ‘পুরুষ’ ও ‘নারী’র বাইরে বিভিন্ন লিঙ্গ পরিচয়ের একটি বিস্তৃত তালিকা অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করুন।

  • রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অবৈতনিক পরিচর্যার কাজকে স্বীকৃতি দিন, এটি জাতীয় মোট জাতীয় উৎপাদনে অন্তর্ভুক্ত করুন এবং পরিচর্যা অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়ান।

দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রমের জন্য দাবি

এই দাবিগুলোর জন্য পদ্ধতিগত পরিবর্তন, নীতি সংস্কার ও কাঠামোগত উন্নতি প্রয়োজন এবং তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় কৌশল এবং পরিচালনা ও কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার—

  • সম্পত্তির অধিকার, উত্তরাধিকার আইন ও বৈবাহিক বিধিবিধানের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে নারী, অন্যান্য লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক প্রাচীন ঔপনিবেশিক আইনসমূহ সংস্কার ও নির্মূল করার জন্য একটি বিস্তৃত পর্যালোচনা করুন।

  • উত্তরাধিকার আইন সংস্কার করুন এবং লিঙ্গ পরিচয়নির্বিশেষে সবার জন্য পারিবারিক আইনে সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য একটি অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রয়োগ করুন।

  • আইনি ভাষার বোধগম্যতা বাড়াতে এর সরলীকরণ নিশ্চিত করুন, যেখানে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর জন্য ভাষাবৈচিত্র্য এবং ‘তৃতীয় লিঙ্গ’র মতো পারিভাষিক শব্দের ব্যাখ্যার অবকাশ থাকবে।

  • যৌনকর্মীদের অধিকার ও সুস্থতা রক্ষার জন্য অল্প বয়সী মেয়েদের শোষণ প্রতিরোধ করা এবং তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন, পুনর্বাসন ও ত্রাণ পাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করতে ‘যৌনকর্মী সুরক্ষা আইন’ প্রবর্তন করুন।

  • চা–বাগান এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর শিশুদের প্রাথমিক স্তরের পরে স্কুল থেকে ঝরে পড়া রোধে এই এলাকাগুলোর কাছাকাছি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করুন।

  • স্টেম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত) শিক্ষার প্রচার করুন।

  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারীদের খেলাধুলার সুবিধার্থে অর্থসংস্থান, স্থান ও রসদের জোগান নিশ্চিত করুন।

  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা বাড়াতে প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত নকশা হালনাগাদকরণ নিশ্চিত করুন।

  • বাংলাদেশ শ্রম আইন (২০০৬)–এর ৪৬ ধারা প্রয়োগ করে কর্মজীবী মায়েদের চার মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি, আট সপ্তাহ প্রসবপূর্ব ছুটি এবং আট সপ্তাহ প্রসব–পরবর্তী ছুটি মঞ্জুর করতে হবে।

  • প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধার মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবাকে একীভূত করুন। দুর্যোগপরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদানের জন্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করুন, যা জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের কারণে আঘাত, সহিংসতা এবং ক্ষয়ক্ষতির মতো বিষয়গুলোকে আমলে নেয়। এই মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোর বিনা মূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করুন।

  • স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সেবায় বৈষম্যহীন নীতির প্রয়োগ নিশ্চিত করুন, যার মধ্যে বৈবাহিক অবস্থা, বয়স ও লিঙ্গনির্বিশেষে সবার জন্য প্রজননক্ষমতা–সংক্রান্ত চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ থাকবে।

  • স্থানীয় প্রশাসনে (চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য প্রমুখ) নারী ও পুরুষের সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করুন, পাশাপাশি দলিত, হিজড়া, আদিবাসী ও লিঙ্গবৈচিত্র্যময় ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করুন।

  • লিঙ্গ, প্রতিবন্ধিতা ও জাতিগত বিভাজন অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ করুন, যার মধ্যে বয়স, লিঙ্গ, শহর বা গ্রামভিত্তিক অবস্থান এবং সামাজিক-আর্থিক পটভূমির চিত্র উঠে আসবে।

  • লিঙ্গভিত্তিক তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একটি সবিস্তার জরিপ পরিচালনা করুন এবং প্রতিবন্ধী উপবৃত্তির প্রয়োজন আছে এবং উপবৃত্তি প্রদানের যোগ্য ব্যক্তিদের চিহ্নিত করুন। বর্তমান জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বরাদ্দকৃত উপবৃত্তির পরিমাণ পুনর্বিবেচনা করুন।

গীতাঞ্জলি সিং

প্রতিনিধি, ইউএন উইমেন

‘যেহেতু আমরা বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনার ৩০তম বার্ষিকীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, আমাদের অর্জনগুলোর পাশাপাশি এখনো অপূর্ণ প্রতিশ্রুতিগুলোর কথাও স্বীকার করতে হবে। নারী ও কন্যাশিশুরা এখনো বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে সীমিত প্রতিনিধিত্ব, সহিংসতা এবং গভীরে প্রোথিত সামাজিক রীতিনীতি তাদের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

৩০ বছর আগে বেইজিংয়ে দেওয়া সমতার প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবায়ন করতে আমাদের প্রয়োজন এক ডিজিটাল বিপ্লব, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, সহিংসতার অবসান, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমান ক্ষমতা, শান্তি এবং জলবায়ু ন্যায়বিচার। আসন্ন কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেন (CSW) অধিবেশন আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ এনে দিচ্ছে, যেখানে লিঙ্গসমতার প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি নতুন করে দৃঢ় করার প্রয়োজন। পেছনে ফেরার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের বিচার হবে শুধু কথার ভিত্তিতে নয়, বরং আমাদের কাজের মাধ্যমে। কারণ, লিঙ্গসমতা অর্জন শুধু নারীদের জন্য নয়, শুধু কন্যাশিশুদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন।’