যক্ষ্মা ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে বেসরকারি অংশীদারত্ব

বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস উপলক্ষে স্টপ টিবি পার্টনারশিপের সহযোগিতায় আইসিডিডিআরবি ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস: যক্ষ্মা ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে বেসরকারি অংশীদারত্ব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ২৩ মার্চ ২০২৪ এই গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয়ছবি: খালেদ সরকার

প্যানেল আলোচক: 

ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা

অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ডা. মো. মাহফুজার রহমান সরকার

লাইন ডিরেক্টর, টিবি–এল অ্যান্ড এএসপি, এনটিপি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ডা. সায়েরা বানু

সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ও প্রধান, পিইআই, আইডিডি, আইসিডিডিআরবি

সামিনা চৌধুরী

আইডি টিম লিড, ইউএসএআইডি

সৈয়দ আব্দুল হামিদ

অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মো. আকরামুল ইসলাম

জ্যেষ্ঠ পরিচালক, ব্র্যাক

মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম

ভাইস প্রেসিডেন্ট, নগদ লিমিটেড

স্বর্ণলতা রায়

সভাপতি, সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি

মো. মুহসিন

পরিচালক, মার্কেটিং অপারেশন, এসিআই লিমিটেড

ডা. এস এম মোস্তফা জামান

অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ

ডা. শেখ আব্দুল ফাত্তাহ্‌

মেডিসিন বিভাগের প্রধান, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন

সমন্বয়ক, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, বিজিএমইএ

রুবিনা খান

হেড অব এইচআর, বেক্সিমকো পেট্রো

মাহমুদুল হাসান খান

জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক, এসএমসি

জয়ীতা তালুকদার

সংগীতশিল্পী ও আইসিসিআর স্কলার

জেসিয়া ইসলাম

মিস বাংলাদেশ ২০১৭

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা

অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

যক্ষ্মা একটি পুরোনো রোগ হলেও আমরা কেন এখনো এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, এই প্রশ্ন আমার শিক্ষার্থীজীবনে পরীক্ষায় এসেছিল। একই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় কিছুদিন আগেও দেখলাম একই প্রশ্ন পরীক্ষায় আসছে।

এখনো ৬৬ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশুদের যক্ষ্মা রোগের বিষয়ে জানা যায় না। এই সমস্যার সমাধান হিসেবে বেসরকারি খাতকে সরকারি কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। বেসরকারি খাত বলতে কেবল ‘সরকারি নয়’ এমন খাতকে বোঝানো হয় না। এখানে লাভজনক ও অলাভজনক বলে দুটি অংশ আছে। আবার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বেসরকারি খাতও আছে। একজন চিকিৎসক যেমন বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত, আবার তিনি আলাদা চেম্বারও করেন। রোগী কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আলাদা চেম্বারেই যান। রোগী চিকিৎসার জন্য যেখানেই যাক, সেখান থেকে তাকে সরকারি কিংবা সরকারের সহযোগী কোনো রোগনির্ণয় কেন্দ্রেই পাঠানো হয়। সেখানেই মূলত যক্ষ্মা আছে কি না ধরা পড়ে।

যক্ষ্মা হয়েছে জানতে পারলে চাকরি চলে যেতে পারে—এই ভয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত রোগীরা সেটি চেপে যান। এখানে আমাদের আরও কাজ করার সুযোগ রয়েছে। বেসরকারি খাতগুলো যক্ষ্মা রোগ নিরাময়ে বিনিয়োগ না করলেও অন্তত চাকরি না হারানোর নিশ্চয়তা দিলেও অনেক বড় কাজ হবে। যক্ষ্মা কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর আর ছড়ায় না। সুতরাং রোগীদের কীভাবে আলাদা রেখে কাজ করানো যায়, সেই উপায়ও আছে। চাকরিতে থেকেও রোগী নিজের চিকিৎসা চালিয়ে নিতে পারেন।

বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিদেশি তহবিল ধীরে ধীরে কমছে এবং একসময় বন্ধ হয়ে যাবে। তাই স্বনির্ভর হতে হলে নিজস্ব কৌশল দাঁড় করাতে হবে। এই জায়গায় সরকারি–বেসরকারি খাতের একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ আছে।

এখনো যক্ষ্মা রোগী যদি চিকিৎসা না পায় কিংবা চিকিৎসা পুরোপুরি না করা হয় অথবা যথাযথ উপায়ে না হয়—প্রতিটি ক্ষেত্রেই যক্ষ্মা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকে যায়। আশার কথা হলো, বেসরকারি পর্যায়ে এখন যক্ষ্মা রোগের ওষুধ তৈরি হচ্ছে। বেসরকারি খাতের কার্যক্রমগুলো এখন সরকার ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের জায়গাগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে।

যক্ষ্মা নির্মূল করা খুবই জরুরি। কারণ, এই রোগ নিরাময়ে ভালো ব্যয় হয়। এ ছাড়া আগাম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রতি আমাদের অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে দ্রুত শনাক্ত করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি রোগীর জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করাও জরুরি। যক্ষ্মার চিকিৎসার জন্য আলাদা প্রকল্প রয়েছে। সুতরাং সরকার এ ক্ষেত্রে কতটা আন্তরিক, সেটি নিশ্চয় বোঝা যায়।

ডা. মো. মাহফুজার রহমান সরকার

লাইন ডিরেক্টর, টিবি–এল অ্যান্ড এএসপি, এনটিপি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি যক্ষ্মা নির্মূল, যক্ষ্মার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ–সম্পর্কিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন এবং ২০৩৫ সালের মধ্যেই যক্ষ্মা নির্মূল, নাগরিকদের জন্য বিনা মূল্যে যক্ষ্মা রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসাদানে অঙ্গীকারবদ্ধ।

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, যক্ষ্মা রোগের কারণে মৃত্যু ও সংক্রমণের হার এমন পর্যায়ে কমিয়ে আনা, যাতে যক্ষ্মা একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচিত না হয়। আর আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে যক্ষ্মা রোগের মৃতু্যহার ২০১৫ সালের তুলনায় ৯৫ শতাংশ কমিয়ে আনা। আর নতুনভাবে সংক্রমিত যক্ষ্মা রোগের হার ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনা।

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে যক্ষ্মা রোগের উপসর্গ আছে, এমন প্রায় ৩০ লাখের বেশি মানুষের যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। বাংলাদেশে ২০২৩ সালে ৩ লাখ ১ হাজার ৫৬৪ জন যক্ষ্মারোগী শনাক্ত হয়েছে এবং তাদের চিকিৎসার আওতায় আনা হয়েছে। রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য সারা দেশে উপজেলা পর্যায়ে এ কর্মসূচির আওতায় জিন এক্সপার্ট মেশিন স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। পুরো দেশে এখন আমাদের এ রকম ৬২২টি মেশিন কার্যকর আছে। এ ছাড়া এলইডি মাইক্রোস্কোপ, লিকুইড কালচার, এলপিএ, ডিজিটাল এক্স–রে এনটিপির পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। আমাদের একটি ন্যাশনাল টিউবারকুলেসিস রেফারেল ল্যাবরেটরি আছে। এ ছাড়া পাঁচটি বিভাগে রিজিওনাল রেফারেন্স ল্যাবরেটরি আছে।

অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কারণে ২০২৩ সালে ২ হাজার ৭২৯ জন ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা (এমডিআর টিবি) রোগী শনাক্ত হয়েছে। সরকারিভাবে আমাদের ৪৪টি বক্ষব্যাধি ক্লিনিক আছে, ৭টি বক্ষব্যাধি হাসপাতাল আছে। মেডিকেল হাসপাতাল, সদর হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কিছু এনজিও ক্লিনিকে যক্ষ্মারোগীর চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের পর প্রতে৵ক রোগীকে বিনা মূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হয়।

শনাক্তের পরপরই যক্ষ্মারোগীকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসা হয়। ২০১০ সালে প্রতি লাখ মানুষের মধ্যে যক্ষ্মায় মৃত্যু হতো ৫৪ জনের। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৫ জনে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, ওষুধের মাধ্যমে ছয় মাসের স্বল্পমেয়াদি চিকিৎসাপদ্ধতির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যা যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী একটি পদক্ষেপ। যক্ষ্মা নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি করপোরেট ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

ডা. সায়েরা বানু

সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ও প্রধান, পিইআই, আইডিডি, আইসিডিডিআরবি

যক্ষ্মা একটি সংক্রামক রোগ। বিশ্বের যে ৩০টি দেশে যক্ষ্মারোগী বেশি, বাংলাদেশ তার মধ্যে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, আমাদের দেশে ২০২২ সালে আনুমানিক ৩ লাখ ৭৯ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় এবং ৪২ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় মারা যায়। এ ছাড়া ৪ হাজার ৯০০ মানুষ ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মায় (এমডিআর) আক্রান্ত হয়। ২০২২ সালে ২ লাখ ৬২ হাজার ৭৩১ যক্ষ্মারোগী শনাক্ত হয়, যা আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ ৩১ শতাংশ ব্যক্তি রোগ শনাক্তের বাইরে রয়ে যায় এবং এমডিআর টিবি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ জন শনাক্ত হচ্ছে না।

চিকিৎসার সুযোগ বাড়লেও মানুষ সহজে যক্ষ্মা পরীক্ষা করায় না। পরিস্থিতি অনেক খারাপ হওয়ার পর পরীক্ষা করাতে বা চিকিৎসকের কাছে আসে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে শিশুদের যক্ষ্মা ঠিকমতো শনাক্ত হচ্ছে না। মোট যক্ষ্মা শনাক্তের ৮ থেকে ১২ শতাংশ শিশু হওয়ার কথা, কিন্তু শনাক্ত হচ্ছে ৪ শতাংশ। ফলে শনাক্ত না হওয়ায় অনেক শিশুর যক্ষ্মা থাকলেও তারা চিকিৎসার আওতায় আসছে না।

দুই কারণে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মায় মানুষ আক্রান্ত হয়। প্রথমত, যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তি যদি নিয়মিত সঠিক মাত্রায় পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ সেবন না করে, ব্যক্তির শরীরে থাকা জীবাণু ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণু সরাসরি অন্য ব্যক্তির শরীরে যেতে পারে। প্রতিবছর ৪ হাজার ৯০০ মানুষ নতুন করে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। এদের দুই-তৃতীয়াংশ শনাক্ত হয় না। একটি কথা মনে রাখতে হবে, নখ ও চুল ছাড়া শরীরের যেকোনো অঙ্গে বা অংশে যক্ষ্মা হতে পারে। কিন্তু কিছু মানুষের এখনো এই ধারণা আছে যে যক্ষ্মা শুধু ফুসফুসের রোগ। ২৫ শতাংশ যক্ষ্মা ফুসফুসবহির্ভূত। শহর ও গ্রামে রোগনির্ণয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা যাচ্ছে না।

আমাদের দেশে এখনো অনেক মানুষ জানে না যে সরকার যক্ষ্মার চিকিৎসা বিনা মূল্যে দিচ্ছে। সরকারের সেবা বিষয়ে মানুষের ধারণা কম। বেসরকারি খাতে অর্থাৎ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে শনাক্ত হওয়া রোগীরা জাতীয় কর্মসূচির মধ্যে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সচেতনতার ঘাটতি আছে বলে আমি মনে করি। যক্ষ্মার মতো রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন দরকার। এই সামাজিক আন্দোলনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রাখতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি চিকিৎসায় বিনিয়োগের বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। তরুণদের যক্ষ্মা আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে হবে। আমার বিশ্বাস, সবার ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা যক্ষ্মাকে পরাস্ত করব।

সামিনা চৌধুরী

আইডি টিম লিড, ইউএসএআইডি

স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে যুক্ত করাকে অনেকে ভাবেন তাঁদের অর্থ দেওয়া বা এ রকম কিছু। বিষয়টি এমন কিছুই নয়। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির একটি অংশীদার হচ্ছে বেসরকারি খাত। গ্রামে যক্ষ্মার শুরুতে মানুষ যায় কোনো চিকিৎসকের সহকারী, প্যারামেডিক বা ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতার কাছে। তাঁরাও কিন্তু অংশীদার, অনানুষ্ঠানিক পেশাদার। আবার যাঁরা আনুষ্ঠানিক পেশাদার আছেন, তাঁরাও অনেক সময় কর্মসূচি সম্পর্কে জানেন না।

ইউএসএআইডি এর প্রকল্পের মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক সেবাদাতাদের সঙ্গে সংযোগ করার চেষ্টা করেছে। এ ছাড়া আইসিডিডিআরবির টিবি স্ক্রিনিং সেন্টার আছে, যেখানে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সেবাদাতাদের সংযোগ করা হচ্ছে। আমাদের ৭১টি বেসরকারি হাসপাতাল জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত আছে। আরও অনেক ডট সেন্টারও যুক্ত হয়েছে৷ কিন্তু সংখ্যাটা আরও বেশি হওয়া প্রয়োজন ছিল। আমাদের আরও বৃহত্তর পরিসরে কাজ করতে হবে। ইউএসএআইডির অধীনে আমরা ইউএস ফার্মাকোপিয়ার মাধ্যমে এ সহায়তা দিয়েছি। এ জন্য পোস্ট মার্কেটিং সার্ভিলেন্সের বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি একত্রিতভাবে কাজ করার অভিমত প্রকাশ করেছে।

করপোরেট সেক্টর অনেক কিছু করতে পারে। টিবি রোগীদের নিউট্রিশন গ্যাপ থাকে, রেফারেন্স সিস্টেমে গ্যাপ আছে। এ বিষয়ে সংস্থাগুলো কাজ করতে পারে৷ অনেকে শহরে চলে আসেন যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা করাতে। অথচ তিনি জানেন না তাঁর উপজেলায় এর চিকিৎসা হচ্ছে। সেখানে জিন এক্সপার্ট মেশিন চলে গেছে, সে তথ্যটা তাঁর কাছে নেই। এই জ্ঞানগুলো ছড়িয়ে দিতে ও স্ক্রিনিংয়েও সহযোগিতা করা যেতে পারে। এ ছাড়া করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্স টিমকে এখানে যুক্ত করা যেতে পারে।

আমাদের কিন্তু ইলেকট্রনিক রেকর্ডিং ব্যবস্থা আছে। যে রোগী চিকিৎসা নেওয়া শুরু করবেন, সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর রেকর্ড হওয়া শুরু করবে। এখন ই-টিবি ম্যানেজার নামে একটা সিস্টেমের মাধ্যমে এ কাজ হয়, সেখানে তথ্য আছে। ‘জানাও’–এর সঙ্গে ই-টিবির লিংক আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা ‘জানাও’কে তেমন জনপ্রিয় করতে পারিনি। আমরা জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে এখানে লিংক করার চেষ্টা করেছি। রোগীকে অপরাধী হিসেবে দেখা যাবে না। তাকে তথ্য দিতে হবে। অজ্ঞানতা থেকে ভয় আসে, জ্ঞান থেকে সাহস আসে। যক্ষ্মা হয়েছে, ওষুধ খেলে ভালো হবে—এ তথ্য তাকে দিতে হবে।

সৈয়দ আব্দুল হামিদ

অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এ যুগেও যক্ষ্মার মতো একটা প্রতিরোধযোগ্য রোগ আমাদের জন্য বড় একটি বোঝা। আমি রোগের অর্থনৈতিক বোঝার প্রতি আলোকপাত করতে চাই। ২০১৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বাংলাদেশি গবেষক তাঁর পিএইচডি গবেষণায় দেখিয়েছেন, ওষুধসংবেদী (ডিএস) টিবি চিকিৎসার খরচ ২৭৫ ডলার। এতে রোগী ও সেবা প্রদানকারী উভয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচ অন্তর্ভুক্ত। আর মাল্টিড্রাগ প্রতিরোধী যক্ষ্মার খরচ অনেক বেশি—২ হাজার ৪৪৩ ডলার।

আমরা জানি, যক্ষ্মা একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। তাই একে প্রতিরোধ করতে পারলে খরচ অনেক কমবে। একে ডিএস টিবি অবস্থায় নিয়ন্ত্রণে আনা গেলে খরচ বেশ কম। কিন্তু যদি এটি মাল্টিড্রাগ প্রতিরোধী যক্ষ্মা হয়, তাহলে এর খরচ অনেক বেশি। যদিও এর প্রাদুর্ভাব অনেক কম। এ খরচ নাগালের বাইরে চলে যায়। আমার মনে হয়, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি, যক্ষ্মা রোগের চ্যালেঞ্জ কিন্তু সরকার একাই গ্রহণ করছে। সরকার কিছু এনজিওর সহয়তায় এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

জ্বর-কাশি নিয়ে গেলে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এর সঙ্গে টিবি পরীক্ষা করা গেলে শুরুতেই অনেক কাজ এগিয়ে যাবে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই এখনো বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যায়। সেখানে যক্ষ্মা শনাক্ত হলে ডট সেন্টারে রোগীকে পাঠানো হবে এবং তার চিকিৎসা সেখানেই হবে। অর্থাৎ শনাক্ত বেসরকারি হাসপাতালে হলেও চিকিৎসা সরকারের ডট সেন্টারই দিল। এ রকম করা যায় কি না, ভাবা যেতে পারে।

মো. আকরামুল ইসলাম

জ্যেষ্ঠ পরিচালক, ব্র্যাক

যক্ষ্মা রোগ নিয়ন্ত্রণের সেবা মানুষের কাছে কতটা পৌঁছানো যায়, এ বিষয়ে ১৯৮৪ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ব্র্যাক একটি গবেষণাকর্ম পরিচালনা করে। এরপর জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমরা এই প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চারের চেষ্টা করি। তখন পর্যন্ত জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা হতো। প্রান্তিক মানুষের পক্ষে সেখানে এসে চিকিৎসা নেওয়া সে সময়ে সম্ভব ছিল না।

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির নেতৃত্বে ৫০টি জেলায় আমরা এই মডেলে কাজ করছি। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয় রোগীর ঘর থেকে, পরীক্ষা–নিরীক্ষা হয় ল্যাবরেটরিতে এবং চিকিৎসা বা ওষুধ পৌঁছানো হয় স্বেচ্ছাসেবীদের তত্ত্বাবধানে। এর মাধ্যমে পুরোপুরি চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়।

আগে মানুষ পুরোপুরিভাবে চিকিৎসা শেষ করত না। এখন সেটি কমে এসেছে। ফলে পার্শ্ববর্তী যেকোনো দেশের তুলনায় আমাদের যক্ষ্মারোগী কমে এসেছে। তবে আরও অনেক কিছুই করার আছে।

এখন পর্যন্ত যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বড় দুটি বিদেশি দাতা সংস্থা তহবিল দিয়ে থাকে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারও সহায়তা করে। আজকে থেকে পাঁচ-ছয় বছর পর যখন দাতা সংস্থাগুলো তহবিল দেওয়া বন্ধ করে দেবে, তখন চার থেকে পাঁচ লাখ রোগীর চিকিৎসা কীভাবে চলবে? এই জায়গায় কাজ করতে হবে। আমি আশাবাদী, একদিন বাংলাদেশ থেকে যক্ষ্মা পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হবে।

মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম

ভাইস প্রেসিডেন্ট, নগদ লিমিটেড

‘নগদ’ একটি দেশীয় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান। সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রেক্ষাপটে আমরা দেশের নানান কাজে লাগার চেষ্টা করি। তবে যেহেতু তথ্যপ্রযুক্তি নিয়েই আমাদের কাজ, ফলে চেষ্টা করি প্রযুক্তি আধুনিকায়নসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়কে প্রাধান্য দিতে। আমাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাও (এসডিজি) রয়েছে। সিএসআর প্রেক্ষাপটে নগদ জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কয়েকটি কাজ করছে। এর মধ্যে মানসিক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে প্রযুক্তিগত জায়গা থেকে সহায়তার বিষয়টি রয়েছে। এর আগে যক্ষ্মা নিয়ে কোনো কাজে আমরা যুক্ত হইনি। তবে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই সুযোগ পেলে কাজ করব।

গ্রাহক সংখ্যার বিবেচনায় ৯ কোটি গ্রাহক নিয়ে ‘নগদ’ এখন দেশের সবচেয়ে বড় সেবানির্ভর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। আমাদের সেবা প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান অনুদান সংগ্রহ করে। আমরা চেষ্টা করি এসব প্রতিষ্ঠানকে বিনা মূল্যে সহায়তা করার। যক্ষ্মা প্রতিরোধে তহবিল গড়তে কোনো সংগঠন চাইলে আমাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারে। একইভাবে একসঙ্গে ৯ কোটি মানুষকে যক্ষ্মা বিষয়ে সচেতন করে তোলার সুযোগও নেওয়া যাতে পারে। আইসিডিডিআরবি ও অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান যক্ষ্মা নিয়ে কাজ করে থাকে, তারাও নগদের সাপোর্ট নিয়ে কাজ করতে পারে। যেকোনো ভালো কাজে নগদ সঙ্গী হতে আগ্রহী।

স্বর্ণলতা রায়

সভাপতি, সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি

চাকরিজীবী বা শ্রমজীবীদের অনেকেই গণপরিবহন ব্যবহার করেন। পাশের লোকটি যক্ষ্মায় আক্রান্ত কি না, সেটি কিন্তু কেউ জানতে পারে না। সে ক্ষেত্রে ঝুঁকি তো থেকেই যায়। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে, সবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করতে আপনারা আরও ব্যবস্থা

গ্রহণ করবেন। নিয়মিতভাবে এটি করা প্রয়োজন। আমাদের পাশের দেশে স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রমাণপত্র জমা না দিলে চাকরিতে ইনক্রিমেন্ট বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং আমরাও চাইলে এটি করতে পারি।

আমরা যারা প্রতিষেধক নিয়ে রোগ নিরাময়ে অভ্যস্ত হচ্ছি, আমাদের জানতে হবে যক্ষ্মা রোগের প্রতিষেধক নেওয়ার পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে কি না, থাকলে তা কী ধরনের?

জনসচেতনতাই যক্ষ্মা প্রতিরোধের মূল উপায়। উইমেন চেম্বারে আমরা সবাই নারী। তাই মাতৃত্বের বিষয়টি আমাদের সঙ্গে সংযুক্ত। সিলেট উইমেন চেম্বারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে গোলটেবিল আয়োজন করার ইচ্ছা আছে।  এ ক্ষেত্রে আইসিডিডিআরবি ও এ ধরনের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর পরামর্শ আমরা গ্রহণ করব।

মো. মুহসিন

পরিচালক, মার্কেটিং অপারেশন, এসিআই লিমিটেড

যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে একধরনের ড্রাগ থেরাপি আছে। এটিকে বলা হয় ‘ফোর-ড্রাগ’ পদ্ধতি। এসিআই বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এটি তৈরি করেছে। এর আগে এটির জন্য আমাদের বিদেশি ওষুধের ওপর নির্ভর করতে হতো। আমাদের এই ওষুধ মানুষের মধ্যে ট্রায়াল দেওয়া হয়েছে। জর্ডানের একটি প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠানেও এটি নিয়ে কাজ করা হয়েছে। এরপর বাজারজাত করা হয়েছে।

যক্ষ্মার ওষুধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ আমরা শুনি। এগুলো ভৌগোলিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। অর্থাৎ কার্যক্ষমতার ক্ষেত্রে পার্থক্য গড়ে দেয়। তাই মানুষের শরীরে ট্রায়াল দিতে হয়।

ইতিমধ্যে একটি বড় এনজিও আমাদের কাছ থেকে এই বিষয়ে সহায়তা নিয়েছে। আমরা এ ধরনের কাজ করতে সক্ষম। শুধু এসিআই নয়, বাংলাদেশের আরও ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি এ ক্ষেত্রে সক্ষম। গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান থাকবে, আপনারা আমাদের এই সক্ষমতা নিয়ে কাজ করুন। এতে বিশ্বব্যাপী আমাদের পণ্য সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরি হবে।

ডা. এস এম মোস্তফা জামান

অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ

১৮৮২ সালে যক্ষ্মার জীবাণু আবিষ্কারের ১৪২ বছর পর আমরা আলোচনা করছি। ৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অনেক দিন ধরেই যক্ষ্মা নিয়ে আমাদের দেশে কাজ চলছে। সরকার বিনা পয়সায় ওষুধ বিতরণ করছে। প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সুপ্ত যক্ষ্মা এখনো বড় সমস্যা। কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের দেশের যক্ষ্মার চিকিৎসা কার্যক্রমে অনেক সাফল্য আছে। আমাদের চিকিৎসা কার্যক্রম আরও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের সীমিত সম্পদের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।

মানুষকে সামাজিকভাবে সচেতন করতে হবে। যক্ষ্মা নিয়ে দিবসভিত্তিক আয়োজনের বদলে নিয়মিত সমন্বয় করে আলাপ চালিয়ে যেতে হবে। মানুষ যেখানে–সেখানে কফ ফেলছে। হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার প্রয়োজন। যক্ষ্মা সন্দেহে অনেক প্রবাসী শ্রমিক ফিরে আসছে। বড় একটি সমস্যা হচ্ছে এমডিআর যক্ষ্মা। ওষুধ না খাওয়ার কারণেই এ সংকট বেড়ে যাচ্ছে। রোগীরা অনেকেই জানেন না রোগ শনাক্তের জন্য কোথায় যেতে হবে। এক্সট্রা পালমোনারি টিবিও বাংলাদেশে অনেক বড় সমস্যা। মানুষের সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া যক্ষ্মা প্রতিরোধ করা কঠিন।

ডা. শেখ আব্দুল ফাত্তাহ্‌

মেডিসিন বিভাগের প্রধান, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ বেসরকারি খাত থেকে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে। ফলে বেসরকারি খাত থেকে যক্ষ্মাসংক্রান্ত সেবা আমরা কতটা দক্ষতার সঙ্গে দিতে পারছি, তার সঙ্গে এ কার্যক্রমের সাফল্য অনেকখানি নির্ভরশীল। ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশে সরকারিভাবে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি অব্যাহত আছে। পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে কিছু এনজিও যোগ দেওয়ায় সরকারি এ কাজ আরও জোরদার হয়েছে। কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট মাত্রায় সফলতা অর্জনের পর আর অগ্রগতি হচ্ছে না বা খুব ধীরগতিতে অগ্রগতি হচ্ছে।

বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারি কার্যক্রমের সঙ্গে কিছুটা অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়। কোথাও এটি ওভার ডায়াগনসিস হয়, কোথাও আন্ডার ডায়াগনসিস হয়। আর আন্ডার রিপোর্টিং তো আছেই। বেসরকারি খাতের যক্ষ্মা চিকিৎসার দিকে আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে। বেসরকারি খাতে চিকিৎসকেরা চেম্বারে ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখেন, ক্লিনিক আছে, হাসপাতাল আছে। এ ছাড়া বেশ কিছু এনজিও আছে, যারা এ কাজগুলো করে থাকে। যক্ষ্মার শনাক্তকরণ ও চিকিৎসায় অনেক উন্নত প্রযুক্তি এসেছে, যা বেসরকারি পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবায় অপ্রতুল। এ খাতের চিকিৎসকদের নতুন নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে অবহিত ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন

সমন্বয়ক, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, বিজিএমইএ

বিজিএমইএ ১৯৯৪ সাল থেকে পোশাকশ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে। বিজিএমইএ মালিবাগে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করলে আমি তখন থেকেই সেটির সঙ্গে যুক্ত আছি। ২০১০ সাল থেকে যক্ষ্মার জাতীয় গাইডলাইন অনুসরণ করে ডটস পদ্ধতি অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যেসব এলাকায় পোশাক কারখানার সংখ্যা বেশি, সেসব স্থানে আমরা ১০টি ডট সেন্টার স্থাপন করেছি। এ ক্ষেত্রে ব্র্যাক আমাদের সহযোগিতা করছে। পাশাপাশি জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিও আমাদের সহায়তা করছে।

পোশাক খাতে যক্ষ্মার প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ, এখানে ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিক আছেন, তাঁদের পরিবারে আরও অনেক সদস্য আছেন। যেসব এলাকায় পোশাক কারখানা বেশি, সেখানে বিজিএমইএর যক্ষ্মা নির্ণয় ও চিকিৎসাকেন্দ্র করার পরিকল্পনা রয়েছে।

রুবিনা খান

হেড অব এইচআর, বেক্সিমকো পেট্রো

আইসিডিডিআরবি বা ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যক্ষ্মা নির্মূলে কাজ করছে। তাদের ধন্যবাদ। এত বছর ধরে যক্ষ্মা দূর করতে কাজ করা হচ্ছে, কিন্তু এখনো যক্ষ্মা নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। তার মানে প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো সমস্যা রয়েছে কি? আমি ভাবতাম, বাংলাদেশে খুব অল্পসংখ্যক যক্ষ্মারোগী রয়েছে। কিন্তু এখন দেখছি এ সংখ্যা অনেক।

কোভিড–পরবর্তী সময়ে বেক্সিমকো থেকে সচেতনতা অবলম্বন করা হয়েছে। সবাইকে কোভিড টিকা নিতে আমরা বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করেছি। তাতে সফল হওয়া গেছে। তেমনি যক্ষ্মা পরীক্ষার ক্ষেত্রেও উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ গড়া কঠিন কিছু নয়।

মাহমুদুল হাসান খান

জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক, এসএমসি

এসএমসি ২০১০ সাল থেকে অনানুষ্ঠানিক উপায়ে যক্ষ্মা নিয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া ২০২১ সাল থেকে আইসিডিডিআরবির এসিটিবি কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হয়েও কাজ শুরু করেছে।

গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক নন, এমন কিছু ব্যক্তি এসএমসির সঙ্গে যুক্ত আছেন। তাঁদের আমরা প্রশিক্ষণ প্রদান করি। বিশেষত সম্ভাব্য যক্ষ্মারোগীদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত জায়গায় পরীক্ষা করতে পরামর্শ

দেওয়ার বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এভাবে আমরা তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। এভাবে অনেক নতুন রোগীর সন্ধান মেলে। আমি মনে করি, যক্ষ্মা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এসএমসির মতো এই ধরনের কাজ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এতে করে অনেক কাজ সহজ হয়ে যাবে।

জয়ীতা তালুকদার

সংগীতশিল্পী ও আইসিসিআর স্কলার

যে কথাটি আমরা জানলাম, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি যক্ষ্মা আক্রান্ত ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, যা খুবই উদ্বেগজনক! সত্যি কথা বলতে কি, হাঁচি–কাশির শিষ্টাচার মানার অভ্যাসটা সবার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তাই সংক্রামক রোগ হিসেবে  যক্ষ্মা বেশি মাত্রায় ছড়াচ্ছে।

গত দেড়-দুই মাসে হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত হয়নি, এমন কেউ বোধ হয় আমাদের মধ্যে নেই। শিক্ষক ও শিল্পী হিসেবে মানুষের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বেশি হয়। সবাই হয়তো চিকিৎসকের কাছে যানও না। আবার অনেকেই বলে থাকেন, চিকিৎসক তাঁর কথা ঠিকমতো শোনেননি। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের প্রতি রোগীর আস্থা বাড়ানো দরকার। আমি মনে করি, সবার মধ্যে যক্ষ্মা সচেতনতা বাড়াতে সামাজিক মাধ্যম ও বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার চালাতে হবে।

জেসিয়া ইসলাম

মিস বাংলাদেশ ২০১৭

যক্ষ্মা ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের তরুণদের সচেতন হতে হবে। এখন তরুণেরা নানা ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ইন্টারনেটে তরুণদের যক্ষ্মা সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি করতে হবে।

অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও অসচেতনতার কারণে যক্ষ্মার ক্ষতিকর প্রভাব বাড়ছে। আর এখনকার শিশুদেরও যক্ষ্মায় আক্রান্তের ঘটনা বাড়ছে। এ জন্য শিক্ষক ও মা-বাবার সচেতনতা বেশি প্রয়োজন। স্কুল-কলেজে আরও বেশি সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর যাঁরা সেলিব্রিটি আছেন, তাঁরাও যক্ষ্মা নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে পারেন। যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তাদের কাজগুলো আরও বেশি করে প্রচার করা উচিত।

বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস উপলক্ষে স্টপ টিবি পার্টনারশিপের সহযোগিতায় আইসিডিডিআরবি ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস: যক্ষ্মা ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে বেসরকারি অংশীদারত্ব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা
ছবি: প্রথম আলো

আরও অংশগ্রহণকারী:

ডা. আজহারুল ইসলাম

পরামর্শক, এসিটিবি, আইসিডিডিআরবি

ডা. শাহরিয়ার আহমেদ

সহকারী বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআরবি

অঞ্জন সাহা

সিনিয়র এম‌ইএল অ্যাডভাইজার, এসিটিবি, আইসিডিডিআরবি

নাদিম রেজা

টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার, পিপিএম, আইসিডিডিআরবি

ডা. শারমিন আহমেদ

চিকিৎসক

শাহরিয়ার হাসান জিসান

ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট, এটুআই, আইসিটি ডিভিশন

রুবিনা হক

জনস্বাস্থ্য গবেষক

ফওজিয়া জাহান

স্থপতি

নিশাত আনজুম

আইনজীবী

সৈয়দ গিয়াস উদ্দীন

শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

শিশির মোড়ল

বিশেষ প্রতিনিধি, প্রথম আলো

সুপারিশ

  • যক্ষ্মার গবেষণা ও চিকিৎসার জন্য অর্থায়ন বাড়ানো প্রয়োজন।

  • সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে করপোরেট ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

  • সিএসআর কার্যক্রমে যক্ষ্মা ও জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।

  • যক্ষ্মা নির্মূলে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ও স্টেকহোল্ডারদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।

  • সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমের ভূমিকা বাড়ানোর বিকল্প নেই।

  • তরুণদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রযুক্তিনির্ভর সমাধানে মনোযোগ দিতে হবে।