কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তা উন্নয়নে করণীয়

উন্নয়ন সংস্থা আনন্দ, ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তা উন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়েছবি: দীপু মালাকার

অংশগ্রহণকারী

মো. রওশন আলম

অতিরিক্ত পরিচালক (উপকরণ), সরেজমিন উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

ডা. এবিএম খালেদুজ্জামান

পরিচালক (উৎপাদন), প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর

 

মনিরুজ্জামান মিয়া

নির্বাহী পরিচালক, আনন্দ

 

অধ্যাপক ড. সেকেন্দার আলী

সাবেক উপ–উপাচার্য, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সাইফুদ্দীন আহমেদ

সহযোগী অধ্যাপক, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ;

প্রক্টর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

তানভির সুলতানা

উপ মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন্স),

পিকেএসএফ

মহসিন আলী

নির্বাহী পরিচালক, ওয়েভ ফাউন্ডেশন

পঙ্কজ কুমার

কান্ট্রি ডিরেক্টর, ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে

 

হাসিনা রহমান

কান্ট্রি ডিরেক্টর, আইআরসি

আশীষ দামলে

কান্ট্রি ডিরেক্টর, অক্সফ্যাম

আনোয়ার হোসেন মোল্লা

হেড অফ প্রোগ্রামস, আনন্দ

সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

মো. রওশন আলম

অতিরিক্ত পরিচালক (উপকরণ), সরেজমিন উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

কক্সবাজার জেলায় মূলত গম, ভুট্টা, গোল আলু, মিষ্টি আলু, শীতকালীন শাকসবজি, ফেলন ডাল, চিনাবাদাম, শর্ষে, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ ও ধনিয়া চাষ হয়। কক্সবাজারে ধান মূলত রোপা আমন ও বোরো এ দুটি মৌসুমে হয়ে থাকে। এখানে জীবিকা কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। চকরিয়া, মহেশখালী, টেকনাফ, পাকুরিয়া, রামুতে শীতকালে লবণ চাষ করা হয়। যে জমিতে লবণ চাষ হয়, পরে সে জমিতে তারা রোপা আমন করে থাকে। শীতকালে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় লবণাক্ততা বেশি থাকে।

সমুদ্রের কাছে হওয়ার কারণে কক্সবাজারে তীব্র শৈত্যপ্রবাহও হয় না, আবার তীব্র তাপপ্রবাহও হয় না। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সহায়তায় কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও রামুতে ২৫টি সবজি, ফসল সংগ্রহ কেন্দ্র আছে৷ প্রতিটি উপজেলায় এ ধরনের সংগ্রহ কেন্দ্র থাকলে বাজারের সমস্যা থাকবে না।

মহেশখালী ও রামুতে ভালো পান চাষ হয়। এ পান বিদেশে রপ্তানি হয়। আমাদের হর্টেক্স ফাউন্ডেশন আছে, যার মাধ্যমে বিদেশে পণ্য রপ্তানির সুযোগ করে দেওয়া হয়। কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের সেতুগুলোয় স্লুইসগেট নেই। ফলে সাইক্লোনের সময় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে এবং কৃষকের ফসল মারা যায়। কক্সবাজারের প্রকৃত উন্নয়ন করতে হলে সরকারি, বেসরকারি ও উন্নয়ন সহযোগীদের সমন্বিতভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিএডিসিকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। খুলনায় আমাদের একটা প্রকল্প আছে। সেখানে লবণাক্ততাপ্রবণ এলাকায় ভালো তরমুজ চাষ হচ্ছে। এখন আমরা কিন্তু সারা বছর তরমুজ খেতে পারছি। কক্সবাজারে বাণিজ্যিকভাবে তরমুজ চাষ করা যেতে পারে। এখানে মাশরুম চাষেরও ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। এতে বেশি জায়গা লাগে না, ছায়াতেও ভালো জন্মায়। একজন কৃষক মাচা করে সহজেই মাশরুম চাষ করতে পারেন। আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে বাজার ব্যবস্থাপনা। চাষিদের সুপারশপের সঙ্গে সংযোগ করে দিলে তাঁরা লাভবান হবেন।

ডা. এবিএম খালেদুজ্জামান

পরিচালক (উৎপাদন), প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর

আমরা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে নিরাপদ আমিষের প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রান্তিক খামারিদের জন্য কাজ করছি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেন টেকসইভাবে প্রাণিসম্পদ উৎপাদনের মাধ্যমে উপার্জনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে, সে জন্য আমরা সব ধরনের কারিগরি সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছি। কক্সবাজারে গবাদিপশুর সংখ্যা ছয় লাখের বেশি, ৪৫ লাখের বেশি মুরগি আছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আসার পর এর চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে৷ সেখানে এখন দুধের চাহিদা ১ লাখ ৮৪ হাজার মেট্রিক টন। আর আমরা ১ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টনের জোগান দিতে পারছি। ফলে কিছু ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। অথচ ১০ বছর আগেও এখানে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মাংস, দুধ ও ডিম উদ্বৃত্ত থাকত। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আসার পর এখন তা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আমাদের মূল কার্যক্রম কারিগরি সহায়তা, প্রাণিস্বাস্থ্যের প্রশিক্ষণ দেওয়া। এ ছাড়া এখন আমরা বিপণন অধিদপ্তরের সঙ্গে ডিমের মূল্য নিয়ে একত্রে কাজ করছি। আবার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দ্রব্যমূল্য জনগণের সহনীয় পর্যায়ে রাখার কাজেও আমরা যুক্ত আছি। আমরা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে চর ও পতিত জমিতে খামারিদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রাণিখাদ্য চাষের ব্যবস্থা করতে চাই। কারণ, খাদ্য খরচ একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এটি কমানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে গোখাদ্য চাষ করা। পতিত জমি বা নতুন করে জেগে ওঠা চরে নেপিয়ার ঘাসের চাষ ভালো হয়। এই জায়গায় ভূমি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা গেলে গোখাদ্যের সমস্যার সমাধান সম্ভব। আবার নেপিয়ার ঘাস কিন্তু ভূমির ক্ষয়রোধ প্রতিরোধ করে। এখন তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। সে জন্য এখন উচ্চ তাপমাত্রায় বৃদ্ধি পায় ও রোগপ্রতিরোধী গরুর জাত নিয়েও চিন্তাভাবনা করছি।

মনিরুজ্জামান মিয়া

নির্বাহী পরিচালক, আনন্দ

করোনা মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়া ও রামু উপজেলা কাছাকাছি হওয়ায় এখানে অনিবন্ধিত অনেক রোহিঙ্গা বসবাস করে। রোহিঙ্গাদের সস্তা শ্রমে নিয়োগ করার কারণে শ্রমবাজারে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য বিনা মূল্যে খাদ্য বিতরণ করলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ তখন চোখে পড়েনি। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত রামুতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চাহিদা বিবেচনায় একটি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

এমতাবস্থায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আনন্দ সেখানে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য করোনা পরবর্তীকালে কৃষি ও অকৃষিভিত্তিক জীবিকা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে  তিন বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প শুরু করে। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে শুরু হওয়া এ প্রকল্প ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ হতে যাচ্ছে। প্রকল্পটিতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে জার্মানিভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়েল্টহাঙ্গারহিলফে (ডব্লিউএইচএইচ) এবং জার্মান ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ইকোনমিক কো–অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিএমজেড)। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল—রামু উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়ি ও খুনিয়াপালং ইউনিয়নের ১ হাজার ২০০ পরিবারের জন্য কৃষি ও অকৃষি উপকরণ বিতরণ ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে পারিবারিক আয় বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি পারিবারিক সবজি বাগান ও হাঁস-মুরগি-গবাদিপশু পালনের মাধ্যমে জীবিকা সুসংহত করা এবং করোনা মহামারিসৃষ্ট জীবিকা ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা।

প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিবারগুলোর ৫৯ শতাংশ আয় বৃদ্ধি, পাঁচ বছর মেয়াদি পারিবারিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের হার ৮৫ শতাংশ, ৯৪ শতাংশ পরিবারের পারিবারিক সবজি বাগান করা। সবজি বাগান, গবাদিপশু পালন ও উন্নত চাষাবাদের পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে পারিবারিক আয়ের উৎসে বৈচিত্র৵ আসে এবং জীবিকা অর্জনে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির মাধ্যমে আয় সুসংহত হয়। স্থানীয় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যবসার জন্য পুঁজি সংগ্রহ করার হার বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবারগুলোর আয় ও জীবিকা টেকসই হয়।

বাস্তবায়িত প্রকল্পটি লক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোভিড-১৯ সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে পেরেছে সত্য। তার পরও প্রকল্প এলাকা রামুতে অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার, নিরক্ষরতা ও বেকারত্বের হার এখনো বেশি। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহারের হার অত্যন্ত কম। তাছাড়া নিয়মিত অতি ভারী বৃষ্টি, হঠাৎ বন্যা, পাহাড় ধস, ঘুর্ণিঝড় ইত্যাদি ঘরবাড়ি, সবজির বাগান, কৃষিক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত করে। শুকনা মৌসুমে সেচের পানির অভাব অত্যন্ত প্রকট। উন্নত বীজ, চারা ও বালাই-ব্যবস্থাপনার জন্য প্রান্তিক কৃষকদের দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা ও ভর্তুকি প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ভ্যালু চেইন ও মার্কেটিংয়ের অভাবে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে শ্রমবাজারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের কারণে সস্তা শ্রমিক সহজলভ্য হওয়ায় স্থানীয় শ্রমিকদের আয় কমে যাচ্ছে। একদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ফ্রি খাদ্য বিতরণ অন্যদিকে দিন দিন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে হতাশা পরিলক্ষিত হয়। তাই এসব সমস্যা মোকাবিলায় সরকার, দাতা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থাগুলোকে তাদের সহায়তা অব্যাহত রাখা অত্যন্ত জরুরি।

অধ্যাপক ড. সেকেন্দার আলী

সাবেক উপ–উপাচার্য, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

কক্সবাজারের রামু উপজেলার দুটি ইউনিয়ন—খুনিয়াপালং ও দক্ষিণ মিঠাছড়িতে ‘আনন্দ’র প্রকল্প কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। প্রকল্পটি ১ হাজার ২০০ পরিবারের (মোট ৬ হাজার ৬৮৪ জন সদস্য) জীবিকা উন্নয়নে কাজ করেছে। কার্যক্রমের প্রধান ক্ষেত্রগুলো ছিল কৃষি কার্যক্রম ও প্রশিক্ষণ, কৃষিবহির্ভূত প্রশিক্ষণ, নারীর ক্ষমতায়ন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রশমন। সর্বশেষ মূল্যায়নটি প্রকল্পের লক্ষ্য ও ফলাফল নির্ধারণের জন্য পরিচালিত হয়, যা মাঠপর্যায়ে পরিচালিত হয়।

মূল্যায়নের জন্য গুণগত ও পরিমাণগত উভয় পদ্ধতির মাধ্যমে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নমুনার আকার দাঁড়িয়েছে ৩৩০ জনে। পাশাপাশি ৮টি ফোকাস দল আলোচনা, ১৯টি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সাক্ষাৎকার, ৫টি নিবিড় গবেষণা ও ৩টি কেস স্টাডি পরিচালনা করা হয়।

মূল্যায়নে প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, প্রকল্পের শুরুতে প্রতি পরিবারের গড় মাসিক আয় ছিল ১০ হাজার ৫৩৬ টাকা, যা প্রকল্প শেষে বেড়ে ১৬ হাজার ৮২৮ টাকায় উন্নীত হয়। অর্থাৎ তাদের গড় মাসিক আয় ৫৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে তিন বছরের মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করলে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশ, যা প্রকল্পের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১১ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। প্রকল্পের বিভিন্ন সূচক অনুযায়ী, ১৮৩টি পরিবার তাদের টেকসই জীবিকা পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার (১৮০) তুলনায় ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। ৯৮ শতাংশ ক্ষুদ্র কৃষক উন্নত কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার (৭০ শতাংশ) তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি।

নারীদের সারা বছর সবজি ও ফল উৎপাদন করার ক্ষেত্রে ১ হাজার ১২৮ জন অংশগ্রহণ করেছেন, যা লক্ষ্যমাত্রার (১ হাজার ২০০) তুলনায় সামান্য কম। প্রকল্পের শুরুতে এ সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। ৮৪ শতাংশ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অংশগ্রহণকারী তাঁদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করেছে, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার (৮০ শতাংশ) তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ বেশি। নারীর ক্ষমতায়নে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। প্রজননক্ষম নারীদের (১৫ থেকে ৪৯ বছর) ৮২ শতাংশ প্রতিদিন ৫ বা তার বেশি খাদ্য গ্রুপ গ্রহণ করেছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি বৃদ্ধি নিশ্চিত করেছে।

অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে ৬৩ শতাংশ পরিবারের আর্থিক সেবা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া ৯৯ শতাংশ উপকারভোগী তাঁদের অধিকার এবং প্রাপ্যতা সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন, যা লক্ষ্যমাত্রার (৭০ শতাংশ) তুলনায় ৪১ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা হালনাগাদ করা হয়েছে এবং ৭১ শতাংশ উপকারভোগী এই পরিকল্পনা সম্পর্কে জানেন।

এ প্রকল্পটি উপকারভোগীদের জীবিকা উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে রয়েছে টেকসই আয়ের উৎস, খাদ্যের বৈচিত্র্যতা, উন্নত কৃষিজ্ঞান, নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থিক সেবার সুযোগ বৃদ্ধি এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি। নারীদের সারা বছর সবজি ও ফল উৎপাদনে অংশগ্রহণ তাঁদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষমতায়নকে আরও জোরদার করেছে।

এ প্রকল্প থেকে আমরা ভালো কিছু চর্চা সম্পর্কে জেনেছি। যেমন ক্ষুদ্র কৃষকদের উন্নত কৃষিপ্রযুক্তি গ্রহণ এবং টেকসই উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের নেতৃত্বে বাড়ির বাগানে সারা বছর সবজি ও  ফল উৎপাদনের বিষয়টিও কার্যকরী ভূমিকা রাখে। জীবিকা পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা তৈরি এবং বাস্তবায়ন করাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গ্রামের মডেল ফার্ম এবং স্থানীয় সেবা প্রদানকারী ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষিতথ্য প্রচারের বিষয়টিও বেশ কার্যকর।

এ প্রকল্পে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে ছিল সেচের অপ্রতুলতা এবং কৃষিপণ্যের ভ্যালু চেইন ও বাজারজাতকরণের অভাব। সুপারিশ হিসেবে আমরা আয়ের উৎস বৈচিত্র্যকরণ, ক্ষুদ্র ব্যবসার উন্নয়ন, সেচব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পানি ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছি। এ ছাড়া নারীদের আরও ক্ষমতায়নের জন্য প্রশিক্ষণ ও ব্যবসা-সহায়তা প্রদান এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর জন্য ঋণ, সঞ্চয় ও বীমার সুযোগ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ।

প্রকল্পটি পরিবেশবান্ধব, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক মালিকানাকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য কাজ করেছে।

সাইফুদ্দীন আহমেদ

সহযোগী অধ্যাপক, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ; প্রক্টর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যখন এসেছিল, সে সময় স্থানীয় জনগোষ্ঠী তাদের সাদরে আশ্রয় দিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর এ আনন্দে ছেদ পড়ে। কারণ, ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে তারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা বাজার হারাচ্ছে, শ্রমিকের বাজারদর কমে যাচ্ছে। সেখানে নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা হয়তো যে ছোট ঝুপড়ি ঘর পাঁচ শ টাকা ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করতেন, তা এখন উন্নয়ন সংস্থা পাঁচ হাজার টাকায় ভাড়া নিচ্ছেন। ফলে স্থানীয় ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য জায়গা পাচ্ছেন না।

আনন্দ বা আইআরসির মতো সংস্থাগুলো যখন কার্যক্রম গুটিয়ে নেবে, তখন কী হবে? আমরা জানি, কক্সবাজারের অনেক জায়গায় স্থানীয় জনসংখ্যার চেয়ে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেশি। ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীই এখন সেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এখানে বড় একটা বাজার তৈরি হয়েছে। সেখানে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অভিগম্যতায় তার কৃষিকাজ, মৎস্য চাষ, গবাদিপশু পালনের মতো কার্যক্রমগুলো তাকে কতটা সহায়তা করছে, তা দেখতে হবে। বাজারের বিস্তৃতির তুলনায় এসব কার্যক্রম কতটুকু কার্যকর হচ্ছে, তা বিবেচনায় নিতে হবে।

পাশাপাশি এ এলাকায় পরিবেশের বিপর্যয় বড় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অতিরিক্ত মানুষদের জায়গা দিতে গিয়ে সেখানে বন উজাড় করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক এনজিও ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বনায়নের কাজ করছে। কিন্তু তা হয়তো ২০ থেকে ৩০ বছর পর ফলপ্রসূ হবে। এর আগে গাছ কাটা রোধে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। বন উজাড়ের কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা আরও বাড়বে। এ জায়গায় আমাদের নজর দিতে হবে।

সুতরাং, কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান বিকাশে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার কোনো বিকল্প আপাতত নেই।

তানভির সুলতানা

উপ মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন্স), পিকেএসএফ

এফপিকেএসএফ সরাসরি মাঠপর্যায়ে কাজ করে না। আমরা সহযোগী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন করি। পিকেএসএফ শুরুতে ক্ষুদ্রঋণ–সংক্রান্ত কাজ করত, এখন আমরা বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকি। কক্সবাজারের অনেক এলাকা কিছু মৌসুমে অনাবাদি থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে সেচের ব্যবস্থা না থাকাকে যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়। এর বিকল্প ব্যবস্থার একটা পরীক্ষা পিকেএসএফ উপকূলীয় অঞ্চলে করেছে। বৃষ্টির সময় ছোট পুকুরভিত্তিক পানি সংরক্ষণ করে রাখলে তা কৃষিকাজে ব্যবহার করা সম্ভব। এটি রাখা হলে বোরো মৌসুমকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি সবজি চাষাবাদও হবে। আমরা যদি তামাককে উচ্চমূল্যের ফসল দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারি, তাহলে উপার্জন বাড়বে। উচ্চমূল্যের ফসলের মধ্যে কাজুবাদাম, স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফল চাষের ভালো সুযোগ আছে। এমনকি মসলাজাতীয় ফসলেরও অনেক সুযোগ আছে।কক্সবাজার একটা পর্যটন এলাকা। এখানে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি। আমাদের খাদ্যাভ্যাস অসামঞ্জস্যপূর্ণ, শর্করা যতটুকু খাওয়া দরকার, তার থেকে বেশি খাচ্ছি। আমিষজাতীয় খাবার আমরা খুবই কম খাই। এ শূন্যতা কিন্তু পশুসম্পদ দিয়ে পূরণ করা যেতে পারে। এ জন্য আমাদের প্রয়োজন নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন। পশুসম্পদ বা পোলট্রির ক্ষেত্রে যদি খাবারে জোর দেওয়া হয়, তা নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হয়। সেখানে পিকিং হাঁস সারা বছর পালন করা হয়, যা আগে কেবল শীতকালে হতো। হিলি চিকেন বেশ দামি এবং এর চাহিদাও ব্যাপক। এসব খাতে উৎসাহ সৃষ্টি করা গেলে তা জীবিকায়নের একটা ভালো উৎস হতে পারে। লবণাক্ত পানিতে কাঁকড়া, কোরাল ও ভেটকি মাছ চাষের সুযোগ আছে। এই টেকসই ধারণাগুলোর দিকে নজর দিলে আচরণগত পরিবর্তন আসবে এবং সব সময় প্রকল্প সহায়তার প্রয়োজন হবে না।

পঙ্কজ কুমার

কান্ট্রি ডিরেক্টর, ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে

আমরা দ্বন্দ্বের মূল কারণ নিয়ে আলোচনা করছি। কারণ, যখন মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় না, যখন তারা প্রাথমিক প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পায় না, তখন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এটি কোনো একক ঘটনা নয়; এটি বহু বছর ধরে চলে আসছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের অবদানও ঠিকমতো স্বীকৃতি পায়নি—তারা কীভাবে এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করেছে, কীভাবে সমাধান করেছে এবং নিরাপত্তা, শান্তি বা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হয়নি। তাই এ বিষয়টিকে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা খুবই জরুরি।

একই সঙ্গে আমি একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, এ প্রকল্পটি আমরা করোনা মহামারির সময় শুরু করেছিলাম। এটি মূলত করোনা মহামারির ক্ষতি পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে চালু করা হয়েছিল। কিন্তু এখন যখন আমি পেছনে তাকাই, দেখি এ প্রকল্পটি করোনার ক্ষতি পুনরুদ্ধারের চেয়েও অনেক বেশি কিছু অর্জন করেছে। কৃষিপদ্ধতির উন্নয়ন, আয়ের উৎস বৃদ্ধি, জেন্ডার সমতা উন্নয়নসহ অনেক বিষয়ে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

এ প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে আমরা এখন আরেকটি প্রকল্প তৈরি করছি, যেখানে আমরা এ ধরনের উদ্যোগগুলোকে আরও এগিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছি। আমরা অন্য জেলাগুলোর মানুষের সঙ্গেও কাজ করছি, যেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সরকারের সঙ্গে সংযুক্ত হলে স্থায়িত্ব আরও কার্যকর হয়। তখন আপনি সেই প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে যান এবং নিশ্চিত করেন যে এই কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।

মহসিন আলী

নির্বাহী পরিচালক, ওয়েভ ফাউন্ডেশন

করোনা মহামারির পর কক্সবাজারে আয় ও জনজীবনে আগের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। শ্রমবাজারে রোহিঙ্গাদের প্রবেশের ফলে স্থানীয় লোকজনের মজুরি কমে গেছে। সেখানে জলবায়ুগত পরিবর্তনের প্রভাবও দিন দিন বাড়ছে। আমরা কৃষি নিয়ে কাজ করি। ব্ল্যাকবেঙ্গল ছাগল বাংলাদেশে বিখ্যাত। এটির উৎপাদন অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছিল। পিকেএসএফের কাছ থেকে কৃষিক্ষেত্রে ভ্যালু চেইনের বিষয়টি আমরা শিখেছি। ফলে আমাদের পশুসম্পদ খাতে বড় ধরনের কাজ হয়েছে।

সারা বিশ্বে নতুন করে একটা প্রশ্ন উঠেছে যে শুধু কৃষি নিয়ে কাজ করার মাধ্যমে প্রতিটি পরিবারের চাহিদা মিটবে কি না। এখানে ভিন্ন আয়ের উপায় দেখা প্রয়োজন। খাদ্য মন্ত্রণালয় ২০২০ সালে তাদের একটা নীতিতে লিখেছিল, খাদ্য অধিকার মানবাধিকার। আগে অধিকারের জায়গায় ছিল চাহিদা। এই পরিবর্তনটুকু আমরা করতে পেরেছি।

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু:  জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তা। ব্যক্তির জীবিকা যদি ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে খাদ্য নিরাপত্তাও আপনা–আপনি সম্পন্ন হয়। কক্সবাজারের একটা বড়সংখ্যক মানুষের জীবিকা অসম্পূর্ণ। ফলে অন্যদিকে দৃষ্টি দেওয়ার কারণে খাদ্য নিরাপত্তা আরও ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই মিলে খাদ্য অধিকার নিয়ে আওয়াজ তুললে ইতিবাচক কিছু সম্ভব।

হাসিনা রহমান

কান্ট্রি ডিরেক্টর, আইআরসি

ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি (আইআরসি) ২০১৭ সাল থেকে কক্সবাজারে কাজ করছে। স্থানীয় লোকজনই সবার আগে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন, সাদরে গ্রহণ করেছেন। এখন সেই স্থানীয় জনগোষ্ঠী নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।

ক্যাম্পের বাইরে কক্সবাজারের রামু, টেকনাফ ও অন্যান্য উপজেলায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নারী ও তরুণদের নিয়ে আমরা কাজ করছি৷ সেখানে ২০ হাজার নারী ও তরুণকে দক্ষতা উন্নয়নের কাজে সংযুক্ত করা হয়েছে। গত তিন বছরে আইআরসি ছোট ছোট ব্যবসায় সহযোগিতা, গৃহস্থালিভিত্তিক উৎপাদনের কাজ, বাজার সংযোগের কাজ করেছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, তাঁদের স্থানীয় উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করা। আমরা নারী, তরুণ ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার মানুষদের নিয়ে কাজ করে থাকি।

স্থানীয় তরুণদের যে দক্ষতা ও সচেতনতা তৈরি হয়েছে, তা যেন পরবর্তী বছরগুলোতে অব্যাহত থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য তাঁদের সঞ্চয় বা ঋণের বিষয়গুলো নিয়ে আরও কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যেসব উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন এ বিষয়ে কাজ করে, তাদের মধ্যে সমন্বয় থাকলে এর পরিসর আরও বাড়বে।

আশীষ দামলে

কান্ট্রি ডিরেক্টর, অক্সফ্যাম

কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা দরকার। সাধারণত ভৌগোলিকভাবে যাঁরা সেখানকার বাসিন্দা, তাঁদের স্থানীয় হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু যাঁরা পর্যটক, স্থানীয় ব্যবসায়ী বা আশপাশের জেলা থেকে আসেন, তাঁদের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এটি খুবই জরুরি। কারণ, তাঁদের বাইরে রেখে খাদ্যের সংকট, জীবিকা ও কৃষির সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব নয়।

সময় এসেছে, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমস্যাগুলোকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, নতুন নীতিমালা বা উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের পরামর্শ ও প্রতিনিধিত্ব কতটুকু বিবেচনা করা হয়? তাঁদের কতটুকু ভূমিকা আছে ক্যাম্পে কর্মসংস্থান বা জীবিকার সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে? এই প্রতিনিধিত্বের অভাব দীর্ঘ মেয়াদে বৈরিতায় রূপ নিতে পারে।

পরিবর্তিত বাস্তবতায় অক্সফাম সংকটের ব্যয় নামে একটি উদ্যোগ নিচ্ছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক একাডেমিক মহল, জাতিসংঘের কিছু সংস্থা এবং অন্যান্য এনজিও ও স্থানীয় কিছু সংগঠনকে নিয়ে এই সংকটের ব্যয় নির্ধারণ করা হবে। আমরা আশাবাদী, এটি একটি শক্তিশালী ভিত্তি দেবে, যাতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে দায়িত্ব ভাগাভাগির আলোচনা করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে আলোচনা ও সমাধানের কেন্দ্রে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আনোয়ার হোসেন মোল্লা

হেড অফ প্রোগ্রামস, আনন্দ

আমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। এ প্রকল্পের মূল সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী ছিলেন নারীরা। তাঁদের ক্ষমতায়নের জন্যই আমরা নানান কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। সেখানে আমরা আঙিনা বা ছাদবাগানের মতো জলবায়ু সহনশীল কৃষির প্রবর্তন করেছি।

সেখানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলো কার্যকর ছিল না। আমরা কমিটিগুলো সক্রিয় করতে উদ্যোগ নিয়েছি। সেখানে কিশোরী ও নারীদের জন্য কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে সবাই অবসরকালীন চিত্তবিনোদন ও সামাজিক সংলাপ করতে পারে। আমাদের এ প্রকল্পের উদ্যোগকে টেকসই করতে আমরা সেখানে ২৪ জন প্রশিক্ষিত কৃষক তৈরি করেছি, প্রকল্প শেষেও যাঁরা সেখানে প্রান্তিক কৃষকদের উন্নত কৃষিপদ্ধতি শেখাবেন। তাঁদের জ্ঞান ও দক্ষতা উন্নয়নে আমরা কৃষি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়েছি। পাশাপাশি আমরা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ১০ সদস্যের স্থানীয় সেবা প্রদানকারী একটি দল গঠন করেছি। প্রকল্প শেষ হলেও তারা স্বল্পমূল্যে কমিউনিটির মানুষের গবাদিপশুর চিকিৎসা করবে। কমিউনিটিতে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি আমরা ২০০ জন নারীপ্রধান পরিবারকে ব্যবসাসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দিয়েছি। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নানাভাবে তাদের সহায়তাও করেছি।

সুপারিশ

*  কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা দরকার।

*  কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান বিকাশে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

* স্থানীয় তরুণদের যে দক্ষতা ও সচেতনতা তৈরি হয়েছে, তা যেন পরবর্তী বছরগুলোতে অব্যাহত থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

*  কক্সবাজারের স্থানীয় নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য প্রশিক্ষণ ও ব্যবসা-সহায়তা প্রদান এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর জন্য ঋণ, সঞ্চয় ও বিমার সুযোগ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ।

*   স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আয়ের উৎস বৈচিত্র্যকরণ, ক্ষুদ্র ব্যবসার উন্নয়ন, সেচব্যবস্থার উন্নয়ন ও পানি ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।