প্রতিটি শ্বাস বাঁচায় জীবন: নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সক্রিয় হোন
অংশগ্রহণকারী
প্যানেল আলোচক
ডা. নাজমুন নাহার
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা
সভাপতি, বিসিপিএস, নিউবর্ন টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং কমিটি, নিউবর্ন হেলথ
অধ্যাপক ডা. মো. আবিদ হোসেন মোল্লা
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, মা ও শিশু হাসপাতাল, বারডেম
ডা. মো. জহুরুল ইসলাম
প্রকল্প ব্যবস্থাপক, জাতীয় নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
ডা. সাবিনা আশরাফী
উপ প্রকল্প ব্যবস্থাপক, জাতীয় নবজাতক ও আইএমসিআই, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
ডা. দেওয়ান মো. ইমদাদুল হক
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক, এমএনসিএইচ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ
ডা. মো. নূরুল ইসলাম খান
প্রোগ্রাম অফিসার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ
ডা. শফিকুল আমীন
সহকারী বিজ্ঞানী, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, আইসিডিডিআরবি
ডা. সাব্বীর আহমেদ
উপ পরিচালক, প্রজন্ম রিসার্চ ফাউন্ডেশন (পিআরএফ)
ডা. গৌতম বণিক
উপদেষ্টা, শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
ডা. নাজমুন নাহার
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ
শিশু স্বাস্থ্য ও নিউমোনিয়া প্রতিরোধে আমাদের আরও গবেষণা করা দরকার। আমাদের দেশের শিশুরা কেন পর্যাপ্ত পুষ্টি পাচ্ছে না, কেন বুকের দুধ খাওয়ানো কমে যাচ্ছে, সেগুলোর সঠিক কারণ খুঁজে বের করা উচিত। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্যবান্ধব না হওয়ায় অধিকাংশ মা-বাবা তাদের শিশুদের বেসরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট নিয়ে যেতে বাধ্য হন। এ অবস্থার উন্নয়ন জরুরি।
কোভিড-১৯ এর সময়ে স্কুল শিক্ষার্থীরা হাত ধোয়া, মাস্ক পরা ইত্যাদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা শিখেছে। শিক্ষকেরা তাদের মাঝে এ সচেতনতা তৈরি করেছেন। শিক্ষকদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে বাচ্চাদের মাঝে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তোলা সম্ভব।
বর্তমানে শিশুদের খাবারে ফ্রোজেন ফুডের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। টিফিনে অভিবাকেরা প্রায়ই ফ্রোজেন ফুড দিয়ে থাকেন। এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে, যা পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের প্রচারণা প্রয়োজন, যেন শিশুরা স্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে আকৃষ্ট হয়।
শিশুদের স্বাস্থ্যগত শিক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শুধু গোলটেবিলে আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বুকের দুধ পান ও শিশু পুষ্টি নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রমগুলো স্কুল-কলেজে করা প্রয়োজন। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে কিছু স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি এবং তাদের কাছে থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনের ফুটপাতের দোকানে অস্বাস্থ্যকর খাবার পাওয়া যায়। যা শিশু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এসব খাবারের বিকল্প স্বাস্থ্যকর খাবার দেওয়ার বিষয়টি গবেষণার মাধ্যমে আনা উচিত।
শিশুদের শারীরিক কার্যক্রমের ঘাটতি উদ্বেগজনক। শিশুদের শারীরিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণ কমছে, যা তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বাধা সৃষ্টি করছে। শিশুদের শুধু পড়াশোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রতিদিন কিছু সময় পার্ক বা খেলাধুলার জন্য রাখলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। নিউমোনিয়া চিকিৎসায় অযথা এন্টিবায়োটিক ব্যবহার শিশু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এ বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার বাড়াতে হবে।
স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকা, টেলিভিশন, ও রেডিওতে প্রচারের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো হলে সঠিক সময়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করার বিষয়ে জনগণ আরও মনোযোগী হবে।
শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে শিক্ষকদের পর ডাক্তারদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডাক্তারদের উচিত জনসাধারণকে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্তকরণ শেখানো ও কোন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া জরুরি তা বোঝানো।
ডা. মো. জহুরুল ইসলাম
প্রকল্প ব্যবস্থাপক, জাতীয় নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
প্রতি বছর বাংলাদেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৬ হাজার শিশু মারা যাচ্ছে। অর্থাৎ, প্রতিদিন গড়ে ৭৪টি শিশুর মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর ২৪ শতাংশই নিউমোনিয়ার কারণে হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ অনুসারে, দেশে প্রতি ১ হাজার জীবিত জন্মের মধ্যে ৭ দশমিক ৪টি শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। ২০১৭-১৮ সালে এ হার ছিল প্রতি হাজারে ৮ জন। সে তুলনায় এ ক্ষেত্রে সামান্য উন্নতি হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া প্রতিরোধে একটি বৈশ্বিক কর্মপরিকল্পনা (গ্যাপপিডি) তৈরি করেছে। বাংলাদেশ এ কর্মপরিকল্পনাটি গ্রহণ করেছে। এর আওতায়, ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি ১ হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে নিউমোনিয়া সংক্রান্ত মৃত্যুহার ৩ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কাজ করছে। এ জন্য সরকার নিউমোনিয়া প্রতিরোধে প্রথম ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে, পর্যাপ্ত পরিপূরক খাদ্য নিশ্চিত করছে, টিকাদানের পরিসর বাড়াচ্ছে, হাত ধোয়া ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার প্রচার করছে এবং গৃহস্থালি বায়ু দূষণ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করছে।
এ ছাড়া সরকার ইন্টিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট অফ চাইল্ডহুড ইলনেস (আইএমসিআই) কৌশলের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের প্রবণতা বাড়াতে কাজ করছে। সরকার রেফারেল সেবার উন্নতি এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি পর্যায়ে রোগ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করছে। তবে এ সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সহজপ্রাপ্যতা ও প্রস্তুতিতে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। কমিউনিটি পর্যায়ে স্যানিটেশন ও হাত ধোয়ার চর্চায় ঘাটতি রয়েছে। তা ছাড়া চিকিৎসাকেন্দ্রে স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে আইএমসিআই ও ইনপেশেন্ট কেয়ার ইউনিটে প্রশিক্ষিত কর্মীদের ধরে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে সেবা গ্রহণের হার এখনও কম। অ্যামোক্সিসিলিন ডিটির প্রাপ্যতা, উপজেলা হাসপাতালগুলোয় নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেনের অভাব এবং প্রয়োজনীয় ওসুধ ও চিকিৎসা সরান্জাম সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। এটি শিশুদের যথাযথ চিকিৎসায় বাধা সৃষ্টি করছে। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সরকারি সংস্থা, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটির মধ্যে বহুমুখী সহযোগিতা জরুরি।
প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর প্রস্তুতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে দ্রুত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অ্যামোক্সিসিলিন ডিটির প্রাপ্যতা অব্যাহত রাখতে ‘প্রয়োজনীয় ওষুধ তালিকায়’ এটিকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। অ্যামোক্সিসিলিন ডিটির ফার্মাসিউটিক্যাল উৎপাদনেও সহায়তা প্রদান করা দরকার। পাশাপাশি স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের সহায়তায় স্বাস্থ্য ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এসব কার্যক্রম টিকাদান ও প্রতিরোধমূলক চর্চা বাড়াতে সহায়ক হবে।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা
সভাপতি, বিসিপিএস, নিউবর্ন টেকনিক্যাল ্ওয়ার্কিং কমিটি, নিউবর্ন হেলথ
নিউমোনিয়া শুধু শিশুদের অসুস্থতাই বাড়ায় না, অনেক শিশুর জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এই মৃত্যু হার আরও বৃদ্ধি পাবে। যে কোনো মানুষের সুস্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি ঠিকভাবে শ্বাস না নিতে পারি, তাহলে স্বাভাবিক কাজকর্ম করা সম্ভব নয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এ শ্বাস-প্রশ্বাসের হার অনেক দ্রুততর হয়। কিন্তু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে শিশুদের শ্বাসের গতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় এবং বুকের খাঁচা দেবে যেতে থাকে। এ অবস্থায় শ্বাসের গতি ও তার মান পর্যবেক্ষণ জরুরি।
বিডিএইচএস জরিপের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে প্রতি হাজারে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুহার দাড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪ । এটি প্রমাণ করে যে আমরা সঠিকভাবে কাজ করতে পারছি না। নিউমোনিয়া প্রতিরোধের জন্য তিনটি মূল পদক্ষেপ: সুরক্ষা, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা।
প্রথমত, শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে এখনও মাত্র ৫৫ শতাংশে আটকে আছি, যা বাড়ানো প্রয়োজন। এতে শিশুমৃত্যুর হার কমবে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ভ্যাকসিনের ওপরও জোর দিতে হবে। পাশাপাশি স্যানিটেশন ও নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপদ পানির অভাবে মানুষ প্রতিদিন ডায়রিয়া ও টাইফয়েডের মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ঢাকায় বাসার পানির সরবরাহ যথেষ্ট নিরাপদ নয়। নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে সরকারি পদক্ষেপ জরুরি। গার্হস্থ্য দূষণের কারণে রান্নাঘরের ধোঁয়া শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে ধোঁয়ামুক্ত চুলা ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে এনজিও ও সরকার প্রচেষ্টা চালালেও এখনও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি।
চিকিৎসার দিক থেকে পালস অক্সিমিটার ব্যবহারের সঠিক তদারকি ও অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করা প্রয়োজন। করোনা মহামারির সময় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, তবে এটি আরও ভালোভাবে নিশ্চিত করা জরুরি।
ডিসপারসিবল অ্যামোক্সিসিলিন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকার উদ্যোগ নিলে অনেক শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে এ ক্ষেত্রে আরও অনেক ক্ষেত্রেই উন্নতি দরকার। স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ হওয়া প্রয়োজন। দৃশ্যমান অগ্রগতির এ বরাদ্দ জন্য অত্যন্ত জরুরি।
অধ্যাপক ডা. মো. আবিদ হোসেন মোল্লা
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, মা ও শিশু হাসপাতাল, বারডেম
নিউমোনিয়া প্রতিরোধ ও এর মৃত্যুহার কমাতে জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নিউমোনিয়া রোগের প্রধান অন্তর্নিহিত কারণগুলোর মধ্যে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব অন্যতম। রোগ শনাক্তকরণ ও সময়মতো সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। অনেক অভিভাবকই নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ যেমন কাশি বা শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতে দেরি করেন।
নিউমোনিয়া রোগ শনাক্তকরণে প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক দক্ষতার অভাব একটি বড় সমস্যা। কম দক্ষতাসম্পন্ন স্বাস্থ্যকর্মী বা জনবল দ্বারা পরিচালিত প্রাথমিক সেবা কেন্দ্রগুলোতে রোগ শনাক্তকরণ ও এর তীব্রতা নির্ধারণে ব্যাঘাত ঘটছে। ফলে সময়মতো রোগীকে উন্নত কেন্দ্রে স্থানান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না।
অক্সিজেন সাপ্লাই ও অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। নিউমোনিয়ার মূল সমস্যা হলো শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধা, যা শিশুদের শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি করে। সঠিক সময়ে অ্যান্টিবায়োটিক ও অক্সিজেন দেওয়া না হলে শুধু অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে রোগটি সম্পূর্ণভাবে সারানো সম্ভব না।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অভাবজনিত কারণে প্রায় ৪৫ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে। তাই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে অনবরত অক্সিজেন সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার উদ্বেগজনক। গ্রামীণ অন্ঞ্চলে নিয়মিত মুখে খাবার অ্যান্টিবায়োটিক না দিয়ে ইঞ্জেক্টেবল অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে, যা শিশুদের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। এ ছাড়াও, পোল্ট্রি ও মাছের চাষে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার সমাজে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের সমস্যা সৃষ্টি করছে।
পরিপূরক খাদ্য গ্রহণ ও শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানোর হার বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের ছয় মাস বয়সের পর থেকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর ব্যাপারে অভিবাবকদের সচেতন করতে হবে। ভুলভাবে অন্য দুধের ওপর নির্ভর না করে শিশুকে ঘরে তৈরি পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। শিশুদের আয়রনের ঘাটতি বর্তমানে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আয়রনের পরিমাণ কম এমন খাবার খাওয়ানোর কারণে আয়রন ঘাটতি ও হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এর ফলে শিশুরা অক্সিজেনের ঘাটতির মতো জটিলতায় ভুগছে। তাই খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধে খাদ্যাভ্যাসের গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা অনেক সাদা খাবার যেমন চালের গুড়া, সুজি, সেরেলাক, সাগু, বার্লি ইত্যাদি খাচ্ছে। এসব খাবারের মধ্যে আয়রনের অভাব রয়েছে। আয়রনের ঘাটতির কারণে শরীরে হিমোগ্লোবিন তৈরি কমে যাচ্ছে এবং অক্সিজেন পরিবহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।
অনেক শিশু চিপস, চানাচুর, চুইংগাম, চকলেট, চাটনি এ ধরনের 'চ' দিয়ে শুরু হওয়া অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। এটি তাদের স্বাস্থ্যহানির কারণ হতে পারে। এসব খাবার নিয়মিত খাওয়া বন্ধ করতে হবে। আয়রনসমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার গ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে। নিউমোনিয়া প্রতিরোধে একীভূত ব্যবস্থাপনা ও সঠিক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। শুধু স্বাস্থ্যকর্মী ও জনবলের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, তাদের দক্ষতা বাড়ানোও জরুরি।
ডা. সাবিনা আশরাফী
উপ প্রকল্প ব্যবস্থাপক, জাতীয় নবজাতক ও আইএমসিআই, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুদের মৃত্যুর হার কমাতে সরকার অসুস্থ্য শিশুর সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা (ইন্টিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট অফ চাইল্ডহুড ইলনেস) কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, যা শিশুদের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়।
প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল ও কিছু মেডিক্যাল কলেজের বহির্বিভাগে আইএমসিআই পুষ্টি কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে পাঁচ বছরের নিচে অসুস্থ শিশুদের সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা হাসপাতালে পালস অক্সিমিটার সরবরাহ করা হয়েছে। এটি শিশুদের শরীরে অক্সিজেন সল্পতা (হাইপোক্সিয়া) শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা তত্তাবধান ও মেন্টরিংয়ের মাধ্যমে পালস অক্সিমিটার ব্যবহারের কার্যকারিতা তদারকি করছি যেন গুরুতর অসুস্থ শিশুদের সঠিক সময়ে অক্সিজেন সহায়তা দিতে পারি।
আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কম হলেও বিগত সাত বছরে বিশ হাজারেরও বেশি চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। নার্সদের প্রশিক্ষণে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। যেন তারা প্রতিটি উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে আইএমসিআজ কর্নারে সেবা প্রদান করতে পারে।
নিউমোনিয়া চিকিৎসার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের ঘাটতি রয়েছে। তবে জেন্টামাইসিন ও অ্যামোক্সিসিলিন সিরাপ সংগ্রহ করা হয়েছে। বরাদ্দ সীমিত হলেও সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী ও গবেষণা সংস্থার সহায়তায় কর্মসূচিটি এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সরকার একটি ডে কেয়ার নিউমোনিয়া নামে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প শুরু করেছে। বর্তমানে দশটি জেলায় চালু এ প্রকল্পে গুরুতর অসুস্থ শিশুদের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ডে কেয়ার সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এই পরীক্ষামূলক প্রকল্প সফল হলে সারা দেশে তা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ছাড়া সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) মাধ্যমে শিশু মৃত্যুর হার কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
ডা. দেওয়ান মো. ইমদাদুল হক
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক, এমএনসিএইচ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ
প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজের মাধ্যমে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যু রোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে ইউনিসেফ বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। ইউনিসেফ বাংলাদেশের সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করছে। বিশেষত, এপিআই কর্মসূচির ক্ষেত্রে ইউনিসেফের অবদান অপরিসীম। সরকার ও ইউনিসেফের যৌথ প্রচেষ্টায় আইএমসি কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে শিশুমৃত্যু কমানো হচ্ছে। স্বাস্থ্য পরিচর্যার ক্ষেত্রে এ কর্মসূচি সরকারের সহযোগিতায় ইউনিসেফ ও ডব্লিউএইচওর সম্মিলিত উদ্যোগে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিভক্ত। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আলাদা মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করায় কার্যকরী সমন্বয় হচ্ছে না। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে সুসংহত করতে হবে, যেন স্বাস্থ্যসেবা সহজে ও কার্যকরভাবে দেওয়া যায়।
একই সঙ্গে বেসরকারি স্বাস্থসেবা খাত অতিরিক্ত ব্যায়বহুল। অনেক মানুষ বেসরকারি খাতে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। অথচ এ খাতের সেবার গুণমান সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই। অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ও ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার কারণে মানুষ অর্থনৈতিক চাপে পড়ছে। সরকারি ব্যবস্থায় এ দুইটি সেবা নিশ্চিত করতে না পারায় মানুষ বেসরকারি খাতে যাচ্ছে।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধে ওষুধ বিক্রেতা ও ফার্মাসিস্টদের দ্বারা অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার আরেকটি বড় সমস্যা । প্রায় ৩৪ থেকে ৩৫ শতাংশ মানুষ তাদের কাছ থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে রোগীরা মারাত্মক অবস্থায় হাসপাতালে পৌঁছে মারা যাচ্ছেন। দেশে ওষুধ বিক্রেতা বা ফার্মাসিস্টদের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এর কার্যকর বাস্তবায়ন এখনও হয়নি।
বায়ু দূষণ গভীর উদ্বেগের বিষয়। রান্নাঘরের ধোঁয়া, ট্রাফিক দুষণ, শিল্প বর্জ্য ও নির্মাণ কাজের ধূলা বায়ু দূষণের পরিমাণ বাড়ায়, যা শিশুদের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। ০ থেকে ১১ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়ার কারণে মৃত্যু সর্বাধিক। এর মূল কারণ এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিংয়ের ঘাটতি।
এই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইউনিসেফের সহায়তায় সরকারের কর্মসূচি সাজানো প্রয়োজন, যা শিশুদের মৃত্যুহার কমাতে সাহায্য করবে।
ডা. মো. নূরুল ইসলাম খান
প্রোগ্রাম অফিসার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ
ডব্লিউএইচও মূলত একটি কারিগরি সংগঠন। এর মূল লক্ষ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে কারিগরি সহায়তা প্রদান করা। শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ডাব্লিউএইচও (বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা) সরাসরি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, জাতীয় পুষ্টিসেবা ও জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত থেকে কাজ করছে। প্রয়োজন অনুসারে সরকারকে আর্থিক সহায়তাও প্রদান করছে।
বিশ্বে যেকোনো নতুন স্বাস্থ্য বিষয়ক নির্দেশিকা প্রকাশিত হলে বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা তা দ্রুত সরকারের সাথে শেয়ার করে এবং সেগুলোর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে কাজ করে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষতা উন্নয়ন কর্মশালার আয়োজন করে। এ কর্মশালায় শিশু স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ক্লিনিকাল প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
ডায়রিয়া প্রতিরোধ ও খাবার স্যালাইনের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। যার ফলে এ ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে নিউমোনিয়া প্রতিরোধেও আমাদের প্রচার প্রচারণার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধ ও সুরক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য (বুকের দুধ পান, পরিপূরক খাবার, ভ্যাকসিন, স্যানিটেশন, নিরাপদ পানীয় জল ও বায়ু দূষণ) নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচার করা হলে শিশুদের নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সফলতা আসবে। জনসচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে বায়ু দূষণজনিত সমস্যাগুলোও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে, যা শিশু মৃত্যু হার কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
গণমাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে জনগণকে সচেতন করা সম্ভব বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মনে করে। এ ধরনের উদ্যোগ স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।
ডা. শফিকুল আমীন
সহকারী বিজ্ঞানী, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, আইসিডিডিআরবি
বাংলাদেশ হেলথ ফ্যাসিলিটি জরিপ ২০২২ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী হাসপাতালের আন্তঃবিভাগ ও বহির্বিভাগে শিশুদের জন্য পালস অক্সিমিটারের প্রাপ্যতা নিয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে শিশু বহির্বিভাগে প্রায় ৬০ শতাংশ ও আন্তঃবিভাগে প্রায় ৮০ শতাংশ পালস অক্সিমিটার রয়েছে। এ সংখ্যাটি আরও বৃদ্ধি পাবে এবং শিশুদের অক্সিজেন সেচুরেশন পর্যবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর হবে।
আইসিডিডিআরবি ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের নেতৃত্বে একটি পরীক্ষামুলক গবেষণা করে পালস অক্সিমিটারকে ‘অসুস্থ্য শিশুর সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা' (আইএমসিআই) কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটির ইতিবাচক ফলাফল দেখে সরকার পালস অক্সিমিটার ব্যবহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিশুদের জন্য একটি শিশু-বান্ধব পালস অক্সিমিটার সরবরাহ করা হয়েছে। তবে সঠিক ব্যবহারের জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।
নিউমোনিয়া ব্যবস্থাপনায় অক্সিজেন ও অ্যান্টিবায়োটিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে প্রায়ই দেখা যায় অক্সিজেনের প্রয়োজন নেই এমন শিশুদেরও অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। ফলে অক্সিজেন প্রয়োজন এমন শিশুরা প্রয়োজনীয় অক্সিজেন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রোগীর তথ্য সংরক্ষণের জন্য একটি বিশেষ রেজিস্টার তৈরি করা হয়েছে যা শিশুদের অ্যান্টিবায়োটিক ও অক্সিজেন ব্যবহারের নিরীক্ষণ করতে সহায়তা করবে। এ রেজিস্টারটির স্কেল আপ করা হলে শিশুদের মৃত্যুহার কমানো সম্ভব হবে।
আইসিডিডিআরবি নতুন উদ্ভাবনের জন্য কাজ করছে, যার মধ্যে বাবল সিক্যাপ লো-কস্ট অক্সিজেন ডিভাইস অন্যতম। এটি নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুদের জীবন বাঁচাতে কম খরচে কার্যকর ডিভাইস হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ উদ্ভাবনগুলো শিশুর জীবন বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে। আমাদের এসব কার্যক্রম আরও প্রসারিত করা উচিত।
ডা. সাব্বীর আহমেদ
উপ পরিচালক, প্রজন্ম রিসার্চ ফাউন্ডেশন (পিআরএফ)
নিউমোনিয়া প্রতিরোধে দুটো বিষয় খুবই গুরুত্পূর্ণ। এর একটি হলো সমন্বয় ও অন্যটি গবেষণা। গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর নিউমোনিয়া অ্যান্ড ডায়রিয়া (জিএপিপিডি) বাস্তবায়নে ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থাগুলোরও সমন্বিত অংশগ্রহণ দরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন বিভাগ যেমন এমএনসি অপারেশন প্ল্যান, ইপিআই, হাসপাতাল সার্ভিসেস, বুরো অফ হেলথ এডুকেশন ও ন্যাশনাল নিউট্রিশন প্রোগ্রাম সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু আমরা কি সততার সাথে একসঙ্গে কাজ করতে পারছি কী না—সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
স্বাস্থ্যসেবাগ্রহীতাদের বড় একটি অংশ এখনও অনুপযুক্ত সেবা প্রদানকারীদের কাছে চিকিৎসা সেবার জন্য যায়। এ চ্যানেলগুলো উন্নত ও সমন্বিত করে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশে পালস অক্সিমিটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে। যা সময়মতো রোগী রেফার করার ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে পালস অক্সিমিটারের ব্যাবহারের ফলে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা সঠিক সময়ে যথাযথ স্থানে রোগীকে পাঠাতে পারেন। শরীরে অক্সিজেন সল্পতার (হাইপোক্সিয়া) ক্ষেত্রে জরুরি সেবা নিশ্চিত করতেও এটা সাহায্য করে।
গবেষণার ক্ষেত্রে সেভ দ্য চিলড্রেন, প্রজন্ম ও আইসিডিডিআরবি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় রিসার্চ প্রকল্প পরিচালনা করা হচ্ছে। দিবাযত্ন কেন্দ্র সেবার মাধ্যমে শিশুকে হাসপাতালে নেওয়ার পরিবর্তে হোম ট্রিটমেন্টের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
ডিজিটাল অস্কাল্টেশন ডিভাইসের মাধ্যমে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমানো এবং সঠিক রোগ নির্ণয় সম্ভব হবে। একসঙ্গে কাজ করে আমরা নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারব।
ডা. গৌতম বণিক
উপদেষ্টা, শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ
আমরা সরকার ও বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছি। ন্যাশনাল নিউবর্ন হেলথ, ন্যাশনাল নিউট্রিশন প্রোগ্রাম, উপজেলা হেলথ কেয়ারসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও স্বেচ্চাসেবীদের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছি। শিশু বা মায়ের অসুস্থতার ক্ষেত্রে সময়মতো চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠানো নিশ্চিত করতে কমিউনিটি স্বেচ্চাসেবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধে ৯৮ শতাংশ টিকাদানের আওতায় এসেছে। কিন্তু ‘হার্ড টু রিচ এরিয়া’তে এই হার কম। চর, পাহাড়ি এলাকাগুলোর মতো প্রান্তিক অঞ্চলে শিশুদের টিকাদানে স্বেচ্চাসেবীদের কাজে লাগানোর প্রয়োজন রয়েছে। ইপিআই থেকে লোকবল সরবরাহ করলে এসব এলাকায় আরও কার্যকরভাবে টিকাদানের আওতা বাড়ানো সম্ভব হবে।
সচেতনতার অভাবে অনেকে প্রাথমিক পর্যায়েই সঠিক চিকিৎসা পায় না। এজন্য কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যসেবাপ্রদানকারীদের দায়িত্ব হলো সঠিকভাবে রোগ শনাক্ত ও যথাযথ কেন্দ্রে রেফার করা। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বাড়ায় নিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে বাধা তৈরি হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে পালস অক্সিমিটারের প্রাপ্যতা অত্যন্ত জরুরি। অক্সিজেনের আওতা বাড়ানোও প্রয়োজন। এটি কেবল এমএনসিএইচ অপারেশন প্ল্যানের দ্বারা সম্ভব না। হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট অপারেশনাল প্লানের আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে নিতে হবে।
আইএমসিআই নিবন্ধন ও ডিসিশন মেকিং টুলে উন্নয়নের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা সহজে ডিজিটাল ডেটা যুক্ত করতে পারবেন। এ টুলের সাহায্য রোগ শনাক্ত ও উপযুক্ত চিকিৎসা নিশ্চিত করা যাবে। ফলে শিশুর স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে জাতীয় পর্যায়ে দ্রুত তথ্য সংগ্রহ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হবে।
সুপারিশ
সারাদেশে পালস অক্সিমিটারের সঠিক ব্যবহার ও অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে
নিউমোনিয়া প্রতিরোধে ধোঁয়ামুক্ত চুলা ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন
ডিসপারসিবল অ্যামোক্সিসিলিন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকারি উদ্যোগ দরকার
দৃশ্যমান অগ্রগতির জন্য এ খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের পাঁচ শতাংশ বরাদ্দ হওয়া প্রয়োজন
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন করা যাবে না
নিউমোনিয়া প্রতিরোধে পত্রিকা, টেলিভিশন, ও রেডিওতে প্রচারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে