যক্ষ্মা চিকিৎসায় কেন সরকারি ও বেসরকারি সমন্বয় জরুরি
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে একটি সফল জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য দরকার সরকারি কার্যক্রমের সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কার্যকর অংশগ্রহণ।
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আহসান হাবীব (ছদ্মনাম)। হাবিবের মা যক্ষ্মা চিকিৎসা নিচ্ছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের যক্ষ্মা সেবাকেন্দ্র থেকে। যক্ষ্মারোগীদের জন্য বিশেষায়িত একটি সেবাকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। আইসিডিডিআরবি জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সহায়তায় মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে তৈরি করেছে আধুনিক যক্ষ্মা সেবাকেন্দ্র। সেই কেন্দ্র ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। আমাদের দেশে যক্ষ্মার যেমন প্রকোপ, তার জন্য এমন যক্ষ্মা সেবাকেন্দ্র ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবাই জানি, যক্ষ্মা শুধু রোগ নয়, সামাজিক এক সংকটের নাম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, আমাদের দেশে ২০২৩ সালে আনুমানিক ৩ লাখ ৭৯ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় এবং ৪৪ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় মারা যায়। এ ছাড়া ৪ হাজার ৯০০ মানুষ ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মায় (এমডিআর) আক্রান্ত হয়। ২০২৩ সালে প্রায় ৩ লাখ ২ হাজার ৭৩১ যক্ষ্মারোগী শনাক্ত হয়, যা আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায় ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ ২০ শতাংশ ব্যক্তি রোগ শনাক্তের বাইরে রয়ে যায় এবং এমডিআর টিবিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ জন শনাক্ত হচ্ছে না।
এ ছাড়া আমাদের দেশে শিশুদের যক্ষ্মা ঠিকমতো শনাক্ত হচ্ছে না। মোট যক্ষ্মা শনাক্তের ৮ থেকে ১২ শতাংশ শিশু হওয়ার কথা, কিন্তু শনাক্ত হচ্ছে ৪ শতাংশ। ফলে শনাক্ত না হওয়ায় অনেক শিশুর যক্ষ্মা থাকলেও তারা চিকিৎসার আওতায় আসছে না। এ ছাড়া দুই কারণে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মায় মানুষ আক্রান্ত হয়। প্রথমত, যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তি যদি নিয়মিত সঠিক মাত্রায় পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ সেবন না করে, ব্যক্তির শরীরে থাকা জীবাণু ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয়ত, ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণু সরাসরি অন্য ব্যক্তির শরীরে যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমিত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪ হাজার ৯০০ মানুষ নতুন করে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। এদের দুই-তৃতীয়াংশ শনাক্ত হয় না। আমাদের দেশে এখনো অনেক মানুষ জানে না যে সরকার যক্ষ্মার চিকিৎসা বিনা মূল্যে দিচ্ছে। সরকারের সেবা বিষয়ে মানুষের ধারণা কম। বেসরকারি খাতে অর্থাৎ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে শনাক্ত হওয়া রোগীরা জাতীয় কর্মসূচির মধ্যে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সচেতনতার ঘাটতি আছে তা বলাই বাহুল্য। যক্ষ্মার মতো রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন দরকার।
যক্ষ্মা এখনো কেন চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা থাকলেও প্রায়ই দেখা যায় যে বেশির ভাগ মানুষ সঠিক সময়ে সেবা পায় না। অনেক ক্ষেত্রেই যক্ষ্মা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ অজ্ঞাত বা এর লক্ষণগুলোকে গুরুত্ব দেয় না। ফলে চিকিৎসা গ্রহণে বিলম্ব হয় এবং রোগের সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
অন্যদিকে বেসরকারি খাত, বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। তবে যক্ষ্মা চিকিৎসায় এই খাতগুলোর ভূমিকা এখনো পূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি। আমরা দেখেছি, মানুষ সহজে যক্ষ্মা পরীক্ষা করায় না। পরিস্থিতি অনেক খারাপ হওয়ার পর পরীক্ষা করাতে বা চিকিৎসকের কাছে আসে। দেশে রোগী শনাক্তের কাজে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে জিন-এক্সপার্ট যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। বাকি ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে সনাতন অণুবীক্ষণযন্ত্র ব্যবহৃত হয়। দরকার সব ক্ষেত্রে জিন-এক্সপার্ট যন্ত্র ব্যবহার করা। পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে সবার রোগনির্ণয় পরীক্ষা এই যন্ত্রে সম্ভব হচ্ছে না। আমরা দেখছি, যক্ষ্মা প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে দেশের জনসংখ্যার তুলনায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের সক্ষমতা খুবই সীমিত। অনেক গ্রামীণ এলাকায় সেবাকেন্দ্রের সংখ্যা কম এবং সেসব এলাকায় কার্যকর চিকিৎসা পৌঁছানো কঠিন।
এ অবস্থায় সরকারি প্রচেষ্টা বেসরকারি সেক্টরের সহযোগিতা ছাড়া সফল হওয়া কঠিন। যদিও সরকারের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনটিপি) বেশ কিছু উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন বিনা মূল্যে ওষুধ সরবরাহ এবং পরীক্ষা, কিন্তু জনগণের সচেতনতা ও সঠিক সময়ে চিকিৎসাসেবা গ্রহণের হার বাড়ানোর জন্য আরও বড় পরিসরে পদক্ষেপ প্রয়োজন।
বেসরকারি খাতের সম্ভাবনা
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা দিন দিন বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন রোগের উন্নত চিকিৎসা এবং সেবা প্রদানে এই খাতটি ইতিমধ্যে সাফল্য অর্জন করেছে। বিশেষ করে রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোয় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোয় আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং দক্ষ চিকিৎসক দল নিয়ে গড়ে ওঠা অবকাঠামো জনগণের আস্থা অর্জন করেছে। সাধারণ মানুষ যখন সরকারি হাসপাতালের সেবা নিয়ে অসন্তুষ্ট হন, তখন তাঁরা বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে বেশি আগ্রহী হন। এ প্রবণতা খাতের চাহিদা এবং সম্ভাবনার পরিধি তুলে ধরে।
বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের একটি বড় সুবিধা হলো, এর দ্রুত সেবা প্রদান এবং রোগী ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা। বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে উন্নতমানের পরীক্ষাগার, আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং দক্ষ চিকিৎসক দল থাকায় রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাপ্রক্রিয়া দ্রুত ও সুনির্দিষ্টভাবে সম্পন্ন হয়। যক্ষ্মার মতো জটিল এবং সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে, দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ এবং নির্ভুল চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারি খাতের দক্ষতা এবং পরিকাঠামো এই সেবা প্রদান করতে সক্ষম।
তবে বেসরকারি খাতের সামগ্রিক সাফল্যের মধ্যেও যক্ষ্মার মতো একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যায় তাদের সম্পৃক্ততা এবং কার্যকর ভূমিকা এখনো যথেষ্ট হয়নি। যক্ষ্মার মতো রোগের প্রাদুর্ভাব অনেক ক্ষেত্রেই দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশি দেখা যায়, যারা সাধারণত সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া যক্ষ্মা একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ এবং এর চিকিৎসায় নিয়মিত ও সঠিক ওষুধ সেবন অত্যন্ত জরুরি। এই দীর্ঘমেয়াদি এবং সুসংহত চিকিৎসাপ্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রাইভেট প্র্যাকটিসে নিয়োজিত চিকিৎসকদের যক্ষ্মারোগী শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে আরও দক্ষ ও সচেতন হতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় যে বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে আসা রোগীরা যক্ষ্মার প্রাথমিক লক্ষণ নিয়ে আসেন, কিন্তু সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। কারণ, অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল বা চিকিৎসকেরা যক্ষ্মা পরীক্ষার জন্য সরকারি নির্দেশিকা অনুসরণ করেন না বা জানেন না। এর ফলে রোগীর সঠিক চিকিৎসা বিলম্বিত হয় এবং রোগটি আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে। তাই প্রাইভেট প্র্যাকটিসে নিয়োজিত চিকিৎসকদের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান এবং দায়বদ্ধতা তৈরি করা প্রয়োজন।
বেসরকারি খাতে যক্ষ্মা চিকিৎসায় আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো রোগীর তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ এবং তা সরকার বা জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো অনেক সময় রোগীর তথ্য সংরক্ষণ বা শেয়ার করার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় থাকে, যা যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে তথ্য বিনিময় প্রক্রিয়াটি সহজ এবং কার্যকর করতে প্রযুক্তিগত সমাধানের প্রয়োজন।
প্রশাসনিক ও পরিচালনামূলক সহযোগিতা
বাংলাদেশে যক্ষ্মা প্রতিরোধ এবং চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতিতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সহযোগিতা অপরিহার্য। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে একটি সফল জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য দরকার সরকারি কার্যক্রমের সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কার্যকর অংশগ্রহণ। স্বাস্থ্য খাতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা যত বেশি হবে, দেশের যক্ষ্মা চিকিৎসাব্যবস্থাও তত উন্নত হবে। আমাদের দেশে এখনো অনেক মানুষ জানে না যে সরকার যক্ষ্মার চিকিৎসা বিনা মূল্যে দিচ্ছে। সরকারের সেবা বিষয়ে মানুষের ধারণা কম। বেসরকারি খাতে অর্থাৎ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে শনাক্ত হওয়া রোগীরা জাতীয় কর্মসূচির মধ্যে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সচেতনতার ঘাটতি আছে বলে আমি মনে করি। যক্ষ্মার মতো রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন দরকার। এই সামাজিক আন্দোলনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রাখতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি চিকিৎসায় বিনিয়োগের বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। তরুণদের যক্ষ্মা আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে হবে। আশা করি, সবার ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারব।
ফিরোজ চৌধুরী: সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো