স্বাস্থ্য খাতে চক্ষুসেবা নিশ্চিতকরণ: সমস্যা ও উত্তরণের উপায়
বিশ্ব দৃষ্টি দিবস উপলক্ষে সাইটসেভার্স বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘স্বাস্থ্য খাতে চক্ষুসেবা নিশ্চিতকরণ: সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৯ অক্টোবর ২০২৪। আলোচকদের বক্তব্যের সারকথা এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশ হলো।
অংশগ্রহণকারী
অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন
চেয়ার, আইএপিবি, বাংলাদেশ চ্যাপ্টার, এবং সভাপতি, ওএসবি
অধ্যাপক ডা. আবদুল কাদের
একাডেমিক কমিটির চেয়ারম্যান, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট
অমৃতা রেজিনা রোজারিও
কান্ট্রি ডিরেক্টর, সাইটসেভার্স এবং কো-চেয়ার, আইএনজিও ফোরাম ইন আই হেলথ
মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, ক্লিয়ার ভিশন কালেক্টিভ (সিভিসি)
ডা, মুনির আহমেদ
কান্ট্রি ডিরেক্টর, অরবিস ইন্টারন্যাশনাল এবং চেয়ার, আইএনজিও ফোরাম ইন আই হেলথ
ডা. মো. মনজুরুল মুরশিদ
পরিচালক (স্বাস্থ্য), খুলনা বিভাগ
মো. সাইদুল হক
নির্বাহী পরিচালক, ব্লাইন্ড এডুকেশন অ্যান্ড রিহেবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (বার্ডো)
জয়ীতা তালুকদার
সংগীতশিল্পী ও শিক্ষক
পরাগ শরীফুজ্জামান
কো–অর্ডিনেটর, ডা. কে জামান বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল
অধ্যাপক ডা. নাহিদ ফেরদৌসী
পরিচালক, এসএফএম চক্ষু হাসপাতাল অ্যান্ড ট্রেনিং ইন্সটিটিউট
খোন্দকার সোহেল রানা
অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশনস কো-অর্ডিনেটর, সাইটসেভার্স
এ কে এম বদরুল হক
কর্মসূচি ব্যবস্থাপক, দ্য ফ্রেড হলোস ফাউন্ডেশন
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন
চেয়ার, আইএপিবি, বাংলাদেশ চ্যাপ্টার, এবং সভাপতি, ওএসবি
২০০০ সালে ১০ হাজার জন শিশুর মধ্যে ৮ জনের অন্ধত্ব ছিল। ২০১৮ সালের জরিপে শিশুদের এই অন্ধত্বের হার ১০ হাজার জনের মধ্যে ৬ জনে নেমে আসে। এই সময়ের মধ্যে আমরা প্রায় ৭০ শতাংশ অন্ধত্ব কমিয়ে এনেছি। ২০২০ সালের ভিশন ২০২০ লক্ষ্যমাত্রা শেষ হওয়ার পরে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা আসে। প্রথম দিকে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে চক্ষুসেবার বিষয়টি ছিল না। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগে ইউএন চক্ষুসেবার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে কাউকে পেছনে না রেখে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবাগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে আমাদের সাম্যের অভাব রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের দিক থেকে নারী ও শিশুর সংখ্যা কম। এখানে আমরা লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করতে পারিনি। সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রামীণ ও শহরের জনগণের মধ্যে একটা ফারাক রয়েছে। প্রান্তিক জনগণের সেবা গ্রহণের পরিমাণ কম। এসব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবায় এখনো প্রবেশগম্যতার অভাব রয়েছে। আমরা সব সময় গবেষণাভিত্তিক কাজ করি। ফ্রেড হলোস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ে গবেষণা করছে।
২০৩০ সালের মধ্যে চক্ষুসেবা নিশ্চিত করা ও কাউকে পেছনে না রেখে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের করণীয় ঠিক করতে হবে। এ জন্য আমাদের জাতীয় চক্ষুসেবা পরিকল্পনা থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে এলে এ নিয়ে আমরা কাজ করতে পারব। আমাদের কাজ হলো সরকারকে পরামর্শ দেওয়া। অন্ধত্ব কেবল স্বাস্থ্যগত সমস্যা নয়, এটি এখন উন্নয়নগত সমস্যাও। ল্যানসেট–এর নিবন্ধে এসেছে, চা–বাগানের শ্রমিকদের চশমা দেওয়ায় তাঁদের উৎপাদনক্ষমতা অনেক বেড়েছে। অন্ধত্ব দূর হলে মানসিক উৎকর্ষ, শিক্ষা ও উৎপাদনক্ষমতা বাড়বে। সে জন্য চক্ষুসেবাকে উন্নয়ন ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা স্বাস্থ্যসেবাকে প্রভাবিত করে। স্বাস্থ্যগত সমস্যার বাইরের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা না গেলে চক্ষুসেবা মূল ধারায় নিয়ে আসা যাবে না। বহু খাতভিত্তিক সমন্বয় বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। স্বাস্থ্য খাতের বাইরেও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা সমন্বয় করব।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে এনজিওগুলোর বিশেষ অবদান রয়েছে। টিকাদানের মতো সব কর্মসূচিতে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত অবদান ছিল। আমরা সরকারি-বেসরকারি সমন্বয় আরও বাড়াব ও শক্তিশালী করব। সাইটসেভার্স, ফ্রেড হলোস ফাউন্ডেশন ও অরবিস সিলেটের চা–বাগানের ১০ হাজার প্রান্তিক মানুষকে বিনা মূল্যে চশমা দিয়েছে। ফ্রেড হলোস ফাউন্ডেশন সিলেট বিভাগে এখনো বিনা মূল্যে অনেককে চশমা দিচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশগম্যতার ক্ষেত্রে কুসংস্কার ও ট্যাবু রয়েছে। অনেকের আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এসব কুসংস্কারের কারণে স্বাস্থ্যসেবা খাতে আসছেন না। অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের নেতৃত্ব প্রয়োজন রয়েছে। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলে ২০৩০ সালের মধ্যে কাউকে পেছনে না রেখে আমরা এগিয়ে যেতে পারব।
অধ্যাপক ডা. আবদুল কাদের
একাডেমিক কমিটির চেয়ারম্যান, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রথম অংশ হলো ইনস্টিটিউট। ইনস্টিটিউটের কাজ হলো ডাক্তার তৈরি করা। এর উপজাত হলো হাসপাতাল। কিন্তু হাসপাতাল ইনস্টিটিউটের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে। আমরা এফসিপিএস, এমএস ও ডিপ্লোমা ডাক্তার তৈরি করি। প্রতিবছর আমরা ২৫ থেকে ৩০ জন ডাক্তার তৈরি করি। ডাক্তার তৈরি করা আমাদের প্রাথমিক কাজ। একাডেমিক ইনস্টিটিউট হলেও এখানে একাডেমিক বরাদ্দের ঘাটতি রয়েছে। বেশির ভাগ বরাদ্দ আসে হাসপাতালে। এটি উদ্বেগের বিষয়। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট থেকে সারা দেশে চক্ষু স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।
আমরা আন্তর্জাতিক এনজিও (আইএনজিও) ফোরামের সহায়তা নিয়ে থাকি। তারা অবকাঠামো, লজিস্টিক ও প্রশিক্ষণে সহায়তা দিয়ে থাকে। এ জায়গাটা আরেকটু শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো ছানি ও অন্ধত্ব দূরীকরণ নিয়ে কাজ করে। আর আমরা চোখের সব সমস্যা নিয়েই কাজ করি। দেশে সিনিয়র কনসালট্যান্ট ৫৯টি পদের বিপরীতে মাত্র ১৫ জন রয়েছেন। ৩৩৪ জন জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদের বিপরীতে মাত্র ২৬ জন কর্মরত। এই মানবসম্পদ ঘাটতি সত্ত্বেও আমরা সেবা প্রদান করছি। মানবসম্পদের ঘাটতি পূরণ করা প্রয়োজন।
২০১৯ সালে বেসরকারি চক্ষু ক্লিনিক নীতিমালা তৈরি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে কোনো টেকনিশিয়ান নেই। টেকনিশিয়ানের কাজগুলো নার্সদের করতে হচ্ছে। ২০২০ সালের মধ্যে আমাদের ১ হাজার ৫০০ ডাক্তার তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ২০২৪ সালের মধ্যে আমরা ১ হাজার ৬০০ ডাক্তার তৈরি করেছি। এটি একটি আশার কথা। এনজিওগুলোর সঙ্গে আমাদের সমন্বয় বাড়াতে হবে, যা একটি চলমান প্রক্রিয়া। আই (চক্ষু) ব্যাংকিংয়ের জন্য সাইট লাইফের সঙ্গে কর্মশালা করেছি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে বসেছি, যেন তারা এর পক্ষে মত দেয়।
প্রথমে রাজি হলেও শেষ পর্যন্ত তারা এর বিরুদ্ধাচরণ করে। ইরান প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি কর্নিয়া সংগ্রহ করে। সন্ধানী একসময় বছরে ২৫০ থেকে ৩০০ কর্নিয়া সংগ্রহ করতে পারত। এখন তা ২০ থেকে ২৫-এ নেমে এসেছে।
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের দুই ঘণ্টার বেশি ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না। ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতেই হলে প্রতি দুই ঘণ্টা পর ১৫ মিনিটের বিরতি নিতে হবে। এ ছাড়া ঘন ঘন চোখের পাতা বন্ধ করতে হবে।
অমৃতা রেজিনা রোজারিও
কান্ট্রি ডিরেক্টর, সাইটসেভার্স এবং কো-চেয়ার, আইএনজিও ফোরাম ইন আই হেলথ
সাইটসেভার্স ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় পর্যায়ে অন্ধত্ববিষয়ক জরিপের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং সরকারকে পরিপূর্ণভাবে সহায়তা করে। পরে ২০২০ সালে আরও একটি জরিপ হয়েছিল। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রথম জাতীয় চক্ষুসেবা–সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনায় সাইটসেভার্স অরবিসসহ বিভিন্ন এনজিও সরকারকে কারিগরি ও আর্থিকভাবে সহায়তা করেছিল। ২০১৪ সালের দ্বিতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরিতেও আমরা সহায়তা করি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা অনুমোদন পায়নি। ছানি অপারেশনের আদর্শ প্রটোকল (স্ট্যান্ডার্ড ক্যাটারেক্ট সার্জিক্যাল প্রটোকল) প্রণয়নে সাইটসেভার্স সহায়তা করেছে, যা এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।
শিশুদের চক্ষুসেবা–সংক্রান্ত বিভিন্ন গাইডলাইন ও প্রটোকল তৈরিতেও সাইটসেভার্স বিশেষ অবদান রেখেছে। আমরাই প্রথম জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে চক্ষুসেবা কাঠামো ও ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের কাজ করেছি। প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে একটি জেলায় কাঠামো শক্তিশালীকরণের কাজ করা হয়েছে, যেখানে চক্ষু অপারেশন থিয়েটার স্থাপন, এ–সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা হয়েছে। পরে ১৬টি জেলায় আমরা এটিকে সম্প্রসারিত করেছি। সাইটসেভার্স বাংলাদেশে ৫০ বছর ধরে কাজ করছে। আমরা চক্ষুসেবা বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করি। অংশীদারদের সেবাকাঠামো শক্তিশালীকরণে সাইটসেভার্স বিশেষ অবদান রেখে চলেছে এবং এসব হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন নির্দেশিকা তৈরিতে সহায়তা করে চলেছে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে চক্ষুসেবায় অন্তর্ভুক্ত করতে সাইটসেভার্স বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। হাসপাতালগুলোকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সবার জন্য প্রবেশগম্য করতে সাইটসেভার্স অবকাঠামোগত উন্নয়নে কাজ করেছে। প্রতিবন্ধী ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর যথাযথ সেবা নিশ্চিতকরণে এ–সংক্রান্ত সেবাদাতাদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মানবসম্পদ তৈরিতেও সাইটসেভার্স কাজ করেছে এবং এটি চলমান রয়েছে। কৌশলগত দিক থেকে চক্ষুসেবাকে নন–কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোলের (এনসিডিসি) সঙ্গে সমন্বয় করা দরকার। সাইটসেভার্স এরই মধ্যে ইনক্লুসিভ আই হেলথ গাইডলাইন তৈরি করেছে। এটি এনসিডিসি দ্বারা অনুমোদিত হওয়া দরকার। সে জন্য আমরা কাজ করছি। এ ছাড়া আমরা জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সরাসরি কাজ করি। ন্যাশনাল আই কেয়ারের সঙ্গে আমাদের একটি সমঝোতা স্মারক হয়েছে। সে অনুযায়ী তৃণমূল পর্যায়ের রোগীদের সেবাকেন্দ্র থেকে সেবা গ্রহণে সাইটসেভার্স যাতায়াত সুবিধা প্রদান করবে। হাসপাতাল অংশীদারদের মাধ্যমে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আই টেস্ট করা হচ্ছে। সাইটসেভার্স চক্ষুসেবা কাঠামো শক্তিশালীকরণে কাজ করে চলেছে এবং সেটি নিশ্চিত হলেই সবার জন্য চক্ষুসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সাইটসেভার্স দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চক্ষুসেবাকে বৃহৎ স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোয় একীভূত করা প্রয়োজন।
মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, ক্লিয়ার ভিশন কালেক্টিভ (সিভিসি)
আমি চক্ষু স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে ৩৫ বছর ধরে কাজ করছি। সাইটসেভার্সের উদ্যোগে ও সহায়তায় ২০০০ সালে দেশে প্রথম অন্ধত্ব–বিষয়ক জরিপ হয়। এ জরিপে দেশে অন্ধত্বের সংখ্যা ছিল ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০২০ সালের জাতীয় অন্ধত্ব–বিষয়ক জরিপে তা কমে ১ শতাংশে আসে। এখানে এনজিওগুলোর বিশেষ অবদান রয়েছে। সাইটসেভার্স ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে। সাইটসেভার্স ১৯৭৩ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ‘রুরাল আই ক্যাম্প’–এ অর্থায়ন করেছে। ১৯৯১ সালের পর রুরাল আই ক্যাম্পের পরিবর্তে হাসপাতালভিত্তিক সার্জারির প্রতি জোর দেওয়া শুরু করে। ফলে সার্জারির মান বাড়ে ও সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস পায়। চক্ষুসেবায় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী তৈরিতেও সাইটসেভার্স অবদান রেখেছে।
চক্ষুসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এনজিওগুলোর অবদানই বেশি। সাইটসেভার্স ৫টি জেলায় মডিউলার আই কেয়ার কর্মসূচি নিয়েছিল। যেখানে একটি কেন্দ্রীয় হাসপাতালের চারদিকে চারটি প্রাথমিক কেন্দ্র থাকত। রাতকানা রোগ কমাতে হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ভিটামিন এ ক্যাপসুল নিয়ে কাজ করেছিল। বর্তমানে দেশে রাতকানা রোগীর সংখ্যা অনেক কমে এসেছে।
সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সাইটসেভার্স অনেকগুলো অদ্বিতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। এর মধ্যে ভ্রাম্যমাণ অপারেশন থিয়েটার অন্যতম। এ কর্মসূচির মাধ্যমে চক্ষুসেবার আওতার বাইরের অঞ্চলেও সেবা প্রদান সম্ভব হয়েছে। গ্রামীণ, প্রান্তিক মানুষেরাও সেবার আওতায় আসে। সরকারের সঙ্গে সমন্বিতভাবে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। ব্র্যাক, সাইটসেভার্স ও ন্যাশনাল আই কেয়ার মিলে সিলেট বিভাগে তিন বছরের একটি প্রকল্প নেয়। ‘ভিশন বাংলাদেশ’ নামে এ প্রকল্পে তিন বছরে ১ লাখ ১০ হাজার মানুষের ছানি অপারেশন করা হয়। এ প্রকল্প সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগের একটি সফল উদাহরণ। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন কোনো জেলায় চক্ষুচিকিৎসক না থাকলেই এ–সংক্রান্ত সব কর্মসূচি মুখ থুবড়ে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে দ্রুততার সঙ্গে সরকারের জাতীয় চক্ষুসেবা পরিকল্পনা অনুমোদন ও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
ডা, মুনির আহমেদ
কান্ট্রি ডিরেক্টর, অরবিস ইন্টারন্যাশনাল এবং চেয়ার, আইএনজিও ফোরাম ইন আই হেলথ
এবারের চক্ষু দিবসের প্রতিপাদ্যে শিশুদের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুদের চক্ষুসেবা সহজ, সাশ্রয়ী ও প্রবেশগম্য হিসেবে গড়ে তোলার ক্যাম্পেইন নেওয়া হয়েছে। দৃষ্টির সমস্যা শিশুর শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা অনেকটা রহিত করে। এ সমস্যা শিশুর একটি বাধা হিসেবে কাজ করে। ফলে শৈশবে শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও উন্নয়ন ঠিকভাবে হয় না। ফলে, এবারের দৃষ্টি দিবসের প্রতিপাদ্য অত্যন্ত যথাযথ। কারণ, শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুদের সমস্যার সমাধান করা গেলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাব।
আমরা সীমিত আকারে শিশুদের চক্ষু সমস্যা শনাক্তকরণে কাজ করছি। কিন্তু আমরা স্কুলে বাধ্যতামূলকভাবে চক্ষু সমস্যা শনাক্তকরণ এখনো নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা অরবিসের সঙ্গে ১০টি জেলায় ৫ হাজার স্কুলের মাধ্যমে ১০ মিলিয়ন শিশুর চক্ষু সমস্যা শনাক্তকরণের লক্ষ্য ঠিক করি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কাছে যাওয়া হয়। তারা বিষয়টি সম্পর্কে খুব বেশি জানেন না। তাই জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। এ জায়গায় কাজ করলে একটা ইতিবাচক ফল পাব। শিশুর শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বৃদ্ধির জন্য শিশুর চোখের স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর চক্ষু স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে শিশুর চক্ষু স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে।
চক্ষুসেবা–সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের কথা আলোচনায় এসেছে। চক্ষুসেবা নিশ্চিত করার জন্য শুধু সমন্বয় যথেষ্ট নয়। এ জন্য জাতীয় পর্যায়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রয়োজন। জেলাভিত্তিক চক্ষুসেবা পরিকল্পনা না হলে কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা
যাবে না। শিশুর চক্ষুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আমরা ৬ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত শিশুদের বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কিন্তু পাঁচ ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে আমরা খুব বেশি অবদান রাখতে পারিনি। এ জায়গায় আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
চক্ষুসেবা খাতে কোন হাসপাতালগুলো যথাযথ সেবা দিতে পারছে এবং কোনগুলো পারছে না, তা চিহ্নিত করতে হবে। আমাদের ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এটা নিশ্চিত করা না গেলে শিশুদের চক্ষু স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কঠিন হবে। আমাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সমন্বিতভাবে বসে সরকারকে একটা দিকনির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন।
ডা. মো. মনজুরুল মুরশিদ
পরিচালক (স্বাস্থ্য), খুলনা বিভাগ
সরকারি পর্যায়ে চক্ষু চিকিৎসার ক্ষেত্রে কিছু সংকট রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে চক্ষু চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় তেমন কোনো সরঞ্জাম নেই। নির্বাচিত কিছু উপজেলায় আমরা চক্ষু চিকিৎসা দিয়ে থাকি। সম্প্রতি কিছু কমিউনিটি ক্লিনিকে আমরা চক্ষু চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করেছি। কমিউনিটি ক্লিনিকে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চক্ষু চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। প্রশিক্ষিত নার্সরা সেখান থেকে জেলা পর্যায়ে তথ্য-উপাত্তগুলো পাঠান। এ তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসা প্রদান করেন, যা নার্সরা স্থানীয় রোগীকে দেন।
আমার কর্মরত খুলনা বিভাগের ১০টি জেলার মধ্যে ৬টি জেলায় চক্ষু চিকিৎসক নেই। কমিউনিটি আই সেন্টার থেকে রোগীদের রেফার করা হয়। ১০ জন রোগীকে রেফার করা হলে সেবাকেন্দ্রে মাত্র দু–তিনজনকে পাওয়া যায়। অন্যরা যাতায়াত অসুবিধা, দালালের খপ্পরে পড়া বা অন্য কোনো কারণে আসতে পারেন না। প্রান্তিক পর্যায় থেকে রেফার করা সব রোগী যেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আসে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
চক্ষু চিকিৎসাসেবা–সংক্রান্ত অনেক দামি সরঞ্জাম উপজেলা পর্যায়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অনেক সরঞ্জাম সেখানকার কর্মীরা ব্যবহার করতে পারেন না বা তাঁদের প্রয়োজন হয় না। এসব সরঞ্জাম এমন জায়গায় স্থাপন করা দরকার, যেন তা কাজে লাগে। উপজেলা পর্যায়ে কমিউনিটি আই সেন্টার স্থাপন অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের কাছে তো আমরা পৌঁছাতে পেরেছি, কিন্তু এর চেয়ে কম বয়সী শিশুদের আমরা চক্ষু চিকিৎসাসেবার আওতায় আনতে পারছি না। এ বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
মো. সাইদুল হক
নির্বাহী পরিচালক, ব্লাইন্ড এডুকেশন অ্যান্ড রিহেবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (বার্ডো)
বিশ্ব দৃষ্টি দিবস সম্পর্কে মানুষ খুব একটা জানেন না। তাই সরকারি উদ্যোগে এ দিবস পালনের একটা সুযোগ করা উচিত। এখানে নীতিনির্ধারকেরা এসেছেন। তাঁরা এটা নিয়ে কাজ করতে পারেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।
আমরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা সমাজের মূল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারি না। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা মানুষের জীবনে দুঃখ–বেদনা নিয়ে আসে। সে জন্য এ দিবসটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ করতে হবে। একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর ভোগান্তি সম্পর্কে আমরা জানি না। অনেক মানুষ জানেন না যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা পড়াশোনা করতে পারেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষেরা কর্মসংস্থানে যুক্ত হতে পারেন ও রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। এ জন্যই দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ বলেই আমরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। এ–সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছি। তারপর প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন প্রতিবন্ধী মানুষেরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। এগুলো আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে সম্ভব হয়েছে।
প্রতিটি জেলায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য স্কুল রয়েছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের সেসব স্কুলে পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। সরকার প্রতিবন্ধী মানুষদের এগিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। এ জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য শিক্ষা ও ভাতার ব্যবস্থা করেছে।
কিন্তু প্রতিবন্ধী অধিকার ও সুরক্ষা আইন এখনো বাস্তবায়িত হচ্ছে না। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে চিকিৎসার পাশাপাশি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষদের মনোবল ধরে রাখা ও মর্যাদার সঙ্গে সমাজে বসবাস করা নিশ্চিত করতে আইন বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। আইন বাস্তবায়িত না হলে আইনের কোনো অর্থ থাকে না। প্রতিবন্ধী মানুষদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সাইটসেভার্স সে জন্য কাজ করছে। সমাজের সব স্তরে প্রতিবন্ধী মানুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
জয়ীতা তালুকদার
সংগীতশিল্পী ও শিক্ষক
একজন শিক্ষক ও সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ বিষয়ে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। করোনা দেশে মহামারি নিয়ে এলেও শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে। সে সময় ভার্চ্যুয়াল শিক্ষাব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভার্চ্যুয়াল শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে অভ্যস্ত ও এর সহজলভ্যতার কারণে করোনা–পরবর্তী সময়েও আমরা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছি। ফলে আমাদের পাশাপাশি শিশুদের স্ক্রিনে সময় কাটানোর পরিমাণ বেড়েছে। ডিজিটাল ডিভাইসভিত্তিক পাঠক্রমগুলো ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ও ডিজিটাল ডিভাইসভিত্তিক হয়ে গেছে। বিষয়টির ভালো দিকের পাশাপাশি খারাপ দিকও রয়েছে। খুব কম বয়সের শিশুদের চশমা ব্যবহারের হার অনেক বেড়ে যাওয়া এর মধ্যে অন্যতম। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে মাইগ্রেন ও নিদ্রাহীনতার প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি।
উন্নত দেশগুলোয় সপ্তাহ বা মাসের নির্দিষ্ট দিনে স্ক্রিন অফ–ডে রাখা হয়। এটি সচেতনতার অংশ হিসেবে করা হয়। আমাদের দেশেও এটা করা যেতে পারে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর চোখের বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। একেবারে কম বয়সে আমরা শিশুদের হাতে ডিজিটাল ডিভাইস তুলে দিচ্ছি। শিশু এ ডিভাইসে খেলাধুলা ও পড়াশোনা করছে। ফলে ঘুম ছাড়া বাকি সময় শিশু স্ক্রিনেই কাঠাচ্ছে, যা ঘুমের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে।
উন্নত বিশ্বে মরণোত্তর চক্ষুদানের বিষয়টি খুবই জনপ্রিয়। আমাদের দেশে মরণোত্তর চক্ষুদানের ক্ষেত্রে সচেতনতা ও আগ্রহের ঘাটতি রয়েছে। এ জায়গায় কাজ করার সুযোগ রয়েছে। মরণোত্তর চক্ষুদানে আগ্রহী করতে ক্যাম্পেইন করা যেতে পারে। সাইটসেভার্স ও এখানকার বিশেষজ্ঞরা এ ক্ষেত্রে নতুন উদ্যোগের বিষয়ে ভেবে দেখবেন।
পরাগ শরীফুজ্জামান
কো–অর্ডিনেটর, ডা. কে জামান বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল
২০২০ সালে ন্যাশনাল ব্লাইন্ডনেস সার্ভে হয়েছে। এই জরিপে এসেছে, মাত্র ২২ শতাংশ মানুষ চক্ষুসেবা গ্রহণ করেন। ৭৮ শতাংশ মানুষই এ সেবার আওতার বাইরে। ময়মনসিংহ বিভাগের অন্ধত্বের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। এ অঞ্চলে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার অন্ধ মানুষ রয়েছেন। আমরা সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে পাঁচটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরীক্ষামূলকভাবে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি স্ক্রিনিং চালু করেছি। এ ছাড়া সাইটসেভার্সের সহায়তায় ও স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন পাবলিক স্ক্রিনিং ক্যাম্প করে থাকি।
ময়মনসিংহ বিভাগের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের ১৪টি ভিশন সেন্টার রয়েছে। এ সেন্টারগুলোর মাধ্যমেও আমরা সেবা দিয়ে থাকি। জাতীয় পর্যায়ে অনেক নীতিমালা গ্রহণ করা হয়। অনেক সময় সিভিল সার্জনসহ মাঠপর্যায়ে সেবাদাতারা এ বিষয়ে অবগত হন না। ফলে আমাদের কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি সমন্বয় আরও মজবুত হওয়া দরকার। এ জন্য জেলাভিত্তিক পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। এ পরিকল্পনায় সিভিল সার্জনকে প্রধান করা যেতে পারে। তাহলে এ–সংক্রান্ত তথ্যগুলো আমরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে পারব। এ ছাড়া ক্রস রেফারেল লিংকেজের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে রোগীদের ভোগান্তি কমবে।
অর্থনৈতিকভাবে ময়মনসিংহের হাওর অঞ্চল কিছুটা পিছিয়ে পড়া। চক্ষুসেবা গ্রহণের মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনেক রোগীর থাকে না। সে জন্যই আমরা বাকি ৭৮ শতাংশ মানুষকে সেবার আওতায় আনতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে এনজিওগুলোর মাধ্যমে এ সেবার আওতা বাড়ানো গেলে প্রান্তিক জনগণকে সেবা দেওয়া সম্ভব।
অধ্যাপক ডা. নাহিদ ফেরদৌসী
পরিচালক, এসএফএম চক্ষু হাসপাতাল অ্যান্ড ট্রেনিং ইন্সটিটিউট
চক্ষু চিকিৎসার সহজলভ্যতার ঘাটতি রয়েছে। সে জন্য কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রাথমিক পর্যায়ের নার্সরা যেন চোখের সমস্যা শনাক্ত করতে পারেন, তা নিশ্চিত করা জরুরি। স্বাস্থ্যকর্মীদের উপযোগী প্রাথমিক চক্ষু পরিচর্যাবিষয়ক প্রশিক্ষণ সহায়িকা দরকার। ন্যাশনাল আই কেয়ারের এ–বিষয়ক সহায়িকা রয়েছে। এটাকে আরও সহজ ও ছোট করে উপস্থাপন করতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণও নিশ্চিত করতে হবে।
চক্ষু চিকিৎসাসেবার জন্য রেফারেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। রেফারেল নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লিয়াজোঁ থাকতে হবে। এ জন্য বহির্বিভাগে আলাদা কর্নার থাকতে হবে। আমাদের কাছে ২০২৩ সালে ২২টি উপজেলা থেকে রেফার হওয়া রোগীর পরিসংখ্যান রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২২টি উপজেলা থেকে ১৫ হাজার রোগী আমাদের কাছে রেফার করা হয়েছে। রেফার হওয়া রোগীদের মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ চিকিৎসাসেবা নিতে এসেছেন। বাকি ৯৩ শতাংশ চিকিৎসা নিয়েছেন কি না, তা নিশ্চিত নই। রোগীদের হাসপাতালে আসতে না চাওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে যাতায়াতের সমস্যা অন্যতম। সাইটসেভার্সের সঙ্গে আমাদের এ–বিষয়ক সমঝোতা স্মারক হয়েছে। এখন থেকে সাইটসেভার্স রোগীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।
এখানে শুধু চোখের সমস্যা শনাক্তকরণের মতো সরঞ্জাম প্রয়োজন। বাকি অর্থ মূল কেন্দ্র উন্নয়নে ব্যয় করলে তা খরচসাশ্রয়ী হবে। ন্যাশনাল আই কেয়ার বিনা মূল্যে চশমা দেয়। আমাদের হাসপাতালে সরকারের তহবিল থেকে আউটডোরের রোগীদের সব ওষুধ বিনা মূল্যে দেওয়া সম্ভব হয়। দেড় বছর ধরে আমরা বিনা মূল্যে পরার চশমা দিচ্ছি। এ দৃষ্টি দিবসকে কেন্দ্র করে রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরি চশমাও বিনা মূল্যে দেব।
খোন্দকার সোহেল রানা
অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশনস কো-অর্ডিনেটর, সাইটসেভার্স
বিশ্ব দৃষ্টি দিবস উপলক্ষে ‘ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর প্রিভেনশন অব দ্য ব্লাইন্ডস’ প্রতিবছরের মতো এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘আপনার চোখকে ভালোবাসুন, শিশুর চোখের যত্ন নিন’। দিবসটি পালনে চক্ষুসেবা প্রদানকারী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞসহ অন্য সেবাদাতারা বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে চক্ষু স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্বকে জাতীয় ও বৈশ্বিকভাবে তুলে ধরে। চক্ষুসেবাকে স্বাস্থ্য খাতে একীভূত করার দাবিটি এখন সময়ের। চক্ষুসেবা–সংক্রান্ত সমস্যা থেকে উত্তরণে দিবসটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট প্রতিবন্ধী মানুষের ১৩ শতাংশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের সমস্যা শুধু দৃষ্টিকেন্দ্রিক নয়; এর সঙ্গে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব জড়িত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ২২০ কোটি মানুষের দৃষ্টি–সংক্রান্ত প্রতিবন্ধিতা আছে, যার মধ্যে অন্তত ১০ কোটি মানুষের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা এড়ানো সম্ভব ছিল। আর এ বিষয় নিয়েই সাইটসেভার্স কাজ করছে। ডায়াবেটিস এখন বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যা শিশুদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। এ থেকে দৃষ্টি–সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পঞ্চাশোর্ধ মানুষের ক্ষীণদৃষ্টি ও ছানি পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। এগুলো নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করা প্রয়োজন। চক্ষুসেবা পণ্য, বিশেষত চশমার উৎপাদন, আমদানি ও মূল্য নির্ধারণে জাতীয় নীতিমালা তৈরির মাধ্যমে চশমার সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণ অত্যন্ত জরুরি।
সাইটসেভার্স স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি পরীক্ষা করে থাকে। ডিজিটাল স্ক্রিনে বাড়তি সময় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এ কারণে দেড় বছরের শিশুর ক্ষীণ দৃষ্টির সমস্যা হয়েছে বলে জানিয়েছেন একজন চিকিৎসক। এটি প্রতিরোধে দরকার সর্বস্তরের সচেতনতা।
এ কে এম বদরুল হক
কর্মসূচি ব্যবস্থাপক, দ্য ফ্রেড হলোস ফাউন্ডেশন
সিস্টেম লিডারশিপের ধারণা বাংলাদেশ এখনো বিকাশমান। এ বিষয়ে আমরা সবাই অবহিত নই। একটি ব্যবস্থায় অনেকগুলো বিভাগ ও উপাদান কাজ করে। এখানে একজনের কাজ আরেকজনকে প্রভাবিত করে। তাই এ ব্যবস্থার অংশীদারদের সক্ষম করে তুলতে হবে। যেন তারা সেখানে নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে পারে। তাহলে সেই বিভাগের নীতি বাস্তবায়ন ও চক্ষু চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারবে। বাংলাদেশের চক্ষু চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারিসহ সব অংশীদার একসঙ্গে কাজ করে থাকে। এনজিও পার্টনাররা হাসপাতালগুলোকে প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর কাছে চক্ষু চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিতে কাজ করছে।
দ্য ফ্রেড হলোস ফাউন্ডেশন সিস্টেম লিডারশিপ ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেছে। সিস্টেম ম্যাপিং কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। সিস্টেম ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে চক্ষুসেবার সঙ্গে জড়িত অংশীদার, তাদের ভূমিকা ও সমন্বিতভাবে জনগণের কাছে চক্ষুসেবা পৌঁছে দেওয়ার ধারণা তৈরি করে। এরপর এই সিস্টেম লিডারশিপের বিষয়টি আসে। সিস্টেম লিডারশিপ কার্যক্রম শুরুর আগে আমরা স্থানীয় পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কর্মশালা করেছি। এখনো চক্ষুসেবা–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কর্মশালা থেকে পাওয়া তথ্যগুলো নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। সিস্টেম লিডারশিপ ধারণা নিয়ে আমরা জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করব। জাতীয় পর্যায়ের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ইউএনডিপিকে আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। দেশের চক্ষুসেবা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্ল্যাটফর্মকে আমরা উপদেষ্টা হিসেবে রাখব। তৈরি পোশাক খাতের মতো শ্রমঘন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মীদের চক্ষুসেবা নিশ্চিত করতে আমরা সাইটসেভার্স ও হেলেন কেলারের সঙ্গে কাজ করছি।