ডায়াবেটিস ও এর জটিলতা প্রতিরোধে করণীয়
প্যানেল আলোচক
অধ্যাপক মো. ফারুক পাঠান
প্রধান পৃষ্ঠপোষক, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি ও পরিচালক, বারডেম একাডেমি
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান
সভাপতি, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
অধ্যাপক তানজিনা হোসেন
অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
ডা. শাহজাদা সেলিম
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি ও সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি, বিএসএমএমইউ
অধ্যাপক ডা. সাবিনা হাশেম
অধ্যাপক, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম
বিভাগীয় প্রধান, নেফ্রোলজি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
অধ্যাপক ডা. শেখ জিন্নাত আরা নাসরীন
অধ্যাপক, শিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
ডা. তারিক রেজা আলী
সহযোগী অধ্যাপক, চক্ষু বিভাগ, বিএসএমএমইউ
ডা. এম সাইফুদ্দিন
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
অধ্যাপক মো. ফারুক পাঠান
প্রধান পৃষ্ঠপোষক, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি ও পরিচালক, বারডেম একাডেমি
বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগের চিত্র মারাত্মক উদ্বেগের বিষয়। আইডিএফের (ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন) তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ১ কোটি ৩০ লাখ ডায়াবেটিস রোগী রয়েছেন। বর্তমান হারে রোগী বাড়লে ২০৪৫ সালে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ২ কোটি ২০ লাখের মতো। ২০০১ সালে এ রোগের প্রকোপ ছিল ৫ শতাংশ। বর্তমানে তা বেড়ে প্রায় ১৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির জরিপ অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ২৫ শতাংশের বেশি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কিন্তু মাত্র ৮০ লাখ রোগী বিভিন্নভাবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। অন্যরা চিকিৎসার আওতার বাইরে থেকে যান। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগী জানেন না যে তিনি এ রোগে আক্রান্ত। ৫ থেকে ১০ বছর আক্রান্ত থাকা ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে শতকরা ৬০ জনের বিভিন্ন জটিলতা দেখা যায়। এর মধ্যে হৃদ্রোগ ও কিডনি–সংক্রান্ত জটিলতা অন্যতম।
চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা, রোগীর শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে ৯০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীর শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ডায়াবেটিসের রোগীর গড় আয়ু সাধারণ মানুষের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ বছর কমে যায়। বাংলাদেশে ডায়াবেটিসজনিত মৃত্যুহার ৩ শতাংশ। দ্রুত হারে রোগের প্রকোপ বাড়ার ক্ষেত্রে বংশগত কারণ থাকলেও পারিপার্শ্বিক অন্যান্য কারণ এ রোগের জন্য বেশি দায়ী।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। এর প্রভাবে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পরিবর্তন হচ্ছে। খাদ্যাভ্যাসে ও মনমানসিকতার পরিবর্তন, কায়িক পরিশ্রমের সুযোগ কমে যাওয়া, মাত্রারিক্ত মুঠোফোন ব্যবহার, অপর্যাপ্ত নিদ্রা ও অতিরিক্ত মানসিক চাপ এ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
অল্প বয়সী মানুষেরাও এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ২০ বছর আগে এ রোগে আক্রান্ত হওয়া মানুষের গড় বয়স ছিল ৫০ বছর। এখন তা ৩৫ বছর বয়সে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি বা বাডাসের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার ৭ এবং ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সে তা ৪ শতাংশ। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের প্রতি ঝোঁক শিশুদের দৈহিক, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এ কারণে শিশুদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ বেশি হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়।
অধ্যাপক তানজিনা হোসেন
অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষে আজকের এ অনুষ্ঠান সময়োপযোগী। আলোচনায় ডায়াবেটিসের ভয়াবহতার বিষয়গুলো এসেছে। এসব ভয়াবহতা কমাতে আমাদের মূল কাজ হলো সঠিক ব্যবস্থাপনা। ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনার মূল নীতি চারটি।
প্রথমত, জীবনযাত্রার ইতিবাচক পরিবর্তন। জীবনযাত্রার পরিবর্তনই ডায়াবেটিসের মূল চিকিৎসা। এটি ছাড়া ডায়াবেটিসের চিকিৎসা সম্ভব নয়। এ জন্য সুষম খাদ্যাভ্যাস তৈরি করা প্রয়োজন। ডায়াবেটিস হলে আর কোনো খাবারই খেতে পারবেন না বলে অনেকের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন, না খেয়ে থাকলে বা শর্করা না খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ হবে, এটাও ভুল ধারণা। বর্তমানে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে এ ধরনের ভুল তথ্য ছড়ানো হয়।
ডায়াবেটিক রোগীর উচিত একজন পুষ্টিবিদ বা এনডোক্রাইনোলজিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করে তাঁর জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস জেনে নেওয়া। সুষম খাদ্যাভ্যাসে আমিষ, শর্করা, চর্বি, ভিটামিন, খনিজ সব ধরনের খাবারই থাকবে। কিন্তু সব খাবারই পরিমিত। পরিমাণে থাকবে এবং সঠিক পরিমাণে খেতে হবে। খাবার গ্রহণের সময় ও শৃঙ্খলা মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিসের রোগীর সঠিক সময়ে সঠিক খাবার খেতে হবে। শর্করা একেবারে বাদ দিতে হবে, এ ধারণা ভুল। সাদা চিনি, চিনি যুক্ত খাবার ও সহজ শর্করা বাদে জটিল শর্করা গ্রহণ করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, খাদ্যাভ্যাসের পরেই আসে নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম। শহরাঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ একেবারেই কায়িক পরিশ্রম করেন না। শৈশব থেকেই মুঠোফোনসহ ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্ত। শিশুরাও স্থূলতায় ভুগছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে। কায়িক পরিশ্রম ও সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মধ্য দিয়ে উচ্চতা অনুযায়ী সঠিক ওজন (বিএমআই) বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই ডায়াবেটিস ও অন্যান্য রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।
তৃতীয়ত, ওষুধ, ইনসুলিন ও অন্যান্য ইঞ্জেকশনের ব্যবহার। ডায়াবেটিসে কোন রোগী কোন ওষুধ খাবেন, তা চিকিৎসকেরই নির্ধারণ করা উচিত। নিজে নিজে ওষুধ কিনে খাওয়া উচিত নয়। ডায়াবেটিসের ওষুধ দেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসক রোগীর হৃদ্রোগ, কিডনির অবস্থা, সামর্থ্য ও অন্যান্য শারীরিক অবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় রাখেন। সে অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। তবে গর্ভাবস্থায়, টাইপ-১ ডায়াবেটিস, অপারেশনের আগে-পরে, কোনো জটিল সংক্রমণ বা রোগ থাকলে ইনসুলিনই সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকর চিকিৎসা। ইনসুলিন নিয়ে রোগীদের ভ্রান্ত ধারণা ও ভীতি আছে। ইনসুলিন ইনজেকশন ভয়াবহ ও তা একবার শুরু করলে আর বন্ধ করা যাবে না—এসব ভ্রান্ত ধারণা। বর্তমানের আধুনিক ইনসুলিনগুলো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ব্যথাহীন এবং অত্যন্ত নিরাপদ।
চতুর্থত, স্বাস্থ্য শিক্ষা ডায়াবেটিস চিকিৎসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ, ডায়াবেটিস চিকিৎসা প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগীর নিজের হাতে। রোগী নিজে তার জীবনযাত্রা পরিবর্তন করবেন। ডায়াবেটিসের জটিলতাগুলো জানা, নিজে ব্লাড সুগার মাপা ও নিয়ন্ত্রণ করা, চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ইত্যাদির জন্য রোগীর স্বাস্থ্য শিক্ষার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান
সভাপতি, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি
ডায়াবেটিস একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগ। সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও এ রোগ মহামারি আকারে বেড়ে চলেছে। এ রোগ শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হবে এবং মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। সে জন্য দ্রুত ও সঠিক সময়ে এ রোগ শনাক্ত করা প্রয়োজন।
এশিয়ান জাতি হিসেবে আমরা ডায়াবেটিসের উচ্চ ঝুঁকিতে আছি। রক্ত সম্পর্কিত নিকটাত্মীয়ের কারও ডায়াবেটিস থাকলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রম ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ না করা এবং উচ্চ রক্তচাপ ও কার্ডিওভাসকুলার রোগীরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।
ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার লক্ষণ (ঘাড় ও বগলের চামড়া কালো হয়ে যাওয়া) থাকলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে। স্থূল স্বাস্থ্য, মুখে লোম আছে ও অনিয়মিত মাসিক অর্থাৎ পিসিওএস রোগে আক্রান্ত নারীরা এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
৯ পাউন্ডের বেশি ওজন সন্তান প্রসব করা বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকা নারীরা এ রোগের ঝুঁকিতে আছেন। ওজন ও বয়স বাড়ার সঙ্গে এ রোগের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। যাঁদের এসব ঝুঁকি আছে বা ৩০ বছরের বেশি বয়সীদের ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং করতে হবে। এ ছাড়া ডায়াবেটিসের উপসর্গ দেখা দিলে বা হাসপাতালে ভর্তি হলে ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং করা প্রয়োজন।
খালি পেট ও ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর রক্তের গ্লুকোজ মেপে, যাঁদের ডায়াবেটিসের লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে তাঁদের যেকোনো সময়ে রক্তের গ্লুকোজ মেপে এবং রক্তের এইচবিওয়ানসি পরীক্ষা করে ডায়াবেটিস ও প্রি-ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং করা হয়।
রক্তে গ্লুকোজ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি কিন্তু ডায়াবেটিসের মাত্রার চেয়ে কম—রক্তের এমন মধ্যবর্তী অবস্থাকে প্রি-ডায়াবেটিস বলে। প্রি-ডায়াবেটিস রোগীদের স্বাভাবিক কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। দেখা গেছে ১০ বছরের মধ্যে এসব রোগীর ৪০ শতাংশ সুস্থ হয়ে যান। ৪০ শতাংশের ডায়াবেটিস মেলিটাস হয়ে যায়। আর ২০ শতাংশ একই অবস্থায় থাকে।
প্রি-ডায়াবেটিস রোগীদের হৃদ্রোগ, স্ট্রোক ও মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। তাঁদের অনেকেরই ডায়াবেটিস মেলিটাসের মতো জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। জীবন যাপনের ধরন পাল্টাতে আমাদের জন্য হাঁটার জায়গা তৈরি করতে হবে। ঢাকায় নিরাপত্তার জন্যও আমরা হাঁটতে পারি না। এ জন্য একটা সামাজিক আন্দোলন দরকার।
ডা. শাহজাদা সেলিম
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি ও সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি, বিএসএমএমইউ
শর্করা হলো শক্তি উৎপাদনকারী এমন একটি খাদ্য উপাদান, যা শরীরের সব কোষ ব্যবহার করতে পারে। শর্করাজাতীয় খাদ্য ক্ষুদ্রান্ত্রে পরিপাক হয় এবং গ্লুকোজ হিসেবে রক্তে শোষিত হয়। দেহের প্রয়োজনীয় মোট শক্তির ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ শর্করা থেকে আসতে হবে। এর প্রধান উৎস হতে পারে ভাত, রুটি, ডাল, মাছ-মাংস, শিম ইত্যাদি।
পরিশোধিত শর্করা চিনি, মধু, ময়দা, গুড়, মিছরি, বেকারির তৈরি বিভিন্ন রকম খাদ্যদ্রব্য যেমন পাউরুটি, কেক, বিস্কুট ইত্যাদি ও তেলে ভাজা খাবার যতটা সম্ভব ত্যাগ করতে হবে।
সারা বিশ্বের চিকিৎসকেরা এইচবি১সি পরীক্ষায় রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ৬ দশমিক শতাংশের কম পরিমাণকে নন-ডায়াবেটিস হিসেবে চিহ্নিত করেন। অনেকের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয় না। ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অধিকাংশ রোগীকে এইচবি১সি ৭ শতাংশের নিচে রাখা সম্ভব। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী ৯২ শতাংশ রোগী এ মাত্রা ৭ শতাংশের নিচে রাখতে পারছে না। রোগীর বয়স, অন্য কী রোগে আক্রান্ত ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে রক্তে গ্লুকোজ মাত্রা কেমন হওয়া উচিত, তা নির্ধারণ করি।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস নানাবিধ শারীরিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীর মৃত্যুর অন্যতম কারণগুলো হলো হৃদ্রোগ, কিডনি বিকল হওয়া, স্ট্রোক ইত্যাদি। সে জন্য শুধু রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে লাভ হবে না। একই সঙ্গে রক্তের কোলেস্টেরল, রক্তচাপ, দৈহিক ওজন ইত্যাদিও লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখা জরুরি।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে শরীরে দীর্ঘমেয়াদি নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি, চোখে ঝাপসা দেখা বা অন্ধত্বের ঝুঁকি বাড়ে। ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথির ফলে কিডনি অকেজো হতে পারে। ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির কারণে পা, হাত বা অন্যান্য অঙ্গে ব্যথা, অসাড়তা ও জ্বালাপোড়া হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ ও খারাপ কোলেস্টেরল বৃদ্ধির ফলে হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। রক্ত সঞ্চালন কমে গিয়ে পায়ে ঘা হতে পারে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অপারেশন বা পা কেটে ফেলতে হতে পারে।
নিয়মিত রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শর্করার মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। এটি রোগীকে তার বর্তমান অবস্থার সম্পর্কে ধারণা দেয় এবং চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। নিজেই রক্তের শর্করা পরীক্ষা করার মাধ্যমে রোগী দ্রুত বুঝতে পারেন যে কোন খাদ্য, ওষুধ বা অন্য কোনো কারণ কীভাবে তাঁর শর্করা প্রভাবিত করছে।
সার্বিকভাবে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনযাত্রা ঠিক করা গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক ডা. সাবিনা হাশেম
অধ্যাপক, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
হৃদ্রোগের জন্য ডায়াবেটিস একটি প্রধান ঝুঁকির কারণ। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য জরিপ অনুযায়ী, ডায়াবেটিস রোগীদের ২ দশমিক ৫ শতাংশ সাধারণত হৃদ্রোগে আক্রান্ত। ডায়াবেটিসে মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা বা মৃত্যু হওয়া রোগীদের ৬৫ শতাংশই হৃদ্রোগে আক্রান্ত।
জরিপে এসেছে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যদের তুলনায় আমাদের দেশের ডায়াবেটিস রোগীরা কম বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। অন্য এক জরিপে এসেছে, দেশে হৃদ্রোগে আক্রান্তদের গড় বয়স দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশে এ রোগে আক্রান্তদের তুলনায় ৬ বছর কম। অর্থাৎ, আমাদের দেশে মানুষ অল্প বয়সে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর একটি কারণ হলো কম বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া। তা ছাড়া ধূমপান, সাদা পাতা, জর্দা ইত্যাদি ব্যাপক হারে গ্রহণও অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশে পেটের স্থূলতা অন্য দেশের তুলনায় বেশি। তা ছাড়া শারীরিক কসরতের ঘাটতি রয়েছে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের হার্ট ফেইলিউরের ঝুঁকি বাড়ে। রক্তনালিতে চর্বি জমলে তা সংকীর্ণ হয়ে যায়। ফলে হৃৎপিণ্ডের মাংসে অক্সিজেন সরবরাহ কমে গেলে রোগীর বুকে ব্যথা হয়। একপর্যায়ে রোগীর হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। হার্ট ফেইলিউর হলে রোগীর শ্বাসকষ্ট হয় ও সারা শরীর ফুলে যায়। ব্রেইনের রক্তনালি বন্ধ হয়ে ব্রেইন স্ট্রোক হয়। স্ট্রোকের কারণে রোগীর শরীরের কোনো এক পাশ প্যারালাইজড হয়ে যায়। ডায়াবেটিসের কারণে এসব হৃদ্রোগের ঝুঁকিগুলো তৈরি হয়। এসব প্রতিকারে জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ জরুরি। সে জন্য শারীরিক কার্যক্রম ও ব্যায়াম করা দরকার।
সুষম খাদ্যাভ্যাসে সামুদ্রিক মাছসহ বিভিন্ন মাছ রাখা উচিত। ফলমূল ও শাকসবজি বেশি করে খেতে হবে। এ ছাড়া ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কোনো ক্ষেত্রে ওজন নিয়ন্ত্রণে না থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেতে হবে। প্রয়োজনে ওজন নিয়ন্ত্রণে সার্জারিও করা যায়। হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমাতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রক্তচাপ ১৩০/৮০–এর নিচে রাখতে হবে। এ ছাড়া রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এসব নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে হৃদ্রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যাবে।
ডায়াবেটিস থাকলে ও হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমাতে স্ট্যাটিনস (কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ) দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস থাকলে এলডিএল (লো ডেনসিটি লাইপ্রোটিন) ৭০–এর নিচে রাখতে হবে। হৃদ্রোগ থাকলে তা ৫৫–এর নিচে রাখতে হবে। এলডিএল কমাতে সুষম খাদ্য গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক ডা. শেখ জিন্নাত আরা নাসরীন
অধ্যাপক, শিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
গর্ভকালে মায়ের রক্তের মধ্যে ডায়াবেটিস হওয়ার মতো কিছু উপাদান চলে আসে। ফলে তার ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমে আসে। এর ফলে গর্ভকালে ডায়াবেটিস হতে পারে।
কখনো ডায়াবেটিস ছিল না কিন্তু গর্ভধারণের পাঁচ মাস পর হঠাৎ ডায়াবেটিস দেখা দিলে তাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলা হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গর্ভকালের পর এ ডায়াবেটিস চলে যায়। তবে এর নানা জটিলতাও রয়েছে। এ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা না গেলে মা ও অনাগত শিশুর ওপর নানা বিরূপ প্রভাব পড়ে।
প্রতিকারের ক্ষেত্রে আলোচনায় আসা সুপারিশগুলোর সঙ্গে খুব বেশি তারতম্য নেই। প্রথমত, খাবারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গর্ভকালে তো অনেক বেশি খাবার নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। কারণ, তার গর্ভে অনাগত শিশু বাড়ছে। সে জন্য ডায়েটেশিনের মাধ্যমে ক্যালরি নির্ধারণ করে খাবার বেঁধে দিই। গর্ভকালে হাঁটাচলা করা যাবে না বলে আমাদের দেশে ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকে মনে করেন এতে গর্ভপাত হতে পারে। গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানাতে চাই যে জটিল কোনো সমস্যা না থাকলে গর্ভকালেও ব্যায়াম করা যাবে। এ ক্ষেত্রে সকালে ও বিকেলে ১৫ মিনিট করে হাঁটা ভালো। ডেলিভারি কাছাকাছি সময়ে হাঁটতে কষ্ট হয়, তখন এর মাত্রা কমিয়ে দেব।
গর্ভকালে ইনসুলিন নেওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক তর্কবিতর্ক চলে আসে। এ ক্ষেত্রে ভয়ের বিষয় হলো অনাগত শিশু অনেক মোটা হতে পারে। এটা কোনো ভালো বিষয় নয়। এর ফলে অনেক রকম অসুস্থতা হতে পারে। হঠাৎ করেই শিশুটি গর্ভে মারা যেতে পারে। এ ছাড়া জন্মের সময় বাধাগ্রস্ত প্রসব হতে পারে। ফলে শিশু মস্তিষ্কে আঘাত পেতে পারে। পরবর্তী আরও অনেক সমস্যা হতে পারে। মায়ের ক্ষেত্রে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। প্রসবের সময় অনেক বেশি পানি জমে যাওয়ায় সিজারিয়ান সেকশনের হার বেড়ে যেতে পারে। প্রসবের পর রক্তক্ষরণ হতে পারে। সবচেয়ে খারাপ দিক হলে মায়ের ইনফেকশন হতে পারে। এসব বিষয় রোগীকে বুঝিয়ে আমরা চিকিৎসা দিই।
এসব বিষয়ে মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রোগীকে বুঝিয়ে না বলতে পারলে তিনি ওষুধ গ্রহণ করবেন না। সে জন্য তাঁদের সঙ্গে কথা বলা ও এসব বিষয় জানানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম
বিভাগীয় প্রধান, নেফ্রোলজি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
ডায়াবেটিসের কারণে কিডনি বিকল সমস্যা ডায়াবেটিক রোগীর জন্য অত্যন্ত জটিল ও গুরুতর সমস্যা। দুনিয়াজুড়ে কিডনি বিকল হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস। প্রস্রাবের সঙ্গে প্রোটিন বা আমিষ নির্গত হওয়া ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগের প্রাথমিক নমুনা। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারলে কিডনি বিকল হওয়ার আশঙ্কা কমানো যেতে পারে।
ডায়াবেটিসের কারণে কিডনি বিকল হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোনো লক্ষণ বোঝা যায় না। এ ক্ষেত্রে রোগীরা সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ-মুখ ফোলা খেয়াল করতে পারেন। এরপর ক্ষুধামান্দ্য, বমিভাব ও বমি, গা চুলকানো, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, গায়ের রং ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত দুর্বলতা, ঘুমের ব্যাঘাত, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, হাত–পা কামড়ানো বা ব্যথা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিসের ফলে কিডনির ফিল্টারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিডনি বিকল হলে ৫০ শতাংশ রোগী উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়। কিডনি বিকল রক্তশূন্যতা (এনিমিয়া) ও হাড় ক্ষয়ের কারণ হতে পারে। শতকরা ৩০ শতাংশ ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগীর কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যেতে পারে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে দৈনিক গ্লুকোজের মাত্রা পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। কম শর্করা (কার্বোহাইড্রেট) ও সুনির্দিষ্ট পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ কিডনি সমস্যার ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। এ জন্য চর্বিজাতীয় খাবার ও লবণ কম খেতে হবে এবং পরিমিত পানি পান করতে হবে। রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বেশির ভাগ ডায়াবেটিস রোগীর কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের এবং হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমানোর ওষুধ সেবন করতে হবে। ওজন নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান বর্জন, লবণ ও ক্ষতিকর ওষুধ এড়িয়ে চলার মাধ্যমে কিডনির সুস্বাস্থ্য রক্ষা করা যায়। নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীরচর্চা করা জরুরি।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা (যেমন রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা) করা উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কিডনি সমস্যার অগ্রগতি ধীর করতে হবে। গুরুতর ক্ষেত্রে কিডনির কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেলে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হতে পারে। সঠিক চিকিৎসক দল দ্বারা নিয়মিত ফলোআপ এবং চিকিৎসা চলমান রাখতে হবে।
ডায়াবেটিসজনিত কিডনি বিকল সমস্যা প্রতিরোধের জন্য স্বাভাবিক জীবনাচরণ এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অপরিহার্য। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা সবচেয়ে নিরাপদ উপায়।
ডা. তারিক রেজা আলী
সহযোগী অধ্যাপক, চক্ষু বিভাগ, বিএসএমএমইউ
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৩১ লাখ ৩৬ হাজার ৩০০। ১৫ বছরের বেশি সময় ডায়াবেটিসে ভোগা রোগীদের ৪০ শতাংশের ডায়াবেটিসজনিত রেটিনার রোগ আছে। চোখের সব অংশই ডায়াবেটিসের জটিলতায় প্রভাবিত হতে পারে।
ডায়াবেটিসজনিত অন্ধত্বের প্রধান কারণ তিনটি—ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি, ছানি ও চোখের উচ্চ চাপ বা গ্লুকোমা। ছানি চিকিৎসায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। দেশের সব জেলা হাসপাতালে ছানি অপারেশনের ব্যবস্থা আছে। তবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর ছানি চিকিৎসা অন্য আর দশ জন রোগীর মতো নয়। এখানে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে অপারেশনের পর ইনফেকশন হলে তা নিয়ন্ত্রণ করা বেশির ভাগ সময় সম্ভব হয় না। একইভাবে গ্লুকোমা চিকিৎসাও এখন আগের থেকে বেশি সহজলভ্য।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি থেকে একজন মানুষ সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ও ডায়াবেটিক ম্যাকুলার ইডিমা সঠিক সময়ে নির্ণয় ও চিকিৎসা অত্যন্ত প্রয়োজন। ইনজেকশন, লেজার, সার্জারিসহ বিভিন্নভাবে আমরা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ও ডায়াবেটিক ম্যাকুলার ইডিমার চিকিৎসা করে থাকি। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে আমরা চোখের ভেতরে ইনজেকশন দিই। এই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের অনেক হাসপাতালে এ ইনজেকশন দেওয়া হয়। এর বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা শহরে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসা দেওয়া হয়। বিভিন্ন দামের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ইনজেকশন এখন বাজারে আছে। এর মধ্যে এভাস্টিন বা বিভাসিজুম্যাব কলোরেক্টাল কারসিনোমার চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এটি এফডিএ কর্তৃক স্বীকৃত নয়। দাম কম ও একই ইনজেকশন ভায়াল থেকে অনেক জনকে দেওয়া যায় বলে আমাদের দেশে এটিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।
ডায়াবেটিসজনিত রেটিনাল ডিটাচমেন্ট অপারেশনের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ঢাকার জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেম, ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল, লায়ন্স আই ইনস্টিটিউটসহ অনেক প্রাইভেট চক্ষু হাসপাতালে এ চিকিৎসার প্রয়োজনীয় যন্ত্র আছে। এ চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও অপারেশন করার মতো দক্ষ জনবলের অভাবে বেশির ভাগ হাসপাতালে এ চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। এ বিষয়ে আমাদের আরও উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে।
ডা. এম সাইফুদ্দিন
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
ডায়াবেটিস চিকিৎসা ক্ষেত্রবিশেষে ব্যয়বহুল ও জটিলতাপূর্ণ। সে জন্য প্রতিরোধই এ রোগ ঠেকানোর ভালো উপায়। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ১০টি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
প্রথমত, ফেসবুক ও ইউটিউবের কারণে খাবার নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত। সে জন্য আমরা সুষম খাবার গ্রহণের পরামর্শ দিই। সুষম খাবারে শর্করা ৫০ ভাগ, আমিষ ১০ থেকে ১৫ ভাগ ও চর্বি ৩৫ ভাগের কম থাকবে। একজন ডায়াবেটিস রোগীকে ওজন ও উচ্চতা বিবেচনা করে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ক্যালোরি খাবার হিসেবে প্রদান করতে হবে। খাবার সময়মতো ও পরিমাণমতো খেতে হবে। সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয় কিটোডায়েটে শর্করার পরিমাণ ৫ থেকে ১০ শতাংশ। দেশের মানুষ খাবারের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ শর্করা খাচ্ছে। আমিষ ও চর্বির তুলনায় শর্করার দাম কিছুটা কম। গবেষণায় এসেছে, ৪০ শতাংশের কম বা ৬০ শতাংশের বেশি শর্করা গ্রহণকারীদের হৃদ্রোগ এবং ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। সে জন্য শর্করাজাতীয় খাবার আনুমানিক ৫০ ভাগ খেতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আদর্শ ওজন বজায় রাখতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে দ্রুত ওজন কমানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অব ডায়াবেটিস পরামর্শ হলো সপ্তাহে ১ থেকে ২ পাউন্ডের বেশি ওজন কমানো যাবে না। অর্থাৎ প্রতি মাসে ২ থেকে ৩ কেজির বেশি ওজন কমানো যাবে না। খুব দ্রুত ওজন কমালে ফ্যাটি লিভারজনিত জটিলতাগুলো বেড়ে যায়।
তৃতীয়ত, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করতে হবে। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট শারীরিক কসরত করতে হবে। প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটতে হবে।
চতুর্থত, বর্তমানে ঘুমের সমস্যা মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। ডায়াবেটিস রোগী বা একজন সুস্থ মানুষের প্রতিদিন ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত।
পঞ্চমত, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ ডায়াবেটিসের বড় কারণ।
ষষ্ঠত, ধূমপান, মদ্যপান, পান, সাদা পাতা, জর্দা, তামাকের মতো বাজে অভ্যাস পরিহার করতে হবে।
সপ্তমত, খুশির খবর বা কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সময় মিষ্টির পরিবর্তে ফলমূল নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এটা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। আমাদের দেশে সামাজিক অনুষ্ঠানে কোনো স্বাস্থ্যকর খাবার থাকে না।
অষ্টমত, ফাস্টফুডের সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে এবং শিশুদের খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে হবে। এখন ছোট শিশুদেরও ডায়াবেটিস হচ্ছে।
নবমত, প্রতিদিন এক থেকে দুই ঘণ্টার বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহার করা উচিত নয়।
দশমত, ২০ বছর বয়স হলে বছরে অন্তত একবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৫০ শতাংশ রোগী জানেন না যে তাঁর ডায়াবেটিস আছে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এ ১০টি পদক্ষেপ খুবই কার্যকরী।
সুপারিশ
২০ বছর বয়স হলেই বছরে অন্তত একবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে।
পুষ্টিবিদ বা এনডোকাইনোলজিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করে ডায়াবেটিক রোগী তার জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস জেনে নেবেন।
ডায়াবেটিস রোধ ও নিয়ন্ত্রণে সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করতে হবে।
হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমাতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
ধূমপান, মদ্যপান, পান, সাদাপাতা, জর্দা, তামাকের মতো বাজে অভ্যাস পরিহার করতে হবে।
সবারই প্রতিদিন ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ব্যাঘাতহীন ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।
রোগীর মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।